পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

এক দেশ এক ভোট, বিজেপি শরিকদের ঠকানোর দলিল

  • 27 September, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 516 view(s)
  • লিখেছেন : বর্ণালী মুখার্জী
২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত যে কটা লোকসভা, বিধানসভা, পঞ্চায়েত, পৌরসভা ভোট হয়েছিল তার মোট খরচ ছিল ১.৫ লাখ কোটি টাকা। এখন হলে সেটা ২ লাখ কোটি ধরা যায়। আমাদের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি। সুতরাং মাথা পিছু ভোটের খরচ ১৫০০ টাকা। অন্যদিকে আমাদের দেশের মোট ঋণ হল ২০৫ লাখ কোটি, অর্থাৎ মাথা পিছু ঋণ হল প্রায় ১.৫ লাখ টাকা! তাহলে সঞ্চয়ের জন্য কোনটা কমানো প্রয়োজন সেটা পাঠকই বুঝে নিন! এক দেশ এক ভোট হলে একদিন দেখা যাবে, এক দেশ এক ফ্যাসিস্ট সরকার ছাড়া কিছু নেই।


ভোটের সংখ্যা কমবে?

বিজেপি এক দেশ এক ভোট আইন চাইছে ঠিকই। কিন্তু কোভিন্ড কমিটি রিপোর্ট স্ববিরোধে ভরা। তবে এই স্ববিরোধকে দূর করার উপায় অমিত শাহের ছিল না।  রিপোর্টটিকে যুক্তিসম্মত করতে হলে এই কোভিন্ড কমিটির অন্যতম সদস্য শ্রী সুভাষ কাশ্যপের প্রস্তাবকেই অমিত শাহকে মেনে নিতে হতো। কিন্তু সেটা করার হিম্মত অমিত বাবুর নেই। শ্রী কাশ্যপের প্রস্তাব মেনে নিলে এনডিএ শরিকরা বেঁকে বসতো। মন্ত্রীসভায় আর এই প্রস্তাব গৃহীত হতো না। তাই জোড়াতালি দিয়েই এই রিপোর্ট বের করতে হয়েছে তাদের।

রিপোর্ট স্বীকার করেছে যে বিধানসভা আর লোকসভা ভোট ষাটের দশক পর্যন্ত ভারতে একসাথেই হতো। অর্থাৎ যতদিন ভারতে মূলত দ্বিদলীয় ব্যবস্থা ছিল, ততদিন দিব্যি চলেছে। কিন্তু যেদিন থেকে বহুদলীয় ব্যবস্থা শক্তিশালী হতে শুরু করলো, একসাথে নির্বাচন করা অসম্ভব হয়ে গেল। এখন আবার সেই একসাথে ভোট ব্যবস্থায় বিজেপি ফিরতে চাইছে, অথচ আজ ভারতে বহুদলীয় ব্যবস্থা ষাটের দশক থেকেও আরো বিস্তৃত। যখন তখন মধ্যবর্তী ভোটের চাহিদা তৈরি হয়। তাহলে উপায়? এই কোভিন্ড কমিটির সদস্য শ্রীসুভাষ কাশ্যপ তাই স্পষ্টই বলেছেন যে মধ্যবর্তী সাধারণ নির্বাচন করা যাবে না। অনাস্থা প্রস্তাব এলে ভোট না করে এক বিকল্প স্বৈরতান্ত্রিক পথের সন্ধান দিয়েছেন তিনি, যে প্রসঙ্গে আমরা পরে বিস্তারে আলোচনা করবো। অমিত শাহ জানে যে কাশ্যপের এই প্রস্তাব মানা হলে এনডিএ শরিকরা বেঁকে বসবে। শুধু শরিকরাই নয়, বিজেপির কর্মীরাও হতাশ হবে। পঞ্চায়েত সদস্য, কাউন্সিলর, বিধায়ক, সাংসদ হওয়ার সুযোগ তারাই যে আর পাবে না! তাই সকলের মন রাখতে মধ্যবর্তী বিধানসভা ভোট বাতিলের প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছে কোভিন্ড কমিটি। বরং নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে যে, কমিটি শ্রীকাশ্যপের ফর্মুলা মানছে না। সুতরাং মধ্যবর্তী ভোট হবে। কিন্তু বাস্তবে দেশ জুড়ে এক তৃতীয়াংশ রাজ্যেই যদি মধ্যবর্তী ভোট হতে থাকে, যদি লোকসভার ক্ষেত্রেও মধ্যবর্তী ভোট হতে থাকে তবে আজকের থেকেও এক দেশ এক ভোটের ভারতে ভোটের সংখ্যা কমার বদলে বৃদ্ধি পাবে। কারণ নতুন আইন হলে মধ্যবর্তী ভোটের মধ্যে দিয়ে গঠিত সরকার পাঁচ বছরের হবে না। পরবর্তী লোকসভা ভোটের সময় আবার তাদেরও ভোট হবে। অর্থাৎ যে অর্থ সঞ্চয়ের অজুহাত তারা দিচ্ছে তার বিন্দুমাত্র হবে না, বরং খরচ আরো বেড়ে যাবে।  

আসলে বিজেপি বোধহয় ভাবছে তারা চিরকাল ক্ষমতায় থাকবে। তাই রিপোর্টে ভোট বাতিল না করলেও কার্যত জম্মু কাশ্মীরের ভোটের মত সেটা কয়েকবছর পিছোতেই থাকবে। অথবা এনআরসি, দাঙ্গা, গরু খাওয়া ইত্যাদি নানা আছিলায় তারা এমনই গণ উন্মাদনা তৈরী করবে যে শ্রী কাশ্যপের স্বৈরতান্ত্রিক প্রস্তাবটির দিকেই তারা দেশকে ক্রমে ঠেলে দেবে।

বিরোধীরা কি আত্মতুষ্টির শিকার?

