‘পল্টুর ফিরতে টাইম লাগবে। দূরে গেছে। ততক্ষণ কি কাস্টমারকে বলব বসে বসে আঙ্গুল চুষুন?’ কাউন্টারের ওপাশ থেকে ধমকে উঠল সোনালী। কাউন্টারের এপাশে রাজুর দিকে যতটা এসির ঠাণ্ডা, ওপাশে কাঠ-আগুনের আঁচে তার থেকে কিছুটা কম।
‘আঙ্গুল না অন্য কিছু চুষতে বলবি সেটা তোর ব্যাপার। পল্টু ফিরলে এই অর্ডার ও নিয়ে যাবে। ৪৭-এর অর্ডার না আসা অবধি আমি নড়ছি না।’ এদিকে হলুদ সর্ষেক্ষেতে দুহাত ছড়িয়ে গান ধরেছে রাজ। যতক্ষণ না সিমরান ছুটে এসে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, সেও নড়বে না। এই সিনটা রাজু সাড়ে দুশো চুয়াহ্ন বার দেখেছে। ওই সাড়েটা হচ্ছে যেবার সিনটা দেখার মাঝপথে তার এক চিলতে চিলেকোঠার ঘরে আগুন লেগেছিল।
‘কাজ ইগ্নোর করিস না। যখন চাকরিটা যাবে চোখে সর্ষেফুল দেখতে হবে।’
‘আমি এখনই দেখছি সেটা। সর্ষেফুলের সঙ্গে সারুক কাজল ফ্রি।’
‘তুই কিছু সিরিয়াসলি নিসনা কেন? তুই কি মনে করিস পল্টু চিরকাল চুপ করে থাকবে? একদিন খার খেয়ে বসকে চুগলি করে দেবে। তোর পুরো ঢুকে যাবে। আর সব জেনেও চুপ থাকার জন্য আমি কেস খেয়ে যাব।’ সোনালি একটা টিস্যু পেপারের বল পাকিয়ে রাজুকে ছুঁড়ে মারল। শাহরুখের কপালে লেগে মাটিতে পড়ল। কিন্তু শাহরুখের টুংটুঙ্গি বাজিয়ে গান থামল না। ‘সোনা ছেলে আমার। যা না, এটা দিয়ে আয়। এই মালটা ঠাণ্ডা পৌঁছলে কাস্টমার হুলস্থূল বাঁধাবে। তখন বসকে জবাব দিতে দিতে আমার প্রাণ যাবে। একে এরকম ময়দার মণ্ড বানিয়ে তার মাথায় চিজ মাখিয়ে কোটি কোটি কামাচ্ছি, তার ওপর দেরী করলে …’
‘তুই কামাচ্ছিস?’
‘আমি না কামাই, কোম্পানি তো কামাচ্ছে। সেই টাকাতেই তোর, আমার, পল্টুর সংসার চলছে। লকডাউনের দিনগুলো ভুলে গেলি? মাসের পর মাস আদ্দেক মাইনে।’
‘তুই গরম গরম খেয়ে নে। আমি দাম দিয়া দিমু। তারপর পল্টু এলে নতুন আর একটা বানিয়ে কাস্টমারকে পাঠিয়ে দিস।’
‘তোর খুব পয়সা হয়েছে মনে হচ্ছে! শালা, পিজ্জা খাওয়াবে আমাকে! আগে পিজ্জা খাওয়াবে, তারপর বলবে … নিজের মাকে খাওয়া, হারামজাদা।’
‘মাকে খাওয়াতে গেলে সেই রাণাঘাট যেতে হবে। আমি এখন যাবো না। যা পারিস করে নে।’
‘বসকে আমি আজই বলব।’
‘পারবি না।’ একটা তুড়ি মেরে, ভিডিও থামিয়ে চেয়ার থেকে উঠে পড়ল রাজু। ‘বাথরুম যাচ্ছি, যাবি না কি সাথে?’
ভারি মেনু কার্ডটা ছুঁড়ে মারার অভিনয় করল সোনালী। ‘শুয়োর কোথাকার!’ তারপর চোখ বুজে দু সেকেন্ড বাথরুমের সিনটা ভেবেই নিল একবার। গায়ে কাঁটা দিল। রাজুর কথা শুনে আগেও গায়ে কাঁটা দিয়েছে, পেটের ভেতর জলফড়িং পাখা ফরফরিয়েছে। হঠাৎ ফোনে পিড়িং করে মেসেজ ঢুকতেই ফড়িং বাবাজির তাল কাটল।
কম্প্যুটার স্ক্রিন বলে দিল বড় অর্ডার ঢুকেছে। লকডাউন শিথিল হওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ডালভাত ছেড়ে পিৎজার চাহিদা বাড়ছে। বাড়ির খাবারে ক্ষিদে মেটে, লোভ নয়। এ যাত্রা যারা রোগে ভোগেনি, তাদের ভোগ এখন ঊর্দ্ধমুখী।
রাজু ফিরে এসে আবার চেয়ার নিল। শাহরুখ মাঝপথে গান থামিয়ে অপেক্ষা করছিল। আবার গান ধরল।
‘আর একটা অর্ডার ঢুকেছে। বড় অর্ডার। এটাও নিবি না?’ সোনালী জিজ্ঞেস করল।
‘রাজ্যের দিদিমণি অর্ডার দিলেও, সেটা নেব না মামনি! ৪৭-এর সময় হয়ে এসেছে। আর মিনিট দশেক।’
কথাটা শেষ হয়েছে কি হয়নি, দরজা খুলে ঢুকল রঞ্জন। এই পিৎজ়া চেনের মালিক এবং এই রেস্তোরাঁই তাঁর অফিস। অল্প বয়েসে কাঁচা পাকা চুল। ঠোঁটের তলায় শুরু হয়ে থুতনির আগেই শেষ হয়েছে একটা তেকণা ছাগলদাড়ি। ঢোকার আগে দরজার মুখে সিগ্রেট ফেলে পা দিয়ে চিপে দিল। তারপর সেটা এক শটে পাঠিয়ে দিল ফুটপাথ সংলগ্ন নালায়। কোমরের কাছে ক্রিম রঙ্গা শার্টটা একটু টানটান করে নিয়ে, চশমার ফ্রেম ঠিক করতে করতে সোনালীকে জিজ্ঞেস করল, ‘হাউ’জ় বিজ়নেস টুডে?’
‘আজ ফিফটি হবে।’
‘প্রায় তিন মাস পর! নট ব্যাড।’ আশার সঙ্গে দীর্ঘশ্বাসের স্ববিরোধও রইল। গত বছর জুলাই মাসে দিনে একশো থেকে দেড়শ অর্ডার পড়ত। ‘রাজীবের জুতোয় তো দেখছি শ্যাওলা জমে গেছে! মনে হচ্ছে বহু বছর অর্ডার নেয়নি। হাউ মেনি অর্ডারস্ ডু উই হ্যাভ নাও?’
