পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

কোভিড ১৯ মোকাবিলা- সম্পদ ও উত্তরাধিকার কর বসিয়ে নোট ছাপিয়ে গরিবদের টাকা ও রাজ্যগুলিকে অনুদান দেওয়া হোক

  • 15 April, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1665 view(s)
  • লিখেছেন : অমিত দাশগুপ্ত
কবে এই ভাইরাসের আক্রমণ থেকে আমরা মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরব তা বলা দুস্কর হলেও এটা বলাই যায় যে, অর্থনীতির উপরে দু:সহ আঘাত আসতে চলেছে। পুঁজির বিশ্বায়নপরবর্তিতে এত বড় ঘটনা ঘটেনি। তাই অর্থনীতিতে এর কী প্রভাব পড়বে তা বলা অসম্ভব।কোরোনার প্রভাব যোগান ও চা্হিদা দুদিকেই পড়বে। আগে অর্থনৈতিক মন্দা এসেছে, উৎপাদনে মন্থরতা এসেছে কিন্তু এভাবে আক্ষরিক অর্থেই উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়া ভাবাই যায় নি।

কবে এই ভাইরাসের আক্রমণ থেকে আমরা মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরব তা বলা দুস্কর হলেও এটা বলাই যায় যে, অর্থনীতির উপরে দু:সহ আঘাত আসতে চলেছে। পুঁজির বিশ্বায়নপরবর্তিতে এত বড় ঘটনা ঘটেনি। তাই অর্থনীতিতে এর কী প্রভাব পড়বে তা বলা অসম্ভব।কোরোনার প্রভাব যোগান ও চা্হিদা দুদিকেই পড়বে। আগে অর্থনৈতিক মন্দা এসেছে, উৎপাদনে মন্থরতা এসেছে কিন্তু এভাবে আক্ষরিক অর্থেই উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়া ভাবাই যায় নি। এমন একটা পরিস্থিতি যে বিষয়ে কোন অভিজ্ঞতা না থাকায় বলাই যাচ্ছে না যে অর্থনীতির বিভিন্ন অংশগুলি কীভাবে প্রভাবিত হবে ও কী প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে? চাহিদা ও যাোগান উভয় তরফে এমন আঘাত অন্য কোন ধরণের আক্রমণে ঘটে না।

সরকারকে অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করার জন্য ভূমিকা গ্রহণ করে প্রভূত পরিমাণ টাকা ব্যয় করতে হবে। আনুমানিক ১৫ লক্ষ কোটি থেকে ২০ লক্ষ কোটি টাকা এই কাজে প্রয়োজন হতে পারে। সম্পদ সংগ্রহের জন্য সরকার শিল্পপতি ও ধনীদের উপরে কর বসাক। মনে রাখা দরকার শিল্প প্রতিষ্ঠান ও শিল্পপতি এক নয়। ব্যক্তিগত করকে বাড়ানো হোক। সম্পত্তির উপর কর বসানো হোক। যারা সর্বক্ষেত্রে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ও প্রতিযোগিতার গল্প ফাঁদেন তাদের অধিকাংশই উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি ও মূলধনের উপরে ভরসা করেই ধনী ছিলেন ও আরো ধনী হয়েছেন। দেশের এই সঙ্কটকালে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের উপরে কর বসানো হোক, এবং তা ধার্য হোক পূর্ববর্তিকাল থেকে।

