পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

এসআইআর-এর অগস্ত্যযাত্রা

  • 14 November, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 420 view(s)
  • লিখেছেন : মনসুর মণ্ডল
যারা এই নথির গাড্ডায় পড়বে, তাদের একটি বড় অংশের, যার মধ্যে সিংহভাগ মহিলা, ধরাছোঁয়ার মধ্যে সেসব নথি নেই। এই বিষম পরিবেশে এর দায় ভোটারদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নির্বাচন কমিশন নাগরিকত্বের কষ্টিপাথরে ভোটাধিকারের পবিত্রতা বিধানে নেমেছে। নথিপত্রের সমস্যা আদৌ ব্যক্তিগত ঘাটতির বিষয় নয়, সমস্যা কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক, যাতে বাস্তবিক ভুক্তভোগী ভোটারদের হাত নেই।

বিহারে এসআইআর-এর নখ-দাঁত প্রদর্শনের পর পশ্চিমবঙ্গ সহ বারোটি রাজ্যে এসআইআর করার নির্ঘণ্ট এসে গেল। বিহারে এসআইআর-এ যত সংখ্যক ভোটারের নাম বাদ যেতে পারে বলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি আশঙ্কা করেছিল, তার অনেকটাই মিলে গেছে। প্রায় পুরোটাই মিলে যেত; বিরোধীরা তেড়েফুঁড়ে পথে নেমে পড়তেই নির্বাচন কমিশন তার বজ্র আঁটুনি কিছুটা শিথিল করতে বাধ্য হওয়ায় একাংশ ভোটাররা রেহাই পেয়েছে। ওখানকার এসআইআর-এর ফলাফলের আঁচ পশ্চিমবঙ্গে পৌঁছানোর সময় থেকেই এরাজ্যে এসআইআর করার আওয়াজ উঠেছিল। এখানকার বিজেপি বিরোধী দলগুলো এসআইআর সম্পর্কে বিরুদ্ধবাদী কথাবার্তা বললেও ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না, তারা কতটা বিরোধিতা করবে। আর এখন বিজেপি বিরোধী বড় দলগুলির অবস্থান ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ গোছের। অবশ্য রাজনৈতিক দলের বাইরে বড় সংখ্যায় রাজ্যের নাগরিক ও অধিকার আন্দোলনের সংগঠনগুলি সর্বতোভাবে এসআইআর-এর বিরোধিতা শুরু করেছিল, এবং চালিয়ে যাচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর-এর ধুয়ো দিতে মুহুর্মুহু বলা হচ্ছে, যেসব মুসলিমদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়বে, তারা নির্ঘাত বাংলাদেশী মুসলমান ও রোহিঙ্গা (অবৈধ) অনুপ্রবেশকারী। ভারতে তাদের ঠাঁই নাই। আর সম্ভাব্য বাদ পড়ে যাওয়া হিন্দুরা ‘শরণার্থী’। তাদের জন্য সিএএ আছে, তাদের নাগরিক করে নেওয়া হবে।… এনআরসি নিয়ে বিজেপি যে লাইনে ছিল, এসআইআর নিয়ে সেই লাইনেই রয়েছে। এনআরসি-র সপক্ষে বলতে গিয়ে অনুপ্রবেশ, শরণার্থী, সিএএ-র কথা বলত, এখন এসআইআর-এর সপক্ষে বলতে গিয়ে একই প্রসঙ্গ তুলছে। এর বিপরীতে “একজনও বৈধ ভোটারের নাম কাটতে দেব না’’, “স্বচ্ছ, ত্রুটিমুক্ত ভোটার তালিকা চাই” বলে আকচা-আকচি তুঙ্গে।

 

এসআইআর সত্যিই কি স্বচ্ছ ভোটার তালিকা দেবে?

