পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

পর্বতের মূষিক প্রসব

  • 20 June, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 1348 view(s)
  • লিখেছেন : শতাব্দী দাশ
ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রশ্নই যখন উঠল, তখন 'ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে মেয়ের বাবার পক্সো ধারায় এফ আই আর প্রত্যাহার' মর্মে যে সংবাদ প্রায়শ দেখা যাচ্ছে গণমাধ্যমে, তা নিয়েও আলোচনা করা যাক। প্রথমত, পক্সো প্রত্যাহার করা যায় না। এটি নন-কম্পাউন্ডেবল অপরাধ। মানে, অভিযোগকারী একবার অভিযোগ করলে আর তুলে নিতে পারে না৷ মানে, অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত যদি নিজেদের মধ্যে আপোস মীমাংসা করেও নেয়, তাহলেও আদালতে কেস উঠবে ও বিচারক তা খতিয়ে দেখবেন। ব্রিজ ভূষণের ক্ষেত্রে কেন তা হবে না?

দুই খেপে ধর্না, ফেডারেশনে অন্তর্বতী তদন্ত, পুলিসের এফআইআর নিতে অনীহা, আদালত মারফৎ এফআইআর নিতে বাধ্য করা, প্রায় ২০০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে একটি চার্জশিট প্রসব হয়েছে। প্রতিবাদের শুরুর দিন থেকে ধরলে, চার্জশিট পেশ হয়েছে ছ মাসের মাথায় (জানুয়ারিতে কুস্তিগিররা প্রথম খেপের ধর্না শুরু করেন যন্তর মন্তরে)। আর এফআইএর গ্রহণের (বলা ভাল আদালতের আদেশে এফআইআর গ্রহণে বাধ্য হওয়ার) পর থেকে ধরলে, চার্জশিট প্রসব করতে পুলিস সময় লাগিয়েছে তিন মাস। সচরাচর সাক্ষ্যপ্রমাণ সহ দাখিল করা একটি এফআইআরের ভিত্তিতে চার্জশিট গঠন করতে পুলিসের কত সময় লাগে? বড়জোর সপ্তাহ খানেক। এমনিতে একটি এফআইআর যদি যৌন নির্যাতন সম্পর্কিত হয় তবে এফআইআরের পর কী হয়? দুএকদিন বা খুব বেশি হলে সাত থেকে দশ দিনের মধ্যে মেয়েটিকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গোপন জবানবন্দি দিতে পাঠানো হয়। এক্ষেত্রে এই গোপন জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে প্রায় দু মাস পর। কারণ? অভিযুক্ত কেন্দ্রীয় শাসকদল বিজেপির 'ঘাঁটি' উত্তর প্রদেশের একজন প্রভাবশালী সাংসদ।

 

চার্জশিটটি বহরে বড়। প্রায় ১৫০০ পাতার। কিন্তু এ পর্বতের মূষিক প্রসব নয় তো?  ভিডিও ও অডিও প্রমাণও তার সঙ্গে দেওয়া হয়েছে, তবে তা অভিযোগকারীদেরই দেওয়া, পুলিসি তদন্ত থেকে উঠে আসা কিছু নয়। যে ২০০ জনকে জেরা করা হয়েছে, তার মধ্যে ৭০-৮০ জনের জবানবন্দিও নাকি আছে। যদিও বোঝা যাচ্ছে না তার প্রয়োজনীয়তা কী? যৌন নির্যাতন অন্তরালে ঘটে৷ তার সাক্ষী পাওয়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্ভব না৷ ওই ৭০/৮০ জনের জবানবন্দি অভিযুক্তকে বাঁচাতেই নেওয়া হল না তো?

 

তবে সবচেয়ে অস্বস্তিকর বিষয়টি হল, অভিযুক্তকে যে গ্রেপ্তার করা হবে না, তা স্পষ্ট হয়ে গেল চার্জশিট পেশের সঙ্গে সঙ্গে। দিল্লি পুলিশ বিজেপি সাংসদ এবং ডাব্লুএফআই প্রধান ব্রিজ ভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে নিম্নলিখিত ধারায় চার্জশিট দিয়েছে।

 

ধারা ৩৫৪ (নারীর "শ্লীলতাহানি")

 

৩৫৪ক (যৌন-ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য করা)

 

৩৫৪ঘ (স্টকিং)

 

৫০৬/১(ভীতি প্রদর্শন)

 

এর মানে হল যে দিল্লি পুলিশের তদন্তেই স্বীকার করে নেওয়া হল যে ব্রিজ ভূষণ শ্লীলতাহানি, করেছিলেন, যৌন ইঙ্গিত পূর্ণ মন্তব্য, স্টকিং ইত্যাদি কুকর্ম করে আবার ভয়ও দেখাতেন।

কিন্তু তাঁকে গ্রেফতার করা হল না আইনেরই মারপ্যাঁচ দেখিয়ে। পুলিসের বক্তব্য, উপরিউক্ত সব ধারা খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে এতে সর্বাধিক পাঁচ বছর জেল হতে পারে। পুলিস বলেছে, ক্রিমিনাল প্রসিডিওরের ৪১ এর ধারা ও ২০১৪-এর অর্ণেশ কুমার বনাম বিহার রাজ্য মামলায় সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকে মেলালে যা পাওয়া যায়, তাতে তাদের মনে হয়েছে যে পাঁচ বছর সর্বাধিক সাজা যে মামলায়, সে মামলায় অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার না করলেও চলে৷

 

কী এই অর্ণেশ কুমার মামলা? এর পিছনেও আবার নারী নির্যাতনের প্রসঙ্গ আছে। বিহারের অর্ণেশ কুমারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছিল বধু নির্যাতনের, ৪৯৮ক ধারায়। ৪৯৮ক ধারায় তখন এফআইআর হলেই গ্রেপ্তার করা হত। এই জরুরি ভিত্তিতে গ্রেপ্তারির বিরুদ্ধে প্রতি-মামলা করা হয়। দেশে তখন প্রবল ৪৯৮-ক বিরোধী হাওয়া। অবশ্য পিতৃতান্ত্রিক সমাজ বধু-নির্যাতন বিরোধী আইনের কঠোরতার বিরুদ্ধে চিরকালই মুখর ছিল। সুপ্রিম কোর্ট রায় দেয় যে 'নন-বেইলেবল' ও 'কগনিজিবল' অপরাধের ক্ষেত্রেও পুলিস তদন্তের আগে গ্রেপ্তার না করতে পারে। পুরুষ-অধিকার কর্মীরা খুশি হয়েছিলেন ও নারীবাদীরা প্রতিবাদ করেছিলেন সে সময়। সেই রায় কাজে লাগিয়ে যৌন নির্যাতক ব্রিজ ভূষণও আজ জেলের বাইরে রইলেন।

 

আসলে আইনের বইতে কিছু নির্দিষ্ট লব্জ লেখা থাকে। আইনজীবী, বিচারপতি, পুলিস, আমি, আপনি তাকে নানা ভাবে 'ইন্টারপ্রিট' করতে পারি। এক্ষেত্রে ব্রীজভূষণের প্রতি সদয় পুলিস অর্ণেশ কুমার কেন্দ্রিক রায়কে নতুন ভাবে 'ইন্টারপ্রিট' করল ব্রিজভূষণকে বাঁচাতে। আমরা জানলাম, গৃহ হিংসার নির্যাতনকারীদের মতো এবার যৌন নির্যাতকদের গ্রেপ্তারি এড়াতেও অর্ণেশ কুমার রায় ব্যবহৃত হবে।

 

অথচ ক্রিমিনাল প্রসিডিওরের ৪১ ধারায় এটাও বলা আছে যে 'কগ্নিজিবল' অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিস চাইলে এমনকি ওয়ারেন্ট ছাড়াও গ্রেপ্তার করতে পারে। কিন্তু, ওই যে 'ইন্টারপ্রিটেশন'। আমার ভাষ্যটি খাড়া করতে আমি আইনের কোন অংশটি নেব আর কোনটি বাদ দেব, তা আমিই ঠিক করব। পুলিস এক্ষেত্রে সেই বেছেছে সেই অংশটি, যা বাছলে অভিযুক্তর সুবিধে হয়। পুলিস বলেছে, অভিযুক্ত নাকি সর্বার্থে তদন্তে সহযোগিতা করছে, তাই গ্রেপ্তারি আবার কেন? এদিকে আমিরা দেখছি, অভিযুক্ত সভা সমিতিতে গিয়ে অভিযোগকারিণীদের নামে কুৎসা রটাচ্ছেন। ভিনেশ ফোগটকে ষড়যন্ত্রকারী মন্থরা নামে ডাকছেন। হাততালি পড়ছে। তাঁর সমর্থকরা বলছেন, 'কুস্তিগিরদের চেহারা দেখলে কি মনে হয় ওদের সঙ্গে যৌনতা করার জন্য কেউ লালায়িত হবে?' এইগুলি বোধ করি তদন্তে সহযোগিতার নিদর্শন নয়, বরং তদন্ত প্রভাবিত করার চেষ্টা বলা চলে এদের৷ এমনিতেও সাংসদ ব্রিজভূষণের পদাধিকার বলে প্রাপ্ত ক্ষমতার সামান্য অপব্যবহার করলেই যে তদন্ত প্রভাবিত করা যায়, তা বলাই বাহুল্য।

 

ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রশ্নই যখন উঠল, তখন 'ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে মেয়ের বাবার পক্সো ধারায় এফ আই আর প্রত্যাহার' মর্মে যে সংবাদ প্রায়শ দেখা যাচ্ছে গণমাধ্যমে, তা নিয়েও আলোচনা করা যাক। প্রথমত, পক্সো প্রত্যাহার করা যায় না। এটি নন-কম্পাউন্ডেবল অপরাধ। মানে, অভিযোগকারী একবার অভিযোগ করলে আর তুলে নিতে পারে না৷ মানে, অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত যদি নিজেদের মধ্যে আপোস মীমাংসা করেও নেয়, তাহলেও আদালতে কেস উঠবে ও বিচারক তা খতিয়ে দেখবেন। ২০২১ সালে 'কেরালা রাজ্য বনাম হাফসাল রহমান এবং অন্যান্য' নামক এক কেসে সুপ্রিম কোর্ট একইভাবে কেরালা হাইকোর্টের আদেশ স্থগিত করেছিল। হাইকোর্ট একটি আপোসের ভিত্তিতে পক্সো আফ আই আর বাতিল করেছিল। শীর্ষ আদালত পুলিশকে মামলার তদন্ত চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়। তাছাড়া, যার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আরও ছজন করেছে— তার প্রতি আদালতের সন্দিগ্ধ হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু ব্রিজভূষণের ক্ষেত্রে কি তা হবে?

 

 

তবে হ্যাঁ, অভিযোগকারী যদি তখন ঘটনা অস্বীকার করে, তাহলে অভিযুক্ত সুবিধা পাবেন। সেই সুবিধাই হয়ত ব্রিজভূষণ পেতে চলেছেন। পুলিস নিজেই সাড়ে তিনশ পাতা খরচ করেছে কেন পক্সো দেওয়া হবে না, তা বিচারককে বোঝানোর জন্য। তাদের শ্রমকে কুর্নিশ! কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, এই যে নাবালিকার বাবা এসে জানালেন যে তিনি তাঁর আর তাঁর মেয়ের নাম আর জড়াতে চান না এই মামলায়, এই সময়ে প্রভাবশালী ব্রিজভূষণ নিজে জেলের বাইরেই ছিলেন। তাঁর পক্ষে হুমকি দিয়ে এই বিবৃতি বের করা কঠিন কিছু নয়। উপরন্তু আমরা দেখছি যে, নাবালিকার বাবার ওই নতুন বিবৃতি বেশ ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি বলেছেন, তিনি মেয়ের প্রতি খারাপ ব্যবহারের বদলা নিতে দুটি ঘটনা বানিয়ে বলেছেন, কিন্তু একটি ঘটনা সত্যি। কিন্তু যৌন নির্যাতনের একটি ঘটনাও কি ক্ষমাযোগ্য? কী সেই ঘটনা? এর উত্তরে তিনি বলেছেন, একসঙ্গে গ্রুপ ফোটো তোলার সময় ব্রিজভূষণ মেয়ের কাঁধে এমন ভাবে হাত রেখেছিলেন যাতে তার অস্বস্তি হয়েছিল। তাহলে কি ওই সংশোধিত বিবৃতি দেওয়ার সময়ও তিনি এটাই বলছেন না যে ব্রিজভূষণ অস্বস্তিকর ভাবে মেয়েদের স্পর্শ করেন? উপরন্তু, তিনি যে হুমকি পাচ্ছেন, সেটাও তিনি জানিয়েছেন। বলেছেন, হুমকি দিচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে বিচ্ছিন্ন তাঁর নিজের বাবা ও দাদা, যারা নাকি টাকাও ঘুষ দিতে চেয়েছিল মামলা তোলার জন্য। কিন্তু ভদ্রলোকের ওই দীর্ঘদিনের বিচ্ছিন্ন আত্মীয়জনদের টাকা সহ পাঠালো কে? এর উত্তর তিনি দিচ্ছেন না। কিন্তু বলছেন, বাড়ির সবাই ভেঙে পড়েছে। মেয়ে মনোবিদের কাছে চিকিৎসা করাচ্ছে। তাঁর আর মনোবল নেই লড়াই করার। একবারও বলেননি যে কুস্তিগিরদের অভিযোগ মিথ্যা। বরং বলেছেন, 'ওদের লড়াই সফল হোক।' এ যে ক্ষমতার আস্ফালনের সামনে হেরে যাওয়া সাধারণ মানুষের দীর্ঘশ্বাস, তা চিনতে ভুল হওয়ার কথা নয়। আদালতের প্রথমেই সন্দেহ হওয়া উচিত, প্রভাবশালী অভিযুক্তই কলকাঠি নেড়ে এই বিবৃতি দিতে বাধ্য করেনি ত? এবং ঠিক এই কারণেই, ভবিষ্যতে অন্য মামলাগুলোও প্রভাবিত হতে পারে আশঙ্কা করে, আদালতের উচিত ব্রিজভূষণকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া। কিন্তু আদালতেও বিজেপির প্রভাব খাটানোর বিবিধ নমুনা যেহেতু আমরা  সম্প্রতি যথেষ্ট পরিমাণে দেখেছি, তাই সন্দেহ জাগে, যা উচিত, তা আদৌ সেখানেও ঘটবে কিনা৷

