পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

অনুপ্রবেশ এবং পরিযান নিয়ে কয়েকটি কথা ১ম পর্ব

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 207 view(s)
  • লিখেছেন : অঞ্জন ঘোষ
একটি রাজ্যের জনসংখ্যা কেন অধিক, তার অনেকগুলো কারণের মধ্যে অনুপ্রবেশ যেমন, তেমনই মাইগ্রেশনটাও একটা কারণ। বিগত প্রায় এক বছর ধরে বাংলার বাইরে বাঙালি বিদ্বেষকেও আমরা শ্রেণীর অবস্থান থেকে দেখার চেষ্টা করেছি। কোথাও কোন অত্যচার হচ্ছে না, কই আমাদের ঘরের ছেলে মেয়েরা তো বাইরে থাকে, তাদের কাছ থেকে তো কিছু শুনিনা। কিন্তু সত্যিটা কী? সেই জন্যেই এই লেখাটা পড়া জরুরি।

মাস ছয়েক আগে বেশ নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম, যাক, পাকাপাকিভাবে একটা ঝামেলা বিদায় হল ! ওই যখন ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ‘ঘন্টা সুমন’ আর ‘ময়ূর’ তাদের ফেসবুকের সেনাবাহিনী নিয়ে করাচী, ইসলামাবাদ সব ধ্বংস করে দিচ্ছিল ! একঘন্টা আগে শুনলাম করাচী বন্দর ধ্বংস তো তার মিনিট পনেরো পরেই ইসলামাবাদ। শুনতে পেলাম, আসিম মুনির নাকি গৃহবন্দী, সেনাবাহিনী আসিমকে গ্রেফতার করেছে, শাহবাজ শরীফের বাড়িতে নাকি মিসাইল মেরেছে ঘন্টা সুমনের বাহিনী । তারপর পরমাণু কেন্দ্র গুঁড়িয়ে দেওয়া! খবরে দেখলাম, বিমানে করে নাকি ‘পাকী’রা টন টন কিসের যেন নুন নিয়ে আসছে। নুন ঢেলে তেজস্ক্রিয়তা চাপা দেবে বলে। একে বলে ‘অবোধের গোবধে আনন্দ’! পাকিস্তানে পরমাণু কেন্দ্র গুঁড়িয়ে দিলে তেজস্ক্রিয়তা কি কাঁটাতার দিয়ে আটকানো যায় ? এক ফেবু সৈনিককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, রেডিয়েশন কি কাঁটাতার দিয়ে আটকানো যায়? সেই পরমবীর আমার তিন পুরুষ ধরে টানাটানি করায় এবং পাকিস্তানে চলে যেতে বলায় আমি আর এগোতে সাহস করিনি।

তবে সবকিছু মিলিয়ে পুরো বিষয়টা নিয়ে আমি বেশ খুশিতে ছিলাম। অন্তত, মোটা ভাই আর তার বড়দা, দুজনে মিলে দশ বছরে একটা সমস্যার পার্মানেন্ট সমাধান করল। আর পাকিস্তানকে দেখিয়ে অস্ত্র কেনার দরকার পড়বে না। ওদিকে  মিসাইল ফেলার সাথে সাথে অতি উৎসাহী চাড্ডি বাহিনী করল কী, হায়দ্রাবাদে করাচি বেকারীর কেক বিস্কুট ইত্যাদি লুঠ করে পালালো, তাদের মনে হয়েছে নাম যখন, করাচি  বেকারি, মালিকানা নিশ্চিত আসিম মুনিরের ! ‘পাকী’রা ফিনিশ, মানে প্রায় ফিনিশ, আই সি সি ইউ তে খাবি খাচ্ছে, সেইসময় ট্রাম্প ঘোষণা করে দিল, “যাও, যুদ্ধু শেষ, ফোন করে যুদ্ধু শেষ করে দিলাম” !

