পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

লতার যাপন

  • 07 January, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 534 view(s)
  • লিখেছেন : শীর্ষেন্দু দত্ত
লতার ঘরে আমার যাতায়াত পুরনো। বাগদী পাড়ার এই মেঠো রাস্তায় অমাবস্যার রাতেও আমার পা হড়কায়না। মেঠো রাস্তাটার মতো লতার গোটা শরীরটাও আমার মুখস্থ। খাজ-ভাজ-গুলি- ডাংগুলি সব চেনা। কোথায় কখন জিভ লাগাতে হয়,কখন আঙ্গুলের ডগা চালাতে হয় এবং তাতে কি এবং কেন হয় সব আমার মুখস্থ।

লতার ষোলো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল কালিচরণ বাগদীর সাথে। লতা ছিল কূপার্স ক্যাম্পের বাসিন্দা। পূর্ব বাঙ্গলা থেকে এপারে চলে এসেছিল। ওদের চার বোনের মধ্যে লতাকে শেষ অবধি ওর বিধবা মা বর্ডার ক্রস  করাতে পেরেছিল। সে সব অন্য গল্প। পুরনো গল্প,একঘেয়ে গল্প। শুনে কাজ নাই। বরং লতার কথা বলি শুনুন।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে লতার গতরে মাংস ভরাট হতে থাকে। লতার গল্প তাই আমোদী  মাছের মতোই উৎকৃষ্ট। কালীচরণ বাগদী নিরীহ,ধর্মপ্রাণ মানুষ। কিন্তু সে লতায় গেল মজে। সাথে লতার মায়ের চোখের জলে কালীচরণ পিছলে গেল!  লতাকে নিয়ে ঘর বাঁধল কালীচরণ…

লতার গল্প চলবে। রাত বাড়ছে। আমি লতার ঘরের কড়া নাড়লাম। ঘুম চোখে দরজা খুলল ও।

-ও তুমি! আজকে আবার এলে?

এরকম প্রশ্ন লতা আগে করতো না, আজকাল করছে। ওর এখন শরীরে মন নেই। ভালো করে তেল সাবান পর্যন্ত ঘসে না। একদিন পান্তা করে তো দুদিন  টেনে দেয়। কিন্তু লতার শরীর তো এখনো কেউটের চামড়া! রোদ পরলে চকচক করে ওঠে। ওর বিরক্তি ভরা ভ্রুকুটিও পুরুষের কামে আগুন লাগিয়ে দেয়।

আমি ওকে একরকম ঠেলেই ঘরে ঢুকলাম। ব্যাগ থেকে বোতলটা বের করে বলি,

-গেলাশ আর জলটা দে।

লতা আদুল গায়ে ছিল। আমি আসায় বরাবরের মতো হাতকাটা ব্লাউজটা পরে নেয়। ও একটা গেলাশ আর ঘটি করে জল আমার সামনে নামিয়ে রেখে বলে,

-আমি খাব না।

-কেন রে? তোর কি হল? ঠান্ডা হাওয়া দিতেছে, পেটে পরলে গরম হবি। একটা ডিম ভেজে দিস।

লতা বিরক্তি ভরা মুখে উঠতে উঠতে বলে,

-দোকান থেকে নিয়ে আসতে পারোনি?

আমি লতার হাত ধরে আমার দিকে হ্যাচকা টান মারলাম।  ব্যালেন্স না রাখতে পেরে ও আমার কোলে এসে পরল। বললাম,

-দোকানে তো সবই পাব। তোর হাতের গন্ধ তো পাব না।

লতা ঝটকা মেরে ওঠার চেষ্টা করতে আমি চেপে ধরে ওর ঘাড়ে চুমু খেয়ে বলি,

-ঠিক আছে, ডিম ভাজা দরকার নেই, এটা দিয়েই হবে …

 

ধর্মপ্রাণ কালীচরণ বাগদী, লতাকে ভালবাসে খুব। কিন্তু ওর উদ্ধত যৌবন দেখলেই নিজেকে কেমন পাপী পাপী মনে হত ওর! লতা যখন নিজের বুক কালীচরণের মুখে চেপে ধরত, কালীচরণ তখন হরি হরি রবে ছিটকে যেত।