‘তি … তিনটে … না চারটে। রা … রাজুই নিয়ে বেরোবে। একটা বড় অর্ডার তৈরি হচ্ছে। সব একই রাস্তায়, তাই একসঙ্গে সব নিয়ে বেরোবে।’
রঞ্জন অফিসঘরে ঢুকে গেল।
‘শালা আমার চকচকে জুতো দেখিয়ে বলছে, রাজীবের জুতোয় শ্যাওলা জমেছে!’ অফিসঘরের দরজা বন্ধ হতেই মুখ ভেংচে বলল রাজু। ‘… কেন রে শুয়োরের বাচ্চা, আমাকে বসে থাকতে দেখলে তোর পাছা কুটকুট করে?’
‘চুপ চুপ। আস্তে। লোকটার পেছনে এভাবে গালি দিচ্ছিস কেন?’ সোনালী ফিসফিস করে বলল।
‘তাহলে কি লোকটার মুখের ওপর বলব? আপনি না একটা শুয়োরের বাচ্চা। … আর তুই ঘাবড়াচ্ছিস কেন? তোকে তো চোখের মণি করে রেখেছে। দেখলি না নতুন চশমার ফ্রেমটা নাচিয়ে দেখিয়ে দিল তোর নামের সঙ্গে রং মিলিয়ে ফ্রেম নিয়েছে। নিজে দেরী করে ঢুকবে আর আমাকে বসে থাকতে দেখে …’
‘রোজ আমাদের আগে ঢোকে। আজই শুধু …’
‘ইংরেজিতে কথা বলে আমাকে ছোট দেখানোর জন্য। যেন কিছু বুঝি না।’
‘তুই ইংরেজিটা একটু শিখে নিস না কেন? আর মনে রাখিস, আমাদেরটাই কিন্তু একমাত্র পিৎজা ডেলিভারি সেন্টার যেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজে। বাকি সব স্টোরে ইংরেজি ঝিন্চ্যাক।’
‘পথে এসো মামনি! চোখ থেকে নেমে এবার বসের কোলে বসার শখ হয়েছে। তাই তার হয়ে এত ওকালতি। বাঃ বাঃ! আপনি থাকছেন স্যার!’ দুবার নিঃশব্দে তালি বাজাল রাজু।
‘তোর কথাগুলো মাঝে মাঝে খুব কষ্ট দেয় রে। তোকে চিনেও চিনি না বলে মনে হয়।’
‘যাকে চিনলে কাজে লাভ দেবে, তাকে তো চিনে নিয়েছিস। ঠিক কি না?’
কখনো কখনো জটিল প্রশ্নের উত্তরটা প্রশ্নের থেকে সোজা হয়। কিন্তু প্রশ্নের চাপে সোজা উত্তরটা সোজা ভাবে দেওয়া হয়ে ওঠে না। সোনালী কিছু বলার আগেই পল্টুর ফোন এলো। ফোনটা রেখে কাউন্টার থেকে বেরিয়ে এসে রাজুর উলটো দিকে বসল সোনালী। ‘পল্টুর স্কুটার ব্রেকফেল করেছে। সারাতে সময় লাগবে। এখন তুই ছাড়া ডেলিভারির কেই নেই।’
মোবাইল ফোনে সিনেমাটা বন্ধ করে সোনালীর দিকে তাকায় রাজু, ‘কখনো ভেবেছিস, পিজ্জা অর্ডার দেওয়া আর ডেলিভারি করা — একই পৃথিবীর ভেতর দুটো সম্পূর্ণ আলাদা দুনিয়া? আরামসে টেবিলে তুলে রাখা পা, টিভির স্ক্রিনে ক্রিকেট, বন্ধুদের হইচই, লাভারের আদরে কুঁচকে থাকা বিছানার চাদর, ত্রিশ মিনিটে ডেলিভারি চাই, নইলে একটা পিজ্জা ফ্রি চাই — এটা হচ্ছে অর্ডার দেওয়ার দুনিয়া। আর ডেলিভারির দুনিয়াটা হচ্ছে — একজন পড়িমরি করে পিজ্জা নিয়ে ছুটছে, হাজার গাড়ির ভিড়ে এঁকেবেঁকে স্কুটার হাঁকাচ্ছে, একটু এদিক ওদিক হলেই ব্যাস … হয় সে শেষ, নয় অন্য কেউ! তারপর ঠিকানা খুঁজছে আর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে, ঠিকানা খুঁজছে আর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। এই মুহূর্তে আমি অর্ডার দেওয়ার দুনিয়ায় রয়েছি। যা পারিস করগে যা। আগে ৪৭-এর অর্ডার ঢুকবে, তারপর আবার তোদের দুনিয়ায় ফিরব। সামনে থেকে ফোট্ এবার।’
হঠাৎ সাঁ করে দরজা খুলে বেরিয়ে এল রঞ্জন। ‘আড্ডা হচ্ছে? চমৎকার! এদিকে সিস্টেম দেখাচ্ছে মোট চারটে অর্ডার পেন্ডিং! কীসের জন্য ডিলে হচ্ছে, সোনালী?’
‘স্যার। একজন … একজন কাস্টমার আছেন আমাদের, যিনি গত এক বছর ধরে প্রতিদিন … আই মিন … সত্যিই প্রতিদিন আমাদের কাছ থেকে পিজ্জা নিচ্ছেন। স্বদেশ অ্যাপার্টমেন্টস্, ফ্ল্যাট নম্বর ১৯-এর ৪৭। উনি চান রাজুই ডেলিভারি করুক। ওঁর অর্ডারটা ঠিক পাঁচটায় ঢোকে। সেটা এসে গেলেই রাজু বেরিয়ে পড়বে।’
‘হোয়াট ননসেন্স! উই কান্ট ইগ্নোর আদার কাস্টমারস জাস্ট টু মেক ওয়ান কাস্টমার হ্যাপি। রাজু, তুমি ইমিডিয়েটলি পেন্ডিং অর্ডার নিয়ে ডেলিভারিতে বেরিয়ে পড়ো। ৪৭ নম্বরের অর্ডার এলে, আমাকে ডেকে দেবে, সোনালী। আই উড লাইক টু গ্রিট হিম।’
‘না স্যার। ৪৭-এর অর্ডার না নিয়ে আমি বেরবো না।’ রাজু উঠে দাঁড়িয়ে জানাল।
কিছুক্ষণ স্তম্ভিত মুখ নিয়ে দাড়িয়ে রইল রঞ্জন, ‘প্রত্যেকের মতামত জানানোর বার্থরাইট আছে। তবে সেটা প্রয়োগ করতে গেলে, ওই যে দরজা দেখছ, ...’ বেরিয়ে যাওয়ার দরজাটা দেখিয়ে দিল রঞ্জন, ‘… আউটরাইট তার বাইরে বেরিয়ে গিয়ে করবে।’ কথাটা বলে ঘরে ঢুকে গেল রঞ্জন। দরজাটা ধড়াম করে বন্ধ হোল।
ভেতরে যে পিৎজ়া বানাচ্ছিল তার হাত চমকে দুটো বেশী কুক্কুটখণ্ড পতিত হোল গোধূমচূর্ণ-চক্রের বক্ষে। সোনালী একটা থামে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। বাইরে বৃষ্টি নেমেছে। দরজার কাঁচে বাষ্প জমছে। খিলখিল করতে করতে ঢুকল এক যুগল। মাস্ক ছাড়াই। লকডাউন শিথিল হলেও, রেস্তোরাঁয় যাওয়া এখনও বারণ। তাই অতিথিদের দেখে বেশ কিছুটা অস্বস্তির সঙ্গেই সোনালী বলল, ‘মাস্ক পরে নিন প্লিজ়। অ্যাজ় পার গাভ্মেন্ট লকডাউন পলিসি, আওয়ার ডাইন-ইন ইজ় ক্লোজ়ড। আমরা শুধু ডেলিভার করছি।’
মুখে মাস্ক চড়াতে চড়াতে যুগলের মেয়েটি বলল, ‘উই হ্যাভ নট কাম ফর ডাইন-ইন, ডিয়ার। আমরা বৃষ্টি দেখে ঢুকেছি, পিৎজ়া নিয়ে বেরবো। আমাদের অর্ডারটা নিন।’ সোনালী দুজনের সঙ্গে অর্ডার নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এসে বসে খাওয়া কিংবা এসে খাবার নিয়ে চলে যাওয়া দুটোই কি অবৈধ নয়? — মনে প্রশ্ন জাগলেও এড়িয়ে গেল। সোনালী বোঝে কাস্টমার ঈশ্বর আর ঈশ্বরকে প্রশ্ন না করাই বাঞ্ছনীয়। কেউ কেষ্ট ঠাকুরকে প্রশ্ন করে না এতগুলো গার্লফ্রেন্ড নিয়ে কী করেন!