তারপর দেখি, কোথায় কী! আসিম  মুনির আর শাহবাজ শরীফ দেখি হোয়াইট হাউসে চিকেন তন্দুরি গিলে এঁটোহাতেই ট্রাম্পের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দাঁত কেলাচ্ছে! ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না। এই শুনছি, কোমায় আর এই দেখছি চিকেন তন্দুরি ! যাকে বলে, ‘এই মনে কর চাঁদের আলো পড়লি তারি পাশেতে’ ব্যাপার। তারপর ওদের ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান, খেলার মাঠ থেকে ট্রফি নিয়ে ভাগলবা।

কেউ মনে করতেই পারেন, পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটছি কেন? ঘাঁটছি, তার কারণ হল, গোদী মিডিয়া মানে নিরন্তর ফূর্তি নিরন্তর আমোদ। সে এখানে ঘন্টা সুমন, ময়ূর, ওদিকে অর্ণব, রজত শর্মা, সুধীর চৌধুরি, রাহুল কানওয়াল। এরা পারলে জামা কাপড় খুলেও আমোদের যোগান দিতে পারে। রাজদীপ আবার দুদিকেই খেলে! নভীকা কুমার একঘন্টা আগে কার সমর্থনে বলেছে সেটাই মনে রাখতে পারেনা। বর্খা ইদানীং তথৈবচ। সুতরাং রগড় নিরন্তর ।

গত তিনমাসের রগড় SIR। আচ্ছা, একটা বিনীত প্রশ্ন, বিহারের SIR এর পরে যদি ৬৫ লক্ষ নাম বাদ গিয়ে থাকে তাহলে আগের নীতিশ সরকার কি অবৈধ ছিল! আর SIR নিয়ে এত উদ্বাহু হওয়ার কারণটা কী ? SIR কি আদৌ অনুপ্রবেশ চিহ্নিত করার উপায় হতে পারে? এত বাজে ভাবে কোনও সরকারী কাজ কি আদৌ সমর্থনযোগ্য ? সেই বাজে কাজটাকে,  মানে একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ এত দ্রুততার সঙ্গে এত অদক্ষতার সঙ্গে শেষ করার অর্থ কী? রাজ্যে, যে SIR হচ্ছে, তার সরকারী গেজেট নোটিফিকেশন কবে কোথায় প্রকাশিত হল? যদি হয়ে থাকে, তার উপযুক্ত প্রচার হয়েছে? যারা উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করছেন, তাঁরা ২০০২ এর তালিকায় কত ভুল আছে সেটা দেখেছেন? আমার নিজেরই ২০০২ এর তালিকায় অসঙ্গতি আছে। নাম আছে কিন্তু EPIC নং নেই! তাহলে নতুন  ফর্মে সেই কলামটা রেখেছেন কেন? কে এর জবাব দেবে? একজন গ্রামের মানুষ, এই ধন্দের উত্তর কোথায় পাবেন? আমার স্ত্রীর ক্ষেত্রে ২০০২ এর তালিকায় চরম অসঙ্গতি আছে, ২০০২ এর তালিকায় পুরুলিয়ার তালিকায় তাঁর নাম আছে কিন্তু পুরুলিয়ায় থাকাকালীন যে EPIC নং ছিল সেটি ২০০২ এর তালিকায় নেই, আছে পূর্বের মালদহ এর EPIC নং ! এই ছ্যাবলামির উত্তর দেবে কে ? আসলে সব কিছু নিয়ে রাজনীতি করতে গেলে তার বিষফল একসময় টের পাওয়া যাবেই! আর সবথেকে বড় প্রশ্ন, কেন ২০০২ ? কেন, কেন এবং কেন ?