বিরোধীদের কথা শুনে মনে হচ্ছে এই আইন নিয়ে অত দুশ্চিন্তার কিছু নেই। তাঁরা হয়তো ভাবছেন যে এই আইন কার্যকর হওয়া কঠিন। কারণ বহু সাংবিধানিক ধারাতে বদল আনতে হবে। কিন্তু ফ্যাসিস্টদের কাছে সংবিধানের ধারা পরিবর্তন ছেলেখেলা মাত্র। ইচ্ছা হলেই করা যায়। তাই ফ্যাসিস্টদের এই কোভিন্ড রিপোর্ট বলছে যতটুকু বদল ধারায় আনা হবে তা সামান্যই। রিপোর্টের দাবী, সংবিধানের স্তম্ভ যখন জনপ্রতিনিধি মূলক ব্যবস্থা, পাঁচ বছর অন্তর ভোট আর সেটা যখন থাকছে তখন এই নতুন আইন প্রণয়ন কঠিন হবে কেন? রিপোর্ট দাবী করছে রাজ্যপালের ক্ষমতা ব্যবহার করেই আইন কার্যকর করা যায় অনায়াসে। রিপোর্টের দাবি, এই ব্যবস্থা আগেও ছিল আবার হবে।

আসলে  শরিকরাও কেউ বোকা নয় আর বিরোধীরাও আত্মতুষ্ট নয়। এনডিএ শরিকদের মনে হয় স্থির বিশ্বাস যে বিরোধীরা নিশ্চয়ই মামলা করবে, এই আইন সিন্দুকে ঢুকবে। আবার বিরোধীদের স্থির বিশ্বাস ছিল যে এন ডি এ শরিকরাই এই আইন গ্রহণ করবে না। কিন্তু হয়তো দুই পক্ষই খেয়াল রাখলেন না যে বিভিন্ন আইনের ধারায় বদল এনে এই নীতি প্রণয়ন হবে না। শ্রী কাশ্যপের ফর্মুলা কার্যকর করতে হলে চাই দাঙ্গার ফ্যাসিস্ট রাজনীতি। দেশ জুড়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতি তৈরি হলেই তবে কাশ্যপের ফর্মূলা কাজে পরিণত করা সম্ভব।

অতি উচ্চ কোভিন্ড কমিটি

শ্রীরামনাথ কোভিন্ডের সভাপতিত্বে অমিত শাহ, গুলাম নবি আজাদ, এন কে সিং, সুভাষ কাশ্যপ, হরিশ সাল্ভে, সঞ্জয় কোঠারি, নিতীন চন্দ্র, এবং আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে আইন মন্ত্রী অর্জুন রাম মেঘওয়াল— এই কমিটি সুপারিশ করেছে ‘এক দেশ-এক ভোট’ আইন। ৩২২ পাতার রিপোর্ট এটি। যা ১৮ই সেপ্টেম্বর মন্ত্রীসভায় গৃহীত হয়ে গেছে। প্রস্তাবটি সংসদে পেশ হবে শীতকালীন অধিবেশনে। রিপোর্ট চায় পাঁচ বছর অন্তর ৪ মাসের জন্য ভোট হোক। প্রথমে বিধানসভা আর লোকসভা এক সাথে আর তার পর তিন মাসের মধ্যে পঞ্চায়েত আর পৌরসভা ভোট। রিপোর্টটি তৈরী করা হয়েছে ১৯১ দিনে। অন্তত একজন সাংসদ আছে এমন ৪৭ টা রাজনৈতিক দলের মতামত নেওয়া হয়েছে। ২০১৯ সালে কিছু প্রাথমিক আলোচনা হলেও ২০২৪ সালের জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের মতামত জানায়। এছাড়া ভারতের তিনটি বৃহৎ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ফিকি- এসোচেমে- সিআইআই-দের থেকে নেওয়া হয়েছে পরামর্শ। পরামর্শ নেওয়া হয়েছে আদালতের উকিল এবং বিচারপতিদের থেকেও। এই সুপারিশ গঠনে বিশেষ ধন্যবাদ জানানো হয়েছে আইন মন্ত্রকের এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের উচ্চ পদস্থ দুই চারজন আমলাকে। যদিও যে নামগুলো আছে সেগুলো বাছাই করা তাতে সন্দেহ নেই। চারজন বাছাই করা সুপ্রীম কোর্টের জজ, কিছু বাছাই করা হাই কোর্টের বাছাই করা জজ, আবার অখিল ভারতীয় অধিভক্ত পরিষদ অর্থাৎ আর.এস.এস-এর উকিল সংগঠনের প্রতিনিধি, কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের এবং রাজ্য নির্বাচন কমিশনের প্রাক্তন আধিকারিক। আর জনগণ? হ্যাঁ তাও আছে বৈকি!! ১৪০ কোটির এই দেশে ২১৫৫৬ জন নাগরিক তাদের মতামত জানিয়েছেন। যাদের মধ্যে ৮০% অর্থাৎ ১৭ হাজার মানুষ এই সুপারিশের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। ৩২ টি রাজনৈতিক দল এই প্রস্তাবের পক্ষে রায় দিয়েছে, ১৫ টি দল বিরুদ্ধে মত দিয়েছে। তবে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল শিবসেনা পক্ষে মত দিয়েছে আর লালু প্রসাদের দল নীরব থেকেছে। অন্তত বিরোধিতা করেনি।
 
