পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

শিকাগোর হে মার্কেট স্কোয়ার ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস

  • 01 May, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 425 view(s)
  • লিখেছেন : মিতালি বিশ্বাস
১৮৮৬ সালের শিকাগোর হে মার্কেট স্কোয়ার থেকে যে আওয়াজ উঠেছিল, সেই আওয়াজ আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের আওয়াজ। ৮ ঘণ্টা কাজ, সম্মানজনক মজুরি, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম এবং ৮ ঘণ্টা বিনোদনের ন্যায্য দাবিতে হাজারে হাজারে শ্রমিকরা জড়ো হয়েছিল হে মার্কেট স্কোয়ারে। আজকে যখন দেখা যায়, গিগ শ্রমিকরা ছুটে চলেছেন, আমার আপনার প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র পৌঁছে দিতে তখন এই দিনটা নিয়ে আবার ভাবতে হয়। আজকের দিনে একটি অন্যরকম আখ্যান থাকলো।

আজকে আমাদের যে আওয়াজকে তোমরা ফাঁস দিয়ে রুদ্ধ করতে চাইছো, এমন দিন আসবে, যখন আমাদের নিস্তব্ধতা এই আওয়াজের থেকেও অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠবে।" "The day will come when our silence will be more powerful than the voices you strangle today" - ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলেছিলেন আমেরিকার শ্রমিক নেতা আগস্ট স্পাইস।

গতবছর শিকাগো শহরে প্রথমবার গিয়েই আমি গিয়েছিলাম হে মার্কেট স্কোয়ারে। সে এক মুহূর্ত! আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম সেই ঐতিহাসিক মাটিতে - যেখান থেকে শুরু হয়েছিল 'মে দিবস'-এর যাত্রা। যদিও আজ আর সেই হে মার্কেট স্কোয়ার নেই। চারপাশে সারি সারি আকাশচুম্বী অট্টালিকা, আধুনিক নগরের ব্যস্ততার মাঝে একটি ছোট ব্রোঞ্জের স্মৃতিস্তম্ভ বয়ে চলেছে সেই লড়াইয়ের ইতিহাস।

১৮৮৬ সালের ৪ঠা মে, শিকাগোর হে মার্কেট স্কোয়ারে রচিত হয়েছিল ইতিহাসের এক রক্তাক্ত অধ্যায়। ৮ ঘণ্টা কাজ, সম্মানজনক মজুরি, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম এবং ৮ ঘণ্টা বিনোদনের ন্যায্য দাবিতে হাজারে হাজারে শ্রমিকরা জড়ো হয়েছিল হে মার্কেট স্কোয়ারে। শ্রমিকরা যখন বক্তব্য রাখছিলেন, আচমকা সেই মিছিলে ছোড়া হয় একটি বোমা। ধোঁয়ায় ঢেকে যায় চারিদিক। পুলিশ-শ্রমিক সংঘর্ষে রক্তাক্ত হয় হে মার্কেট স্কোয়ার। নিহত হন ৪ জন শ্রমিক ও ৭ জন পুলিশ। আহত হন আরও বহু মানুষ।

এরপরই শুরু হয় 'বিচার' নামে রাষ্ট্রীয় প্রতিশোধ। অভিযোগের ভিত্তিতে ৮ জন শ্রমিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদেরই একজন ছিলেন আগস্ট স্পাইস। মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় আগস্ট স্পাইস, অ্যালবার্ট পারসন্স, জর্জ এঙ্গেল ও অ্যাডলফ ফিশারকে। আর সরকারি হিসাব মতে বিপ্লবী লুই লিং জেলে আত্মঘাতী হন - কিন্তু এই সৌধেই লেখা আছে "Louis Lingg died violently in jail, prior to his scheduled execution"। আসলে তাকে জেলের মধ্যেই হত্যা করা হয়েছিল। আর তিন শ্রমিক নেতা স্যামুয়েল ফিল্ডেন, মাইকেল শোয়াব ও অস্কার নিবেকে দেওয়া হয়েছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

শুধু পুরুষ শ্রমিক নয়, এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন লুসি পারসন্স। লুসি ছিলেন অ্যালবার্ট পারসন্সের স্ত্রী। লিঙ্গ ও বর্ণের কারণে তাঁকে বারবার বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছিল, কিন্তু আপোষহীনভাবে তিনি লড়াই চালিয়ে গেছেন। হে মার্কেটের ঘটনার পর, যখন নেতারা একে একে গ্রেফতার হচ্ছেন, তখনও তিনি শ্রমিকদের সংগঠিত করার কাজ চালিয়ে যান। পরে তার নেতৃত্বে গঠিত হয় ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স অফ দ্য ওয়ার্ল্ড (IWW)।

সেই সময় জুড়ে সারা আমেরিকা উত্তাল হয়েছিল পরিবেশ, ন্যায্য মজুরি ও কম কাজের সময়ের দাবিতে শ্রমিক বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছিল দেশজুড়ে। ১৮৮৬ সালের ১লা মে থেকেই আগস্ট স্পাইস ও অ্যালবার্ট পারসন্সের নেতৃত্বে শিকাগো শহরে রাস্তায় নামে শ্রমিকেরা। ৩ মে পুলিশের গুলিতে দু'জন শ্রমিক নিহত হন। ৪ঠা মে সেই হত্যার প্রতিবাদেই ডাকা হয় হে মার্কেটের সভা।