সুস্মিতা রায়, নার্গিস বেগম সেখ, জরিনা বিবি, শোভা দলুই পড়েছে আতান্তরে। তারা বিবাহিতা। ২০০২ সালের পর ভোটার তালিকায় তাদের নাম উঠেছে। সুস্মিতা মণ্ডল হয়েছে সুস্মিতা রায়, শোভা দলুই হয়েছে শোভা বাগ, নার্গিস খাতুন হয়েছে নার্গিস বেগম সেখ, জরিনা খাতুন হয়েছে জরিনা বিবি। কারও মাধ্যমিকের সার্টিফিকেট আছে, কারও জন্ম সার্টিফিকেট আছে। এদের সবারই পিতা-মাতার নাম ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় আছে। কিন্তু জন্ম বা মাধ্যমিকের সার্টিফিকেটে পিতা নামীয় ব্যক্তি যে নিজের পিতা, কী দিয়ে প্রমাণ হবে? বিবাহ রেজিস্ট্রি কাগজ, যা তাদের নেই, এটি ছাড়া পিতার যোগসূত্র প্রমাণে আর কোন ডকুমেন্টই কাজের নয়। ২০০২ সালের পরে বিবাহিত সিংহভাগ মহিলারাই এক-একজন সুস্মিতা- নার্গিস-জরিনা-শোভা। খবর পাওয়া যাচ্ছে, বেশ কিছু জায়গায় নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে আপলোড করা ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় একাধিক ভোটারের নাম ডিলিট হয়ে গেছে। এমন বহু ভোটার আছে, যাদের নাম/পিতার নাম/বয়স সংশোধনের ফলে ২০০২ সালের ও ২০২৫ সালের ভোটার তালিকার তথ্যে কিছু হেরফের ঘটেছে।  

বলা হচ্ছে, ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় কারও নাম থাকলে অথবা ঐ তালিকায় নাম নেই, সেক্ষেত্রে পিতা-মাতা-ঠাকুর্দা-ঠাকুমার নাম থাকলে কেবলমাত্র এনুমারেশন ফরমটুকু পূরণ করলেই হবে, আর কোন কাগজ লাগবে না। নির্বাচন কমিশন বলেছে ভিন্ন কথা, হেঁয়ালিভরা কথা—খসড়া তালিকায় নাম থাকলেই চূড়ান্ত তালিকায় নাম উঠবে, এমন নয়; কারও তথ্যে অসংগতি থাকলে নোটিশ দিয়ে শুনানি করা হবে। এদিকে পশ্চিমবঙ্গের জন্য এনুমারেশন ফরমে নির্বাচন কমিশনের প্রথম দিকের নিয়মেরই (বিহারের ক্ষেত্রে যেমন ছিল) উল্লেখ আছে, যা নির্দেশ করে, ২০০২ সালের ভোটার তালিকায় যাদের নাম নেই, তাদের পিতা-মাতার নাম ঐ তালিকায় থাকুক অথবা না থাকুক, তাদের নিজেদের তো বটেই, এমনকি তাদের পিতা এবং/অথবা মাতারও জন্ম তারিখ এবং/অথবা জন্মস্থানের প্রমাণস্বরূপ নির্বাচন কমিশন দ্বারা নির্দিষ্ট এগারোটি নথির থেকে একটি দর্শানোর বাধ্যবাধকতা থেকে যাচ্ছে। খসড়া তালিকা প্রকাশের পরেই শুরু হবে কাগজের বিড়ম্বনা। এক্ষেত্রে শিথিলতা কি আশা করা যায়? হতে পারে বিহারের পন্থা গ্রহণ করা হল, অর্থাৎ শুধু ভোটারের নিজের নথি চাওয়া হল; এর বেশি শিথিলতার কথা ভেবে লাভ নেই। ভোটার যাচাই-বাছাইয়ের পদ্ধতিই যখন গলদে ভরা, তখন যে কোন অনিয়মই তার কার্যধারায় অগ্রাধিকারের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে সুস্মিতা-নার্গিসদের বেলায়ও এবং উপরোক্ত আর সব সমস্যাগুলিতেও নোটিশ-শুনানির আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। শুনানি নিশ্চয় মুখে-মুখে হবে না, সংশ্লিষ্ট নথিপত্র দর্শাতে হবে।

