পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

গান্ধীর সাথে ১০০০ কিলোমিটার

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 205 view(s)
  • লিখেছেন : মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়
গান্ধীর সাথে পথ চলা, এমনই একটি ঘটনা ঘটে গেল প্রায় ৫৬ দিন ধরে। এদেশের ১০০০ কিলোমিটার পথ ধরে বেশ কিছু মানুষ হাঁটলেন বেনারসের রাজঘাট থেকে দিল্লির রাজঘাট পর্যন্ত। দেশের বাইশটি প্রদেশের পদযাত্রী এতে যুক্ত হয়েছিলেন। 'এক কদম গান্ধী কে সাথ' এই ছিল মূল কথা এবং তার সাথে যুক্ত হয়েছিল 'প্যায়ার কি কারওয়া'র কথা। ‌

'একলা চলো রে'  এই কথাটি গান্ধীর সাথে কীভাবে যেন যুক্ত হয়ে গেছে।  রবীন্দ্রনাথ এই বিখ্যাত গানটি গান্ধীর জন্যই লিখেছেন কিনা জানা নেই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই গানটি গান্ধী জীবনের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছিল বিশেষ করে শেষ নোয়াখালী পর্বে যেখানে গান্ধী নামক 'নাছোড় ভগবান' ভাঙাচোরা সেতু দিয়ে হেঁটে চলেছিলেন সাম্প্রদায়িক আগুনের মধ্যে দিয়ে।‌ গান্ধী মানেই চলা এটা কিন্তু সবাই মানেন।  এক দার্শনিকের মতে গান্ধীর কাছে পথ চলাই ছিল এক ধরনের মুক্তি ‌ও  সত্যানুসন্ধান।  ৬০ বছর বয়সে ২৩১ মাইল হেঁটে ডান্ডিতে গিয়ে লবণ আইন ভঙ্গ করেন তবে সেটা একা নয়,  সঙ্গে ছিলেন বহু মানুষ। 

এই গান্ধীর সাথে পথ চলা, এমনই একটি ঘটনা ঘটে গেল প্রায় ৫৬ দিন ধরে। এদেশের ১০০০ কিলোমিটার পথ ধরে বেশ কিছু মানুষ  হাঁটলেন বেনারসের রাজঘাট থেকে দিল্লির রাজঘাট পর্যন্ত।  দেশের বাইশটি প্রদেশের পদযাত্রী এতে যুক্ত হয়েছিলেন। 'এক কদম গান্ধী কে সাথ' এই ছিল মূল কথা এবং তার সাথে যুক্ত হয়েছিল 'প্যায়ার কি কারওয়া'র কথা। ‌ পদযাত্রার স্পষ্ট উদ্দেশ্য ছিল ‌ আজ দেশের আইন ব্যবস্থা, সংবিধান, গণতন্ত্র এবং সম্প্রীতির উপর যে সংকট উৎপন্ন হয়েছে তা নিয়ে এবং  ঘরে ঘরে ঢুকে যে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে তা নিয়ে কথা বলা।‌ 

এর সাথে বারাণসীর রাজঘাটে সর্বসেবা সংঘের যে পরিসর ছয় দশক ধরে গান্ধী বিচারধারার  যে  বিভিন্ন গতিবিধি চলছিল সেই ঐতিহ্যবাহী পরিসরটি উত্তরপ্রদেশ সরকার ২২শে জুলাই ২০২৩ অবৈধভাবে দখল করে এবং ‌ ১২ ই আগস্ট ২০২৩ বুলডোজার দিয়ে ঘরবাড়ি সব ভেঙে দেয়।  এই জমি কিন্তু সর্ব সেবা সংঘের জমি যার সমস্ত কাগজপত্র আছে। বিষয়টি নিয়ে মামলাও চলছে  কিন্তু উত্তরপ্রদেশে কাগজের চেয়ে বুলডোজারের জোর অনেক বেশি এমন কি আইন আদালতের চেয়েও। এর কাছাকাছি গঙ্গার ঘাটতির বর্তমান নামকরণ হয়েছে নমোঘাট এবং সম্ভবত তার বিকাশের জন্যেই এই পরিসর টুকু প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।‌

ভেঙে যাওয়া পরিসরে দাঁড়িয়ে আছেন একা গান্ধী পাশে তিন বাঁদর।‌ যা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল সেটি ছিল এক প্রাচীন প্রকাশনা যেখানে থেকে গান্ধী ভাবনার কত বই প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু বিদ্বেষের রাজনীতি কোটি কোটি টাকার বই আস্তাকুঁড়ে ছড়িয়ে দিল, আশেপাশের গ্রামের মানুষ সে সব কুড়িয়ে নিয়ে গেছেন পরম শ্রদ্ধায়।‌

এর প্রতিবাদে ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ বিনোবা জয়ন্তী থেকে শুরু করে ১১ অক্টোবর ২০২৩ পর্যন্ত বারাণসীর গ্রাম শহরে পদযাত্রা হয়। তারপর ঐ পরিসরের গেটের সামনে ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ থেকে ১৯ নভেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত ১০০ দিনের ন্যায়ের দীপ জ্বালানোর সত্যাগ্রহ হয়। সে সময় ২৪ রাজ্যের ২০০ জেলার ৪০০ গান্ধীজন ও সমাজকর্মী এসে অবস্থান ও প্রতীকী অনশন করেন। 