চাড্ডি বাহিনীর কাছে, জ্ঞ্যানেশ এর সমর্থক, মানে অন্ধ সমর্থকদের কাছে ২০০২ কি তাহলে কাট অফ্‌ পয়েন্ট? মানে যা কিছু অনুপ্রবেশ, ওখান থেকেই হয়েছে? আর এর সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে, মনগড়া সব তত্ত্ব। তথ্য নয়, তত্ত্ব। পার্সেপশন বা বিশ্বাস, তার সঙ্গে তথ্যের যে বিস্তর ফারাক সেটা কাকে বোঝানো যায় ? কীভাবে? কোন পদ্ধতিতে? মোটামুটি SIR নিয়ে হইচইয়ের অলীক কুরঙ্গনাট্যে, যেটা মিশিয়ে দেওয়া গেছে, পশ্চিমবঙ্গটা ভরে গেছে ওপার বাংলা থেকে মানুষে। এবং তাদের ১০০ শতাংশই মুসলমান।

SIR নাটকের হাত ধরে এলো, বিভিন্ন রাজ্যে, বিশেষ করে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে, পরিযায়ী বাঙালির ওপর নির্যাতন, থানায় টেনে নিয়ে যাওয়া, রাতারাতি ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বিদায় করা, পারলে বাদবিচার না করেই JCB দিয়ে সীমান্তের ওপরে ছুঁড়ে ফেলা। যুক্তি হল, বাংলাভাষী পরিযায়ী মানেই বাংলাদেশি। মধ্যবিত্ত (আদতে হাভাতে সাংস্কৃতিক বোধহীন) বাঙালি রাতারাতি প্যান-ইন্ডিয়ান সেজে সমাজ-মাধ্যম ভরে দিতে লাগল, “কই, আমাদের ঘরের ছেলেমেয়েরাও তো বাংলার বাইরে আছে , তাদের সঙ্গে তো তেমন কিছু হচ্ছে না। তারা দিব্যি বেঁচেবর্তে, ফূর্তিতে, ইন্সটামার্ট এ অর্ডার দিয়ে , জোম্যাটো থেকে খাবার আনিয়ে টিকে আছে, কোথায় অত্যাচার”? এই হচ্ছে মধ্যবিত্ত হাড়-হাভাতে বাঙালির শ্রেণীচেতনা! সঙ্গে চ্যানেলের প্যানেলে উদয় হলেন দুই বং লেখিকা ! সাহিত্যপ্রেমী বাঙালি এতদিন এনাদের লেখা পড়েছেন, ভেবেই ভিরমি খেতে হয়! আপনি যে কোন মতই পোষণ করতে পারেন কিন্তু তার পশ্চাতে যুক্তি থাকবে না! বাইরে কাজ করতে যাওয়া ইট ভাঁটার শ্রমিক, রাজমিস্ত্রি , ছুতার মিস্ত্রি, রঙ মিস্ত্রি, এদের বিপন্নতা ধরবে, এমন বাঙালি প্রায় ডোডো পাখির মত বিলীয়মান । সুতরাং!

পরবর্তী স্বতসিদ্ধ সিদ্ধান্তগুলো হল, পশ্চিমবঙ্গ ভরে গেছে ওপার বাংলার থেকে আগত অবৈধ অনুপ্রবেশকারীতে, তাদের ১০০ শতাংশই হল মুসলমান, এবং আরো একটু বাড়িয়ে নিয়ে এমনও স্বতসিদ্ধ সিদ্ধান্ত আছে যে, এই রাজ্যকে করিডোর বানিয়ে সেই অবৈধরা অন্য রাজ্যেও কাজ করতে চলে যাচ্ছে।

অনুপ্রবেশ যে আছে, হচ্ছে, সেটা নিয়ে হয়ত দ্বিমত থাকার কথা নয়, কিন্ত তার পরিমাণ কত? অন্তত শেষতম সেনসাসের হিসাব বা পরবর্তী সময়ের কিছু তথ্য তো এই ‘জলস্রোতের মত অনুপ্রবেশ’ এর তত্ত্বকে স্বীকার করছে না। এটা ধরতে গেলে তাহলে সংখ্যাতত্ত্ব ছাড়া উপায় নেই।

