অকপটে প্রথমেই স্বীকার করে নিই, পুরো গানটি আমি শুনি নি। আমার অভিমত নির্মাণের জন্যে যতটা প্রয়োজন ছিল, ততটাই শুনেছি। তাছাড়া পুরোটা শুনে এর দর্শকবৃত্ত বাড়াবার কোনো অভিপ্রায় আমার ছিল না। আরেকটা কথা, মূল সষ্টার সৃষ্টিতে হস্তক্ষেপ আজ নতুন নয়, বহুদিন ধরেই চলছে। রবীন্দ্রনাথ থেকে লোকগান, সর্বত্রসর্বত্র। কেউই রেহাই পায় নি। তবে হস্তক্ষেপ কথাটা যদি ইংরেজি এঙ্গেজমেন্টের অর্থে বলি তবে সব হস্তক্ষেপকে অবশ্যই নিন্দনীয় বলব না। সময়ের সাথে সাথে ভাষা বদল হয়, সংস্কৃতির বদল হয়, ধর্মের বদল হয়, রাজনীতিরও বদল হয়। কিছু কিছু বদল আবার তথাকথিত আদিতে ফিরে যাওয়ার নামে হয়। এগুলোর উদ্দেশ্য অসততায় ঠাসা থাকে।
যাইহোক, সবচেয়ে বেশি ঠুনকো, আবার সবচেয়ে বেশি স্পর্শকাতর বিষয়, গান। এখানে হস্তক্ষেপ ঘটে সবচেয়ে বেশি। কিছু হস্তক্ষেপ মানুষ দু'হাত তুলে মেনে নেয়। কিছু হস্তক্ষেপে সমাজে ক্রোধের আগুন বয়ে যায়। এ আর রহমানই বন্দে মাতরম গানে 'মা তুঝে সালাম, আম্মা তুঝে সালাম' জুড়ে একটি সংস্করণ করেছিলেন যা উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম হিন্দু মুসলিম শিখ বৌদ্ধ নির্বিশেষে জনগনের বিপুল ভালোবাসা অর্জন করেছিল। হয়ত তখন দেশ ক্যালেন্ডারের আজকের পৌঁছয় নি, সেটা কারণ। আবার অজয় চক্রবর্তী বেশ কয়েক বছর আগে রবীন্দ্রনাথের গানে আলাপ বিস্তার যোগ করে বেশ কালোয়াতী করে রেকর্ড করেছিলেন। এত জনপ্রিয় শিল্পী তিনি, তবু কোনো মিছিল মিটিং আইনী হস্তক্ষেপ ছাড়াই সেই গান শেষ পর্যন্ত জনসমাজে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখাত হয়েছে। এই প্রত্যাখানে অজয়বাবু এতটাই গুটিশুটি মেরে যান যে তার কিছুদিন পর শিলচরে অনুষ্ঠান করতে এলে উদ্যোক্তাদের শর্ত দিয়েছিলেন কোনো সাংবাদিক বা দর্শক তাঁকে তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ডিং নিয়ে প্রশ্ন বা আলোচনা করতে পারবে না। বন্দে মাতরম পরাধীন দেশে যে সুরে গাওয়া হত স্বাধীন দেশে সেভাবে গাওয়া হয় না। এখনকার সুরটি রবিশঙ্করের। সমবেত কন্ঠে গাওয়ার উপযোগী করে সুরারোপ করা। কেউই আপত্তি তোলে নি এই নিয়ে। বাংলা গানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি স্পর্শকাতরতা কাজ করে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়েই। এক সময়ে কুন্দনলাল সায়গলের গাওয়া নিয়ে আপত্তি উঠেছিল। তখন রবীন্দ্রনাথ জীবিত, তিনি নিজেই সায়গলের গাওয়াকে ছাড়পত্র দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত মহল দেবব্রত বিশ্বাসের গাওয়া, বিশেষ করে তাঁর গানের যন্ত্রানুষঙ্গ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আপত্তি