যারা এই নথির গাড্ডায় পড়বে, তাদের মধ্যে একটি বড় অংশের, যার সিংহভাগ মহিলা, ধরাছোঁয়ার মধ্যে সেসব নথি নেই। নথিপত্রের সমস্যা আদৌ ব্যক্তিগত ঘাটতির বিষয় নয়, সমস্যা কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক, যাতে বাস্তবিক ভুক্তভোগী ভোটারদের হাত নেই। এই সকল মানুষদের প্রান্তিক জীবনধারা, শিক্ষার অভাব, সরকারি অবহেলা অথবা আমলাতান্ত্রিক  সংকীর্ণতার কারণে তারা ঐ ধরনের নথির অধিকারী হওয়ার মতো উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেনি। সেই জায়গায় তাদের প্রতি সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বনই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা সরকারের দায় ও দায়িত্ব। পক্ষান্তরে প্রামাণ্য নথি নিয়ে নির্বাচন কমিশন যেটা করছে, সেটা শুধু দায়-দায়িত্ব ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলা নয়, সেটা স্বৈরাচারী পদক্ষেপ।         

বিজেপির সাধের ‘শরণার্থী’ তকমাপ্রাপ্ত হিন্দুদের একটা অংশ ২০০২ সালের পরে ভারতে এসেছে। তারা ভোটার হয়েছে, হাতে আধার, রেশন কার্ডের মতো দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সহায়ক নানান সরকারি পরিচয়পত্র আছে। আজ কেন্দ্র সরকারের ‘শারণার্থী’ হিসাবে তাদের সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি নির্বাচন কমিশনের নথিপত্রের গাড্ডায় নিমজ্জিত হয়েছে। তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার তৎকালিক প্রতিক্রিয়ার চাপ সামলাতে সিএএ-র টোটকা নিয়ে হাজির হয়েছে বিজেপি-- কি না, ভোটার তালিকা থেকে বাদ যাওয়ার পর তাদের নাগরিক করে নেওয়া হবে। নাগরিক অধিকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ভোটাধিকার ছিনিয়ে নিয়ে নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা যে শূন্যগর্ভ প্রতিশ্রুতি, এটা বুঝতে খুববেশি বুদ্ধি খরচ করার প্রয়োজন পড়ে না। 

 

এসআইআর- কার্যত নাগরিকত্ব যাচাই করা হচ্ছে  

একজন ভোটারকে পরখ করে নেওয়া মানে তার পরিচিতি সাপেক্ষে দেখা, যে প্রক্রিয়ায় তার নাম ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সেই নিরিখে দেখা। এটিই স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত পদ্ধতি হতে পারে। কিন্তু এসআইআর-এ কাজটা করা হচ্ছে ভিন্ন নিরিখ থেকে। ভোটার যাচাইকরণে যে পদ্ধতি হাতে নেওয়া হয়েছে, তা নাগরিকত্ব যাচাই করার সমতুল। ভোটাধিকার সংক্রান্ত এতদিনকার ধারণাকে, ভোটারদের পরিচয়ের যোগসূত্রকে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের মতো আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। নাগরিকত্ব যাচাই কিন্তু নির্বাচন কমিশনের কাজ নয়।

যখন নাগরিকত্ব নির্ধারণের পদ্ধতি সম্পর্কে আইনপ্রণেতাদের মধ্যেই বিস্তর বিতর্ক আছে, তখন ভোটার যাচাইকরণে মনোগতভাবে প্রামাণ্য নথির হুকুমনামা জারি করে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে চাওয়া হচ্ছে। ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি সম্পর্কে অসঙ্গতি দেখা গেলে অর্থাৎ বংশগত যোগসূত্রে অথবা নাম-ধাম-জন্ম তারিখে অসঙ্গতি দেখা গেলে নথি দর্শানোর ফরমানে এগারোটি নথি নির্দিষ্ট করেছে নির্বাচন কমিশন। এগারোটি নথির বাইরে একাধিক নথি থাকতে পারে, এই সমস্যার নিষ্পত্তি করতে পারে, সেসব গ্রাহ্য করা হয়নি। নির্বাচন কমিশনের চাওয়া নথিগুলির একটিও হাতে নেই এরকম ভোটারের সংখ্যা বিপুল। তারা বাস্তবিক এই দেশের নাগরিক। এই দেশেরই এলিট শ্রেণিকৃত নাগরিকত্বের মনোগত সংজ্ঞায়নের নিরুপায় শিকার তারা।