কিন্তু এভাবে কি চলে! গাছ লাগালে জল তো দিতেই হবে। কালীচরণ লতার জন্য স্নো,শ্যাম্পু,গন্ধ সাবান, আলতা, কাচের চুরি, লইট্যা মাছ, তেলাপিয়া মাছ সব কিনে আনত। তবু লতা গেল বিগড়ে। একদিন দুপুরে রাইস মিলের ছোকড়া মালিক দুই স্যাঙ্গাতকে নিয়ে কালীচরণের অনুপস্থিতির সুযোগের স্বদব্যবহার করল। দুচারবার চিল্লামিল্লি ছাড়া ওদের বিশেষ বাধার সন্মূখীন হতে হল না। ফলত, পরবর্তী সময়ে উঠতি বড়লোক ছোকড়া একাই আনাগোনা শুরু করল। লতার কানে রূপোর দুল, পায়ে রূপোর ঘুঙ্গুর উঠল। ঘুঙ্গুরের শব্দে লতার ঘর জমজমাট। ছোকড়ার বাবা বেগতিক দেখে ক্যানিং সাইড থেকে একটা ডাঁশা বউমা এনে ছোকড়ার সাথে জুতে দিল।

ঘাস মাঠে পথ চলতে চলতে পথ আপনিই তৈরি হয়ে যায়। পরবর্তীতে আর পথ চিনতে অসুবিধা হয়না। লতার দুপুরে তাই ঘুম হয়না। কালীচরণ সব বুঝে সজল চোখে আকাশের দিকে চেয়ে বলে, হে প্রভু…

 

লতা আবার ব্লাউজটা পরতে পরতে বলে,

-আমার তিনি চিঠি দিয়েছেন, ঘরে ফিরছেন।

আমি প্যান্ট পরতে পরতে বলি,

-কালীচরণ!

-হুমম।

বেশ উৎসাহভরে আমি নড়েচড়ে উঠি।

-তাই নাকি? তা, কোথায় ছিল এদ্দিন? গেলই বা কেন? আবার ফিরছেই বা কেন?

লতা শাড়িটা গায়ে জড়াতে জড়াতে বলল,

-বেন্দাবনের কোন এক আখড়ায় ছিল। তারপর নাকি আখড়াও ছেড়ে দিয়ে কোনো এক ভাল মানুষের সন্ধান পেয়ে তার সাবান ফ্যাক্টরিতে কাজ করছে। এখন আসছে আমাকে নিয়ে যেতে।

-বাবা এতো কিছু! তা, তোকে নিয়ে ও করবেটা কি? পূজো?

বলে আমি খিকখিক করে হাসি। লতা গোমড়া মুখে বলে,

-বললেই তো আর আমি ওর পোঁ ধরে চলে যাব না। অচেনা জায়গা,কাউকে চিনিনা। এখানেও তো ও ছিল! তাও তো আমায় নাঙ্গর ধরতে হয়েছে!

আমি বলি,

-ও কিন্তু তোকে ভালোবাসত খুব।

মুখ ভ্যাটকায় লতা,

-শুধু ভালবাসলেই হয়না, আগলে রাখতে হয়।

-সে তুই যদি কাপড় তুলে হাওয়া লাগাস তো ও কি করবে?

-কাপড় কি আমি সাধ করে তুলেছিলুম! আর তুললেই বা! ও তো আমায় শাসন করে হাত টেনে ফিরিয়ে আনতে পারত। তা না, সন্নেসী হয়ে গেল!

 

শেষমেষ কালীচরণ গৃহত্যাগী হল। একদিন ভোরে একটা চিরকুট লিখে লতা ঘুম থেকে ওঠার আগে চলে গেল। চিরকুটে লেখা ছিল,  লতা, আমি সংসার ছেড়ে সন্নেসী হতে চললুম। এই সংসারে আমার কিছু নেই"

পরে কালীচরণের থেকে শোনা গেছিল, কালীচরণ বৃন্দাবনে এক বাবার আখড়ায় যোগ দিয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন পরই ওর মোহ কেটে গেল। আখড়ার জনা দশেক বাবাজি পালা করে ওর পোঁদ মারতো। কালীচরণ সিধেসাধা ভালমানূষ,ধার্মিক মানুষ। অতি ভালমানুষীর জন্য সে লতার সঙ্গে কাম করতে ভয় পেত যেমন সত্যি, তেমনই সে সমকামী কখনোই ছিল না। কিছুদিন পর সে বাবাজীদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আখড়া ত্যাগ করল। পথে পথে ঘোরাঘুরি করে যখন সে বেদম হয়ে পড়ে ঠিক তখনই এক দয়ালূ সর্দারজীর নজরে পড়ল সে। সর্দারজীর ছিল সাবান ফ্যাক্টরি। কাপড় কাচার সাবান তৈরি হত সেখানে। সর্দারজী এখানে একা থেকে কারবার চালায়, পরিবার পরিজন সব পাঞ্জাবের এক সুদূর গ্রামে থাকে। বছরে দু’বছরে  যায়। সেখান থেকে কেউ এখানে কখনো আসেনা। কালীচরণকে দেখে তার দয়া হয়,ভালোও লেগে যায়। সমবয়েসী প্রায় দুজনে। কালীচরণকে ফ্যাকটরিতে নিয়ে যায়।খেতে পরতে দেয়। তাকে ফ্যাক্টরি দেখাশোনার কাজ দেয়।

