পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

টলে যাচ্ছে আস্থা

  • 16 January, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1707 view(s)
  • লিখেছেন : মহাশ্বেতা সমাজদার
যে আইন বাতিলের দাবিতে আন্দোলনের ঝড় উঠেছে, তার প্রয়োগে আদালতের স্থগিতাদেশ, অযাচিত ভাবে কমিটি গঠন, কৃষকদের সেই কমিটি প্রত্যাখ্যান এবং অবশেষে কমিটির সদস্যেরই অব্যাহতি কি বিচারবিভাগের প্রতি অনাস্থাকেই বাড়িয়ে দিল না ?

এই লেখা শুরু করার কিছুক্ষণ আগে সুপ্রিমকোর্ট গঠিত কৃষক সমন্বয় কমিটি থেকে অব্যাহতি নিলেন ভুপিন্দর সিং মান । এই কমিটির অন্যান্য সদস্যদের মতোই যদিও ভারতীয় কিষান ইউনিয়নের জাতীয় প্রেসিডেন্ট ভুপিন্দর সিং মান প্রথম থেকেই কৃষি আইনের পক্ষেই সওয়াল করে আসছেন, তবুও তিনি তাঁর অব্যাহতি পত্রে লিখেছেন, একজন কৃষক এবং একজন ইউনিয়ন নেতা হিসেবে তিনি কৃষক ইউনিয়নগুলি ও দেশের জনসাধারণের মনোভাব অনুধাবন করে তাঁর পদ থেকে অব্যাহতি চাইছেন, যাতে পাঞ্জাব এবং দেশের কৃষকদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন না হয়। তিনি সর্বদা পাঞ্জাবের এবং দেশের কৃষকদের পাশে থাকবেন।
তার মানে, তিনি বুঝেছেন, যে এই কমিটি কৃষকস্বার্থ ক্ষুণ্ণ করতে পারে। অথচ এই সম্ভাব্য কৃষক স্বার্থ ক্ষুণ্ণকারী কমিটিটি সম্পূর্ণ অযাচিত ভাবে গড়ে দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। স্বভাবতই এর ফলে কিছু প্রশ্ন উঠে গেছে।
প্রথমত, সুপ্রিম কোর্টের পক্ষে কৃষকের আন্দোলনে অযাচিত হস্তক্ষেপ করে কমিটি গড়ে দেওয়া কি উচিত হল ? মনে রাখতে হবে, এই কমিটি গড়ার আগে সুপ্রিম কোর্ট তিনটি বিতর্কিত কৃষি বিল প্রয়োগে স্থগিতাদেশ জারি করেছে। অথচ, আইনগুলির সাংবিধানিক বৈধতাকে প্রশ্ন করেনি। আইন পাশের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। বিশেষত যখন হিমাঙ্কের কাছাকাছি তাপমাত্রায় দিল্লির সীমানা থেকে কয়েকদিন অন্তরই কৃষকমৃত্যুর খবর আসছে, তখন কৃষকদের দাবিগুলি সম্বন্ধে আরেকটু সহানুভূতি নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট পদক্ষেপ করতে পারত না কি ? কৃষকরা যে সরকারের প্রতি আস্থা হারিয়েছেন, সে কথা আন্দোলনে অটল কৃষকরা বারবার বলছেন। তাঁদের আস্থা ফিরে পাওয়া সুপ্রিম কোর্ট তার দায়িত্ব হিসেবে দেখতে পারত।
এই সংক্রান্ত আলোচনায় অবশ্য সুপ্রিম কোর্ট সরকারকে পুরো ব্যাপারটা সামলাতে না পারার জন্য ভর্ৎসনা করে বলেছে, কিছু একটা অঘটন ঘটে গেলে আমরা সকলে তার জন্য দায়ী থাকব। আমরা তো আমাদের হাত রক্তাক্ত করতে পারি না।