সেই দিন শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বোমাছোড়ার জন্য শ্রমিক নেতারা দায়ী না থাকলেও কোনো প্রমাণ ছাড়াই ৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আদালতও কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। ১৮৯৩ সালে ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের গভর্নর জেলে বন্দী বিপ্লবী স্যামুয়েল ফিল্ডেন, মাইকেল শোয়াব ও অস্কার নিবের সাজা মকুব করেন এবং স্বীকার করেন - এই বিচার ছিল অনায্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কিন্তু যে শ্রমিক নেতারা আপোষহীন লড়াই করে মিথ্যে অভিযোগে শহীদ হলেন, তাঁদের হত্যার দায়ে কারো শাস্তি হয়নি।

১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কার্স কংগ্রেসে এই হে মার্কেটের লড়াইকেই স্মরণ করে ১লা মে-কে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। বিশ্বজুড়ে শ্রমিক সংগঠন ও বামপন্থী আন্দোলনের কাছে এই দিনটি বিশেষ তাৎপর্য বহন করলেও, যে দেশে এই ঘটনা ঘটেছিল - সেই যুক্তরাষ্ট্র ১লা মে পালন করে না। কেবলমাত্র কমিউনিস্ট সংগঠনগুলো এই দিনটি স্মরণ করে, সাধারণ আমেরিকানদের কাছে এটি গুরুত্বপূর্ণ নয়। তারা "লেবার ডে" পালন করে প্রতি সেপ্টেম্বর মাসে - যার সাথে হে মার্কেটের আন্দোলনের কোনো সম্পর্ক নেই। আসলে হে মার্কেটের রক্তাক্ত বামপন্থী ইতিহাসকে মুছে দেওয়ার চেষ্টাতেই ১লা মে-কে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।

এই স্মৃতিস্তম্ভও কোনো সরকারি উদ্যোগে নির্মিত হয়নি। শুরুতে এখানে নিহত পুলিশদের স্মরণে সৌধ স্থাপন করা হয়েছিল। পরে বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলোর চাপে 'পাবলিক আর্ট প্রোগ্রাম' ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর যৌথ উদ্যোগে বর্তমান হে মার্কেট স্মৃতিসৌধ তৈরি হয়। তবে আমেরিকার নতুন প্রজন্মের নাগরিকরা এ ইতিহাস জানে না। তাদের জানতে দেওয়া হয়নি।

সেই ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা আজও অব্যাহত। কিন্তু শ্রমিকদের লড়াই থেমে থাকেনি। আজও শ্রমিকেরা ৮ ঘণ্টা কাজ, ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ কাজের পরিবেশের দাবিতে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে কর্পোরেট মুনাফাখোরদের বিরুদ্ধে। কর্পোরেট পুঁজির আগ্রাসন শ্রমিকদের পিষে মারতে চায়, বিশেষ করে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। তাদের নেই নির্দিষ্ট মজুরি, নেই কাজের সময়, নেই নিরাপদ পরিবেশ। পুঁজিবাদ শোষণের নতুন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করছে - গিগ ইকোনমি, প্রাইভেটাইজেশন, কন্ট্রাক্ট চাকরি। অ্যাপ-নির্ভর এই দুনিয়ায় হাজারে হাজারে শ্রমিক নাম লেখাতে বাধ্য হচ্ছে নানা সংস্থায়। সরকার বলছে হচ্ছে বেকারদের কর্মসংস্থান। অথচ বাস্তবে সুইগি, ব্লিংকিট থেকে জোম্যাটো - সব জায়গায় কেড়ে নেওয়া হচ্ছে শ্রমিকদের ন্যূনতম শ্রমের অধিকার। তাদের জন্য নেই কোনো শ্রম আইন। এই সময়ে নারী শ্রমিকদের অবস্থা আরও কঠিন। লিঙ্গগত মজুরি বৈষম্যের সাথে সাথে নেই কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা ও নিরাপত্তা।

আজ আমেরিকার অ্যামাজন, স্টারবাক্সের মতো বড় সংস্থার শ্রমিকরা ইউনিয়নের অধিকার ও ন্যায্য মজুরির দাবিতে লড়ছে। ভারতেও কেন্দ্র সরকার যখন শ্রম কোডের নামে শ্রমিকদের অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে, তখন বেঙ্গালুরুর গার্মেন্টস শ্রমিক থেকে বাংলার এক্সোডাসের বস্ত্র নারী শ্রমিকদের লড়াই এক হয়ে উঠছে - ৮ ঘণ্টা কাজ, ন্যায্য মজুরি আর নিরাপদ-সুষ্ঠু পরিবেশের দাবিতে।

মে দিবস শ্রমিকদের ঐক্য ও মর্যাদার গৌরবময় ইতিহাস। হে মার্কেটে আগস্ট স্পাইস, অ্যালবার্ট পারসন্স, জর্জ এঙ্গেল ও অ্যাডলফ ফিশার যে লড়াই লড়ে শহীদ হয়েছিলেন, আজ সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। তার চরিত্র বদলেছে। তাঁদের সেই শোষণমুক্ত সমাজের স্বপ্নকে সফল করতে লড়াইকে ছড়িয়ে পড়ুক কারখানার চার দেওয়াল থেকে রাষ্ট্রের আঙিনায়।

আজ আন্তর্জাতিক শ্রম দিবসের দিনে শিকাগো থাকলে হে মার্কেট স্কোয়ারে শহীদ সৌধের সামনে গিয়ে দাঁড়াতাম। বিপ্লবের অঙ্গীকারের প্রতীক হিসেবে রেখে আসতাম লাল গোলাপ।

0 Comments

Post Comment