পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

শেষ দেখা

  • 07 November, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1225 view(s)
  • লিখেছেন : অনিন্দ্য মান্না
হাওড়া জেলার নারিকেলদহ গ্রামে আমাদের পৈতৃক বাড়িটা পেল্লায় বড়। দোতলায় আটটা শোবার ঘর। তারই মধ্যে বাড়ির পশ্চিম দিকে দুটো ঘর নিয়ে থাকে আমার জ্যাঠতুতো দাদা, তার স্ত্রী ও দুই মেয়ে। আর থাকে ওর ল্যাব্রাডর কুকুর কালু। কালু নামটা বড়ই বেমানান কারণ কুকুরটা ধপধপে সাদা। বাড়ির পূর্ব দিকটা বেশির ভাগ সময় তালা দেওয়াই থাকে। নিচের তলায়, মানে একতলায়, বেশির ভাগ ঘরই ভাড়া দেওয়া। ছোট ছোট পরিবার। তাদের ছেলেমেয়েরা সবে থ্রী -ফোর এ উঠেছে।

সন্ধ্যের পর একটু গা ছমছম করে। তিনটে কম পাওয়ারের বাল্ব বাড়ির সামনের রাস্তাটা হালকা আলো করে রাখে । রাস্তাটা দেখা গেলেও যারা আসাযাওয়া করে তারা যেন সব ছায়ামূর্তি। এরকম পরিবেশ হলেও দু তিন দিনে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া যায়, যেমন আমার হয়ে গেলো। আমি গ্রামের বাড়িতে আসছি প্রায় দশ বছর পর। বাড়ির সামনের রাস্তার মুখে মস্ত গেট, যেটা দিয়ে ঢুকে ছ-সাত টা বাড়ি। ঘড়ির কাঁটা দেখে আমার দাদা বুঝতে পারে কে ঢুকছে বা বাইরে যাচ্ছে। আর বোঝা যায় কালুর ঘেউ-ঘেউ শুনে। অপরিচিত কেউ এলে কালুর ডাক বোধহয় পাশের গ্রামেও শোনা যায় ।

এই সব মজার অথচ জরুরি রীতি আচার গুলো যখন রপ্ত করে ফেললাম তখন আমার দাদা তার পরিবারকে নিয়ে তিন দিনের ছুটিতে দীঘা বেড়াতে গেলো। কালুর জন্য অনেক দিন কোথাও যেতে পারেনি।

ভেবেছিলাম তিনটে দিন বই পড়ে আর লেখালেখি করে সময় কাটিয়ে দেবো। কিন্তু প্রথম দিনটা কেটে গেলো কালুর সঙ্গে পাড়া বেড়ানো, বাগানে বল নিয়ে খেলা আর দৌড়ে। কালু দৌড়োয় কাঠবিড়ালির পেছনে আর আমি কালুর পেছনে।

রান্নার লোককেও ছুটি দেওয়া হয়েছে। দুপরে মাছের ঝাল আর ভাত রান্না করে, খেয়ে, বিছানায় একটু গড়িয়ে নেওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু চোখ লেগে আসতেই কালু এসে আমার গোটা মুখ চেটে আমাকে তুলে দিলো। চললাম দুজনে, আবার পাড়া বেড়ানো।

দ্বিতীয় রাতের কথা। রাতের খাবার তাড়াতাড়ি সেরে নিয়ে নিচেরতলা ও ওপরতলার সব দরজায় তালা চাবি লাগিয়ে একটা বই নিয়ে ঠাকুরদার আমলের একটা আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিলাম। একতলায় একটা আলো টিমটিম করে জ্বলছে। ভাড়াটেরা মনে হয় সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। গ্রামের জীবনধারা আর কী। বাইরে থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া আসছে খোলা জানলা দিয়ে। চারদিক নিস্তব্ধ। শুনতে পাচ্ছি শুধু ঝিঁঝি পোকার ডাক।

বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে চোখ লেগে গেছিলো। হঠাৎ কালুর ভয়ঙ্কর ঘেউ-ঘেউ আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলো। সোজা হয়ে বসলাম। ঘড়ি বলছে ১১:১৫। কালু একবার চুপ করার পর একটা ক্ষীণ আওয়াজ কানে এলো। কেউ যেন আমাকে ডাকছে। একবার ভাবলাম একতলার পশ্চিমের ঘরের ভাড়াটে হয়তো ডাকছে। পরমুহূর্তেই মনে পড়লো সে কয়েকদিনের জন্য বাইরে গেছে। তাহলে অন্য কেউ কি কোনো বিপদে পড়লো?

বেশ কয়েকটা দরজা। সেগুলোর তালা খুলতে খুলতে নিচে নামলাম। কালুর ডাক এখন আরও প্রবল। বাড়ির প্রধান ফটকের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে এক ছায়ামূর্তি। আবছা অন্ধকারে দেখতে পেলাম আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। একটা নিষ্প্রভ কণ্ঠস্বর কানে এলো। "কেমন আছো ভাইপো?" সঙ্গে সঙ্গে চিনতে পারলাম। এতো মধুদা।

মধুদা আমাদের বাড়ির প্রধান পরিচারক ছিল। আমাদের ঠাকুরদার ভৃত্য ও তাঁর শেষ জীবনের পরিষেবক। ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি মধুদাকে। সে সমস্ত কাজে দক্ষ ছিল ইলেকট্রিক-এর কাজ, চাষ করা, বাড়িতে অনেক অতিথি এসে পড়লে রান্না করা, কেউ অসুখে পড়লে তার শুশ্রুষা করা...কি না করছে মধুদা। বেশ কয়েক বছর আগে অবসর নিয়ে নিজের বাড়ি ফিরে গেছিলো মধুদা। কাছেই বাড়ি। বলেছিলো একটু বাগান-টাগান নিয়ে থাকতে চায়। তাকে আটকানো হয়নি। আমাদের পরিবারের যাঁরা বয়স্ক ছিলেন একে একে চলে গেছেন। চাষবাস একদম কমে গেছে। মধুদাকে নিজের মতো থাকতে দেওয়াই ঠিক হয়েছিল। আর তা ছাড়া পাশেই তো বাড়ি। মনটা একটু খারাপ লাগলো। দাদার কাছে মধুদার খবর অনেক দিন নেওয়া হয়নি। যাই হোক, এসে তো পড়েছে ঠিক।

­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­­মধুদা চিরকালই রোগা, শরীরের সব হাড় গোনা যায়, চোয়াল দুটো গর্তে ঢোকা আর কাঁধ অবধি লম্বা চুল। কপালের কাছে কিছুটা চুল অনেক বছর আগে পুড়ে গেছিলো যখন গাছে উঠে একটা পেল্লায় বোলতার চাকে আগুন দিয়েছিলো। কিন্তু আজ যেন তার সেই আগের শীর্ণ চেহারার আবছায়া, প্রায় ভূতুড়ে। ভেতরে আসতে বললাম আর দোতলায় গিয়ে বসলাম আমরা। আমি বসলাম আরামকেদারায় আর মধুদা বসলো একটা মোড়ায়।

লক্ষ করলাম কালু একদম চুপ করে গেছে। মধুদার দিকে তাকাচ্ছে না। টেবিলের তলায় গিয়ে শুয়ে পড়েছে। একটু আশ্চর্য লাগলো। কালু তো মধুদাকে আগে দেখেনি। হয়তো সারাদিনের দৌড় ঝাঁপের ক্লান্তি।

আমি মধুদার দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলাম, "তুমি ঢুকলে কী করে? রাস্তা থেকে ঢোকার বড় গেটে তো তালা দেওয়া" মধুদা মুচকি হেসে বললো "ভুলে গেছো ভাইপো? এই বাড়ির যাতায়াতের পথ আমার চেয়ে কেউ ভালো জানে?"