পরিযায়ী শ্রমিক আর সংস্কার স্থবিরতা

ফিকি, এসোচেম, সিআইআই নিজেদের মধ্যে তারতম্য সত্ত্বেও এই প্রস্তাবকে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়েছে। এদেশের বড় ব্যবসায়ীদের অবস্থান স্পষ্ট, ঢোঁক গিলে হোক বা সানন্দে হোক, তাদের মধ্যে যারা নেতা তাদের কথাই বাকিরা স্বীকৃতি দিয়েছে। তাদের সমর্থনের কারণ হিসেবে রিপোর্টে স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে যে এর ফলে পরিযায়ী শ্রমিকরা আর বার বার ছুটি নিয়ে ঘরে ভোট দিতে যাবে না।  একটি সরকারি অতি উচ্চ স্তরীয় কমিটির রিপোর্টে এমন নির্লজ্জ লোভের বহিঃপ্রকাশ দুর্লভ। তবে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলি আরও একটা শব্দ ব্যবহার করেছে—policy paralysis, আমার অনুবাদে যা হল ‘সংস্কার স্থবিরতা’। যদিও এর ব্যাখ্যায় রিপোর্ট বলেছে যে ভোটের মডেল কোড অব্‌ কন্ডাক্ট মেনে অনেক সরকারি কাজ বন্ধ থাকে। না দেওয়া যায় গ্রান্ট, না শিলা স্থাপন করা যায়। শিক্ষক সহ ইস্কুল চলে যায় ভোটের কাজে। নেতারা কাজের বদলে বক্তৃতা বাজি করে বেড়ায়। সুতরাং কাজের জন্যই নাকি ভোট কমাতে হবে।

কিন্তু আসল সত্য হল, এখন চীনের চেয়ারম্যান বিজেপির চেয়ারম্যান। রাষ্ট্রপতি শিজিংপিন আর তার বর্তমান ভারতীয় ভক্ত ফিকি-এসোচেম- সিআইআই এটা ভালই বোঝে যে আজ মুক্ত প্রতিযোগিতা, বাজার অর্থনীতি স্রেফ কষ্ট কল্পনা। তাদের উৎসাহ উৎপাদনে নেই। তাদের মুনাফা ধ্বংসে, যুদ্ধে, ড্রাগে, ফাটকা কাণ্ডে। ফলে গণতন্ত্র, ভোট তাদের কাছে বড় বালাই। বছরে একবার ভোট মানেই, বিরোধী দলগুলি তো বটেই, এমনকি সরকারি দলও জনপ্রিয় থাকা চেষ্টা করবে, জনদরদী থাকার চেষ্টা করবে। ফলে শ্রম আইন পাশ করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চাপ থাকে। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা লুট করলে সংসদে সমালোচনা হয়, আদানির লুট নিয়ে শোরগোল তোলে বিরোধী পক্ষ। এমনকি পরিচিতি সত্ত্বাকে ব্যবহার করে দাঙ্গা হাঙ্গামা হলে ( যা আজকের যুগে সি আই আই-দের কাছে অনভিপ্রেত নয়) সেটা নিয়ে চলে তুমুল চাপানোতর। সরকার নিশ্চিন্তে দেশের বেকারদের ইউক্রেন বা আফ্রিকায় যুদ্ধ ক্ষেত্রে পাঠাতে পারে না। সামনে ভোট থাকলে সংসদ অধিবেশনগুলিও হয়ে ওঠে আকর্ষক প্রচারের মঞ্চ। বিরোধী সাংসদরা আদানি আম্বানির শ্রাদ্ধ করে ছাড়েন। সুতরাং, রাজনৈতিক দলগুলি যাতে সারা বছর ধরেই জনগণকে তুষ্ট করার সুযোগ না পায়, বা দলগুলো জনপ্রিয়তা অক্ষুণ্ণ রাখার প্রতিযোগিতায় প্রতি মুহূর্তে বৃহট ব্যবসায়ীদের মুখোশ খুলে যাতে না ফেলে তাই ভোটের সংখ্যা কমাতে পণ ধরেছে তারা। গণতন্ত্র আর উন্নয়ন আজ আর একসাথে চলতে পারেনা, বলেছিলেন চীনের রাষ্ট্রপতি শিজিংপিন। সংখ্যালঘু তোষণের থেকেও এখন বিজেপির ভয় হল জনতা তোষণ। পাঁচ বছর অন্তর ভোট হলে বিরোধী দলের জনপ্রতিনিধিদের সক্রিয়তা কমবে, বিরোধিতার ধার কমবে, এমনই আশা করছেন ফ্যাসিস্ট বিজেপি। আর তখনই তাদের অভিপ্রেত ফ্যাসিস্ট ‘উন্নয়ন’, ‘সুশাসন’ প্লাবন আসবে।