অন্তত তিনটি পর্বে আমি আমার মত করে লিখব, সে লেখার রসদও কিন্তু ধার করা। সেই তিনটি পর্ব হল, Migration বা পরিযান ( রাজ্যের আভ্যন্তরীন এবং রাজ্যের বাহিরে ), Infiltration বা অনুপ্রবেশ এবং ‘হাকিমপুর সরগরম’। ‘হাকিমপুর সরগরম’ নিয়ে আলোচনার দরকার কারণ এই যে রোজ লক্ষ লক্ষ অনুপ্রবেশকারী জড়ো হচ্ছে সীমান্তে, তার একটা হিসাব নেওয়ার দরকার। এইরকম কাছাকাছি ঘটনা আমরা ছোটবেলায় দেখেছি। ঠাকুর্দার বয়স আশি পেরোলেই ছেলে ছোকরার দল গল্প দিত, ঠাউরদা সামনের বছর সেঞ্চুরি করছে! ঘন্টা সুমন বা ময়ূর, সেই প্রাগৈতিহাসিক কালের নাদান বাচ্ছাদের থেকে বেশি কিছু নয়। সুতরাং ‘দলে দলে’ বা ‘হাজারে হাজারে’ বা ‘লাখে লাখে’র হিসাব নিতে হবে’ ঘন্টা বাহিনী’ র কাছে। শেষে কি সুজলা সুফলা বঙ্গভূমি জনমানবশূন্য হয়ে যাবে !  

হ্যাঁ, রাজ্যের ক্ষমতাসীন শাসকদল এবং তাদের সুপ্রিমো যদি বিষয়টাকে নিয়ে রাজনীতি করেন, সেই একই দোষে দুষ্ট কেন্দ্রের সরকারের এই রাজ্যের কাণ্ডারীরা। দেড় কোটি রোহিঙ্গা ! পাঁচ কোটি অনুপ্রবেশকারীদের তাড়াবেন! তাড়ান, কিন্তু আগে তো পাঁচ কোটি চিহ্নিত করতে হবে ! নাকি গেছোদাদার হিসাব? ত্রৈরাশিকে দেব না ভগ্নাংশে দেব? হিসেব করে দেখা যাচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখনো পর্যন্ত জনসমক্ষে ৩০ হাজারের বেশি মিথ্যা বলেছেন! ফ্যাক্ট চেক করে দেখা গেছে। মিথ্যা বলাটা রাজনীতিক দের মোটামুটি স্বীকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার। সমস্যাটা হল সাধারণ নাগরিক যখন দলীয় ভক্ত হয়ে সেই মিথ্যাকে সত্যি বানায়। ‘সত্য’ বা ‘ট্রুথ’ এর বিবর্তন চলছে। হাফ ট্রুথ থেকে পোস্ট ট্রুথ, সেখান থেকে ফাংশনাল ট্রুথ। সে কাহিনী আরেকদিনের জন্য তোলা থাক। কোডি ম্যাকফাডেন এর ‘স্মোকি ব্যারেট’ সিরিজের পাঁচ নম্বর বই ‘ট্রুথ ফ্যাক্টরি’। কোডির গল্পে সুন্দর ধরা পড়েছে কিভাবে মিডিয়া আর রাজনীতিকরা মিলে সত্য নির্মাণ করে থাকে। আমরা এখন সেই ট্রুথ ফ্যাক্টরির ম্যানু্ফ্যাকচার্ড ট্রুথের পাল্লায় পড়েছি। আজকের সমাজ মাধ্যম সেই ‘ট্রুথ ফ্যাক্টরি’র অন্যতম কারিগর ।