এটা অবশ্য সত্যি। মধুদা এই বাড়ির প্রত্যেকটা দরজা জানালা শুধু না, প্রত্যেকটা ইট পাথর পর্যন্ত চেনে। হয়তো এই প্রাচীন বাড়ির সব রহস্যও জানে। আমরা পুরনো দিনের কথা বলতে লাগলাম। কত অতিথির আনাগোনা, যাতায়াত। বাড়ি তখন প্রায়ই গমগম করে। রান্নাঘরে লেগে থাকতো তাড়াহুড়ো এবং ছুটোছুটি। ঠাকুরদার ছিল সস্ত্রম উদ্রেককারী ব্যক্তিত্ব। সব দিকে তাঁর চোখ অথচ মুখে কোনো অনুভূতি প্রকাশ পায় না। আমরা তখন খুবই ছোট। আমাদের দুষ্টুমিতে সবাই বিরক্ত। এই সব কথা পুরোনো দিনের কত স্মৃতি ফিরিয়ে আনলো। আমি একটা সিগারেট ধরালাম। মধুদা তার পছন্দের বিড়ি বের করে বার দুয়েক চেষ্টা করে ধরালো। তারপর যেন বেশ কষ্ট করে টান দিতে লাগলো ।

কথা বলতে বলতে সময় পেরিয়ে গেলো। প্রায় ১টার সময় মধুদা উঠে পড়লো। আমি তাকে থেকে যেতে বললাম। "এতো রাতে কোথায় যাবে? এখানে থেকে যাও" মধুদা বললো তাকে অনেকটা পথ যেতে হবে, আর তার রাস্তায় কোনো ভয় নেই। আমাকে শেষ বারের মত দেখতে এসেছিলো।

আমি বললাম আমি খুব শিগগিরই গিয়ে দেখা করবো। তাতে আবার সেই মুচকি হাসি। "এতো তাড়াতাড়ি নয়" বলে হঠাৎ যেন একটা কাজ মনে পড়ে গেছে এমন একটা ভাব নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। অদ্ভুত মানুষ। আমি আবার সব দরজায় তালা চাবি লাগিয়ে ঘরে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। কালু দেখি আমার খাটে উঠে আমার গা ঘেঁষে শুলো। আশ্চর্য !

পরের দিন সকাল টা মেঘলা। যখন কালুকে নিয়ে বেড়াতে বেরোলাম তখন ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। আজ আমরা একটু বেশি দূর অবধি গেলাম। বৃষ্টির ছাঁট এড়াতে একটা ছোট গলি ধরলাম যার দুই পাশে বড় বড় গাছগুলো ছাউনির কাজ করছে। হঠাৎ মনে পড়লো, এই রাস্তায় মধুদার বাড়ি। এগিয়ে গেলাম। বাড়ি চিনতে অসুবিধে হলো না।

বাইরে থেকে দেখলাম একজন বয়স্ক মহিলা বাড়ির দালান ঝাঁট দিচ্ছেন। তার পরনে সাদা শাড়ি। আমার বুকের ভেতর তখন ধুকপুকুনি শুরু হয়েছে। মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছে। আমার দিকে মুখ তুলে হেসে বললেন "কেমন আছো ভাইপো? কত বছর গ্রামে আসোনি"

কালু তখন কয়েকটা ছাগল দেখে তার চেন-এ টান মারছে। তাকে সামলাতে সামলাতে জিজ্ঞেস করলাম "তুমি কেমন আছো?"

মৃদু হেসে অথচ শুকনোভাবে জবাব দিলো "চলে যাচ্ছে। এখন ইটখোলায় কাজ করি। তোমাদের মধুদা তো হঠাৎ মারা গেলেন তিন মাস হলো "

0 Comments

Post Comment