কথা উঠতে পারে, প্রাপ্তবয়স্ক ভারতীয় নাগরিক যখন ভোটার হওয়ার যোগ্য, তখন নির্বাচন কমিশন ভোটারদের নাগরিকত্ব দেখে নেবে বৈকি। এর জবাবে প্রথমেই বলতে হয়, বিধিবদ্ধ নথি দেখে ভারতীয় নাগরিক গণ্য করে ভোটার হিসাবে অন্তর্ভুক্তির পর পুনরায় নাগরিক কিনা যাচাই করতে নামা, এটা নীতিহীন কাজ। উপরন্তু অবৈধ ভোটার অন্তর্ভুক্তি মানে বিধিসম্মতভাবে নথি জমা না দিয়ে বা জাল নথি জমা দিয়ে ভোটার হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সে’ তথ্য তো নির্বাচন কমিশনের হাতেই আছে, সেসব পরখ করে নিতে পারে। এটা হতে পারে না, যে, একজন চোরকে ধরতে পুরো মহল্লাকে পুলিশ কাস্টডি বানানো হবে। দ্বিতীয়ত, এরপরও যখন সবটাই যাচাই করার গোঁ ধরার ব্যাপারটা ঘটছে, তখন এই-ই তার উপযুক্ত জবাব, যে, যাচাই করতে হবে লক্ষণরেখা মেনেই। নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্তির জন্য নির্বাচন কমিশনকে যে সীমার মধ্যে কাজ করতে হয়, লক্ষণরেখা সেটাই। যাচাইকরণে আগের (অন্তর্ভুক্তিকালীন) নথির অনেক কিছুই বাতিল করে দেওয়া, এই দ্বিচারিতা কোন যুক্তিতেই মেনে নেওয়া যায় না। এটা নীতিভ্রষ্টতা। এই ছাঁকনিতে যদি কিছু অবৈধ ভোটার চিহ্নিত করা যায়, সেটা আপতিক ব্যাপার এবং প্রকৃত ভোটারদের প্রতি অবিচারের তুলনায় গৌণ বিষয়।

 

কারও সর্বনাশ, কারও পৌষ মাস-এর গোলকধাঁধা

এসআইআর-এর পক্ষে দাঁড়িয়ে চিল-চিৎকারে অনুপ্রবেশের ধুয়ো তুলে মানুষকে ভয় দেখানো চলছে। সচরাচর সুস্মিতা-নার্গিসদের কিন্তু চিন্তা নেই। তেমনই চিন্তা নেই সেইসব মানুষদেরও, যারা কাগজপত্রের গাড্ডায় পড়ার বিপদের মধ্যে রয়েছে। চিন্তা নেই, কারণ তারা জেনেছে, এসআইআর হেথা-হোথা আধার লিঙ্ক করানোর মতো ব্যাপার, আর অহরহ শুনছে “আমরা আছি, কারচুপি করে নাম বাদ দিতে দেব না” জাতীয় স্তোকবাক্য। কিন্তু যেখানে সুস্মিতা-নার্গিসরা জানতে পারছে এসআইআর-এর বজ্র আঁটুনি সম্পর্কে, আর সব মানুষরা জানতে পারছে, তারা বিপন্ন বোধ করছে। এই সংখ্যা বোধহয় সীমিতই।

এইখানেই মাদারির খেল। এসআইআর করা হচ্ছে একাংশ ভোটারদের ভোটার তালিকা থেকে ছেঁটে দেওয়ার লক্ষ্যে। সেখানে “এসআইআর-এ ভয় নাই” জাতীয় আরোপিত পরিবেশের ফাঁকতালে শুরু হয়েছে ম্যানিপুলেশন। দেখা যাবে ভোটার তালিকায় ম্যাপিং করা থেকে খসড়া তালিকা হয়ে চূড়ান্ত তালিকায় নাম ওঠা পর্যন্ত ক্ষমতার দাপাদাপি। ডবল ইঞ্জিন সরকার না হোক, সিঙ্গেল ইঞ্জিন লাগানো সরকারেই কিস্তিমাত। বাদ পড়বে তারাই, যারা ঐ দুইয়ের কোনদিকেই নেই, যারা সাথে-পাঁচে নেই, এবং অবশ্যই তারা প্রান্তিক সমাজের, লেখাপড়া না-জানা কিংবা কম-জানা লোকজন, এবং সিএএ-র দোহাই সেই সারিতে যুক্ত হবে একাংশ বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দুরা।