এই বিন্দুতে এসে আমরা লক্ষ না করে থাকতে পারি না যে , সুপ্রিম কোর্ট কৃষকদের কথা , তাদের ভালোমন্দের কথা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ভাবছে, কমিটি করছে, আইন প্রয়োগে স্থগিতাদেশ দিচ্ছে,অথচ, গত বছর ঠিক এই সময়ই শত শত নারী সিএএ বাতিলের দাবিতে আন্দোলনের রাত কাটিয়েছিলেন শীতের খোলা আকাশের নীচে। সেখানে মৃত্যুও ঘটছিল কচি শিশু থেকে অশীতিপর বৃদ্ধার। সুপ্রিমকোর্ট তখন একটিও বাক্য খরচ করেনি তাঁদের দুর্দশা নিয়ে।
তারপর দিল্লি নিধনপর্বের পর দাঙ্গায় মদত দেবার ভুয়ো অভিযোগে জেলে পোরা হয়েছে, জেলে পচানো হয়েছে একের পর এক সেই সিএএ বিরোধী আন্দোলনকারীদের। আর এই সময় হয়রানির শিকার হচ্ছেন সেই সব আন্দোলনকারীকে আইনি সহায়তাকারী আইনজীবীরা। এই সব হয়রানি, যন্ত্রণার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের হিরন্ময় নীরবতা আমাদের নজর এড়ায় না।

দ্বিতীয়ত, সিএএ , ইলেক্টোরাল বন্ড, বা কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা আর ৩৫ক অনুচ্ছেদ রদ মামলার বেলায় সুপ্রিম কোর্ট যেরকম ঢিলেঢালা গা-ছাড়া মনোভাব দেখিয়েছে, সেই প্রেক্ষিতে দেখলে এই সদ্যঘোষিত স্থগিতাদেশ বা সমস্যা সমাধানে কমিটি গঠন, সবেতেই সুপ্রিম কোর্টের চোখে লাগার মতো আগ্রহ আর তৎপরতা চোখে পড়ছে। সরকার আর কৃষকের বিবাদ মেটাতে সুপ্রিম কোর্টের এত আগ্রহ কেন ? তবে কি সরকারকে বাঁচানো সুপ্রিম কোর্ট তার কর্তব্য বলে মনে করছে ? আগামী প্রজাতন্ত্র দিবসে কৃষকরা যে রাজধানীর বুকে ট্রাক্টর মার্চ করবেন বলে জানিয়েছেন, তা যেনতেনপ্রকারেণ আটকাতে সুপ্রিম কোর্ট কি মরিয়া ?

তৃতীয়ত, সদ্যগঠিত এই কমিটি সম্বন্ধে কৃষকরা তাঁদের বিবৃতিতে অত্যন্ত বিনীতভাবে সুপ্রিমকোর্টকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, কোনো কমিটির সঙ্গে আলোচনায় তাঁরা বসবেন না। তাঁদের একমাত্র দাবি কৃষিআইন বাতিল না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা আন্দোলন চালিয়ে যাবেন।
এখানে আরও একটা কথা মাথায় রাখা দরকার। যে চারজনকে নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট এই কৃষক সমন্বয় কমিটি গড়েছিল, সেই চারজনই কৃষিবিলের সমর্থক। প্রত্যেকেরই কৃষিবিলের সমর্থনে বিবৃতি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত। ফলে এই কমিটি কৃষকের কৃষি আইন বাতিলের দাবি কতটা মনোযোগ সহকারে শুনতে আগ্রহী হবে, এবং কিছুদিন পর কী রিপোর্ট দেবে তা অনুমান করা কষ্টকর নয়।


এই প্রসঙ্গে আরও একটা অন্যায়ের কথা বলা দরকার।
কৃষক আন্দোলন সংক্রান্ত আলোচনা চলাকালীন মহামান্য সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় একটি অন্যায় শব্দ উচ্চারণ করেছে। বিরক্তির সঙ্গে সে উচ্চারণ করেছে, এই আন্দোলনে মহিলাদের "রাখা" হয়েছে কেন। অর্থাৎ নারী যে কৃষক হতে পারেন এবং তাঁর স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হলে যে তিনি স্ব-উদ্যোগেই আন্দোলনে সামিল হতে পারেন , তা এই একবিংশ শতকের তৃতীয় দশকে পৌঁছেও সুপ্রিম কোর্টের মাথায় ঢোকেনি। এই মন্তব্য করে কার্যত দেশের সব নারীকেই অপমান করা হয়েছে।

শেষে একটা কথাই বলব। বাবরি মসজিদ ধ্বংস, রামমন্দিরের জমিবিবাদ, সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্প ইত্যাদি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায়ের ফলে বিচারবিভাগের উপর জনসাধারণের আস্থা যেখানে এমনিতেই টলমল করছে , সেখানে প্রথমে কৃষকদের আন্দোলনের ঝড় থামাতে অযাচিত ভাবে কমিটি গঠন, কৃষকদের সেই কমিটি প্রত্যাখ্যান এবং অবশেষে কমিটির সদস্যেরই অব্যাহতি সেই অনাস্থাকেই আরো বাড়িয়ে দিল না কি ?

0 Comments

Post Comment