পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

নতুন শিক্ষানীতি, উচ্চশিক্ষায় ‘স্বশাসন’ ও বাজারঃ একটি আলোচনা

  • 12 August, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 1860 view(s)
  • লিখেছেন : শিঞ্জিনী বসু
নতুন শিক্ষানীতির ছত্রে ছত্রে আর্থ-সামাজিকভাবে অনগ্রসর শ্রেণির উচ্চশিক্ষায় অংশীদারিত্বের কথা আছে, কিন্তু তার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট আর্থিক দিশানির্দেশ নেই। শুধু ‘ফ্রি-শিপ’ আর ‘স্কলারশিপের’ কথা আছে। পাবলিক ইউনিভার্সিটির মূলে একটি সমতার ধারণা কাজ করে – উচ্চমানের শিক্ষায় সকলের সমান অধিকার এবং সেই অধিকার নিশ্চিত করা কল্যাণকারী রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। যার ক্ষমতা আছে তাকে শিক্ষা কিনতে বলা আর যার নেই তাকে বৃত্তির নামে আলাদা করে চিহ্নিত করা শিক্ষাক্ষেত্রে বিভেদের বীজ বপন করে।

নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির ৬৬ পাতার ক্ষীণতনু দস্তাবেজটির পিছনে এক প্রশস্ত প্রস্তুতি আছে।২০১৫ সালে শিক্ষানীতি বিষয়ে সুব্রহ্মমনিয়ম কমিটি তৈরি হয়। ২০১৬ সালে কমিটির রিপোর্ট জমা পড়লে তার ভিত্তিতে নতুন শিক্ষানীতির প্রথম খসড়া তৈরি হয়।সেই খসড়া সংক্রান্ত সমস্ত প্রস্তাব,পরামর্শ পর্যালোচনা করে সংশোধিত ড্রাফট বানাতে ২০১৭ তে ৯ সদস্যের কস্তুরিরঙ্গন কমিটি বানানো হয়। ২০১৯ সালের মে মাসে এই কমিটির ড্রাফট সরকারের কাছে জমা পড়ে। প্রথমে প্রায় ৫০০ পাতার এই ড্রাফট সরকারি ভাবেই নাগরিক পরিসরে আনা হয়। এর কিছুদিন পরে ৫৫ পাতার ‘স্লিম অ্যান্ড ট্রিম’ একটি দস্তাবেজ অন্তর্জালের পৃথিবীতে ঘুরতে থাকে।তারপরে করোনার আবহে লক ডাউনের মধ্যে ২৯ শে জুলাই প্রেস ইনফর্মেশন ব্যুরোর মাধ্যমে জানানো হয় যে নতুন শিক্ষানীতি মন্ত্রীমণ্ডলের অনুমোদন পেয়েছে। সঙ্গে জারি হয় কয়েকটি পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইড। গণতান্ত্রিকতা এবং ব্যবহারিক স্বচ্ছতাকে এমনিতেই এই সরকার একটা অপ্রয়োজনীয় বাহুল্য মনে করে; তাই ভারতের বর্তমান এবং আগামী প্রজন্মের শিক্ষার রূপরেখা সরকারিভাবে ভারতের নাগরিকদের হাতে এসে পৌঁছয় কয়েকটি বিন্দুর আকারে, সঙ্গে অন্তর্জালে ঘোরা ৬০ পাতার একটি দলিল।কিছু বুলেট পয়েন্ট এবং একটি অসমর্থিত দলিলের ভিত্তিতে টিভির চ্যানেলে চ্যানেলে ‘সংস্কারের’ ঢক্কানিনাদ চলে। তারপরে ফাঁস হয় মন্ত্রীমণ্ডল যে নথিতে অনুমোদন দিয়েছে এটি সেই নথিই নয়।কিছুটা চাপে পড়েই শেষপর্যন্ত সরকারের তরফে ৬৬ পাতার মন্ত্রীমণ্ডল অনুমোদিত দস্তাবেজটি প্রকাশ করা হয়।ঘোষিত এবং অঘোষিত দস্তাবেজের বিবিধতা, অনেকাংশে পরস্পরবিরোধিতা এবং সরকারের নিজস্ব বয়ান কেবল কয়েকটি বিন্দুতে সীমাবদ্ধ রাখার সুবিধা হোলো এতে সহজেই বিভ্রান্তি ছড়ানো যায়, অন্ধের হস্তিদর্শনের মত বিরোধীরা নিজেদের সুবিধামত একটি করে বিন্দু তুলে নিয়ে তর্ক চালিয়ে যায়; বৃহত্তর জনমত গড়ে উঠতে পারে না।নতুন শিক্ষানীতিটি আক্ষরিক অর্থে ‘ইন্টারটেক্সচুয়াল’, এর গড়ে ওঠার সামগ্রিক ইতিহাস এবং অন্য বেশ কিছু নথির সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে তবেই এর পাঠ সম্পূর্ণ হয়; ছাপা অক্ষরের পিছনে লুকিয়ে থাকা অর্থের গভীর চলন নজরে আসে।

সম্প্রতি প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে অধ্যাপক মালিনী ভট্টাচার্য নতুন শিক্ষানীতির চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন অনেক বিষয়ে কস্তুরিরঙ্গন কমিটির চাঁচাছোলা বয়ানে রাজনৈতিক সঠিকতার প্রলেপ লাগানো হয়েছে। কমিটি দম্ভভরে ঘোষণা করেছিল এখনো পর্যন্ত প্রতিটি শিক্ষানীতি নাকি আর্থ-সামাজিক সমতার জন্য মানের সঙ্গে সমঝোতা করেছে। নতুন শিক্ষানীতিতে একাধিক জায়গায় ‘সমতা’, ‘অন্তর্ভুক্তি’ জাতীয় শব্দ আছে।‘যুক্তিবাদী ও বৈজ্ঞানিক চিন্তার’ উল্লেখ আছে, কস্তুরিরঙ্গন কমিটি যে বিষয়ে নীরব থেকে যথেষ্ট সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিল। আর্থ সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার জন্য বিশেষ চেষ্টা এবং আর্থিক সাহায্যের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অধ্যাপক ভট্টাচার্য এটাও দেখিয়েছেন যে এ সবই কথার কথা। আদতে এই নীতি শিক্ষাক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য বৃদ্ধির নকশা।আমার নিজের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে আমি এই সংক্রান্ত আলোচনা উচ্চশিক্ষাবিষয়ক অল্প কয়েকটি বিন্দুতেই সীমাবদ্ধ রাখবো।

স্বশাসনের সাতকাহনঃ

শিক্ষানীতিতে কয়েকটি শব্দ বার বার ঘুরে এসেছে, আবার কয়েকটি শব্দের অনুপস্থিতি চোখে পড়ার মত। গোটা উচ্চশিক্ষার অধ্যায়ে অধিকার শব্দটিই অনুপস্থিত।বিজেপি সরকার যেভাবে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পঠনপাঠনের অধিকার, প্রতিবাদের অধিকার খর্ব করেছে তার প্রমাণ দেশের বিভিন্ন জেলে বন্দী অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ ও ছাত্রছাত্রীরা।কাজেই অধিকারের অনুপস্থিতি এখন নিয়ম, ব্যতিক্রম নয়। অধিকারের বদলে যে শব্দটি প্রাধান্য পেয়েছে তা হোলো ‘স্বশাসন’ বা ‘অটোনমি’।

স্বশাসনের তিনটি দিক – প্রশাসনিক, আর্থিক এবং বৌদ্ধিক। এরমধ্যে শেষেরটি সম্পর্কে প্রতিটি রিপোর্ট আশ্চর্যরকম নীরব – আমরা কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে কী পড়বো এবং পড়াবো তার স্বাধীনতা, চিন্তাভাবনা, রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রকাশ ও প্রচারের স্বাধীনতা থাকবে কিনা সে বিষয়ে কোনো দিশানির্দেশ নেই।স্বায়ত্তের ধারণা প্রশাসনিক এবং আর্থিক স্বায়ত্তেই সীমাবদ্ধ। এবং তার স্বরূপও নথিটি একটু খুঁটিয়ে পড়লেই বোঝা যায়।

গ্রেডেড অটোনমিঃ

নতুন শিক্ষানীতি ভারতের সমস্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে একটি ত্রিস্তরীয় ব্যবস্থায় আনতে চাইছে। সর্বোচ্চ স্তরে থাকবে ‘রিসার্চ ইউনিভার্সিটি’ অর্থাৎ এমন কিছু বিশ্ববিদ্যালয় যাদের মূল কাজ হবে গবেষণা। তার পরের স্তরে ‘টিচিং ইউনিভার্সিটি’ – যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ মূলতঃ পঠনপাঠন। এবং সবশেষে স্বশাসিত ডিগ্রি কলেজ। এতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণায় পঠনপাঠন ও গবেষণা দুটি সমান্তরাল এবং পরিপূরক ধারা ছিল। নতুন শিক্ষানীতি পঠনপাঠন ও গবেষণাকে পরস্পরবিচ্ছিন্ন করে উচ্চশিক্ষায় একটি স্পষ্ট শ্রেণিভেদ আনছে। শ্রেণি অনুসারে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি ‘গ্রেডেড অটোনমি’ অর্থাৎ বিভিন্ন মাত্রায় স্বায়ত্ত অর্জন করবে।এই শব্দটিও নতুন নয়; এর প্রথম উল্লেখ ২০১৮ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের একটি গেজেট নোটিফিকেশনে। সেখানে বলা হয় ন্যাকের র‍্যাংকিংয়ে উঁচুর দিকে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলিকে (ক্যাটাগরি ১ এবং ২)এই মহার্ঘ্য ‘গ্রেডেড অটোনমি’ দেওয়া হবে।স্পষ্ট জানানো হয় এই স্বায়ত্ত ‘প্রশাসনিক এবং আর্থিক’। এই দুই বিশিষ্ট দলভুক্ত উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজেদের ইচ্ছেমতো যেকোনো কোর্স চালু করতে পারবে, তাদের ইউজিসির অনুমতির প্রয়োজন হবে না “যদি তারা সেই কোর্স/বিভাগ/স্কুল/সেন্টার চালু করতে সরকারের কাছে কোনোরকম আর্থিক সাহায্য না চায়”। সেই অনুসারে ২০ শে মার্চ, ২০১৮ ৬৪ টি উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ‘গ্রেডেড অটোনমি’ দেওয়া হয়। এর মধ্যে জেএনইউ, আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়, হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মত সরকারের শিরোঃপীড়ার কারণ হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থাকায় অনেকেই বিস্মিত হয়েছিলেন।কিন্তু গেজেট নোটিফিকেশনের সঙ্গে মিলিয়ে পড়লে বিস্ময়ের কোনো কারণ থাকে না। বোঝা যায় এই ‘স্বশাসন’ আসলে পাবলিক ইউনিভার্সিটির ধারণার মূলে কুঠারাঘাত। উচ্চশিক্ষায় রাষ্ট্রের আর্থিক দায় ঝেড়ে ফেলে শিক্ষায় বাজারের নিয়ম পাকাপোক্ত করার প্রয়াস। যেসব কোর্স খুলতে সরকারের থেকে অর্থ পাওয়া যাবে না, তার অর্থ জোগাড় হবে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে। অর্থাৎ পাবলিক ইউনিভার্সিটি যার কাজ আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট নির্বিশেষে সমস্ত ছাত্রছাত্রীর শিক্ষায় সমানাধিকার নিশ্চিত করা তারা কিছু কোর্স কেবল তাদের জন্যই চালু করবে যাদের কোর্সের পিছনে যথেষ্ট খরচ করার ক্ষমতা আছে। আর তারা কী জাতীয় কোর্সের পিছনে এত টাকা খরচ করবে? অবশ্যই বাজারে যার চাহিদা আছে।

মাল্টিডিসিপ্লিনারিটিঃ সময়ের নয়, বাজারের দাবি

কস্তুরিরঙ্গন কমিটি রিপোর্ট পৃথিবীর তাবড় শিক্ষাবিদের পরিবর্তে সিএনএনের প্রিয় ‘উদারপন্থী’ সাংবাদিক ফরিদ জাকারিয়াকে উদ্ধৃত করে বলে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য নাকি কাউকে কেবলমাত্র একটি চাকরির জন্য প্রস্তুত করা নয়, তাকে তার দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং তারও পরবর্তী চাকরির জন্য তৈরি করা। এই উদ্ধৃতিটি শিক্ষানীতির নতুন বয়ানে না থাকলেও একটি শব্দের উপর খুব জোর দেওয়া হয়েছে – ‘মাল্টিডিসিপ্লিনারিটি’ অর্থাৎ একইসঙ্গে বিবিধ বিষয়ের চর্চা। শব্দটি শুনতে চমৎকার - আহা পদার্থবিদ্যার ছাত্রী কী সুন্দর সাহিত্যপটু হবে! ভাবলেই সম্ভবতঃ রিচার্ড ফাইনম্যান মনে পড়েন। কিন্তু নয়া শিক্ষানীতি সম্পর্কিত আলোচনায় ও লেখাপত্রে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডঃ দেবাদিত্য ভট্টাচার্য দেখিয়েছেন এর পিছনে যে বিশ্ববীক্ষা কাজ করছে তার লক্ষ্য চুক্তিভিত্তিক শ্রমের বাজারের যোগ্য কর্মী তৈরি করা; যে কর্মী বিভিন্ন দক্ষতার সমষ্টি। তাকে দিয়ে যেকোনো কাজ করানো যায়, একের মূল্যে একাধিকের কাজ করিয়ে নেওয়া যায়। কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়ার বদলে কর্মীসংকোচনের দর্শন সরকারি শ্রমনীতি থেকে শিক্ষানীতিতে অক্লেশে জায়গা করে নেয়। এই দর্শনে একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে গভীর জ্ঞানের কোনো মূল্য নেই। ছাত্রছাত্রীদের বিবিধ বিষয়ে পল্লবগ্রাহী দক্ষতা অর্জন করতে বলা হচ্ছে যাতে প্রতিটি ছাত্রছাত্রী কাজ চালানোর মত অনেক বিষয় জানবে, কিন্তু কোনো বিষয়কেই খুব গভীরভাবে আত্মস্থ করবে না। সে প্রশ্ন করবে না, প্রতিবাদও করবে না কারণ সেটা করার মত বিশ্লেষণী জ্ঞান থেকে তাকে বঞ্চিত রাখা হবে।

চারবছরের ‘নমনীয়’ স্নাতক ব্যবস্থাঃ উচ্চশিক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক শ্রেণি ও বর্ণভেদ

তাহলে কি কেউই কোনো বিশেষ জ্ঞান অর্জন করবে না? অবশ্যই করবে। কিন্তু উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতই জ্ঞানও হবে ‘গ্রেডেড’। ত্রিস্তরীয় ব্যবস্থার সর্বোচ্চ স্তর অবধি যারা টিকে থাকতে পারবে ‘স্পেশালাইজেশন’ অর্থাৎ বিশিষ্ট জ্ঞান তাদেরই বিশেষাধিকার। বাকিরা বিভিন্ন দক্ষতার সাড়ে বত্রিশভাজা পাবে।স্নাতক স্তরকে তিন বছরের পরিবর্তে চার বছরের করে দিয়ে সেই উচ্চতম স্তরে আরোহনের পথটি আরো দীর্ঘ করা হয়েছে। প্রতি বছরে ঢোকার এবং বেরোনোর পথ আছে। যদি একজন ছাত্রী প্রথম বছরের শেষে পড়াশুনা ছাড়ে তাহলে পাবে একটি সার্টিফিকেট; দ্বিতীয় বছরের শেষে ডিপ্লোমা, তৃতীয় বছরে সাধারণ স্নাতক ডিগ্রি, চতুর্থ বছরের শেষে অনার্স ডিগ্রি যা ‘বিশেষ’ জ্ঞানার্জনের পরের ধাপ একটু তাড়াতাড়ি খুলে দেবে কারণ তাকে দুবছরের বদলে একবছরের স্নাতকোত্তর করতে হবে।

এই ব্যবস্থা র‍্যাংক-বিলাসী উচ্চমধ্যবিত্তের মনের মত কারণ তারা এরকম স্তরবিভক্ত ব্যবস্থাকে প্রতিযোগিতার উপযোগী মনে করে। বিশ্বাস করে পড়াশুনা শেষ না করতে পারাটা একজন ছাত্র বা ছাত্রীর অক্ষমতা, তার যোগ্যতার ন্যূনতার পরিচায়ক। অথচ আমাদের দেশের একটি বড় অংশের ছাত্রছাত্রী স্রেফ আর্থিক দৈন্যের জন্য পড়াশুনা চালাতে পারে না, অনেককেই পড়াশুনার সঙ্গে কিছু রোজগারের চেষ্টা করতে হয়, বিশেষতঃ মেয়েদের পঠনপাঠন পরিবারের অনিচ্ছায় মাঝপথেই থেমে যায়। এই অবস্থায় একটি অতিরিক্ত বছর পড়াশুনার খরচ চালানো অনেকের পক্ষেই অসম্ভব হবে। শিক্ষানীতি প্রণেতারা কোনো ভণিতা ছাড়াই জানিয়েছেন যেকোনো সময়েই একটি শংসাপত্র নিয়ে পড়াশুনা ছাড়া যাবে ঠিকই কিন্তু সব শংসাপত্রের মূল্য এক নয়। শিক্ষানীতিতে উচ্চশিক্ষায় ড্রপ আউটের হার নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। এই ব্যবস্থা তার অব্যর্থ ওষুধ। বিদ্যালয় শিক্ষার শেষে যাতে সমস্ত ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষার যোগ্যতা এবং সুযোগ অর্জন করে আর উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ করা প্রতিটি ছাত্রছাত্রী যাতে পাঠ সম্পূর্ণ করতে পারে তার কোনো দায় নেওয়ার পরিবর্তে রাষ্ট্র তাদের হাতে একটি করে কাগজ ধরিয়ে দায়মুক্ত হবে। FYUP (Four Year Undergraduate Programme) নাম দিয়ে চারবছরের স্নাতকের কোর্স পূর্ববর্তী ইউপিএ সরকারের আমলে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে আনা হয়েছিল। ছাত্র ও শিক্ষক বিক্ষোভের জেরে ২০১৪ এ মোদি সরকার আসার পরেই এই ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়। কিন্তু কিমাশ্চর্যম! কস্তুরিরঙ্গন কমিটি সেই ব্যবস্থারই সুপারিশ করে, যা অপরিবর্তিত থাকে নতুন রিপোর্টে।ড্রাফটের মূল্যায়নকারীদের অন্যতম ছিলেন ডঃ দীনেশ সিং, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য এবং FYUP র মূল আর্কিটেক্ট।

ছাত্রবৃত্তি ও বেসরকারিকরণঃ

নতুন শিক্ষানীতির ছত্রে ছত্রে আর্থ-সামাজিকভাবে অনগ্রসর শ্রেণির উচ্চশিক্ষায় অংশীদারিত্বের কথা আছে, কিন্তু তার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট আর্থিক দিশানির্দেশ নেই। শুধু ‘ফ্রি-শিপ’ আর ‘স্কলারশিপের’ কথা আছে। পাবলিক ইউনিভার্সিটির মূলে একটি সমতার ধারণা কাজ করে – উচ্চমানের শিক্ষায় সকলের সমান অধিকার এবং সেই অধিকার নিশ্চিত করা কল্যাণকারী রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব। যার ক্ষমতা আছে তাকে শিক্ষা কিনতে বলা আর যার নেই তাকে বৃত্তির নামে আলাদা করে চিহ্নিত করা শিক্ষাক্ষেত্রে বিভেদের বীজ বপন করে। তাছাড়া গত পাঁচ ছয় বছরের অভিজ্ঞতা বলে এই সরকার উচ্চশিক্ষায় স্কলারশিপের সংখ্যা ও পরিমাণ উত্তরোত্তর কমিয়েছে – কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে নন-নেট রিসার্চ স্কলারদের প্রাপ্য স্কলারশিপ উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে। প্রবল ছাত্রবিক্ষোভে পিছু হঠতে হলেও অন্যান্য একাধিক স্কলারশিপ তুলে দেওয়া হয়েছে। যেগুলি আছে তার টাকা আসতে বছর গড়িয়ে যায়। লক ডাউনের চার মাস জেএনইউ আর জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ায় গবেষকদের স্কলারশিপ পুরোপুরি বন্ধ থেকেছে। তাই শিক্ষানীতির বড় বড় বুলি সত্ত্বেও বাস্তবের মাটিতে স্কলারশিপের কী ব্যবস্থা হবে আন্দাজ করা যায়।

অথচ এই ফ্রি শিপ এবং স্কলারশিপের গল্প শুনিয়েই উচ্চশিক্ষায় বেসরকারি বিনিয়োগের সুবিধা করা হয়েছে। এই অংশের শিরোনাম বলছে এর উদ্দেশ্য শিক্ষার বাণিজ্যিকরণ বন্ধ করা। অথচ শিরোনামের নিচের প্যারাগ্রাফই বলছে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলায় বড় বেশি আইনের বেড়াজাল; শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জমি, বাড়ি বা পরিকাঠামো নিয়ে দাবি বড় বেশি। এতকিছু চাইলে চলবে না; নিয়ম সরল করতে হবে যাতে বেসরকারি এবং বিদেশি বিনিয়োগ আসে। যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান “মানবকল্যাণ ও জনসেবার উদ্দেশ্য" নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে চায় তাদের উৎসাহ দেওয়া হবে। প্রশ্ন জাগতেই পারে মুনাফাই যেখানে ব্যবসার প্রধান চালিকাশক্তি সেখানে এত মানবকল্যাণকামী ব্যবসায়ী কতজন আছেন? উত্তর খুঁজতে বাইরে তাকাতে হবেনা, নথিটিতে এ বিষয়ে যথেষ্ট স্বচ্ছতা আছে। বেসরকারি উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজেদের ইচ্ছেমতো কোর্সের মূল্য ধার্য করতে পারবে (বলা হয়েছে progressive fee structure; ভাষার আশ্চর্য জাগলারি। আগে এইসব ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক বা competitive fee structure শব্দবন্ধ ব্যবহার হোতো। কিন্তু তাতে বাজারের বড় আঁশটে গন্ধ। বাজারকে এমনভাবে যাপনের অংশ করতে হবে যাতে তাকে বাজার বলে আর চেনা না যায়) যদি তারা কিছু ফ্রি-শিপ বা স্কলারশিপের ব্যবস্থা রাখে।

উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হ্রাসঃ

নতুন শিক্ষানীতির কেন্দ্রে রয়েছে এক আপাত অসম্ভবের সাধনা। বলা হয়েছে সামগ্রিক ভর্তির অনুপাত (গ্রস এনরোলমেন্ট রেশিও) আগামী পনেরো বছরে দ্বিগুণ করা হবে। আবার ঐ একই সময়ে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মোট সংখ্যা, বর্তমানে যা প্রায় ৫২, ০০০, তাকে কমিয়ে ১৫০০০ করা হবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে, একই সঙ্গে একাধিক উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জুড়ে দিয়ে উচ্চশিক্ষা ‘হাব’ তৈরি হবে। উচ্চশিক্ষার যে ত্রিস্তরীয় ব্যবস্থার আলোচনা আগে হয়েছে তার কোন স্তরের প্রতিষ্ঠান তথাকথিত ‘অনগ্রসর’ অঞ্চলে তৈরি হবে তা সহজেই অনুমেয়। প্রতিষ্ঠান কমিয়ে ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধির এই অসাধ্য সাধনের জন্যই একদিকে বেসরকারি বিনিয়োগ এবং অন্যদিকে অনলাইন শিক্ষার উপর জোর দেওয়া।

টেনিওর ট্র্যাকের আমদানিঃ

শিক্ষাক্ষেত্রে কর্মসংস্থান বিষয়ে এই শিক্ষানীতির অবস্থান একইরকম দ্বিচারিতাপূর্ণ।যোগ্য শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টিতে বার বার জোর দেওয়া হয়েছে। আবার বলা হয়েছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত কলেজ ব্যবস্থা (যাতে কলেজগুলি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশিকা, সিলেবাস ইত্যাদি মেনে চলে এবং পাঠশেষে ছাত্রছাত্রীরা সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি লাভ করে) ‘ফেজ আউট’ করে দেওয়া হবে, অর্থাৎ ধীরে ধীরে তুলে দেওয়া হবে। একই ভাবে যেসব কলেজে একটিমাত্র ধারার পঠনপাঠন হয় সেগুলিকে হয় ‘মাল্টিডিসিপ্লিনারি’ হতে হবে নাহলে তুলে দেওয়া হবে। প্রতিষ্ঠানের ‘ফেজ আউটের’ সঙ্গে সেখানে কর্মরত শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মীরাও কি বায়ুভূত হবেন? বিশেষতঃ যেসব চুক্তিভিত্তিক শিক্ষক ও কর্মীরা বর্তমানে বেশিরভাগ কলেজের পঠনপাঠন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখেছেন তাঁদের কী হবে? তাঁরা যে চরম আর্থিক অনিশ্চয়তা এবং কর্মক্ষেত্রে নানাবিধ হয়রানির সম্মুখীন হন তার কোনো উল্লেখ বা প্রতিবিধানের আশ্বাস নয়া শিক্ষানীতিতে নেই। উপরন্তু গুণমানের উন্নতির জন্য বিদেশি, বিশেষতঃ আমেরিকান উচ্চশিক্ষার ‘টেনিওর ট্র্যাক’ ব্যবস্থা এদেশের উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রেও নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। ৬০ পাতার ড্রাফটটিতে ‘টেনিওর’ প্রসঙ্গ থাকলেও ‘টেনিওর ট্র্যাক’ এই শব্দবন্ধ ছিল না। কিন্তু মন্ত্রীমণ্ডল অনুমোদিত বয়ানে শব্দবন্ধটি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।এর সোজা মানে দাঁড়ায় যতজন অধ্যাপক নিযুক্ত হবেন তাঁদের সকলের নিয়োগ নিয়মিত হওয়া আর নিশ্চিত থাকবে না। এই ট্র্যাক একধরণের ইঁদুরদৌড় – প্রতিটি নিযুক্ত শিক্ষককে এই দৌড়ে অংশ নিতে হবে টেনিওর অর্থাৎ নিয়মিত হওয়ার মোক্ষ লাভের জন্য। বলা হয়েছে অন্যান্য নানা বিষয়ের সঙ্গে ওই মোক্ষ নির্ভর করবে তাঁদের সহকর্মী, উপরওয়ালা এবং প্রতিষ্ঠানের প্রশাসকমণ্ডলীর মূল্যায়নের উপর।বোঝাই যায় যিনি প্রশাসনের বিরাগভাজন হবেন তাঁর মোক্ষলাভের সম্ভাবনা খুবই কম।

ভারতীয় উচ্চ শিক্ষা সংসদঃ

শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে একাধিক নিয়ন্ত্রক সংস্থার হস্তক্ষেপে যাতে প্রাতিষ্ঠানিক স্বাতন্ত্র খর্ব না হয় তার জন্য ‘লাইট বাট টাইট’ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আনা হবে। ইউজিসি, অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনোলজিকাল এডুকেশন জাতীয় নিয়ামক সংস্থাগুলি তুলে দেওয়া হবে (ইউজিসির ভবিষ্যৎ অবশ্য অনিশ্চিত কারণ একজায়গায় আবার বলা আছে ইউজিসি অন্যান্য আরো কিছু সংস্থার মত গবেষণায় অনুদানের ব্যবস্থা করবে)। বদলে নিয়ে আসা হবে একটি মাত্র সংস্থা – ভারতীয় উচ্চশিক্ষা সংসদ (Higher Education Council of India, সংক্ষেপে HECI)। উচ্চশিক্ষার চারটি প্রধান দিক – নিয়ন্ত্রণ, গুণমান নির্ণয়, গবেষণায় আর্থিক অনুদান এবং পঠনপাঠনের দিশানির্দেশ। এতদিন এগুলি পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত কিন্তু স্বতন্ত্র সংস্থার আওতায় আসত। কিন্তু এখন এই সব ক্ষমতাই একটিই সর্বক্ষমতাসম্পন্ন লেভিয়াথনসুলভ নিয়ামক সংস্থার হাতে কেন্দ্রীভূত হবে। সংস্থাটি তার আলাদা আলাদা প্রত্যঙ্গের সাহায্যে এই চারটি পৃথক দায়িত্ব পালন করবে। স্বভাবতঃই এই সংস্থা অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার অধিকারী হবে এবং এর দায়বদ্ধতা সুনিশ্চিত করার কোনো ব্যবস্থা নথিতে দেওয়া নেই। এর মধ্যে গুণমান নির্ণয় অর্থাৎ accreditation এর দায়িত্ব National Accreditation Council (NAC) নামক প্রত্যঙ্গের উপর ন্যস্ত থাকবে যার কাজ হবে কিছু প্রতিষ্ঠানকে গুণমান নির্ধারণের লাইসেন্স দেওয়া যারা বিভিন্ন উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুণমানের নিয়ন্তা হবে। পূর্ববর্তী ড্রাফটে বলা ছিল এই প্রতিষ্ঠান এই জাতীয় লাইসেন্স কেবলমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলিকেই দেবে। কিন্তু অনুমোদিত নথিতে সুকৌশলে ‘সরকারি’ শব্দটি পরিহার করে শুধু ‘বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান’ বলা হয়েছে।অর্থাৎ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও চাইলে উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির গুণমানের শংসাপত্র দেওয়ার অধিকারী হতে পারে।

উচ্চশিক্ষা ও আরএসএসঃ

বেসরকারি মানবকল্যাণের উপর সরকারি শিলমোহর ব্যবসায়িক ছাড়া রাজনৈতিক স্বার্থও সুরক্ষিত করে। ‘মানবকল্যাণে’ নিয়োজিত আর একটি বেসরকারি সংস্থার কথা আমাদের মনে রাখতেই হবে, ভারতের সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে ধনী সরকার-পোষিত বেসরকারি সংস্থা – রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ। এই নথির ছত্রে ছত্রে সংঘের মতাদর্শের ছাপ। ‘লিবারাল আর্টসের’ সন্দর্ভে প্রাচীন ভারতের চতুষষ্ঠিকলার বারংবার উল্লেখ, উচ্চমানের বিদ্যাশিক্ষাপ্রসঙ্গে তক্ষশিলা, নালন্দা, বিক্রমশীলার আবাহন অথচ ভারতে ইসলামি শাসনে উচ্চশিক্ষার বিস্তার সম্পর্কে একটি শব্দও খরচ না করা, ইংরাজি নথিতেও একাধিক সংস্কৃত এবং সংস্কৃতায়িত হিন্দি শব্দের ছড়াছড়ি এইসবকিছুতেই আরএসএসের অমোঘ উপস্থিতি।কস্তুরিরঙ্গন কমিটি রিপোর্ট প্রস্তুতকালে যে একমাত্র ছাত্রপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করেছিল সেটি অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ। সংঘের বাজারি রূপ হোলো বিজেপি।ফলে সংঘের সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের সঙ্গে বাজারের কোনো বাস্তব বিরোধিতা নেই।নতুন শিক্ষানীতি ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় এই দুইয়ের মেলবন্ধনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা।

0 Comments

Post Comment