 

ধোঁয়াশা আরও অনেক কিছু ঘিরেই আছে। যেমন, রটনা অনুযায়ী সংগীতা ফোগটকে কি ব্রিজভূষণের বাড়ি নিয়ে গিয়েছিল অপরাধস্থল শনাক্ত করতে? এমনতরো হয়ে থাকলে তা স্থূল রিভিক্টিমাইজেশন। নরেশ টিকায়েত হঠাৎ যে হাজির হলেন গঙ্গাবক্ষে মেডেল বিসর্জনের দিন, তা কার নির্দেশে? কারণ সেদিন সত্যি মহম্মদ আলির মেডেল বিসর্জনের পুনরাভিনয় হলে, দেশের মানুষের ক্রোধ সীমাহারা হত। কিন্তু এ লেখা যেহেতু মূলত চার্জশিট সংক্রান্ত, তাই আপাতত সেসব মুলতুবি থাক৷ 

 

অমিত শাহের 'ক্রোনোলজি' সংক্রান্ত বক্তৃতা ভাইরাল হয়েছিল অসম এনআরসির সময়। সময়পঞ্জি বা ক্রোনোলজির কথা যদি তোলা হয় এই যৌন নির্যাতনের প্রেক্ষিতে, তবে এই যৌন নির্যাতনের কেসের ক্রোনোলজি বা সময়পঞ্জি আপাদমস্তক ঘাঁটা। সচরাচর অভিযোগ, গ্রেপ্তার, চার্জশিট, আদালতে শুনানি— এই ক্রমে ঘটনারা ঘটে। এখানে সে ক্রোনোলজি ঘেঁটে ঘ অভিযুক্তর স্বার্থে। তদন্ত হয়েছে। কিন্তু সমান্তরালে হয়েছে অভিযুক্ত কর্তৃক প্রকাশ্য সভায় অভিযোগকারিণীদের স্লাট-শেমিং! অপরাধস্থল নাকি শনাক্তকরণ হচ্ছে অভিযোগকারিণীকে নিয়ে গিয়ে, অথচ অপরাধী তখন স্বয়ং সেখানে বর্তমান! বস্তুত তদন্ত অভিযোগের সত্যতা খুঁজতে হচ্ছিল, নাকি অভিযোগকে মিথ্যা প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে হচ্ছিল, তা বুঝতে খানিক বেগ পেতে হচ্ছে বৈকি। আপ ক্রোনোলজি সমঝিয়ে, অউর ক্রোনোলজি কা ইরাদা ভি!

 

0 Comments

Post Comment