কোরোনাভাইরাস বা কোভিড ১৯ এর বিশ্বমহামারির এই কালবেলায় ভীত সন্ত্রস্ত বিত্তবান মধ্যবিত্ত বিদ্যাজীবি, বুদ্ধিজীবী বিদ্বজ্জন, প্রচার মাধ্যম, মন্ত্রী শান্ত্রী, পুলিশ, চিকিৎসক, আইনজীবি, শিক্ষক সকলের সকলের প্রতি ঘরে থাকার আর্তি শুনতে শুনতে মনে হতে থাকে যে, সকলেই ভয় পেয়েছে, ভয় পেয়েছে কোরোনা আক্রান্ত হলে মৃত্যুর, প্রিয়জনের, নিজের; ভয় পেয়েছে কোভিড ১৯ আক্রান্ত হলে নিজ বাসে একঘরে হওয়ার, সেরে ওঠার পরে বাড়ি ফিরলে প্রতিবেশীর দাপটে ঘরছাড়া হওয়ার। তাই, আবেদন করছে, নিবেদন করছে, ধমকাচ্ছে চমকাচ্ছে একে অপরকে। যে একটু আগে বাজার থেকে ঘুরে এল সে টিভিতে বাজারের ভিড়ের ছবি দেখে ঘরে বসে চেচাচ্ছে ওই সব বেআক্কেলেদের গুলি করে মারতে হয়। গত পরশু যে রামনবমী উদযাপনে ভিড় জমিয়েছিল সে অর্নব গোস্বামীর টেবিল বিদারক চিৎকারে উৎসাহিত হয়ে ঘুসি মেরে সামনে রাখা চায়ের কাপকে উল্টে দিয়ে বলছে ওই ‘মোল্লা’রাই দেশের করোনার জন্য দায়ী। সেলিমপুরের রেললাইনের ধারের ঝুপড়িতে থাকা, দিনভর পাশের ফাঁকা জায়গায় দল বেধে ক্যারম খেলা ছেলেগুলো, যারা জীবনেও রাজাবাজার যায়নি, তারা রাজাবাজারে কেউ লকডাউন মানছে না বলে খোস গল্প করছে। মাসের শেষে ব্যাঙ্কে বেতনের টাকা জমা পড়ে গেছে যার, অনলাইনে তিনমাসের রসদ জমা করে দেশব্যাপী করোনাবিরোধী ঐক্যের প্রদর্শনীতে আলো নেভানো জ্বালানোর চমৎকার দেখাচ্ছেন বা হাউই তুবড়ি পটকা সহযোগে উৎসব পালনেও মগ্ন কেউ কেউ। যারা তবলিগির অবৈজ্ঞানিক অবিবেচক কোরোনাপ্রসারী আচরণে সমস্ত মুসলিমদের উপরে ক্ষিপ্ত তারাই নিজের বাড়ির ভাড়াটিয়া কোরোনার সঙ্গে লড়াই করা ডাক্তার-নার্সকে বাড়িতে ঢুকতে না দিয়ে বা কোরোনায় মৃত রোগির শবদেহ পোড়াতে না দিয়ে নিজেদেরকে সুরক্ষিত রাখছে। অন্যদিকে ধর্ম না দেখেই চিকিৎসা করার ঘোষণাকারী ডাক্তারবাবু ভিনধর্মের তবলিগিদের বিরুদ্ধে জিঘাংসা উগরে দিচ্ছে। এভাবেই কোরোনা বিরোধী লড়াই জারি আছে।

সকলেই বলছেন, দেশের এই দুর্দিনে, মানবজাতির এই সঙ্কটকালে সকলকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। ঠিক কথা। কিন্তু ঐক্যবদ্ধ থাকা মানে কী? কারুর ব্যাঙ্কে জমা টাকা ও প্রতি মাসে নির্দিষ্ট সময়ে ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্টে বেতন বা পেনশনের টাকা জমা পড়তে থাকা, যা ব্যবহার করে অনলাইনে ছোঁয়া বাঁচিয়ে রোগ বীজাণু মুক্ত করে যথা বিহিত খাওয়া দাওয়া করতে করতে উদগার তোলা; আবার কোন পাট কলের শ্রমিক বা পরিযায়ী শ্রমিকের পেটের খিদে সহ্য করে ঘরবন্দী থাকা। ঐক্য কেবল ওই লকডাউনে ঘরবন্দী থাকাতেই সীমাবদ্ধ। নিজের খাবার ভাগ করে খাওয়াতে নয়, কেন ঐ ২২ জন পরিযায়ী শ্রমিককে রাস্তায় মরে যেতে হল, কেন সুপ্রিম কোর্টের ঘি-মাখনে বেঁচে থাকা বিচারপতিদের ওই ঘরছাড়া শ্রমিকদের কেবল খাবার দিলেই হবে, মজুরির কী দরকার এই নির্দেশের সে সমস্ত বিষয়ে প্রশ্ন তোলাতে, সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ প্রতিরোধে গলা মেলানোতে নয়, কেবল ওই নিজেকে ও পরিজনকে বাঁচানোর লকডাউন যথাযথ রূপায়নেই সেই ঐক্যের পরিসমাপ্তি। লকডাউন উঠে গেলে, পৃথিবী আবার শান্ত হলে যে যার কক্ষপথে আবর্তিত হবে। রোজগার চলে যাওয়া অস্থায়ী শ্রমিকটি বা কাজ খোয়ানো বেসরকারি সংস্থার কর্মচারীটি কিংবা ভুখা থাকা পরিযায়ী শ্রমিকটির পরিবারের সঙ্গে ঐক্যের কোন চিহ্নই অবশিষ্ট থাকবে না নিরাপদ সরকারি চাকুরে , কর্পোরেট আমলা, কোটিপতি ব্যবসায়ীদের। ঐক্যের স্থায়িত্ব কোভিড ১৯ এর ভয়ের সঙ্গেই সংযুক্ত।