সিপিআইএম, কংগ্রেসের মতো দলগুলি বৃথাই ত্রুটিমুক্ত ভোটার তালিকার আশায় ‘আশায় বাঁচে চাষা’ বনে বসে আছে। এসআইআর সাঙ্গ হলে পর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হবে প্রকৃতই অস্বচ্ছ, ত্রুটিপূর্ণ ভোটার তালিকা, যার সবচেয়ে কালো দিক হবে লক্ষ লক্ষ ভোটারের ভোটাধিকার হারানো। এবং এই প্রথম আমরা দেখব রাজনৈতিক ভোটার তালিকা।  

 

এসআইআর-এর শেষের কথা

প্রসঙ্গ উঠেছে, এসআইআর একভাবে এনআরসি । এসআইআর-এ এন আর সি-র আইন প্রয়োগ করার সুযোগ নেই, প্রয়োগ করাও হচ্ছে না। কিন্তু ভোটার তালিকা যাচাই-বাছাই করতে যে প্রক্রিয়া হাতে নেওয়া হয়েছে, তা পদ্ধতিগতভাবে এনআরসি-র সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়। এসআইআর-এ প্রাপ্ত ভোটার তালিকাকে আইনের মারপ্যাঁচে নাগরিক পঞ্জি অথবা নাগরিকদের তালিকা (খসড়া) বলে চালিয়ে দেওয়া হলে বোধহয় আটকানো মুশকিল হবে। তা হলে বাকি থাকবে আঠারো বছর বয়সের নীচের দেশবাসীর নাম সংযোজন, যার জন্য জন্ম-মৃত্যু রেজিষ্টারের সেন্ট্রাল পোর্টাল পরিশিষ্টের জায়গা নিতে পারবে।

এসআইআর থেকে এনআরসি, এটি সম্ভাব্যতার বিষয়। কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন যেটি— যারা এসআইআর-এ ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ে যাবে, তাদের জন্য কী ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে? তাদের নাম কি পুনরায় ভোটার তালিকাভুক্ত করা হবে? নাকি প্রকৃতই তাদের নাগরিকত্বের পরীক্ষায় ঠেলে দেওয়া হবে? আমরা আসামে দেখেছি, যাদের নামে ‘ডি-ভোটার’ ছাপ দেওয়া  হয়েছিল, তাদের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তাদের একটা অংশ ট্রাইব্যুনালের রায়ে ডিটেনশন সেন্টারে বন্দি। এসআইআর-এ নাগরিকত্ব যাচাইয়ের ছল-চাতুরি ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের বিভীষিকার দিকেই ইঙ্গিত করে। রাজ্যে বাংলাদেশী মুসলমান, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কথা বলে বিজেপির আস্ফালনকে রাজনৈতিক গিমিক না ভাবাই উচিত। খুঁজলে লালকেল্লায় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে দেশে ‘অনুপ্রবেশ নিয়ে উদ্বেগের’ আঁচ আমরা এসআইআর-এ পেয়ে যাব।

পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর চলছে, তার লক্ষ্যও পূরণ হবে। বিহারের দৃষ্টান্তে আমরা আন্দাজ করতে পারি, বিহারের থেকে বেশিই ভোটারকে ভোটার তালিকা-ছুট করা হবে। নাগরিকত্বের এই বিপন্নতার আর্তির পাশে কি কোন আশ্বাস ধ্বনিত হবে?  এনপিআর, জনগণনা, এনআরসি-র আইন নিয়ে ‘যুক্তি-তক্কো-গপ্পো’-র প্রাথমিক বিভ্রান্তি কাটিয়ে এনআরসি-র বিরুদ্ধে মানুষ কাতারে কাতারে রাস্তায় নেমেছিল। সেদিনের মতো আবারো সূত্রধরের ভূমিকা নেবে বুঝি নাগরিক ও অধিকার আন্দোলনের অ-পার্টি সংগঠনগুলির বন্ধুরা !   

 

  

                 

      

           

  

0 Comments

Post Comment