রঞ্জন মিনিট পাঁচেকের মধ্যে বেরিয়ে এসে “রাজীব!” বলে চেঁচিয়ে কিছু একটা বলতে গেল। কাস্টমার দেখে, গলা নিচু করে রাজুকে ভেতরে ডাকল। ‘রাজীব, কাম ইন। সোনালী, হোয়্যার ইজ় পলাশ?’
সোনালী কিছুক্ষণ থতমত খেয়ে দাড়িয়ে রইল। তারপর উপস্থিত ক্রেতাদের থেকে যতটা সম্ভব গলা আড়াল করে বলল, ‘পলাশের স্কুটার ব্রেকফেল করেছে।’
রাজুকে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে রঞ্জন বলল, ‘অর্ডার হিস্ট্রি চেক করলাম। এটা সত্যি যে এক ভদ্রলোক, লকডাউনের দিনগুলো বাদে গত এক বছর ধরে রেগুলার পিৎজা অর্ডার করছেন। লকডাউনের পরেও সপ্তাহ দুয়েক টানা অর্ডার করে গেছেন। কিন্তু কোনও স্পেশাল ইন্সট্রাকশন দেননি যে তুমিই ডেলিভার করবে। ইন ফ্যাক্ট, বেশ কয়েকবার পলাশ গেছে। তাহলে তুমি আজ ওখানে ডেলিভারির জন্য এত হেল-বেন্ট কেন? লোকটার বউ না মেয়ে, কাকে মনে ধরেছে? পলাশের ব্রেকফেল, আর তোমার হার্টফেল? যদি সামান্য অসভ্যতার খবর পাই, তোমার এই চাকরিটা তো হারাবেই আর অন্য কোনও পিৎজ়েরিয়ায় তোমার যাতে কাজ না জোটে সেটাও আমি দেখব।’
একটা সময় রঞ্জনের ঘর থেকে বেরিয়ে এল রাজু। সোনালীর চোখ ধাওয়া করল তাকে। কিন্তু সামনের টেবিলে উপস্থিত কাস্টমারদের কথা মাথায় রেখে মনের প্রশ্নটা মুখে আনল না। চেঞ্জিং রুমে ঢুকে গেল রাজু। কিছুক্ষণ পর কোম্পানির উর্দিবিহীন বেরিয়ে এল। পিঠে কালো ব্যাকপ্যাক। দরজা খুলে রেস্তোরাঁ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে একবার ঘুরে তাকাল সোনালীর দিকে। বুড়ো আঙ্গুলটা গলার কাছে হালালের ভঙ্গিতে দুবার চালিয়ে, মুচকি হেসে বেরিয়ে পড়ল। পিছনে ক্যাঁচকোচ শব্দে দু তিনবার দুলতে দুলতে কাঁচের দরজাটা বন্ধ হোল। সোনালী দ্রুত দরজার কাছে এসে দেখল বৃষ্টিঝরা অকাল অন্ধকারে, উলটো ফুটপাথের এক চিনা রেস্তোরাঁর লাল নিওন বাতি গিলে নিচ্ছে রাজুর সিলুয়েট। ওদের রেস্তোরাঁর শেডে জলতরঙ্গের বদলে এখন পাগলপারা মাদল বাজছে। ছেলেটার মাথায় ছাতা নেই। চাকরি ছাড়া এবার ছাতটাও কি আর থাকবে?
রঞ্জন ঘরে ডাকল সোনালীকে। দরজাটা বন্ধ করে বলল, ‘পিৎজ়া ডেলিভারি ব্যবসায় রাজীবের মতো ছেলে আর ফায়ার অ্যালার্মে স্নুজ় বাটন একই ব্যাপার। ডিসগাস্টিং! কল দ্য কাস্টমারস্ অ্যান্ড অ্যাপোলোজাইজ় ফর ডিলে।’
‘কারণ কী বলব, স্যার?’
‘বলো “আমাদের ঘড়িটা লাঞ্চ ব্রেকে গেছে, ফিরলেই আবার ঘড়ি ধরে ডেলিভারি শুরু হবে!” … উফ্! একদিন কোভিডের ভ্যাক্সিন বেরোবে, স্টুপিডিটির ভ্যাক্সিন যে কবে বেরোবে কে জানে? ...’ এরপর ঝেঁঝে বলল, ‘বাইরে ঝম ঝম করে কীসের শব্দ হচ্ছে? বলে দাও সেটার জন্য ডিলে।’ সোনালী বেরোতে যাচ্ছিল, রঞ্জন কিছুটা কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘বাই দ্য ওয়ে, ছেলে এখন কেমন? জ্বর কমেছে? না কমলে আরটিপিসিআর টেস্ট করিয়ে নাও।’
‘হ্যাঁ জ্বর নেমেছে।’
‘আকাশ খবর নেয় ছেলের?’