সঞ্চয়ের অজুহাত

রিপোর্টের শুরুতেই জনগণকে ভোটের খরচের জন্য কথা শোনানো হয়েছে। যদিও এই সঞ্চয়ের যুক্তি কতটা খেলো সেটার একটা হিসেব করা যাক। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত যে কটা লোকসভা, বিধানসভা, পঞ্চায়েত, পৌরসভা ভোট হয়েছিল তার মোট খরচ ছিল ১.৫ লাখ কোটি টাকা। এখন হলে সেটা ২ লাখ কোটি ধরা যায়। আমাদের জনসংখ্যা ১৪০ কোটি। সুতরাং মাথা পিছু ভোটের খরচ ১৫০০ টাকা। অন্যদিকে আমাদের দেশের মোট ঋণ হল ২০৫ লাখ কোটি, অর্থাৎ মাথা পিছু ঋণ হল প্রায় ১.৫ লাখ টাকা! তাহলে সঞ্চয়ের জন্য কোনটা কমানো প্রয়োজন সেটা পাঠকই বুঝে নিন!
 
বেলজিয়ামের সাথে ভারতের তুলনা!

এই আইনের ন্যায্যতা প্রমাণ করতে ভারতের সাথে তুলনা করা হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইডেন, জার্মানি, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিনস, বেলজিয়াম, দক্ষিণ আফ্রিকার মত দেশের যেহেতু এই কটা দেশে ভোট একসাথে হয়। বহু বৈচিত্রের দেশ ভারতের সাথে ওই দেশগুলির তুলনা চলে? বহু রাষ্ট্রীয়, বহু ভাষার, বহু ধর্মের, বহু জাতের এবং সবচেয়ে বড় কথা বহু দলের এই দেশের কাঠামোটিকে ইংল্যন্ডের হুবহু নকল করতে গিয়ে দেশভাগ ডেকে এনেছিলাম আমরা। মৌলানা আবুল কালাম আজাদের সেই সাবধানবার্তা আজও আমাদের ভাবায়। এখানে এক ব্যক্তি এক ভোট এবং কেন্দ্রের হাতেই চুড়ান্ত ক্ষমতা দিলে বা রাজ্যগুলির ক্ষমতা হ্রাস করলে শেষ পর্যন্ত ৭টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য (তখনকার দিনে প্রভিন্স) আর ১৫ টা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রভিন্সের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা পাবে না, এই আশঙ্কা ছিল ওনার, এবং সেটাই সত্য হয়েছিল। এখন আবার ওই হাতে গোনা কয়েকটা দেশের নকল করতে গিয়ে দেশকে টুকরো টুকরো করার ফন্দি আঁটছে বিজেপি। চক্ষুলজ্জার খাতিরে যে দুই একটি বিরোধী মতামত দেওয়া হয়েছে রিপোর্টে সেরকম একটি মতামত থেকে বেরিয়ে এসেছে ইংল্যন্ডের মত অমন একটি ছোট এবং একবজ্ঞা দেশেও একসাথে ভোট পরিচালনা করতে তাদের অসুবিধা হয়েছিল। আসলে অমিত শাহের দৃষ্টি বেলজিয়ামে নয়, নিবদ্ধ হয়ে আছে পূর্ব ইয়োরোপের দিকে। যে দেশগুলি টুকরো টুকরো হওয়ার ফলে অঞ্চলটি চিরস্থায়ী ড্রাগ আর অস্ত্রের বাজারে পরিণত হয়েছে। অমিত শাহ দের কাছে দেশ ভাঙার জন্য বিদেশের কত টাকা আসছে সেই খোঁজ বরং নিক ইডি।

কংগ্রেস দলকে বিপদে ফেলার ছক

রিপোর্টে বার বার স্বাধীনতা পরবর্তী চারটি লোকসভা নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে বিজেপি দেখিয়েছে যে আদতে এটাই ছিল ভারতের ভোট কাঠামো। অর্থাৎ এই কাঠামো আসলে কংগ্রেসেরই দান। বিজেপি স্রেফ সেটাকেই ফিরিয়ে আনছে, এই মাত্র। বার্তা হল, কংগ্রেসেরও উচিৎ দ্বিদলীয় ব্যবস্থাকেই আঁকড়ে ধরা। বিজেপি কংগ্রেসকে মনে করাতে চায় যে ১৯৬৬-র পর থেকেই চলে এলো তাদের দলে ভাঙন, দল বদল, অনাস্থা প্রস্তাব এবং বারংবার ৩৫৬ ধারার সাহায্যে রাজ্য সরকার ফেলে দেওয়ার প্রবণতা। ফলে বার বার বিধানসভা ভোট করতে হয়েছিল এবং একসাথে ভোটের ব্যবস্থা প্রত্যাহার করতে হয়েছিল। যদিও এর মধ্য দিয়ে বিজেপি স্বীকার করে নিয়েছে যে দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় যা চলে বহুদলীয় গণতন্ত্রে সেটা চলে না। ১৯৬৬-র পর থেকে ভারত ক্রমেই বহুদলীয় ব্যবস্থায় উন্নীত হচ্ছিল। কংগ্রেসকে আরও অস্বস্তিতে ফেলে ১৯৯১ সালে আইন কমিশনের এই মর্মে একটি প্রস্তাবের উল্লেখও করেছে রিপোর্ট।