করেছিলেন। এটা ঘিরে আপত্তির ধরন এতটাই শক্তিশালী ও সংগঠিত চেহারা নিয়েছিল যে দেবব্রত বিশ্বাস রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করা থেকে সরে আসতে বাধ্য হন। যে সমস্ত দিকপাল শিল্পীরা দেবব্রত বিশ্বাস বিরোধিতায় সক্রিয় ছিলেন তাঁরাই পরবর্তীতে একই ধরনের, অনেক সময়ে তার চেয়েও উচ্চকিত যন্ত্রানুষঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেছেন। আরো বহু শিল্পী গানের চেহারার নানা বিকৃতি ঘটিয়ে গান গেয়েছেন। তখন রেকর্ড প্রকাশ বিশ্বভারতী সঙ্গীত সমিতির আওতাধীন থাকলেও একটি টু শব্দও করেন নি তারা। দেবব্রত বিশ্বাস বিরোধিতার মূল কারণ গানের বিকৃতি বা যন্ত্রানুষঙ্গ ছিল না। এর উৎসে ছিল দেবব্রত বিশ্বাসের বিপুল জনপ্রিয়তা ও তাঁর রেকর্ডের বিক্রির ব্যাপকতাকে ঘিরে অন্য শিল্পীদের ঈর্ষা। প্রকৃতপক্ষে শুধু তাঁর জীবদ্দশায় নয়, আজও বাণিজ্যিক বিক্রির ধারাবাহিকতায় দেবব্রত বিশ্বাসের সমকক্ষ কেউ নেই।
মূল কথা হল, গানের ওপর হস্তক্ষেপ কেন হচ্ছে এবং কারা করছে? ভগবান রামের গানে মহাত্মা গান্ধী ঈশ্বর আল্লাহ তেরে নাম জুড়েছিলেন। কেউ সীতারাম বা সিয়ারামকে শ্রীরাম করে ভারতকা বাচ্চা বাচ্চা জয় শ্রীরাম বোলেগা করেছেন। দুইই পরম্পরাগত গানে হস্তক্ষেপ। এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। কোনটা ভালো কোনটা মন্দ, সেটা যিনি করছেন তার রাজনীতির দ্বারা নির্ধারিত হবে। এখানে আইনের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না। রাজনীতির বাইরে গানে হস্তক্ষেপ মূলত হয় বাণিজ্যিক কারণে। রবীন্দ্রসঙ্গীতে উলালা যখন হয় তখন মূল উদ্দেশ্য থাকে বাণিজ্য। বন্দিত শিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরী ও শ্রদ্ধাস্পদ সাংবাদিক সাহিত্যিক অমিতাভ চৌধুরী মিলে সিলেটের পরম্পরাগত বৌ নাচের গান, সুয়াগ চান্দ বদনী ধনি বিকৃত করে সোহাগ চাঁদ বদনী ধনি করেছিলেন। শুধু তাই নয়, 'নাচইন ভালা সুন্দরীয়ে পিন্দইন ভালা নেত, এলিয়া দুলিয়া পড়ে সুন্দি জালির বেত'কে 'নাচেন ভালো সুন্দরী আর বাঁধেন ভালো চুল হেলিয়া দুলিয়া পড়ে নাগকেশরের ফুল' করেছিলেন। এছাড়াও সেখানে 'রুনু ঝুনু নুপূর বাজে ঠুমুক ঠুমুক তালে' বলে একটা সঞ্চারীর অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছিলেন। লোকগানে সঞ্চারী হয় না সাধারণত। সিলেটে নেইই। বৃহত্তর বাঙালি শ্রোতার কাছে গানের বাণিজ্যিক আকর্ষণ বাড়াতেই এটা করা হয়েছিল। এছাড়া সেই কবে হবিগঞ্জের শেখ ভানুর মারফতি গান 'নিশীথে যাইয়ো ফুল বনে' কথার বিকৃতি ও ছন্দের বিকৃতি ঘটিয়ে প্রেমের গানে পরিণত করেছিলেন