সোনালী মাথা নিচু করে প্রশ্নটা এড়িয়ে যায়। রঞ্জন ঠোঁটের বাঁদিকে হাল্কা হাসি চড়িয়ে বলে, ‘নতুন করে জীবন শুরু করার কথা ভাবো। জীবনে তো অনেক কিছুর প্রয়োজন থাকে। আকাশ ইজ় হিস্ট্রি নাও।’ দরজায় দাঁড়িয়ে সোনালী ঠোঁট কামড়াচ্ছে দেখে রঞ্জন বলল, ‘দাঁড়িয়ে থেকে এই ঘরের অক্সিজেনে ভাগ বসিও না। কাস্টমারদের কল হয়ে গেলে, কল আপ পলাশ অ্যান্ড আস্ক হাউ’জ় সিচুয়েশন। মেক থিংগস মুভ।’
রাজুর হয়ে কিছু একটা বলতে ইচ্ছে হলো খুব। কিন্তু একা একা সন্তান মানুষ করার একমাত্র সহায় এই চাকরিটা। চাকরিটা গেলে শহরের নেকড়েরা ওঁত পেতে আছে। রঞ্জন স্যারের ইঙ্গিতপূর্ণ কথাগুলো তাদের সামনে ছাগশিশু।
স্বদেশ অ্যাপার্টমেন্টসের গলিটার সঙ্গে তার চাকার পরিচয় বহুদিনের, জুতো জোড়ার পরিচয় হোল আজ। হ্যালোজেন বাতির আলোয় বৃষ্টির আঁচড় কমেছে। রাস্তার গর্তে জমা জলে যেটুকু আঁকিবুঁকি সবটুকুই গাছের পাতা থেকে ঝরা জলের। গেটে সিকিউরিটি আটকাল, ‘কী রে তোর পিজ্জার থোলে কই? স্কুটার কই? পুরো বৃষ্টিটা তো দেখছি তুইই গায়ে, মাথায় নিয়েছিস। তাই ভাবি, বৃষ্টি হচ্ছে অথচ রাস্তা শুখন।’ তিনজন সুরক্ষা কর্মী আর রাজু মিলে এক চোট হেসে নিল।
‘আসিফদা, আজ ডেলিভারির জন্য আসিনি।’ ঠাণ্ডা হাওয়ায় কিছুটা কাঁপুনি লাগছে শরীরে। গলাটা কেঁপে গেল।
‘দাঁড়া, চা খেয়ে যা। ফ্লাস্কে এখনও কিছুটা আছে। কিন্তু কোন ফ্ল্যাটে যাবি?’
’১৯-এর ৪৭। চা এখন থাক।’
চমকে তাকালেন আসিফ। গুমটির পিছন দিকে আর এক কর্মী হাঁড়িতে রান্না চড়াচ্ছিল, সাঁ করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। তারপর উনুন ছেড়ে উঠে কিছুটা দ্রুত পায়ে সেঁধিয়ে গেল আরো ভেতরের দিকে। সিকিউরিটি গুমটি থেকে বেরিয়ে এলেন পঞ্চাশ পেরনো আসিফ। আজ বিশ বছর এই আবাসনের দ্বাররক্ষী। রাজুর সামনে এসে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘হঠাৎ ১৯-এর ৪৭ কেন? তার ওপর ডেলিভারি ছাড়া?’
পাশ থেকে তৃতীয় রক্ষী সুখদেব ভাঙ্গা বাংলায় বলল, ‘বিনা ডেল্ভারি এমনি ঘুসে যাবি? পার্মিসন লাগবে।’
‘সুখদেবদা, স্যারকে ফোন করে বলুন রাজু দেখা করতে চাইছে।’ রাজু জামা থেকে জল ঝাড়তে ঝাড়তে বলল।
‘চেয়ারম্যানের পার্মিসন নিতে হবে।’ কথাটা বলে সুখদেব ইন্টারকমের দিকে এগিয়ে গেল।
‘চেয়ারম্যানের! কেন? আমি তো যাব ১৯-এর ৪৭। হঠাৎ চেয়ারম্যান কেন? বাকি সবার জন্য তো ফ্ল্যাটের মালিককে ফোন করছেন।’
ততক্ষণে চেয়ারম্যানের নম্বর ডায়াল করতে শুরু করেছে সুখদেব। আসিফ গিয়ে ফোনটা কেটে দিল।
‘রাজুকে যেতে দে। রাজুকে সবাই চিনি। আগেরজনের মতো সাংবাদিক নয়।’
সুখদেব ফিসফিস করে বলল, ‘চেয়ারম্যান সাহেব কিন্তু বলেছেন, উনসে বিনা পুছে যেন কোঈ ভি উন্নিস বটা স্যায়তাল্লিস যেতে না পারে। কোনও সাংবাদিক যে রাজুকে ভেজেনি উসকা কওন গ্যারান্টি দেগা?’
‘আমি দিচ্ছি।’ আসিফ জানালেন।
সুখদেব চোখ ছোট আর চোয়াল শক্ত করে বলল, ‘সে তো আপনি দিবেই। আসলে আপনিও চান হমলোগোঁকা বদনামি হো।’
‘হমলোগ মতলব?’ আসিফ জিজ্ঞেস করল। রাজুর মনে হোল আসিফের গলায় যেন বেশ কিছুটা রাগ খেলা করে গেল।
‘জানে দিজিয়ে না আসিফ ভাই। আপকো ভি পতা হ্যায়, হমে ভি।’ সুখদেব আসিফের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে বলল।
আসিফের অনুমতি পেতেই ডি ব্লকের দিকে এগিয়ে পড়ল রাজু। ক্যাম্পাসের বাঁধানো রাস্তা আজও নিস্তরঙ্গ। নিঃসঙ্গ টেনিস কোর্টে হলদে আলো, একলা হয়ে যাওয়া সবুজ নেট। সেই মার্চ থেকে ফাঁকা পড়ে থাকা বাস্কেটবল কোর্টের গায়ে বর্ষার শ্যাওলা। আগে যখন রাজু বিকেলের দিকে আসত, সারা ক্যাম্পাস জুড়ে যেন মেলা লেগে থাকত — ফুটবলের মাঠ, চিল্ড্রেন্স পার্ক — আজ সেখানে মেলা নেই, সকাল হতেই যেন বেলা শেষ।
১৯ নম্বর বিল্ডিঙ্গের চার তলাটা অন্ধকার। ল্যান্ডিং-এর আলো জ্বালানো হয়নি এখনো। ওপর আর নিচ তলা থেকে টিভির শব্দ ধার করে চলছে দুনিয়ার সঙ্গে তার নিজেকে অবিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা। সান্ধ্য সংবাদে বিতর্কের নামে বিভেদ বাড়ান আগুন ছড়াচ্ছে সঞ্চালক। বেল বাজাতে দরজার ওপাশে দূর থেকে হাওয়াই চপ্পলের থপথপ একটা শব্দ এগিয়ে আসতে লাগল। সলওয়ার কামিজ় পরিহিত ছিপছিপে চেহারার বয়স্কা এক মহিলা দরজা খুললেন। ওড়নাটা হিজাবের মতো মাথায় জড়ান। মুখে মাস্ক। তবু রাজু চেনে এঁকে।
‘সেলাম আলেকুম, মাসিমা। কেমন আছেন?’ রাজু খুব নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল মহিলাকে।
মহিলা দরজা থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির আলো জ্বালিয়ে মাস্কের আড়ালে রাজুর চোখদুটো ভালো করে দেখলেন। খুব ধীরে ধীরে নিচু স্বরে বললেন, ‘রাজু বেটা! ওয়ালেইকুম আস্সালাম। কিন্তু আজ তো কোনও পিজ্জার অর্ডার ছিল না!’