সাংবিধানিক ফাঁক দিয়ে শ্রীকাশ্যপের ধুরন্ধর প্রবেশ

তিন নম্বর অধ্যায়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রখ্যাত লেখক, সংসদের প্রাক্তন সেক্রেটারি জেনারাল এবং এই ‘অতি উচ্চ কমিটি’র অন্যতম সদস্য শ্রী সুভাষ কাশ্যপের এক নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা রয়েছে এই সুপারিশের সমর্থনে। উনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন প্রমাণ করতে যে এই সুপারিশ আদৌ সংবিধান বিরোধী নয়। তিনি দুটো যুক্তি দিয়েছেন। এক, এদেশ আদৌ যুক্তরাষ্ট্রীয় নয়। দুই, রাজ্যে বা কেন্দ্রে অনাস্থা এলে বিকল্প মুখ্যমন্ত্রী/প্রধানমন্ত্রী বেছে নিতে হবে বিধানসভা/লোকসভা কক্ষেই। ভেতরেই ভোট হবে, সাধারণ নির্বাচন দরকার নেই। এই প্রক্রিয়ার দায়িত্ব নেবে রাজ্যপাল, রাষ্ট্রপতি। সবই নাকি সাংবিধানিক, বলেছেন তিনি। আসলে তিনি জানেন সংবিধানসভা কিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বারংবার সওয়াল করে গেছে এবং রাজ্যপাল পদকে গুরুত্ব দিয়ে টিঁকিয়ে রেখে গেছে।
 
সংবিধানসভার  দুর্বলতা আজ ONOE রিপোর্টের ভিত্তি

সংবিধান সভায় বিতর্ক হয়েছে রাজ্যপালের নিয়োগের প্রক্রিয়া নিয়ে, রাজ্যপালকে সরিয়ে দেওয়ার প্রকরণ নিয়ে, রাজ্যপালের হাতে দেওয়া ৩৫৬ ধারার মতন বিশেষ ক্ষমতা নিয়ে। কিন্তু রাজ্যপালের পদের অবলুপ্তি নিয়ে হয়নি। এমনকি K T Shah, Kamath, T N Krishmachari, Shibban Lal Saxena দের মুখেও রাজ্যপাল পদের অবসান নিয়ে কোনো বক্তব্য আমি অন্তত খুঁজে পাইনি। সংবিধান সভার একটা বড় অংশ, অনেক দিকপাল সহ, রাজ্যপালকে অমিত শক্তিধর করতে চেয়েছিলেন। কারণ তারা সমগ্র স্বাধীনতা সংগ্রাম জুড়ে ছিলেন সবল কেন্দ্রের পক্ষের লোক। তারা চাননি যে রাজ্যগুলি বেয়াদপি করুক। বিপরীতে ছিলেন এমন অনেকে, দিকপাল সহ, যারা চেয়েছিলেন রাজ্যপাল হবেন একটি আলংকারিক প্রধান। রাজ্যগুলির ক্ষমতা যাতে বিন্দুমাত্র খর্ব না হয় সেই ব্যাপারেই তারা বেশী আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু সবটাই রাজ্যপাল পদ বহাল রেখে!! ঠিক যেমন ক্যাবিনেট মিশন প্রস্তাব বাতিল করেও তারা ভেবেছিলেন দেশের ঐক্য বজায় থাকবে। অথবা মুসলিম লীগের ১৯২৭ সালের ১৪ দফা দাবী সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে নেহরু রিপোর্ট পেশ করলেও বোধহয় ঐক্য ভাঙবে না। স্বশাসিত রাজ্যের যে প্রস্তাব, দাবী ভারতে ভিন্ন মহল থেকে নানা কারণে উঠেছিল, সেগুলোকে সংকীর্ণ স্বার্থে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলে যে দেশ ভাঙবে সেদিনও নেতারা বোঝেননি, বা না বোঝার ভাণ করেছেন। আর তাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও তারা ভাবতেও পারেননি রাজ্যপালের পদ তুলে দিয়ে স্বশাসিত রাজ্য বানাবেন তারা।     

শ্রী আম্বেদকার ছিলেন কট্টর কেন্দ্রীভূত শাসনপন্থী সংবিধানসভার ভারী অংশ আর সংখ্যালঘু ফেডেরাল কাঠামোপন্থী (স্বশাসিত নয়) অংশের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা মানুষ। বাস্তবেও কোনো গুরুত্বপূর্ণ সাব কমিটির মাথা উনি না থাকলেও তিনি ছিলেন খসড়া কমিটির প্রধান। তবে সেইদিন এই ভারসাম্য রক্ষা করার দরকারও ছিল। না হলে প্রভাবশালীরাই ছড়ি ঘুরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দফা রফা করে ছেড়ে দিতো। সংবিধান সভার আসল কাজ করেছিল সাব কমিটিগুলো। আঞ্চলিক বা রাজ্য সরকারের দায় দায়িত্ব, unitary সরকারের সাথে এই আঞ্চলিক বা রাজ্য সরকারের সম্পর্ক কি হবে সেই সাব কমিটির মাথায় থাকলেন প্যাটেল, যিনি নিজে ছিলেন শক্তিশালী কেন্দ্র সরকার পন্থী মানুষ। ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী ভারতের হওয়ার কথা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। কিন্তু এই সাব কমিটি কোনো সিদ্ধান্তেই পৌঁছতে পারল না। বিতর্ক হল বড় পরিমাণে। রাজ্যপাল নিয়ে আলোচনা মানেই ঘুরে ফিরে সেই একই প্রশ্ন, দেশের যুক্তরাষ্ট্রে কেন্দ্র কত শক্তিশালী হবে, রাজ্যগুলো কতটা শক্তিশালী হবে। রাজ্যগুলো স্বশাসিত হবে, নাকি কেন্দ্র নামক অভিভাবকের সংসারে জুনিয়র পার্টনার হবে? শক্তিশালী কেন্দ্র পন্থীদের পক্ষ থেকে রাজ্যপাল পদটাকে শক্তিশালী করার জন্য দুই তিনরকম প্রস্তাব এলো। রাজ্যপালকে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত করার প্রস্তাব যেগুলোর মধ্যে ছিল অগ্রগণ্য। রাজ্যপাল নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে পারেনি এই সাব কমিটি। ঠিক হল, রাজ্যপাল বিষয়টা কেন্দ্রীয় সরকার সাব কমিটিরও অন্তর্ভুক্ত। যে কমিটির মাথা নেহরু। যুগ্ম কমিটির বৈঠকে সিদ্ধান্ত হল, কেন্দ্রের প্রতিনিধি রাজ্যপাল কেন্দ্রের দ্বারা নয়, বরং রাজ্যের জনগণের সার্বজনীন ভোটাধিকারের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হবেন। কিন্তু এটা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান হয়ে গেছে সেটা বুঝে কমিটিতে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে রাজ্যের বিধায়করা নির্বাচিত করবেন চার জন প্রার্থীকে। এবং সেই চারজনের মধ্যে থেকে একজনকে বেছে নিয়ে রাজ্যপাল মনোনীত করবেন রাষ্ট্রপতি। অর্থাৎ রাজ্যের বিধায়কদের দ্বারা নির্বাচিত রাজ্যপাল। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মত প্রক্রিয়া প্রস্তাব করলো ওই যুগ্ম কমিটি। কিন্তু দুই বছর পর যখন সংবিধান সভা বসলো তখন সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ বদলে গেল। শক্তিশালী কেন্দ্র পন্থী এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো পন্থীরা একটা জায়গায় এসে মিলিত হলেন, আম্বেদকরের সাহয্যে। রাষ্ট্রপতি মনোনীত করলে তার ক্ষমতা কমবে নির্বাচিত হওয়ার তুলনায়, আম্বেদকারের এই যুক্তি শেষ পর্যন্ত টিকে গেল। কে কে মুন্সী, কৃষ্ণস্বামী আল্‌হাদিরা আর আপত্তি তুললেন না। নির্বাচিত হওয়া মানেই রাজ্যপাল হয় প্রধানমন্ত্রীর মতই শক্তিধর হবেন অথবা মুখ্যমন্ত্রীর মতই সবল হবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রাজ্যপালকে রাষ্ট্রপতি দ্বারা মনোনীত করবেন ঠিক হল। রাজ্যের দ্বারা ভোট তো হলই না, এমনকি মনোনয়নও হল না। ফলে এই দিক থেকে সবল কেন্দ্র পন্থীরাই জিতে গেলেন।  উপরন্তু আর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কথা এলো। রাজ্যপাল যাতে রাজ্যের পছন্দসই হয়, তাই রাজ্যের মন্ত্রিসভার আলোচনার নিরিখেই মনোনীত করা হবেন রাজ্যপাল। সুতরাং রাজ্যপাল এবার সরাসরি কেন্দ্রের লোক। রাজ্যপালকে সরানোর প্রক্রিয়া নিয়েও যথেষ্ট বিতর্ক হল। প্রথম প্রস্তাব এলো যুক্তরাষ্ট্রীয় পন্থীদের তরফ থেকে যে জজদের যেভাবে সরানোর সুযোগ থাকছে, ঠিক সেই প্রক্রিয়াতেই রাজ্যপালকেও বরখাস্ত করার আইন থাকা উচিত। কিন্তু সেটাও মানা হল না। একমাত্র রাষ্ট্রপতি, বা রাষ্ট্রপতি যার পরামর্শে চলবেন যে কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেটের উপরেই রাজ্যপালের যাওয়া নির্ভর করলো। রাজ্যপাল যখন থাকলই স্বশাসিত রাজ্যের ন্যূনতম সম্ভাবনাকে বাতিল করে, ফলে তার হাতে থেকে গেল বিশেষ ক্ষমতা। এই সিদ্ধান্তের পর ৩৫৬ ধারা নিয়ে যা যা তর্ক বিতর্ক হয়েছিল সেটা অর্থহীন। আসলে কেন্দ্র বনাম রাজ্য বিতর্কে জিতে গেল কেন্দ্র। আর আজ, ২০২৪ সালে এসে দেখা যাচ্ছে, স্বৈরাচার থাবা বসিয়েছে আরও অনেকটা। তাই আজ এই যুক্তিকেই হাতিয়ার করছেন শ্রী কাশ্যপ এবং ONOE রিপোর্ট।