(১)  মাইগ্রেশন বা পরিযান

একটি গ্রাফ আপনি নিজেই তৈরি করতে পারেন। কিন্তু পরিযায়ী বা মাইগ্রান্ট নিয়ে যারা চিৎকার করেন তাঁরা এই গ্রাফটা দেখাতে চান না। এই গ্রাফটি এমন অনেক কথা বলে যা বর্তমান বাংলা বিরোধী প্রচারের সঙ্গে মেলে না। যাঁরা চিৎকার করেন, তাঁরা আদতে আমাদের থেকেও বুদ্ধিমান না হলেও চালাক। চালাকির সঙ্গে সৎ বুদ্ধির একটা তফাৎ আছে।  তাই এই গ্রাফটি চিৎকারবিদরা তৈরি করেন না।  আপনি নিজেই তৈরি করুন।  সেই গ্রাফে নেট মাইগ্রান্টের সংখ্যা বের করা হবে রাজ্যে আসা মাইগ্রান্ট থেকে রাজ্য থেকে বেরনো মাইগ্রান্টের সংখ্যা বাদ দিয়ে।তার মানে যে সব রাজ্যের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটি ধনাত্মক তারা মাইগ্রান্টের গ্রহীতা, যাদের ক্ষেত্রে সংখ্যাটি ঋণাত্মক তারা মাইগ্রান্টের সরবরাহকারী। এখন কারা গ্রহীতা হতে পারেন? যেসব রাজ্যে কাজের সুযোগ বেশি বা যারা অর্থনৈতিক ভাবে এগিয়ে আছেন। অর্থাৎ, শ্রমের গ্রহীতা হওয়া অর্থনৈতিক উন্নতির একটা পরোক্ষ সূচক হিসেবে কেউ ভাবতে পারেন। এই তথ্যগুলি কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য ভাণ্ডার থেকেই নেওয়া বা এন এস এস এর তথ্যভাণ্ডার। সুতরাং পক্ষপাতিত্বের কথা বলা ঠিক হবে না ।

সেই তথ্য থেকে আপনি যদি গ্রাফ তৈরি করেন তাহলে দেখতে পাবেন,  এই গ্রাফের একেবারে ওপরে অর্থাৎ যে সব রাজ্য ধ্বনাত্মক অবস্থানে আছে, অর্থাৎ যারা পরিযায়ী গ্রহিতা, তাদের মধ্যে প্রথম তিন হল, মহারাষ্ট্র, দিল্লি, গুজরাট। আর একেবারে তলার তিন রাজ্য, অর্থাৎ যারা পরিযায়ী সরবরাহকারী তারা হল উত্তরপ্রদেশ, বিহার, রাজস্থান। শ্রমিক গ্রহীতাদের লিস্টে সবচেয়ে ওপরে – মহারাষ্ট্র, দিল্লি, গুজরাট প্রথম তিনে। এই অবধি গ্রাফ আমাদের বিশ্বাসের সঙ্গে যায় কারণ আমাদের ঘরের ছেলেরাও তো এই সব রাজ্যে চাকরি করতে যায়। কিন্তু গ্রহীতার লিস্টে চার নম্বরে -- পশ্চিমবঙ্গ ! কী অবাক কাণ্ড ! আরো অবাক কাণ্ড হল গ্রহীতার লিস্টে পশ্চিমবঙ্গের স্থান কর্ণাটকের ওপরে! অথচ, আমরা জানি যে চাকরি না পেলেই সবাই কর্ণাটক চলে গিয়ে চাকরি বাগিয়ে বসে। আমাদের জানাটা যে ভুল তা না, কিন্তু আমরা শ্রমের বাজার সম্পর্কে ধারণা করি আমাদের শ্রেণীর লোকেদের দেখে। ওই যে আগেই লিখলাম “কই আমাদের ঘরের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কিছু হচ্ছে না তো”! কিন্তু আমাদের সামাজিক অবস্থান থেকে যারা শ্রমের বাজারে যাচ্ছেন, সামগ্রিক শ্রমের বাজারের চরিত্র তার থেকে অনেক আলাদা।

কিন্তু এটা দেখে তৃণমূলীরা উদ্বাহু হতে পারেন, আপনি হবেন না। কারণ শ্রমের বাজারে মাইগ্রান্টের আসা যাওয়া অনেকগুলি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। এটাও হতে পারে এই রাজ্যে হোয়াইট কলার জব যাকে বলা হয় তার থেকে ব্লু কলার জব, সেই ক্ষেত্রে কাজের পরিমাণ বেশি। অথবা হোয়াইট কলার জব যা আছে, অন্য রাজ্যের থেকে মজুরী কম। আরো নানা কারণ আছে, কিন্তু আমি এই লেখায় পরিযানের সংখ্যা নিয়ে লিখতে বসেছি, তাই সেই জটিল বা দীর্ঘ আলোচনায় যাব না ।