জসীমউদ্দীন ও শচীন দেববর্মণ। স্বয়ং নজরুল উত্তরবঙ্গের লোকগান 'নদীর নাম সই কচুয়া'কে রেকর্ড কোম্পানির নির্দেশে 'নদীর নাম সই অঞ্জনা' বলে লোকগানে নাগরিক হস্তক্ষেপ ঘটিয়েছিলেন। শুধু এ আর রহমানকে দোষী করলে হবে না, বাণিজ্যিক অভিপ্রায় থেকে রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল হোক বা লোকায়ত স্রষ্টার সৃষ্টিই হোক, সব হস্তক্ষেপই সমভাবে অন্যায় হস্তক্ষেপ। ব্যক্তিগত পক্ষপাতে দুষ্ট হওয়ার ভয়কে উপেক্ষা করেই বলি, সমকালীন সময়ে লোকগান গেয়ে যারা আসর মাতাচ্ছেন, অকাল প্রয়াত কালিকাকে বাদ দিলে বেশিরভাগই লোকগান নিয়ে প্রায়শ যথেচ্ছাচার করে থাকেন। এদের মধ্যে অনেককেই শহর কলকাতা লোকগানের গুরুর মর্যাদাও দিয়েছে। এই যে এখন বলা হচ্ছে এতগুলো বঙ্গসন্তান কীভাবে রহমানের এই অনাচারে যোগ দিল, এগুলো অর্থহীন অভিযোগ। যথেচ্ছাচার সমাজ মানসে মান্যতা পেয়ে গেছে বলেই ওরা এতে শুধু রহমানের সাথে কাজ করার বিরল সুযোগটাই দেখেছে। মহত্তর কিছু দেখার সাংস্কৃতিক শিক্ষা বা দীক্ষা হয়ই নি ওদের। আমরা তো রবীন্দ্রসঙ্গীতে কথা অদলবদল করার মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাবকেও নীরবেই শুনেছি। ফলে নজরুলের গান নিয়ে এই “স্মার্ট কাজ” প্রত্যাশিতই ছিল।সঙ্গত কারণেই বিষয়টা “মাত্রাছাড়া” হয়ে যাওয়ায় সমাজে বিস্ফোরণ ঘটেছে। মাত্রাছাড়া উদ্ধৃতির মধ্যেই দিলাম, কারণ মাত্রাধীন আর মাত্রাছাড়ার হিসেব কে করবে!
তবে সময়টা আরো নানা কারণে খারাপ! ন্যায় অন্যায় প্রতিবাদ বিক্ষোভের মধ্যেও সব ধর্মের অমিত মালব্যরা ঢুকে প’ড়ে নিজেদের ব্যান্ড বাজাতে শুরু করে। লোপামুদ্রার ফেসবুক পোস্টে একজন মন্তব্য করেছে, “এই আল্লারাখা রহমান যখন ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দে মাতরমকে মা তুঝে সালাম করে তখন কিছু বলেন না, এখন নজরুল ইসলামের গানে হস্তক্ষেপ হতেই হৈচৈ শুরু হয়ে গেল!” এটা একধরনের রাজনৈতিক খেলা! এই খেলার দ্বিতীয় নমুনা “এই আল্লারাখা রহমানকে কে অধিকার দিল গাজনের বাজনা বাজার সুর পাল্টানোর!” লক্ষণীয় এরা সকলেই রহমানের পুরো নামের ওপর জোর দিচ্ছেন যেখানে আল্লা শব্দটা রয়েছে।তাঁর পূর্ব নাম দিলীপ বা তাঁর ভিন্নধারার ইসলামে ধর্মান্তর এখানে অপ্রাসঙ্গিক। একই ধরনের অসহিষ্ণু অমিত মালব্যের অপর মেরুতে অমিত উল ইসলাম নামেও রয়েছে যাদের বক্তব্য, “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে পান থেকে চুন খসলেই যারা গেল গেল রব তোলেন কাজী নজরুল ইসলামের গানের বিকৃতি নিয়ে কিছু বলছেন না কেন? রবীন্দ্রনাথের গানকে অবিকৃত রাখার এত আয়োজন, নজরুল নিয়ে যত রাজ্যের যথেচ্ছাচার কেন?”