১৯৯৪ সালের বোম্মাই রায় হল। ৩৬৫ ধারা নিয়ে রাজ্যপালের হাতে পায়ে বেড়ি পড়ানোর পরেও রাজ্যপাল নিজেদের কার্যসিদ্ধি করতে সাংবিধানিক ফাঁক ঠিকই বের করে নিয়েছেন। ১৬৩, ১৬৭ এবং ২০০ নম্বর ধারাকে ব্যবহার করে, প্রতিটা বিল দেখতে চেয়ে এবং রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানোর আছিলায় আটকে রেখে রাজ্যপালরা অবিজেপি রাজ্যের মানুষকে হেনস্থা করে চলেছে।  বোম্মাই মামলারও আগে সারকারিয়া কমিশন বসলো, কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্ককে ভারসাম্যযুক্ত করার জন্য। সারকারিয়া কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী hung assembly-র ক্ষেত্রে রাজ্যপালের কি করণীয়? রাজ্যপাল কোন ক্রম অনুযায়ী কাদের কিভাবে ডাকবে সরকার গঠনের জন্য, সেটা বোঝানো হল। প্রথমে তাদের ডাকতে হবে যাদের ভোটের আগে থেকেই জোট ছিল। তার পর সেই দলকে যে সবচেয়ে বেশী আসন পেয়েছে, তাকে বাইরে থেকে সমর্থন দিচ্ছে অন্যান্য দল বা নির্দল প্রার্থী। তার পর ডাকতে হবে ভোট পরবর্তী জোটকে , যদি সেই জোটের সব শরিক সরকারে ঢুকতে রাজি হয়। তার পর সুযোগ পাবে ভোট পরবর্তী কোনো জোট, যার কিছু শরিক সরকারে ঢুকবে, কিছু বাইরে থেকে সমর্থন করবে।

এই সব ইতিহাস সুভাষ কাশ্যপ জানবেন এবং সেটাকে ফ্যাসিস্ট উদ্দেষ্যে কাজে লাগাবেন সেটাই স্বাভাবিক। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন পণ্ডিত হয়ে এটাও তার জানার কথা যে সংবিধান সংশোধনীর অধিকার আসলে একটা দর্শন। যার অর্থ হল, সংবিধান স্থাণু নয়। যে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রায় অস্বীকার করে যাত্রা শুরু হয়েছিল্‌ সেটাই ক্রমেই ভারতের গণতন্ত্রের বাস্তবতা হয়ে উঠলো। তিনি নিশ্চয়ই জানেন যে পরবর্তীতে সর্বোচ্চ আদালতের বিভিন্ন মামলায় এই প্রসঙ্গগুলি এসেছে, এবং সংবিধানের সংজ্ঞা ক্রমেই বদলে গেছে। বাস্তব রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও বহুদলীয় গণতন্ত্র ক্রমেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