কালীচরণের আর কোনো গুন না থাকলেও সে ছিল সৎ। তার সততায় কিছুদিনেই সর্দারজী প্রসন্ন হয়ে উঠল। তাকে নিজের বাসাতেই একটা বড় ঘর রান্নাঘর কলতলা দিল। ভাল বেতনও চালু করে দিল। সকলের কাছে সে ম্যানেজার বাবু হয়ে উঠল।

সর্দারজী বলল,

-তোমার বউকে এখানে নিয়ে এসে নতুন করে করে সংসার শুরু করো। ও এসে আমাদের ঘরদোর সামলাবে, রান্নাবান্না করে দিবে।

কালীচরন সব কথা সর্দারজীকে বলেছিল। সর্দারজী সন্ধ্যেবেলায় মদ খেতে খেতে কালীচরণের দুখের কাহিনী শুনেছিল। তারপর ক্ষণিক চুপ থেকে বলেছিল,

-দোষ  তো তোমারই কালী। অত ধম্মো ধম্মো না করে সংসার ধম্মের কথা ভাবো। মেশিনে তেল না দিলে মেশিন বসে যায়।বোউকে খুশ রাখাটাও তোমার ধম্মো। শুধু শাড়ি, বেলাউজ আর মিঠে কথায় বোউ থাকেনা।

কালীচরন সজল চোখে সর্দারজীর মদ খাওয়া দেখে। সর্দারজী গ্লাশ বাড়িয়ে দেয়,

-এক ঢোক মারো কালী, সব ঠিক হয়ে যাবে।

কালীচরণ হাত জোড় করে “হরি হরি”  বলে…

 

লতা আনমনে বগল চুলকাতে চুলকাতে কিসব ভেবে চলে। আমি যাব বলে উঠে দাড়িয়েছি খেয়াল করেনা। কালীচরণ ফিরে এলে কি করবে সেটাই ও ঠিক করে উঠতে পারছে না। আমি জোড়ে গলা খাকারি  দিতে ওর সম্বিত ফেরে। ওর ব্লাউজের মধ্যে টাকা গুজে দিয়ে ওর গাল টিপে বলি,

-অতো ভাবিস না লতা, শরীর খারাপ করবে। কালীচরণ ফিরুক, কটা দিন ওর যত্ন আর্তি কর। তারপর থাকতে চাইলে থাকবে,আর ফিরে যেতে চাইলে যাক। তুই যাস না। ওসব অচেনা জায়গা। কোথায় কি আছে কালীচরণ অত বোঝেনা। এখানে কিছু দরকার হলে আমায় বলিস।

আমার কথা শোনেনি লতা। ও কালীচরণের সাথে বৃন্দাবনে চলে যায়। যাবার আগে একবার আমার সাথে দেখা করতে আসে।

-কি করি বলোতো? ও একেবারে ঝুলোঝুলি করছে। বলছে ওখানে ওর খুব ইজ্জত। সবাই ম্যানেজার সায়েব বলে। ফ্যাক্টরির লেবাররা ওর বাসনপত্র মেজে দেয়,কাপড় কেচে দেয়,বাজার করে দেয়। সর্দারজীর একটা এনফিল্ড বাইক আছে,সেটা ওকে দিয়ে রেখেছে। ঘরে খাট,আলমারি পর্যন্ত কিনে দিয়েছে। টাকা পয়সাও ভাল দেয়। এতদিন তো কষ্ট করলাম। এখন বয়স বাড়ছে। নিজের লোক ছাড়া আমায় কে দেখবে বলো? এখানে কষ্ট,অসম্মান দুটোই কোনোদিন পিছু ছাড়বে না।

এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে যায় লতা। আমারো কিছু বলার থাকে। সেগুলো না বলে অন্য কথা বলি,

-এত করে যখন বলছে তখন যা একবার। ভাল না লাগলে চলে আসবি। কিন্তু তোর সব হলেও তোর গতরের যত্ন আর্তি কি কালীচরণ ঐ লেবারদের দিয়ে করাবে?