হাতে গরম পিৎজ়ার বাক্স ছাড়াও যে তার একটা পরিচয় আছে, সেটা ভেবে রাজু অস্বস্তিতে পড়ল। হোঁচট খেতে খেতে বলল, ‘না … পিজ্জা দিতে আসিনি। … খবর নিতে এসেছি। … আজ বাইশ দিন হয়ে গেল স্যার কোনও অর্ডার প্লেস করেননি। … গত এক বছর ধরে টানা … তারপর হঠাৎ … উনি ভালো আছেন তো? … ব্যস এটুকু জেনেই আমি চলে যাব। … আপনাদের সময় নষ্ট করব না।’
মহিলা রাজুকে আন্তরিক কণ্ঠে ডাকলেন, ‘ভেতরে এসো।’
‘আমি পুরো ভিজে গেছি। … তার ওপর এখন এই করোনা চলছে … আমি বাইরেই থাকছি। রহিম স্যার ভালো আছেন জেনেই চলে যাবো।’
‘আর ভালো নেই জানলে ভেতরে ঢুকবে তো?’ চশমাটা ঠিক করতে করতে বললেন মহিলা। প্রশ্নটার আকস্মিকতায় চমকে গেল রাজু। ভিতরে ঢোকা নিয়ে আরো সংশয় জাগল মনে। ‘ভয় নেই, করোনার জন্য মানুষের বাকি রোগগুলো ছুটি নেয়নি।’
রাজুকে নিয়ে গিয়ে বসার ঘরে বসালেন মহিলা। ছিমছাম আসবাবের ঘর। অস্তরাগের দেওয়াল জুড়ে ফ্রেমে বাঁধানো স্মৃতির মেলা আর সেই মেলায় সবচেয়ে জ্বলজ্বল করছে খুব সুপুরুষ একটা মুখ। ঠিক যেন শাহরুখ খান! সব ছবিতেই তার গায়ে মিলিটারি উর্দি। আর উদয়পথের দেওয়াল জুড়ে ঢাউস বইয়ের আলমারি। এত বই কোনোদিন একসঙ্গে দেখেনি রাজু। রাণাঘাটে পৈতৃক ভিটেই হোক, বা রথতলায় তার এক চালার চিলেকোঠাই হোক, মানুষ থাকা বাড়িতে এত বড় দেওয়াল দেখাও এই প্রথম। অপর্যাপ্ত আলোয় কুণ্ঠিত হয়ে বসে রইল রাজু। ঘরের বাইরে স্প্রে দেওয়ার সোঁ সোঁ শব্দ হোল।
কিছু পরে মহিলা এসে ডেকে নিয়ে গেলেন রাজুকে। ভিতরের এক ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আঙ্গুল দিয়ে বিছানার দিকে দেখালেন। হাসপাতালের মতো স্টিলের বিছানা। অক্সিজেন যন্ত্রের সাঁই সাঁই শব্দ। অন্ধকার ঘরে নানান্ যন্ত্র-আলোর লাল সবুজ জোনাকি। হাজার নলের জালে শরীর ডুবিয়ে শুয়ে আছেন রহিম সাহেব। চন্দন গন্ধের স্প্রের আড়ালে অসুখের গন্ধটা ঢাকা যাচ্ছে না। ‘আজ দিন দশেক কোনও সাড় নেই। টয়লেটের ওপর কন্ট্রোল নেই। এক স্ট্রোকেই হয়ত সময় হয়ে এল। … তুমি নিজেদের কেউ না হয়েও ওঁকে দেখতে এলে, সেটা বোঝার ক্ষমতা থাকলে উনি খুব খুশি হতেন।’
মনের মধ্যে বলার মতো কথা হাতড়াতে লাগল রাজু। এই দুনিয়াটা কীসের? পিজ্জা অর্ডার দেওয়ার না ডেলিভারির?
‘কী হয়েছিল?’
মহিলা স্বামীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন ফ্যালফ্যাল করে। তারপর অস্ফুট স্বরে বললেন, ‘চলো বাইরের ঘরে গিয়ে বসো। চা দিই?’
সামান্য হ্যাঁ না কিছুই বলে উঠতে পারল না রাজু। মহিলার পিছন পিছন গিয়ে আবার বাইরের ঘরে বসল।
‘চা নয় মাসিমা। আমি চা খাই না।’ এত বড় মিথ্যে কথাটা সত্যি হলে ওদের পিৎজ়েরিয়ার ডান দিকের চায়ের দোকানটার এতদিনে উঠে যাওয়ার কথা। ‘একটু জল দেবেন।’ জীবনে এত বড় তেষ্টাও এই প্রথম।
মহিলা জল নিয়ে ফেরার পর রাজু প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি ঘটাল না। ‘হাসপাতালে ভর্তি করেননি? …’
‘করোনা পেশেন্টদের চাপে, প্রথমে বেড পাওয়া যায়নি। তারপর হাসপাতাল থেকে হোম কেয়ারের ব্যবস্থা করে দিল। একজন নার্স থাকছে রাতে। করোনার সময় যতটা পারছি নিজে করে নিচ্ছি। বাকিটা উপরওয়ালার মর্জি।’
‘ওঁর হায়দ্রাবাদের ভাইজান, যিনি পিজ্জা ডেলিভারির ছোকরা দেখলেই লাঠি নিয়ে তেড়ে যান, উনি আসবেন না?’
মহিলা মৃদু হাসলেন, ‘যাকে ভালোবেসে লাঠি নিয়ে তেড়ে যাওয়া, সেই বিরিয়ানির দোকানই আজ কত মাস বন্ধ। ব্যবসা বন্ধ, প্লেন বন্ধ, ট্রেন বন্ধ, সব বন্ধ। উনি আসবেন কী করে?’
পরের পাঁচ মিনিট গ্লাসের চুমুকে থমকে রইল সময়। একটা সময় উঠে দাঁড়াল সে, ‘মাসিমা। আজ আসি? যদি আপনাদের কোনও কাজে লাগতে পারি জানাবেন। দুবার ভাববেন না।’
‘ভাববো না ভাই। উনি বলতেন রাজু পিজ্জা নিয়ে আসে না, এক বাক্স খুশি নিয়ে আসে। খালি হাতেও খুশি নিয়ে আসা যায়, তোমার মতো মানুষ সেটা বারবার মনে করিয়ে দেয়।’
কথাটা শুনে দরজার কাছে ঘুরে দাঁড়াল রাজু। প্যাসেজের শেষে রহিম সাহেবের দরজার দিকে শেষ বারের মতো তাকিয়ে বলল, ‘সেই এক বাক্স খুশিই কি স্যারের ক্ষতি করল না? এই বয়সে দিনের পর দিন পিজ্জা। কেউ স্যারকে বারণ করল না? … আমিও ব্যবসার লোভে …’
মহিলা মৃদু হেসে বললেন, ‘নিজের জন্য কোনওদিন কোনও পিজ্জা অর্ডার করেননি।’
রাজু আশ্চর্য চোখে জিজ্ঞেস করল, ‘তাহলে, কার জন্য?’