কাশ্যপের রাষ্ট্রপতি শাসন ফর্মুলা

সুভাষ কাশ্যপ স্বাধীন ভারতের সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়ার ফাঁককে ব্যবহার করে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন যে রাজ্যেগুলির স্বেচ্ছামিলন আমাদের দেশ নয়। স্বেচ্ছায় মিলিত হলে যেহেতু বিচ্ছিন্নতার অধিকারও থাকে, এক্ষেত্রে সেটা নেই। বরং এখানে কেন্দ্র কিছু দায়, দায়িত্ব, অধিকার রাজ্যকে দিয়েছে (পড়ুন দয়া করে)। বৈচিত্র্য রক্ষা করতে। কাশ্যপ বলছেন যে সংবিধানের ৮৪ এবং ১৭৪ নং ধারা অনুযায়ী রাজ্যপাল/রাষ্ট্রপতি বারে বারে সরকার ফেলতে পারে। ৮৩ এবং ১৭২ নং ধারা বলছে যদি সরকার ফেলে দেওয়া না হয় তবেই পাঁচ বছর চলতে পারে যে কোনো সরকার। ১৬৩ (২) আর (৩) অনুযায়ী সরকার ভাঙার জন্য রাজ্যপালকে রাজ্যের মন্ত্রীদের পরামর্শ নিতে হবে না, এবং সেটা নিয়ে আদালতেও যাওয়া যাবে না। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন যে সংবিধান সভা যুক্তরাষ্ট্রকে বাতিল করেছে। এখানে কেন্দ্রই মূল। যদিও বোম্মাই মামলার উল্লেখ করতে তিনি ভোলেননি। তবে তিনি এও বলেছেন যে বোম্মাই মামলার অন্তর্বস্তু লুকিয়ে আছে রাজ্য, কেন্দ্র ও যুগ্ম- এই তিনটি তালিকার মধ্যে, এবং সেটা যেহেতু প্রত্যাহার করা হচ্ছে না, সুতরাং কোভিন্দ কমিটি সুপারিশ সংবিধানসম্মত! এবার তিনি সেই বিকল্প স্বৈরতান্ত্রিক প্রস্তাব দিয়েছেন। দলবদল ঘটলে, অনাস্থার প্রয়োজন পড়লে সারকারিয়া বা পুঞ্চ কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতেই কাজ করবে রাজ্যপাল। অর্থাৎ ভোট আর হবে না, সরকার পড়ে গেলেও। ৬৩ এবং ৬৭ নম্বর ধারা অনুযায়ী রাজ্যপাল সাধারণ নির্বাচনের বদলে বিধানসভা বা পার্লামেন্টের মধ্যেই সাংসদ বা বিধায়কদের ডেকে পরবর্তী মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করতে বলবে। এর জন্য সাংবিধানিক কোনো ধারায় পরিবর্তন দরকার হবে না, স্রেফ দুটি হাউজের নিয়ম কানুনে কিছু বদল আনলেই হবে। জার্মানির চান্সেলর নির্বাচনের মত হবে এখানেও ভোট। অর্থাৎ যার অর্থ হল বিকল্প মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী নির্ধারণ করতে না পারলে আর অনাস্থা প্রস্তাবও আসবে না, আর যদি অনাস্থা আসে অথচ বিকল্প মুখ্যমন্ত্রী/ প্রধানমন্ত্রীর মুখ না আসে তবে অবধারিত রাষ্ট্রপতি শাসন হবে।

কমিটি কতটা মানলো কাশ্যপকে?

শ্রী কাশ্য্যপের এই ভোট না করার বিধানকে, কমিটি আপাতত মেনে নেয়নি। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী মধ্যবর্তী ভোট হবে। তা সত্ত্বেও কাশ্যপের বক্তব্য কেন রাখা হল একটি গোটা অধ্যায় জুড়ে? স্পষ্ট করা হল, এই ভোট ব্যবস্থা টিঁকিয়ে রাখা হচ্ছে নিতান্ত দয়া করে, কোনো সাংবিধানিক বাধ্যতা নেই বিজেপির। যেহেতু বহুদলীয় এই ব্যবস্থায় অনাস্থা হবেই, ফলে ১৯৬৭ পরবর্তী ভারতের রাস্তায় আর তারা হাঁটবে না। তখন কাশ্যপের ফর্মূলাই  তারা গ্রহণ করবে। এই রূপান্তরের সেতু হিসেবে কাজ করবে জনরোষ, দাঙ্গা। অন্যদিকে ভোট না হওয়া মেনে না নিলেও, কাশ্যপের মূল সুরের প্রতিধ্বনি করেছে কমিটি। কমিটিও কাশ্যপের কথার রেশ ধরেই আম্বেদকরকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে যে আমাদের দেশ আদৌ যুক্তরাষ্ট্র নয়। ভারত আর আমেরিকার তফাত হল এই যে সেখানে রাজ্যগুলি স্বেচ্ছায় একটি ইউনিয়নে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে আর এখানে স্বেচ্ছায় নয়।

বিরোধীদের বিভ্রান্ত করেছে রিপোর্ট

অধ্যায় ৭-এ এসে রিপোর্ট এবার বিরোধীদের তিন রকমভাবে বিভ্রান্ত করার কাজে হাত দিয়েছে। এক, তারা উড়িষ্যার উদাহরণ দিয়ে দেখিয়েছে যে নবীণ পট্টনায়কদের আঞ্চলিক দল লোকসভা ভোটে বেশী আসন পেয়েছে বিধানসভার থেকে। দুই, বেশ কিছু রাজ্যে কেন্দ্রের ভোটে আর বিধানসভায় একই দল জিতেছে। তিন, একসাথে ভোট হলে সব দলের নেতাদের একচ্ছত্র সুবিধাভোগ বন্ধ হবে। আজকের ব্যবস্থায় একজনই নেতা লোকসভাতেও দাঁড়ায় আবার বিধানসভাতেও দাঁড়ায়। একসাথে ভোট হলে দলের বহু সাধারণ যোগ্য কর্মী টিকিট পাবে।
 
ভোট বনাম জিডিপি

শেষ পর্যন্ত রিপোর্ট এই সিদ্ধান্তে পৌছে গেছে যে দেশের মাথা পিছু জিডিপি ভয়ানক রকম কম কারণ ভোট বেশী হচ্ছে। ভোট কমলেই নাকি জিডিপি বাড়বে।

ফলে আগামী শীতকালীন অধিবেশনের আগেই বিরোধী ঐক্য গড়ে তোলা একান্ত প্রয়োজন। শিবসেনা আর তেজস্বীকে এর বিরুদ্ধে ভোট দিতে রাজি করানো যেমন জরুরি,  তেমনই জরুরি এনডিএ শরিকদেরকেও এটা বোঝানো যে তাদের স্রেফ ঠকানো হয়েছে

0 Comments

Post Comment