একটি রাজ্যের জনসংখ্যা কেন অধিক, তার অনেকগুলো কারণের মধ্যে অনুপ্রবেশ যেমন, তেমনই মাইগ্রেশনটাও একটা কারণ। বিগত প্রায় এক বছর ধরে বাংলার বাইরে বাঙালি বিদ্বেষকেও আমরা শ্রেণীর অবস্থান থেকে দেখার চেষ্টা করেছি। কোথাও কোন অত্যচার হচ্ছে না, কই আমাদের ঘরের ছেলে মেয়েরা তো বাইরে থাকে, তাদের কাছ থেকে তো কিছু শুনিনা। স্বীকার করে নেওয়া ভালো আমার বাড়ির পরবর্তী প্রজন্ম হয় রাজ্যের বাইরে থাকে অথবা দেশের বাইরে, কিন্তু সেই অবস্থান থেকে কি বর্হিবঙ্গে বাঙালির ওপর অত্যাচার হচ্ছে না, একশ্রেণীর পরিযায়ী মানুষ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় হিংসার শিকার হচ্ছেন না, এককথায় বলে দেওয়া যেতে পারে?  এই আলোচনার সঙ্গে জুতে দেওয়া হয়, সব ওপার বাংলা থেকে আসছে।

কিন্তু একটা পরিস্কার হিসাব আপনি পাবেন কোথা থেকে? তথ্যের যোগান তো বন্ধ করে দিয়েছেন কেন্দ্রের সরকার। করোনার দোহাই দিয়ে ২০২১ এর আদমশুমারী করতে দেন নি, এবং তার পরের চার বছরে অত্যন্ত সুচতুরভাবে বন্ধ রেখেছেন। কেন বন্ধ করেছেন সেনসাস? ভক্তদের কাছে কোনো উত্তর আছে? সেনসাসের পরিবর্তে SIR কি আদৌ কোনো সমাধান ? নাকি সবকিছু  গুলিয়ে দেওয়ার জন্য ?

ঠিক কতজন ঘুষপেটিয়া? ঠিক কতজন ওপার বাংলা থেকে এসে এই রাজ্যকে করিডোর করে অন্য রাজ্যে চলে গেছেন? এই পরিপ্রেক্ষিতে সংখ্যার প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। কতজন আক্রান্ত বাংলার বাইরে ? যেটুকু খবরে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কতজন বিপন্ন? এবং রাজ্য সরকারের দায়িত্ব কী? প্রশ্ন, অভিবাসী শ্রমিকদের কতজন বাংলা থেকে ভারতের অন্যান্য রাজ্যে গেছেন কাজের সূত্রে, এবং তার উল্টোদিকে বাইরের অন্যান্য রাজ্য থেকে কতজন বাংলায় এসেছেন কাজের খোঁজে? এই সংখ্যাগুলো আপনি বের করবেন কিভাবে ?

বিবেক দেবরয় এবং দেবীপ্রসাদ মিশ্র একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন । “Examining volume and directions of domestic migration in India using novel high-frequency data” (EAC-PM Working Paper No. 35/2024) । তিন ধরণের ডেটা নিয়ে তাঁরা কাজ করেছিলেন , সেগুলো হল ঃ

১) ভারতীয় রেলওয়ের আনরিজ়ার্ভড টিকিট সিস্টেম অর্থাৎ ইউ-টি-এস থেকে যাত্রীর সংখ্যা (যাতে প্রায় তিরিশ কোটি ডেটাপয়েন্টস) - আনরিজার্ভড টিকিট ব্যবহৃত হয়েছে ‘ব্লু কলার’ অভিবাসী-সংখ্যার প্রক্সি হিসেবে।
২) টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটি অফ ইণ্ডিয়া অর্থাৎ ট্রাই থেকে মোবাইল ফোন রোমিং-এর ডেটা, আর
৩) জেলাভিত্তিক ব্যাঙ্কিং ডেটা।