‘আবার একদিন এসো ভাই। উনি থাকুন, না থাকুন এসো।’ আবার রাজুর প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেন মহিলা।
লিফটে চড়ার ধৈর্য রইল না রাজুর। ছুটে ছুটে চার তলা থেকে নেমে দ্রুত পৌঁছে গেল গেটে। আসিফ ভাইয়ের জন্য অনেক প্রশ্ন জমা রয়েছে মনে।
সুখদেব কড়া গলায় বলল, ‘অওর জরাসি দের হো যাতি তো হম চেয়ারম্যান সাহাবকো ফোন কর দেতা। এক বাত বতা, রাজু। তুই এপাড়ের আছিস, না বংলাদেসের আছিস? এমন রাজু নাম নিয়ে বহোত বঙ্গালী আছে, যারা আসল মেঁ ওপাড়ের মুসলিম আছে।’
রাজু হকচকিয়ে গেল, ‘এ আবার কী ফালতু বাত, সুখদেবদা?’
‘দে-খা করা হয়ে গেছে। এবার আয়। পরের বার পিজ্জা ছাড়া আসলে ঘুসতে দেব না।’
অপমানে কানের কাছটা গরম হয়ে গেল রাজুর। কিন্তু কিছু বলার আগেই, আসিফ এগিয়ে এলেন।
‘দেখা হোল। কেমন আছেন দেখলি?’
মাথায় অপমানের জট কাটিয়ে, মুখে উত্তর জোটাতে সময় লাগল রাজুর, ‘ভালো নেই। সাড় নেই। এরকম হোল কী করে? কবে হোল?’
সুখদেব এগিয়ে এসে রাজুর কাঁধে বাঁ হাতটা রাখল, ‘আমার বাংলা বুঝতে অসুবিস্তা হচ্ছে? কাজ হয়ে গেছে। আগে বঢ়। ইতনে সারে সওয়াল কিঁউ ভাই?’ মৃদু হলেও কাঁধে একটা ধাক্কাও অনুভব করল রাজু।
‘কাঁধ থেকে হাত নামান। শেষ যে আমার কাঁধে এভাবে বাঁ হাত রেখেছিল, সে এখন ডান হাতেই ছোঁচায়, ডান হাতেই ভাত খায়।’ কথাটার মধ্যে মাস্তানির সুরটা এমন মাত্রায় ছিল, সুখদেব হাত নামিয়ে নিল। আসিফ রাজুকে নিয়ে গেটের বাইরে গিয়ে দাঁড়াল।
‘মাথা গরম করিস না, চল তোকে কিছুটা এগিয়ে দিই। নে, একটা সিল্ক কাট ধরা।’ আসিফ হেসে এগিয়ে পড়ল রাজুকে সঙ্গে নিয়ে।
‘রহিম সাহেব আর ওঁর স্ত্রী একলা থাকেন। ছেলে কাজ করত মিলিটারিতে। সোলজার নয়, ইঞ্জিনিয়ার। বছর ছয়েক আগে কাশ্মীরে টেররিস্টদের অ্যাটাকে ওদের ক্যাম্পে সবাই মারা যায়। যেদিন ওঁর ছেলের বডি আনা হয়, গোটা ক্যাম্পাস স্যালুট জানাতে নিচে নেমেছিল। বুড়ো বুড়ি ভেঙ্গে পড়েন। রহিম সাহেবের হায়দ্রাবাদের ভাই এসে নিজের কাছে নিয়ে যান। কিন্তু যেখানে ছেলের ছোটবেলা কেটেছে, সেই শহর, সেই আবাসন কি ছেড়ে যাওয়া সোজা রে ভাই? দু মাস পরেই ফিরে আসলেন দুজন। পূরবী ম্যাডাম বলে একজন এখানে থাকেন। তাঁদের জীবনটাও কিছুটা একই রকম। ছেলে আমেরিকা গিয়ে বাবা মায়ের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখে না।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে আসিফ। পাশ দিয়ে হর্ন বাজিয়ে চলে যায় একটা লরি।
‘পূরবী ম্যাডামের কথায় ওঁরা মন খারাপের ডাক্তার দেখান। তারপর থেকে ক্যাম্পাসের বাচ্চাদের সঙ্গে লেগে পড়েন রহিম সাহেব। পুজো কমিটি, স্পোর্টস ডে, রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধে সব কিছু ওঁর ঘাড়ে। তাতেও মন ভরে না। প্রতিদিন বিকেলে তোর এনে দেওয়া পিজ্জা নিয়ে বাচ্চাদের খেলার মাঠে চলে যাওয়া শুরু হয়। রেফারি সেজে হাতে বাঁশি, পায়ে কাদা — মাঠেই নেমে পড়তেন। সুখদেব আর আমি কতবার বারণ করেছি। হাই প্রেশারের রুগী। কী ক্যাচাল হয়ে যায়। খেলা শেষে সবাই দৌড়ে এসে ওঁর কাছ থেকে এক টুকরো পিজ্জা খেয়ে বাড়ি ফিরবে। যারা হাত না ধুয়ে পিজ্জায় হাত দেবার চেষ্টা করবে, তাদের নিজের হাতে খাইয়ে দেবেন রহিম সাহেবের স্ত্রী। এটা একদম রুটিন হয়ে গেস্লো। পিজ্জা খেতে খেতে খিলখিল করে ছেলেমেয়েদের সে কী হাসি! এই বয়েসে হাসির তো কারণের দরকার হয় না। আর হাসির সঙ্গে গপ্পো। কে স্কুলে মাঝে মাঝেই ফাইভটাকে উলটো করে লিখছে বলে একটা মোটা টাইপের টিচার বলেছে “ঈশ্বর আমাকে তুলে নাও” আর সেই শুনে মেয়েটা বলেছে “তাহলে ঈশ্বর ভারোত্তোলনে গোল্ড মেডেল পাবে”। কে গানের ক্লাসে কাকুর কাছে শেখা “ভিগে হোঁঠ তেরে” গেয়েছে বলে টিচার হেঁচকি তুলতে তুলতে ক্লাস ছেড়ে পালিয়েছে। গল্পের যেন কোনও শেষ নেই। … খেয়াল করে দেখবি, এই বয়েসে সবাই গল্প বলে আর বড় হলেই গল্প ব্যবহার করে।
‘লকডাউনের সময় খেলাধুলো বন্ধ হোল। গল্পের নটেগাছগুলি মুড়োল। রহিম সাহেবের ছটফটানি বাড়ল। গেটে এসে আমাদের সঙ্গে গল্প জুড়তেন। বন্ধ গেটে থুতনি ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন দূরের দোকানগুলোয় আলো জ্বলছে কি না দেখার জন্য। ছাপরা জিলায় সুখদেবের পরিবারের খবর নিতেন। লকডাউন কম হতেই আবার ছেলেপুলেরা মাস্ক বেঁধে নেমে পড়ল মাঠে। আবার তোর পিজ্জা আসা শুরু হোল। কিন্তু হঠাৎ হপ্তা তিনেক আগে সব বন্ধ হয়ে গেল।’
‘স্ট্রোক হয়ে গেল?’