বলে আমি খ্যাকখ্যাক করে হাসতে লাগি। লতা মুখ ঝামটা দিয়ে বলে,

-চুপ করো মিনসে। প্রথম কথাটাই ঠিক বলেছো। না পোষালে ফিরে আসবো।

লতা সাবান ফ্যাক্টরির ঠিকানাটা কাগজে লিখে আমায় দিয়ে গেল। ওদিকে যদি কখনো যাইতখন একবার যেন খোজ খবর করি,বেঁচে আছে কিনা।

 

লতার কথা আস্তে আস্তে ভুলেই গেছিলাম। নিজের কাজে হঠাৎ বৃন্দাবন যাবার প্রয়োজন পড়ল। আমি না গেলেও চলত, অন্য কাউকে পাঠিয়ে দিলে হতো। ঠিক করলাম যাব।যাবার সময় লতার দেওয়া সেই ঠিকানা লেখা কাগজটা নিতে ভুললাম না।

নিজের কাজকম্মো মিটিয়ে ফেরার আগের দিন সকাল সকাল পৌছে গেলাম সেই সাবান ফ্যাক্টরিতে।

কালীচরণ আমাকে দেখে তো খুব খুশি। যতই হোক দেশের লোক। ওর আলাদা ওফিস ঘর। টেবিল,চেয়ার,মাথার উপর পাখা,একটা টেলিফোনও আছে সেখানে। কালীচরণ জানালো দোতলায় মালিকের চেম্বার। সেখানে বিশেষ কেউ যায় না। যাবতীয় মোলাকাত,কাজকর্ম কালীচরণের ঘর থেকেই চলে। কালীচরণ একজন লেবারকে দিয়ে আমাকে ওর বাসায় পাঠালো। বলল, আমি যেন খাওয়া দাওয়া করে যাই, লতা খুশি হবে।

সেই লেবারটি আমাকে লতার কাছে নিয়ে চলল। কারখানার পাশেই আরেকটা বড় বাড়িতে ওরা থাকে। দড়জায় কড়া নাড়তে লতা এসে খুলল। লতা আরো মোটা হয়েছে,গায়ের রঙ ফেটে পড়ছে! নাকে,কানে, গলায় সোনার গয়না! আমাকে ঘরে এনে বসালো ও। চা বানালো। বললাম,

-কেমন আছিস লতা?

ও আমার দিকে না চেয়ে জানলার দিকে চেয়ে বলল, ভালোই।

লতাকে পেরে ফেলতে বেশি সময় লাগল না। ওর বুকদুটো চাদের মতো ঝকঝক করছে। আমি সেগুলো কচলাতে কচলাতে বললাম,

-আমার সাথে ফিরে চল লতা। তোকে আলাদা ঘরে রাখব।

ও কোনো কথা বলল না। আমাকে সবটা করতে দিল। তারপর উঠে গিয়ে বলল,

-দুটো লুচি ভেজে দিই খেয়ে যেও…

লুচি আর পায়েস খেতে খেতে আমি লতাকে দেখছিলাম। লতা বলছিল,

-আমি আর ফিরবো না। এখানে আমি সব পেয়েছি। ফিরবো কেনো!

আমি বললাম,

-কালীচরণ তো তোকে এখনো পূজোই করে? না কি?

লতা আমার চোখে চোখ রেখে বলে,

-এই লুচি আর পায়েস এইসময়ে রোজ সর্দারজী খেতে আসে। আমার দেখভাল সর্দারজী তোমার থেকে ভাল করে ঠাকুর।

আমি সব বুঝতে পারি। লতার সব মনোবাঞ্ছাই এখানে পূরণ হচ্ছে।

আমাকে দোর অবধি এগিয়ে দেয় লতা।

-মাঝে মধ্যে এলে ঘুরে যেও ঠাকুর।

তারপর দুজনেই খানিক চুপ করে থাকি। আমার কিছু যেন বলার আছে,বলতে পারি না। লতারও কিছু কৈফিয়ত আছে, দিতে পারে না! শুধু বলে,

আর যাই হোক, এখানে আমাকে কেউ বেবুশ্যে বলে না ঠাকুর। বাকি সব একই আছেগো।।

 

 

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment