পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

একদিন মহাত্মা গান্ধী হেঁটেছিলেন, আজ রাহুল গান্ধী হাঁটছেন

  • 30 January, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 582 view(s)
  • লিখেছেন : মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায়
একদিন আমরা দেখেছি, মহাত্মা গান্ধীকে হাঁটতে, আজ আর এক গান্ধী পথে আছেন। মানুষ তার সাথে জুড়েছেন। চক্রব্যূহ ভেদ করা বড় কঠিন। বিশেষ যখন জ্যেষ্ঠরা সাথে যেতে ভয় পায়। তখন তো একলাই চলা। অভিমন্যু ফেরার কৌশল জানতেন না। তবু ঢুকেছিলেন। বর্ষীয়ান গান্ধীচিন্তাবিদ কুমার প্রশান্ত যেমন বলেছেন, অন্তত রাহুল ঢুকেছেন।‌ সেটাই‌ সত্য।

একলা চলো রে', রবীন্দ্রনাথের বহুশ্রুত এই পংক্তি বরাবর সেই মানুষটির অবয়ব সামনে আনে, বয়স ও জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার ভারে শীর্ণ কিন্তু অটল পার হচ্ছেন নোয়াখালির ভঙ্গুর সাঁকো। গান্ধীর চলা সর্বজনবিদিত। সবরমতী আশ্রম থেকে হাঁটতে হাঁটতে তিনি ২৪১ মাইল পেরিয়ে ডান্ডিতে গিয়ে লবণ তৈরি করেছিলেন।‌ পরাক্রমী ব্রিটিশ ভাইসরয় ঘটনাটিকে 'এক চিমটি লবণ দিয়ে সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করার জন্য  মিস্টার গান্ধীর পাগল প্রকল্প' বলে হেসে উড়িয়ে দিলেও যাত্রা শেষে সম্যক টের পেয়েছিলেন লবণের গুণ যা সাম্রাজ্যের ভিত কাঁপিয়ে ছিল। ১৯৩০ সালে সুপরিকল্পিত এই যাত্রা গোটা দেশকে উদ্বেলিত করে।

কিন্তু ১৯৪৬ সালের ভারত অবিশ্বাস, সন্দেহ ও সর্বোপরি তীব্র বিদ্বেষ বিষে জর্জরিত। কলকাতায় প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস, তারপর নোয়াখালির ভয়াবহ দাঙ্গা, মনুষ্যত্বের কোথাও কিছু অবশিষ্ট নেই। দিল্লি থেকে অশক্ত শরীরে রওনা হলেন তিনি, দিল্লি তখন রাজনৈতিক ভরকেন্দ্র। অন্তর্বর্তী কেন্দ্রীয় সরকারে মুসলিম লিগ যোগ দিয়েছে কিন্তু বিভাজনের বিষবৃক্ষ সর্বত্র মাথা তুলে আছে। এক জাতি, এক প্রাণ ইত্যাদি ধুয়ে মুছে এখন দুই জাতিতে বিভক্ত এক দেশ।‌ এই রাজনৈতিক ভরকেন্দ্র ছেড়ে চললেন গান্ধী বহুদূরে প্রত্যন্ত গ্রামে তার জীবনের সত্যটুকু অবলম্বন করে। আজ বাইরের কোনো শক্তি তার প্রতিপক্ষ নয়, আজ ভাই ভাইকে মারছে, সবচেয়ে বিচলিত হয়েছেন গান্ধী নারীর অবমাননায়। এতটাই যে, অহিংসার পূজারী আক্রান্ত নারীকে বলপ্রয়োগে নিজেকে বাঁচানোর কথা বলেছেন।‌

প্রবল অবিশ্বাস ও বিদ্বেষে ভরা এই পথে কয়েকজন সঙ্গী ছাড়া গান্ধী প্রাথমিকভাবে একলাই চলেছিলেন। নোয়াখালীতে যখন তিনি পথে, দেশের তাবড় নেতারা তখন অনেক দূরে, তাই বারবার সেখানে তিনি শুনেছিলেন প্রিয় গুরুদেবের এই গানটি।  ধীরে ধীরে সময় বদলে যায়। অত্যাচারিত মানুষের মনে সাহস ফিরে আসে, হিন্দুরা জড়ো হন তার উপাসনায়, তার প্রতি সন্দিহান স্থানীয় মুসলমানেরাও আসতে থাকেন। গান্ধীর জীবনের এই শেষ অভাবনীয় কাজ যা তাঁকে চিরদিনের জন্য গোটা দুনিয়ায় সম্প্রীতির প্রতীক হিসেবে স্মরণীয় করে রাখে।

যা অভাবনীয় ছিল আজ আবার তাই ঘটে চলেছে হিংসায় উন্মক্ত পৃথিবীতে , আর এই ভারত রাষ্ট্র আজ ভয়াবহ সংঘাতে ক্ষতবিক্ষত। ধর্মের নামে জাতের নামে গোষ্ঠীর নামে যে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে, যা নির্মিত হয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে, সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িকতার বিষ বাষ্পে শ্বাসরুদ্ধ সময়, তখন গান্ধীকেই মনে পড়ে।

এই ভয়ঙ্কর সময়ে যখন সবাই নিশ্চুপ, অল্প কয়েকজন ছাড়া কেউ কোনো বিতর্কে জড়াতে চান না, কেউ দাঁড়াতে চাননা সত্যের সামনে , ঠিক তখনই এমন কাউকে পাওয়া যায় আপাতভাবে যিনি প্রত্যাশার বাইরেই অবস্থান করছিলেন। গণতন্ত্রের ৭৫ তম বর্ষপূর্তি উদযাপনের মাত্র কয়েকদিন আগে একপ্রকার ধর্মরাষ্ট্র তৈরির উদ্যোগ যখন এই দেশে, ঠিক তখনই ভারতের উত্তর পূর্বে সবচেয়ে অবহেলিত অংশের উপর হেঁটে চলেছেন তিনি। ক্ষতবিক্ষত মণিপুর, বীভৎস দাঙ্গায় যেখানে হত্যাকান্ডের পাশাপাশি ভয়াবহ নারীনির্যাতন চলছিল, তখন কোনো রামের সৈনিক তাঁদের পাশে গিয়ে দাঁড়াননি। ঠিক যেমন নোয়াখালীতে পৌঁছাননি বিনায়ক সাভারকর। সেই সংশয় আকীর্ণ পথ বেয়ে ন্যায় যাত্রা শুরু করেছেন রাহুল গান্ধী। হ্যাঁ, তিনি একটি রাজনৈতিক দলের নেতা। একদা গান্ধীও সেই দলে ছিলেন। ছলে বলে কৌশলে ক্রীত সংবাদ  মাধ্যমে একদা রাহুল ছিলেন মূর্খ 'পাপ্পু', পরবর্তীতে শুধুই খলনায়ক। কিন্তু আমাদের চোখের সামনে আমরা তার বিবর্তন দেখেছি। এর আগের 'ভারত জোড়ো' যাত্রায় দেশের সব প্রান্তে মানুষ তার কাছে এসেছেন, তার পাশাপাশি হেঁটেছেন। কোনো বড় দাবি না করেই তিনি তাদের সাথে মিশেছেন। তার প্রতিটি পদক্ষেপ সংঘের দালালেরা ব্যঙ্গে ভরিয়েছে, তিনি কিন্তু এগিয়েছেন।

ভারতের স্বাধীনতার পর যে বৃহৎ রাজনৈতিক দল এই দেশটির দায়িত্ব নিয়েছিল, ক্রমেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে একদিন চূড়ান্ত স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। ক্ষমতা যায়, আসে। কিন্তু জনবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক দলের ভিতরে কখনোই কোনো বিকল্পের কথা হয়না। শুধুই ভোটের অঙ্কে কাজ চলে। রাহুল গান্ধী অন্ততঃ এইটুকু বুঝেছেন যে আজকের লড়াই ভোটের লড়াই নয়, মৌলিক আদর্শের সংঘাত। তাই তিনি পথে নেমেছেন, মানুষের কাছে যাচ্ছেন।

দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফেরার পর ভারতীয় রাজনীতিতে সদ্য আগত গান্ধী ঘরে বসে মিটিং না করে গোটা দেশ দেখতে বেরিয়েছিলেন, জেনেছিলেন। তার সেই অভিজ্ঞতা ভারতের নরমপন্থী অভিজাত রাজনীতিকে আমূল বদলে দিয়েছিল।

২২ জানুয়ারির পর এদেশে গণতন্ত্র রক্ষার যে লড়াই লড়তে হবে তার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন রাহুল গান্ধী। এই আষ্টেপৃষ্ঠে ধরা ক্ষমতা যার ইডি, সিআইডি, এবিসিডির ভয়ে সবাই জো হুজুর কপচাচ্ছে, মুহূর্তে জোট বদলাচ্ছে, এই ভয়ঙ্কর নীরবতায় কেউ তো অন্যরকম ভাবছে।

স্বাধীনতার পর অনায়াসে যে গণতন্ত্র আমরা পেয়েছিলাম হয়তবা তাকে আমরা সঠিকভাবে বুঝিনি। সে যে শুধুই সাবালকের ভোটের অধিকার নয়, এটা বুঝতে সময় লাগল, যখন গণতন্ত্র সত্যই বিপন্ন। না হলে অন্ন, বস্ত্র বাসস্থান স্বাস্থ্য শিক্ষা কাজ যে দেশের অধিকাংশের কাছে এখনো দূর অস্ত, সে দেশের গণতন্ত্রের ৭৫ বর্ষে প্রধান ঘটনা হয় প্রাণপ্রতিষ্ঠা ! আজ এ দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র ঠাট্টার বিষয়। আমাদের বামপন্থীদের জামার ভিতর থেকে উঁকি মারছে উপবীত, দাড়িটুপি দেখলেই আমাদের জঙ্গিভয় জাগে, অশীতিপর বৃদ্ধকে একটি স্ট্র নিতে আদালতে যেতে হয়, একমাথা সিঁদুর নিয়ে সামনের জনকে হিজাব খুলতে বলি।

এই নির্বিবাদে মেনে নেওয়া আপোষকামী সুবিধাভোগী সমাজ  আজ সবার জন্য সর্বনাশ ডেকে আনছে। হিংসায় দীর্ণ হয়ে যাচ্ছে সম্প্রীতি, ভালোবাসা কিন্তু অদ্ভুত এক গা সয়ে যাওয়া সবার। প্রতিবাদ করলে কী ঘটতে পারে সবাই দেখছে। পথে নামতে ভয়!  দক্ষিণ আফ্রিকায় ৪৪ বছর বয়সে গান্ধী ৫০০০ জনের সাথে ৮ দিনে ১৬০ মাইল হে‌ঁটেছিলেন, ৬১ বছর বয়সে ২০০ মাইল লবণ আইন ভাঙতে, আর ৭৬ বছর বয়সে নোয়াখালি যেখানে তিনি একাই এক সেনাদল  হয়ে ভালোবাসার বীজ বুনেছিলেন।

আজ আর এক গান্ধী পথে আছেন। মানুষ তার সাথে জুড়েছেন। চক্রব্যূহ ভেদ করা বড় কঠিন। বিশেষ যখন জ্যেষ্ঠরা সাথে যেতে ভয় পায়। তখন তো একলাই চলা। অভিমন্যু ফেরার কৌশল জানতেন না। তবু ঢুকেছিলেন। বর্ষীয়ান গান্ধীচিন্তাবিদ কুমার প্রশান্ত যেমন বলেছেন, অন্তত রাহুল ঢুকেছেন।‌  সেটাই‌ সত্য।

0 Comments

Post Comment