‘না রে। আগে সব বন্ধ হোল, তারপর স্ট্রোক।’
‘কেন বন্ধ হোল?’
থমকে দাঁড়ালেন আসিফ। রাজুর দিকে ভালো করে তাকালেন। ‘হোয়াটস্অ্যাপ্ করিস?’
‘হ্যাঁ।’
‘ভিডিও এলে ফরোয়ার্ড করিস?
‘হ্যাঁ।’
‘একবার যাচাই করিস, সত্যি না মিথ্যে?’
‘না। আমার কি আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, মাইরি? মজা করার জন্য ভিডিও আসছে, যাচ্ছে। আপনি যাচাই করেন?’
আসিফ কিছুক্ষণ ভাবলেন, ‘না রে আমিও করি না। কী করে করব সেটাই তো জানি না। তাই ফরোয়ার্ড করাই ছেড়ে দিয়েছি। একটা ভিডিও এসেছিল। দাড়িওয়ালা মুসলমান একজন ফলের গায়ে থুতু দিয়ে ভাইরাস লাগাচ্ছে। সেটা ফরোয়ার্ড করেছিলি?’
‘হ্যাঁ। অনেককে। লোকটার ওপর হেব্বি রাগ হয়েছিল। মনে হয়েছিল দিই শালার কানের গোড়ায়।’
‘তোর লোকটার ওপর রাগ হয়েছিল, অনেকে পুরো জাতটাকে সন্দেহ করেছিল। আরো অনেক ভিডিও এসেছিল। একজন থালা চাটছে যাতে করোনা ছড়ায়। কয়েকজন লোক একসঙ্গে হাঁচছে যাতে করোনা ছড়ায়। এরকম অনেক কিছু। পরে তো সব ভুয়ো প্রমাণ হোল। ওই ফলওয়ালা টাকা গোণার মতো থুতু লাগিয়ে ফল গুনছিল। তাও মার্চের অনেক আগে। মালটাকে ওই জন্য পুলিশেও ধরেছিল। একটা উজবুকের জন্য আমরা সবাই খারাপ?’
‘আমি সব কটা ভিডিও ফরোয়ার্ড করেছিলাম।’
‘ওই লোকগুলো যদি হিন্দু হতো আমিও করতাম। আমরা এমনই। অন্য জাত মানেই বজ্জাত! তাদের সম্পর্কে সব খারাপ কথা বিশ্বাস করা যায়। সেই বিশ্বাসটা করোনার থেকেও ভয়ানক।’
‘আমি এখনো বুঝতে পারছি না এর সঙ্গে রহিম স্যারের স্ট্রোকের কী সম্পর্ক?’
‘একদিন খেলাশেষে সব কটা বাচ্চা পিজ্জা না খেয়ে দৌড়ে মাঠ ছেড়ে পালিয়ে গেল। পরের দিনও তাই। তার পরের দিনও। সুকান্ত স্যারের ছেলে রনিকে ধরলেন উনি। “রহিম আঙ্কেল, বাবা তোমার হাত থেকে খাবার নিতে বারণ করেছে।”’
রাস্তায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল রাজু। আসিফ কয়েক পা এগিয়ে গিয়েও ফিরে এল। পাশের ঝোঁপে ঝিল্লি ডাকছে। একজন ট্রিং ট্রিং করে সাইকেলের বেল দিয়ে চলে গেল পাশ কাটিয়ে।
‘হোয়াটস্অ্যাপের ভিডিও দেখে!’ রাজুর গল্পটা কেমন যেন বিশ্বাস হোল না। জ্বলন্ত সিগ্রেটের বাকিটা রাস্তার ধারে ছুঁড়ে দিল। ছোঁক শব্দে সেটা নিভে গেল।
‘হ্যাঁ। তারপর কানাঘুষোয় শুনতে পেলেন ক্যাম্পাসের বাকিরা ওঁদের ভয় পাচ্ছে। নতুন চেয়ারম্যান মিষ্টি করে বারণ করে দিলেন বাচ্চাদের এভাবে পিজ্জা খাওয়াবেন না। আমাদের ক্যাম্পাসের জন্মদিনে খুব খাওয়া দাওয়া হয়। রহিম সাহেবকে ফুড কমিটি থেকে সরিয়ে দেওয়া হোল। সুখদেবও ভিডিও দেখার পর কেমন যেন হয়ে গেল। আগে রহিম সাহেব বাজার করে ফিরলেই, হাত থেকে থলে কেড়ে নিয়ে লিফট্ অবধি পৌঁছে দিত। সব বয়স্কদের জন্যই এটা করত। সুখদেবের মনটা তো খারাপ নয়। কিন্তু মুখ্যু মানুষের মনে সন্দেহ ঢুকলে মানুষটাই বিষিয়ে যায়। হঠাৎ রহিম সাহেবের থলে বয়ে দেওয়া বন্ধ করে দিল। আমার সঙ্গে ‘আমরা’ ‘তোমরা’ শুরু করে দিল।
‘হাসপাতালে স্যালাইন দেওয়া দেখেছিস? বাচ্চাদের ওই আল্টুস ফাল্টুস গল্পগুলো, ওই হাসিগুলো রহিম সাহেবদের সংসারে স্যালাইন যুগিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ করে সেটার তার কেটে দিলে যা হয়, তাইই হোল। ওঁর স্ত্রী যখন গেটে আমাদের জানালেন ওঁর স্ট্রোক হয়েছে, বোর্ডকে জানানোর পরেও কেউ এগিয়ে এল না রে রাজু। সব ফোনে ফোনে কথা হোল। হাসপাতালে বেড পেলেন না। পূরবী ম্যাডামের হেল্প নিয়ে বাড়িতে হাসপাতাল সাজিয়ে দিয়ে গেছে। খুব খরচা। পয়সার অভাব নেই, তাই চালাতে পারছেন। এই ঘটনা নিয়ে একজন রিপোর্টার লেখালেখিও করল। ওই যে মোবাইলে দেখা যায় শুধু, এমন কাগজ হয় না, সেমনি একটাতে। তাই ৪৭ নম্বর নিয়ে চেয়ারম্যান সাহেবের এতটা বাড়াবাড়ি।’
‘আসিফদা, খাবারেরও ধর্ম হয়? আমার কাছে তো শালা খাওয়াটাই ধর্ম। আমি তো মন্দিরের থেকে বেশি গেছি দীপুদার দোকানে। ফিশ ফ্রাই খেতে। এবার থেকে কি আমের দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করব আপনার ল্যাংড়া হিন্দু না মুসলমান? চালের দানায় দানায় উল্কি করা থাকবে চাষির নাম? আমাদের যে পিজ্জা বানায় তার নাম জানেন? লোকটার নাম তারিক শেখ। এমন চুপচাপ মানুষ দেখিনি মাইরি। আমাদের হারামি বসের সাত চড়ে রা কাটে না। ওর নাম জানতে পারলে এই ক্যাম্পাসের সবাই আমাদের কাছ থেকে পিজ্জা নেওয়া বন্ধ করে দেবে? সবাই যে নুরজাহান কোম্পানির হাণ্ডি বিরিয়ানি খাচ্ছে এত, ওদের বিরিয়ানি বানানো লোকটা আমার দোস্ত - নাম রহমান। তাহলে এই ক্যাম্পাসের লোক বিরিয়ানি খাওয়া বন্ধ করে দেবে?’