এই গবেষণার বিষয়গুলি আমি জানতে পারি অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় এর কিছু লেখা থেকে। তারপর প্রতিবেদনটি সংগ্রহ করে পড়লাম। ৬৫ পাতার এই প্রতিবেদনটি খুব সহজেই আন্তর্জাল থেকে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটি  আমি এখানে দিতেই পারতাম, কিন্তু সহজে কিছু যোগান দিলে পড়ার আগ্রহ কমে যায়। তাই অনুরোধ আগ্রহীরা নিজে খুঁজে নিয়ে পড়ুন। ‘রায়-মিশ্র’, প্রতিবেদনটি কেন্দ্রের বর্তমান সরকারের কাছেই পেশ করেছিলেন, সুতরাং আমার মতের বিরুদ্ধপক্ষীয়রা নিশ্চিন্তে ওইটির ওপর ভরসা করতে পারেন।

এই হিসাব অনুযায়ী, ২০১১-এর তুলনায় গোটা দেশেই অভ্যন্তরীণ অভিবাসনের বা পরিযানের  হার কমেছে, ওঁদের হিসেবে ২০২৩ সালে দেশে মোট অভ্যন্তরীণ অভিবাসীর বা পরিযায়ীর সংখ্যা প্রায় আনুমানিক ৪০,২০,৯০,৩৯৬ – অর্থাৎ, ২০১১ সালের সেন্সাসে গোনা ৪৫,৫৭,৮৭,৬২১ জনের তুলনায় প্রায় ১১.৭৮% কম। ফলত ২০১১ সালে, যদি মাইগ্রেশন রেট হয়ে থাকে ৩৭.৬৪%, এখন তা দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৮.৮৮%–এ। কিছু সহজ-সরল জিনিষ ধরে নিলে, হিসেব কষে দেখা যাবে, পশ্চিমবঙ্গে এই হিসেব অনুযায়ী আউট-মাইগ্র্যান্টের সংখ্যা ২১.২১ লাখ। তারা ছড়িয়ে আছেন সারা দেশে। তার সঙ্গে দেব রায় – মিশ্র ‘র তথ্য ভাণ্ডার বিশ্লেষণ করে যা পাওয়া যায় তা হল এই একই পর্বে পশ্চিমবঙ্গে ইন-মাইগ্রান্টের সংখ্যা ৪৪ লক্ষের অধিক, অর্থাৎ আউট মাইগ্রান্টের থেকে ইন- মাইগ্রান্ট অনেক বেশি। হতে পারে এটা ব্লু কলার জব কেন্দ্রিক আর আমরা মধ্যবিত্তরা হিসাব করে থাকি হোয়াইট কলার জবের চলন থেকে। কিন্তু ওপার বাংলা থেকে এসে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ছে এবং পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতেও ধ্বস নামাচ্ছে, সেই মিথটা এই তথ্য ভাণ্ডার থেকে পরিস্কার হচ্ছে না।  

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে বহিরাগত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। এবং সেটা অ-বাংলাভাষী অর্থাৎ মোট হিসাবে রাজ্যের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের সঙ্গে রাজ্যের বাংলাভাষীর সংখ্যা সাযুজ্যপূর্ণ অর্থাৎ ওপার বাংলা হতে  অনুপ্রবেশের তত্ত্বের পক্ষে তেমন প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না কিন্তু অন্যভাবে ইন-মাইগ্রান্টের সংখ্যা বাড়ছে। সেটা হতেই পারে, একটা গণতান্ত্রিক দেশে মানুষ রুজি রোজগারের সন্ধানে দেশের নানা প্রান্তে যেতেই পারে এবং সেখানে স্থায়ী বাসিন্দা হতেও পারে। কিন্তু সেটা ‘ওপার বাংলা’ বলে চালালে চলবে না। বিগত সেনসাসেই রাজ্যে বসবাসকারীদের মধ্যে অন্য ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি। 

সেই আলোচনা পরের পর্বে।

 

 

 

0 Comments

Post Comment