ফলে সাবধান থাকতে হবে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার মুহূর্তে। আবার অহিষ্ণুদের কুটিল ছকবাজীকে প্রশ্রয় দেবো না এই যুক্তিতে চুপ থাকলে প্রতিবাদের রাশ অসহিষ্ণু শক্তির হাতেই চলে যাবে।
রহমান যা করেছেন তা ক্ষমাহীন অন্যায় সন্দেহ নেই। তবে এটা এমন নয় যে প্রথম কোনো অন্যায় হল। ফলে দেখতে হবে এই প্রতিবাদ যেন মাত্রাছাড়া না হয়। যেন কোনো দুর্বৃত্ত কল্কে না পায়। আর এমন ধরনের সমস্ত অন্যায় সাংস্কৃতিক হস্তক্ষেপে আমরা যেন সমমাত্রায় প্রতিবাদী হই। যারা বলছেন আইনী হস্তক্ষেপ করা। কপিরাইট আইন ছাড়া আর কোনো আইনের প্রয়োগ এতে হলে সেটা হবে গণতন্ত্রের উপর আক্রমণ। আগেই বলেছি ইংরেজি এঙ্গেজমেন্ট অর্থে হস্তক্ষেপ থাকতেই হবে। না থাকলে আমরা 'হরি নাম দিয়ে জগৎ মাতালে' থেকে 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ' বা 'হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ' থেকে 'ক্লান্তি নামে গো' বা সোভিয়েত রেড আর্মি সঙ মিডোল্যান্ড থেকে 'ধরতি কহে পুকারকে' হত না। পেতাম না 'প্রাণে গান নাই মিছে তাই রবিঠাকুর মূর্তি গড়া'র মত পংক্তি কিংবা 'রাই জাগো রাই জাগো শুকসারী বলে'। পেতাম না রবীন্দ্রনাথের 'কৃষ্ণকলি' ভেঙে তৈরি সলিল চৌধুরীর 'সেই মেয়ে' বা হেমাঙ্গ বিশ্বাসের 'সুরের গুরু' গানগুলিও। এঙ্গেজমেন্ট আর বিকৃতির তফাৎ করা অত্যন্ত জরুরি। এর জন্যেও চাই একটা সঠিক রুচি ও রাজনীতি। এই দুইয়ের মধ্যে গুলিয়ে ফেলা ঠেকাতেই নিষিদ্ধকরণ সমর্থনযোগ্য সমাধান নয়। অজয় চক্রবর্তীর রবীন্দ্রসঙ্গীত যেমন জনগনের সম্মিলিত প্রত্যাখানে অন্তর্হিত হয়েছে, ঠিক তেমন সম্মিলিত প্রত্যাখানই গড়ে তুলতে হবে জনসমাজে। এটা শিল্প সংস্কৃতিতে মুনাফাবাজীর হস্তক্ষেপ। এটাকে বাঙালি অস্মিতার ওপর অবাঙালিদের আঘাতের মত সংকীর্ণ চশমা দিয়ে দেখলে আবার অন্য এক বিকৃত ছবিই ফুটে উঠবে। ফলে প্রতিবাদেরও একটা সংস্কৃতি ও রাজনীতি থাকা আবশ্যক।
দৈনিক বার্তালিপি, শিলচরে প্রকাশিত নিবন্ধের ঈষৎ সম্পাদিত সংস্করণ।