‘যখন ভিডিও ফরোয়ার্ড করিস, এই দোস্তদের কথা মাথায় থাকে?’
স্বদেশ অ্যাপার্টমেন্টসের গলিটা ছেড়ে বড় রাস্তায় এসে পকেট থেকে সেলফোনটা বাড় করল রাজু। প্লাস্টিকের ব্যাগ পরিয়ে রেখেছিল। সাইলেন্ট মোডেও রেখেছিল। চাকরিটা যাওয়ার পর আর কারোর সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে হয়নি। কল লিস্টে চোখ রেখে দেখল সোনালী, পলাশ আর রঞ্জন স্যারের গুচ্ছ গুচ্ছ কল। একবার ফিরে গিয়ে দেখতেই হচ্ছে কী আগুন লাগল।
রেস্তোরাঁয় ফিরতে সন্ধে সাতটা বেজে গেল। এসির হাওয়ায় ভেজা জামায় হুল ফুটতে লাগল। ওকে দেখেই সোনালী চেঁচিয়ে উঠল, ‘কী রে, কোথায় ছিলি? সবাই মিলে তোকে ফোন করছি। এর মধ্যে বারোটা অর্ডার ঢুকেছে। পল্টু তো পাগল হয়ে গেছে ডেলিভারি করতে করতে।’
পলাশও ছিল ভেতরে। বলে উঠল, ‘শালা, ইচ্ছে করছে তোর পাছায় চার লাথি লাগাই। রঞ্জন স্যারও তোকে বারবার ফোন করেছে। কোন চুলোয় মরতে গেছিলি?’
‘কেন বাল? রঞ্জন স্যার আমাকে ফোন করছিল কেন? চাকরি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর, কে কাকে কোন পিজ্জা ডেলিভারি করবে, সে নিয়ে আমি মাথা ঘামাব কেন?’
বাইরে শোরগোল শুনে দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছে রঞ্জন, ‘চাকরি থেকে তাড়িয়ে দিয়ে মানে? তোমায় চাকরি থেকে কে তাড়াল?’
‘কেন আপনি?’
‘হোয়াট ননসেন্স!’
‘আপনি তো আমাকে ফায়ার করে দিলেন।’
‘ওহ মাই গুডনেস। আমি তোমার অ্যাংরি ইয়াং ম্যান রূপ দেখে বলেছিলাম “ইট সিম্স ইউ আর ওন ফায়ার”। তোমাকে আমি “ফায়ার” করিনি। বাই জোভ, একটু ইংরেজিটা শিখে নিতে কী হয়? কিন্তু মরতে গেছিলে কোথায়?’
রঞ্জনকে পুরো ঘটনা জানানোর পর রাজুর খুব আফসোস হলো তারিকের প্রসঙ্গটা কেন বলতে গেল সে। ব্যবসার জন্য সব কিছু পারে রঞ্জন স্যার। অত বড় একটা কমপ্লেক্স ওদের কাছ থেকে পিৎজ়া নেওয়া বন্ধ করতে পারে, সেই সন্দেহটুকু হলেই নির্বাক তারিকের চাকরি যাওয়া শুধু তারিখের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।
রঞ্জন একটা থামে হেলান দিয়ে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ব্যাপারটা ভাবাচ্ছে।’
পলাশ পাশ থেকে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, ‘তুই ওদের সিকিউরিটিকে তারিকের কথা বলতে গেলি কেন? এখন ওরা যদি আমাদের কাছ থেকে পিজ্জা নেওয়া বন্ধ করে দেয়।’ তারিক তখনও রোবটের ভঙ্গিতে পিৎজ়া চড়িয়ে চলেছে ইলেকট্রিক চুল্লিতে।
রাজু প্রমাদ গুনল। রঞ্জন সোনালীর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘চাইনিজ় ভাষায় ক্রাইসিসকে কী বলে জানো?’
সবাই মাছি গেলা হাঁ করে তাকিয়ে রইল রঞ্জনের দিকে।
‘আমি মড়া কেন যে এখানে কাজ করছি!? ইংরেজিই চিনে উঠতে পারল না, তাদের চিনা ভাষা নিয়ে জিজ্ঞেস করছি! যাইহোক, চিনা ভাষায় ক্রাইসিসকে বলে “ওয়েই জি”। “ওয়েই” মানে বিপদ। “জি” মানে ঘুরে দাঁড়ানোর সময়। অর্থাৎ বিপদের মধ্যেই রয়েছে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ। আমাদের আর কিছু করার নেই, সোনালী! তারিককে নিয়ে অন্য কিছু ভাবতেই হবে। আমাকে তিনজনের ছবি পাঠাও। তারিক, রাজীব আর রাফ্ফায়েলে এস্পোজ়িতো।’
সোনালীর প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা, ‘তারিক আর রাজীব বুঝলাম। রাফ্ফায়েলে আমাদের কোন ডাইন-ইনে কাজ করে, স্যার?’
‘রাফ্ফায়েলে আমাদের সব ডাইন-ইনেই বিরাজ করেন। পিৎজ়া বহু প্রাচীন এক খাদ্য। কিন্তু মডার্ন পিৎজ়ার জনক এই রাফ্ফায়েলে এস্পোজ়িতো। যে বছর আমাদের দেশে মোহন বাগানের জন্ম, সে বছরে ইতালির নাপোলিতে আধুনিক পিৎজ়ারও জন্ম। আমাদের যিনি বাক্স ডিজ়াইন করেন, তাঁকে বলো এবার থেকে আমাদের বাক্সের গায়ে এই তিনজনের ছবি থাকবে আর লেখা থাকবে — “দ্য ইউনাইটেড পিৎজ়া অফ ইন্ডিয়া – ড্রেমট্ বাই আ ক্রিশ্চিয়ান, বেক্ড্ বাই আ মুসলিম অ্যান্ড ডেলিভার্ড্ বাই আ হিন্দু।”’