তবুও, ভয় কাটছে না উত্তমর্ণদের। কবে আবার দেশ, পৃথিবী পুরোনো ধারায় ফিরবে, আদৌ তা পূর্ব নির্দিষ্ট ছন্দে ফিরবে কিনা তা নিয়ে ধন্ধে রয়েছে অর্থনীতির আপাত চালিকা শক্তিরা। প্রকৃত চালক-শ্রমিক কৃষক মেহনতি জনতা যখন কী করে এই লক ডাউনে দুমুঠো খাবার যোগাড় করা যাবে সেই দুশ্চিন্তায় নিমজ্জিত, তখন চা বাগান মালিক, চটকল মালিক, কী ভাবে ফার্স্ট ফ্লাশের চা পাতা তোলানো যায় বা কীভাবে কল খুলিয়ে মুনাফা করা যায় সেই পরিকল্পনা চালাচ্ছে। সরকারও সঙ্গত করছে। একদিকে দেশ জোড়া লকডাউন, অন্যদিকে চাবাগান খোলার অনুমতি দিয়ে বাগান শ্রমিকদের কোরোনার মুখে দাঁড় করানো হচ্ছে।

পুরোপুরি অপরিকল্পিত লকডাউনের ফলে ৪০ কোটির বেশি শ্রমিক করোনার থেকেও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দারিদ্র ও ক্ষুধার আঘাতে। সরকারি নির্দেশ অমান্য করেই সর্বত্র শ্রমিক ছাঁটাই চলছে। অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে (এমএসএমই) কর্মরত শ্রমিকেরা কোন মজুরিই পাচ্ছে না। বহু ক্ষেত্রে তারা আগের কাজের মজুরিও পান নি। এব্যাপারে সরকার তেমন কোন পদক্ষেপই নেয় নি।

আর্থিক ভাবে চরম ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক কৃষকদের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এপর্যন্ত যেঅর্থ বরাদ্দ করেছে তা অতি সামান্য। ইউরোপ আমেরিকা যেখানে মোট জাতীয় উৎপাদনের ১০% এর বেশি অর্থের প্যাকেজ প্রদান করেছে, আমাদের দেশ সেখানে ব্যয় করেছে ০.৫% এরও কম।। যে আর্থিক সাহায্যের কথা অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, তার মধ্যে অতিরিক্ত চাল-ডাল, মহিলাদের জনধন এ্যাকাউন্টে সামান্য টাকা ও বয়স্কদের সামান্য পেনশন ব্যতিরেকে তেমন কোন বাজেট বহির্ভুত অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ের কথা বলা হয় নি। সেগুলিও সর্বাংশে কার্যকর হয় নি।

২০১১র জনগণনা অনুযায়ী ভারতে আন্তর্রাজ্য বা আন্ত:শহর অভিবাসীর সংখ্যা ৪৫ কোটি। বছরে ৯০ লক্ষ করে অন্তর্দেশীয় অভিবাসন হচ্ছে। এর একটা বড় অংশ পরিযায়ী শ্রমিক, যারা কোন স্থায়ী চাকুরি করে না, দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে শহরাঞ্চলে কাজ করে। ভারতের অর্থনীতির একটা বড় অংশ তাদের কাজের উপর টিঁকে আছে। গ্রামীণ অর্থনীতিও ওই শ্রমিকদের উপর বিপুল ভাবে নির্ভর করে। পরিযায়ী শ্রমিকদের পাঠানো টাকার উপর ভর করে বহু রাজ্যের অর্থনীতির চাকা গড়াচ্ছে। একদিকে দিল্লি, কেরালা, মহারাষ্ট্র, তামিনাড়ু, কর্ণাটক, হরিয়ানাগুজরাটের মত তুলনামূলক ধনী রাজ্যগুলিতে সস্তা শ্রমের যোগান দিয়েছে পরিযায়ী শ্রমিক, যার ফলে সেখানকার অর্থনীতিতে উৎপাদনের পরিমাণ বেড়েছে, মুনাফা বেড়েছে, পুঁজিও বেড়েছে। অন্যদিকে বিহার, ওড়িশা, উত্তর প্রদেশ, আসামের মত গরিব রাজ্যগুলিতে তাদের পাঠানো অর্থ চাহিদা সৃষ্টি করে কিছুটা হলেও সামাল দিয়েছে। করোনা এই পুরো অর্থনৈতিক বন্দোবস্তকে আঘাত করেছে। শিল্পপতি ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলিও উদ্বিগ্ন পরিযায়ী শ্রমিকদের গ্রামে ফিরে যাওয়ায়। শ্রমিকদের ফিরে যাওয়ার ফলে কারখানাগুলি যথাযথ ভাবে চলতে পারবে না। ফলে সস্তা শ্রম থেকে তারা বঞ্চিত হবে। তাই সরকারের কাছে পরিযায়ী শ্রমিকদের ফেরত আনার জন্য পরিবহণেরও দাবি করেছে চেম্বারগুলি।

কবে এই ভাইরাসের আক্রমণ থেকে আমরা মুক্তি পেয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরব তা বলা দুস্কর হলেও এটা বলাই যায় যে, অর্থনীতির উপরে দু:সহ আঘাত আসতে চলেছে। পুঁজির বিশ্বায়নপরবর্তিতে এত বড় ঘটনা ঘটেনি। তাই অর্থনীতিতে এর কী প্রভাব পড়বে তা বলা অসম্ভব।কোরোনার প্রভাব যোগান ও চা্হিদা দুদিকেই পড়বে। আগে অর্থনৈতিক মন্দা এসেছে, উৎপাদনে মন্থরতা এসেছে কিন্তু এভাবে আক্ষরিক অর্থেই উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়া ভাবাই যায় নি। এমন একটা পরিস্থিতি যে বিষয়ে কোন অভিজ্ঞতা না থাকায় বলাই যাচ্ছে না যে অর্থনীতির বিভিন্ন অংশগুলি কীভাবে প্রভাবিত হবে ও কী প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে? চাহিদা ও যাোগান উভয় তরফে এমন আঘাত অন্য কোন ধরণের আক্রমণে ঘটে না। কোথাও আঘাতটা আসে চা্হিদার দিক থেকে যা যোগানের দিককে পরবর্তিতে আঘাত করে, যেমনটা ঘটেছিল বিমুদ্রাকরনে, আবার কখনো তার সূত্রপাত ঘটে যোগানের অভাবে।

এই সামগ্রিক সামাজিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষিতে রাষ্ট্র ও সমাজের উপর প্রভাব বিস্তারকারী সকল পক্ষই কীভাবে এই সংকটকে মোকাবিলা করা যায় তার উপায় বাতলাচ্ছে। মনে রাখা দরকার বিভিন্ন জন ও ক্ষেত্র করোনার ফলে বিভিন্ন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, কেউ কেউ লাভবানও হবে। প্রত্যেক গোষ্ঠিই সরকারের নীতি ও কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে নিজেদের পক্ষে আনতে চাইবে।

চেম্বার অফ কমার্সগুলি নিজেদের দিকে ঝোল টানার চেষ্টা করছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক সুদের হার কমিয়েছে অনেক আগেই। সুদের হার আরো কমানোর দাবি রয়েছে। সুদের হার কমানোর সাথে সাথেই ব্যাঙ্কগুলি আমানতের উপর সুদের হার কমাচ্ছে, একই সাথে স্বল্প সঞ্চয়ে সুদের হার চূড়ান্ত মাত্রায় কমানো হচ্ছে। আমানতের উপরে সুদ কমার ফলে বয়স্ক নাগরিকদের আয় কমছে। লকডাউনের ফলে যখন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম কমছে তখন আয়ের হ্রাসের ফলে তাদের জীবন যাপন দুর্বিসহ হয়ে উঠছে। এ্যাসোচ্যাম বা ফিকি (ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান চেম্বার অফ কমার্স) যে দাবিগুলি করছে সেগুলো মূলত: ব্যবসায়ীদের কর ছাড়, জিএসটি ছাড়, কর্মচারী ভবিষ্যনিধি তহবিলে নিয়োগকর্তার দেয় অংশ দিয়ে দেওয়ার দাবি, ব্যাঙ্ক ঋণে ছাড় ইত্যাদি। সঙ্গে অবশ্য অতি ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র শিল্পে সুবিধে দেওয়া এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের অর্থ প্রদানের দাবিও রয়েছে। কিন্তু তা মূলত: ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য রাখা। চেম্বার অফ কমার্সের দাবিগুলি দেখলে খেয়াল করা যাবে যে ১১ লক্ষ কোটি টাকা থেকে ২২.৫ লক্ষ কোটি টাকার মত আর্থিক সহায়তার দাবি জানানো হয়েছে। অর্থাৎ দেশে জিডিপির ৫ থেকে ১০ শতাংশ। কিন্তু তার মধ্যে মাত্র ২ লক্ষ কোটি টাকার বরাদ্দ রাখার কথা বলা হয়েছে গরিব নিরন্ন মানুষ ও পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য। চেম্বারগুলি মূলত: তাদের জন্য সহজ শর্তে ধার, ঋণখেলাপির শর্ত শিথিল, জিএসটিতে ছাড় চাইছে।

কোভিড ১৯ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে যে শহরের অর্থনীতির চালিকা শক্তি আসলে ওই পরিযায়ী শ্রমিকেরা, যাদের এই শহর মনুষ্যেতর করে রাখে, যখন তখন উচ্ছেদের হুমকির সামনে। ওই শ্রমিকদের কেবল পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে গেলেই হবে না তাঁরা যেখানে থাকবেন সেখানে তাদের অধিকার দিতে হবে, থাকার সুবন্দোবস্ত করতে হবে। সরকারকেই তার জন্য অর্থ ব্যয় করতে হবে। করোনার সময়ে, প্রয়োজনে তারপরেও দরিদ্রজনের হাতে পরিবার পিছু প্রতি মাসে অন্তত ৬ হাজার টাকা দিতে হবে। যেহেতু, করোনার ফলে অন্তত আগামী ৬ মাস কাজে ভাটা পড়বে বলে মনে হচ্ছে তাই ৬ মাসের জন্য ওই অর্থ দেওয়া শুরু করতে হবে। অবস্থার উন্নতি ঘটলে সে বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। এমএসএমই, অর্থাৎ ক্ষুদ্র শিল্প যে ব্যাঙ্ক বা অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছে, তার জন্য মরেটোরিয়ামের পাশাপাশি ঋণ মকুবের বন্দোবস্ত করতে হবে। তা না হলে দেশ জুড়ে অসংগঠিত ক্ষুদ্র শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে।

দেশের কৃষি অর্থনীতি এমনিতেই খারাপ অবস্থায় ছিল। কোরোনার ফলে নগদ শস্য বা ক্যাশ ক্রপের দাম পাওয়া মুশকিল হবে। সরকারকে খালি ন্যূনতম মূল্য নির্ধারণ করে দিলেই হবে না, কৃষকের কাছ থেকে ফসল কিনতে হবে তাঁর দোড়গোড়ায় গিয়ে। বহুক্ষেত্রেই ঋণ যেহেতু প্রতিষ্ঠানের বাইরে মহাজনের কাছ থেকে নেওয়া হয়, সেই অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ক্ষেত্রেও সরকারকে শোধের জন্য দায় নেওয়ার কার্যকরী ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। শিল্পোৎপাদন ও ব্যবসায় ও যথেষ্ট সমস্যায় পড়েছে, তাই ওই সমস্ত ক্ষেত্রকে চাঙা করার জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় অর্থ ব্যয় করতে হবে; কিন্তু শর্ত হিসেবে ওই প্রতিষ্ঠানগুলি কোন কর্মচারীকে ছাটাই করতে পারবে না, এবং তাদের বেতন কাটতে পারবে না। শহরাঞ্চলে বহু মানুষ ফ্রি ল্যান্স কাজ করেন, গিগ অর্থনীতিতে কর্মরত অর্থাৎ ওলা-উবের চালান, জোম্যাটো-সুইগির ডেলিভারি দেন, ফিল্মে নাটকে কাজ করেন, তাদের রুজি বন্ধ হয়েছে; তাদের জন্যও পরিবার পিছু মাসিক ৬ হাজার টাকা দেওয়ার বন্দোবস্ত করতে হবে।

রাজ্য সরকারগুলিই কোরোনা মোকাবিলায় সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাদের নোট ছাপিয়ে সামাল দেওয়ার উপায় নেই। ওদিকে অতিরিক্ত সম্পদ সংগ্রহের কোন রাস্তাই রাজ্য সরকারগুলির কাছে নেই পণ্য ও সেবা কর চালু হওযার পর। যেহেতু অর্থনৈতিক কাজকর্ম শিকেয় উঠেছে তাই পণ্য ও সেবা কর থেকে আদায়ও কম, তার ভাগও কম। তাই, কেন্দ্রীয় সরকারকে রাজ্য সরকারের দায় গ্রহণ করতে হবে। এমন এক ভয়ংকর দুর্যোগে রাজ্য সরকারগুলিকে সব মিলিয়ে ৩-৪ লক্ষ টাকা অনুদান দেওয়া দরকার।

সব মিলিয়ে সরকারকে অর্থনীতিকে উজ্জীবিত করার জন্য ভূমিকা গ্রহণ করে প্রভূত পরিমাণ টাকা ব্যয় করতে হবে। আনুমানিক ১৫ লক্ষ কোটি থেকে ২০ লক্ষ কোটি টাকা এই কাজে প্রয়োজন হতে পারে। সম্পদ সংগ্রহের জন্য সরকার শিল্পপতি ও ধনীদের উপরে কর বসাক। মনে রাখা দরকার শিল্প প্রতিষ্ঠান ও শিল্পপতি এক নয়। ব্যক্তিগত করকে বাড়ানো হোক। সম্পত্তির উপর কর বসানো হোক। যারা সর্বক্ষেত্রে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ও প্রতিযোগিতার গল্প ফাঁদেন তাদের অধিকাংশই উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তি ও মূলধনের উপরে ভরসা করেই ধনী ছিলেন ও আরো ধনী হয়েছেন। দেশের এই সঙ্কটকালে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের উপরে কর বসানো হোক, এবং তা ধার্য হোক পূর্ববর্তিকাল থেকে। অপ্রয়োজনীয় সরকারি ব্যয় কাটছাট করে অর্থ বাঁচানো যেতে পারে, তবে জনপ্রতিনিধিদের উন্নয়ন তহবিলকে বন্ধ করে নয়। অতিরিক্ত সম্পদ সংগ্রহ ও ব্যয় কমানোর পরেও যে ঘাটতি থাকবে তাকে মেটানো হোক নোট ছাপিয়ে। আমাদের যে এফআরবিএম (রাজস্ব দাযিত্ব ও বাজেট পরিচালন) আইন আছে তা বারবারই ভাঙা হয়েছে। এমন দুরূহ পরিস্থিতিতে রাজস্ব ঘাটতি ও তার থেকে উদ্ভুত মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে চিন্তা না করে দেশের সকল মানুষের কথা চিন্তা করাই সরকারের কাজ।

0 Comments

Post Comment