তারপর এই 'এক কদম গান্ধীর সাথে চলা'। গান্ধীর সাথে চলা যায় কীভাবে তিনি তো সশরীরে উপস্থিত নেই কিন্তু গান্ধী তো শুধু এক ব্যক্তি নন তিনি একটি ভাবনা মানবিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ভাবনা শোষণমুক্ত জাত পাত সম্প্রদায়ের ভেদমুক্ত সমতাভিত্তিক অহিংস সহযোগী স্বাবলম্বী সমাজ তৈরির বিষয় গোটা পৃথিবীতে মানুষ আজ তার কথা ভাবছেন। 

এই চলা শুরু হল বেনারসের রাজঘাট থেকে। আর ৫৬ দিন ধরে চলে পৌঁছাবে দিল্লী রাজঘাটে। ১০০০ কিলোমিটার পথ।  বাধা অনেক। থাকা খাওয়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা।‌ কোনো বিশাল স্পন্সর নেই। মানুষের দানেই চললো যাত্রা। যেখানে যে আছেন সমাজকর্মী বন্ধুদের জন্য থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত করলেন। সুবিধা এটাই যে গান্ধী ভাবনা নিয়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কিছু প্রতিষ্ঠান এখনো রয়ে গেছে যেখানে অন্ততঃ মাথা গোঁজার ঠাঁই মেলে।‌কোথাও কোথাও সমস্যা হল। ব্যবস্থা বদলাতে হল। তবু মানুষ চললেন।‌

শুরুর দিন অর্থাৎ গান্ধী জয়ন্তীর দিন এবার ছিল বিজয়া দশমী।‌ এক বিশেষ কার্টুনের কথা সেদিন মনে হল। বহুকাল আগে প্রকাশিত সেই কার্টুনে দশেরায় রাবণ বধের ছবি। রাবণের দশ মাথায় গান্ধীর পাশাপাশি সুভাষচন্দ্র নেহরু সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল মাওলানা আজাদের পাশাপাশি আম্বেদকর সবাই উপস্থিত। আর এ হেন রাবণকে দহন করতে চলেছেন ধনুর্ধারী শ্যামাপ্রসাদ ও সাভারকর। তাদের নিশানায় যাঁরা আছেন তাঁদের নিজেদের মধ্যে মত ও পথ নিয়ে যে বিতর্কই থাক, একশ বছর আগে জন্ম নেওয়া সংঘের কাছে এরা সবাই প্রতিপক্ষ। 

তারিখটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলো কারণ এই দশেরাতেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের জন্ম আর ঘটনাক্রমে এবার সেটি তাদের মূল প্রতিপক্ষের জন্মদিন। গান্ধী কোনো এক সময় ১২৫ বছর বাঁচতে চেয়েছিলেন এই দেশের জন্য, তার সে আকাঙ্ক্ষাকে বহু আগে থামিয়ে দেয় সংঘ ভাবাদর্শের অন্যতম আততায়ী। তবে ধনুক নয়, বন্দুক দিয়ে। 

২ অক্টোবর পদযাত্রার  শুরুতেই প্রশাসন অধিক তৎপর হয়ে ওঠায় শেষপর্যন্ত পুলিশ পাহারায় গান্ধীজী কে প্রণাম করা গেল ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে। বেনারসের রাজঘাটে গান্ধী ভাবনার  যে পরিসরটি বুলডোজারে বিধ্বস্ত, সেখানে দাঁড়িয়ে আছে গান্ধীমূর্তি। এও এক অভিজ্ঞতা। স্বাধীন দেশে গান্ধীর কাছে পৌঁছতে এত পুলিশ। 

তারপর বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা পদযাত্রীদের পরিচয় পর্ব। তখন  ১৬ টি রাজ্যের মানুষ ছিলেন। বিচিত্র তাঁদের কর্মকাণ্ড। কেউ কেউ সম্পূর্ণ পদযাত্রায় থাকবেন, আমাদের মত কেউ কেউ কিছুদূর যাবেন।আমার সঙ্গে এসেছে দুই  তরুণ তরুণী, আহমদ রেজা আর রুনি খাতুন। মহারাষ্ট্র থেকে প্রয়াত নরেন্দ্র দাভোলকারের কর্মকান্ডের সাথীরা এসেছেন, এসেছেন চম্পারণ থেকে পঙ্কজজী, ২০১৭ সালে গান্ধীর চম্পারণ আন্দোলনের শতবর্ষে যার বন্যাপীড়িতদের নিয়ে অসাধারণ কাজ দেখেছি বেতিয়ায়। রয়েছেন রেল নিয়ে নিরন্তর আন্দোলন করে যাওয়া ঈশ্বর ত্রিপাঠী, রেলে সাধারণ মানুষের বিশেষত মহিলাদের সাধারণ কামরা কমিয়ে দেওয়া বা তুলে দেওয়া নিয়ে যিনি আন্দোলন করে চলেছেন। ওনার উপস্থিতি বরাবরই ব্যতিক্রমী। বেনারসের বিভিন্ন মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা গানে স্লোগানে ভরিয়ে দিচ্ছেন।‌ এদের অনেকেই লিঙ্গ সমতা এবং ক্যুইয়ার সমাজের সমস্যা নিয়ে কাজ করেন। পদযাত্রার অন্যতম উদ্যোক্তা চন্দন পাল পায়ে দারুন ব্যথা নিয়ে ট্রাক্টরে চড়ে চলছেন। ভাষার বাধা পেরিয়ে তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, কর্ণাটক কেরালার মানুষেরা সবার সাথে মিশেছেন। সকালে খানিক বাধা পেয়ে  বিকেল থেকে পদযাত্রা শুরু হল। সেদিন থাকা হল চাঁদপুর সরস্বতী ইন্টারমিডিয়েট কলেজে।

0 Comments

Post Comment