প্রীতি ও প্রভেদের যে জায়মানতা নিয়ে একটি হালকা সুতোর ওপর দড়িখেলা দেখাতে দেখাতে একটা সভ্যতা এতদূর পর্যন্ত এল তার অন্তমূলে সহাবস্থান কখনও নিজেকে রক্তাক্ত করেছে ভেঙেছে আবার নিজেকে গড়েছে। নৃতত্ত্বের গবেষণায় মানুষ কিন্তু এগিয়েছে। যেটা গ্রহণ করার তাকে গ্রহণ করেছে অপরদিকে যেটা বর্জন করার সেটাকে বর্জন করেই মানুষ হিসাবে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। কিন্তু যখনই সভ্যতার অন্তর্গত সত্যে কোনো অশান্তির বীজ মানুষই সকলের অজান্তে সমাজ নিগড়ে বপন করেছে তখনই অজান্ত সত্যে লেনাদেনার বা ভাগ বাঁটোয়ারার অলক্ষ্য উপাদান জলে স্থলে মহীরুহ হয়ে ওঠে। সুযোগ পেলেই তার সদ্ব্যবহার প্রত্যক্ষত হয় এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তার প্রয়োগ ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে। পুরাণ চর্চায় আছে শনি নলের শরীরে ঢোকার জন্য একটা ছিদ্র খুঁজেছিল এবং তার এই অন্বেষণ বৃথা যায় নি, সে সেই ছিদ্র পেয়েও গিয়েছিল। স্বাধীনতার আগে ও পরে এবং বর্তমানে সর্বনাশের ছিদ্র খোঁজার কাজটি যারা করেছিলেন এবং এখনও করছেন তাঁরা সফল হতে পারেননি এ কথা জোর দিয়ে বলি কী করে! সফল এই কারণেই যে আমাদের ভাবাবেগ এখন নিয়ন্ত্রিত এবং অবশ্যই অন্য অশুভ শক্তির দ্বারা পরিচালিত। তাই, একদিন কোনো এক সুন্দর সকালে দলবল নিয়ে আমি পাড়ায় পাড়ায় গাইতে শুরু করলাম,‘মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু -মুসলমান’ আর হৈ হৈ করে মানুষ রাস্তায় বেরিয়ে এসে এ ওর গলা জড়িয়ে বলতে শুরু করল ‘বিভেদের মাঝে দেখো মিলন মহান’ সেই মহত্তম দিনের সম্ভবনা আজ রাজনীতির গর্ভে বিলীন হতে বসেছে। তাহলে সম্প্রীতি বা পারস্পরিক সৌহার্দ্যের যে বাণী ছড়িয়ে আমরা সামাজিক নানা অনুষ্ঠানে সমবেত হই তারই বা অর্থ কী দাঁড়ায়! প্রীতি যখন প্রভেদকে প্রাসঙ্গিক করে তোলে তখন মানুষ নিজের অস্তিত্ব নিয়ে কাঁদতে বসে; কারণ তার জোটবদ্ধ হওয়ার ক্ষমতা কারও না কারও কাছে বাঁধা পড়েছে। তাই তার নির্যাস থেকে জন্ম নিয়েছে অসহিষ্ণুতা। গলদটা তাহলে গোড়ায়। আমরা যে ভিন্ন ধর্মের মানুষের ধর্মাচরণে একপ্রকার সহিষ্ণুতার কথা বলি, পাশে থাকার কথা বলি বা ’বেঁধে বেঁধে থাকা’র কথা বলি তাতেও কী শনির মতো ছিদ্র খুঁজে বেড়াই। অন্তঃসারশূন্য প্রীতির অন্তরালে প্রভেদ কেই পকেটস্থ করে বাড়ি ফিরি! আমরা সভ্য থেকে সভ্যতর হচ্ছি, আমাদের বিজ্ঞান এগোচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আগমনী গান গেয়ে আমরা দ্রুত ডিজিটালাইজেশনের যুগে প্রবেশ করছি বলে যে শ্লাঘা অনুভব করছি তাতে রবীন্দ্রনাথ সত্য হয়ে উঠছেন, “ইংরেজই হিন্দু মুসলমান পরস্পরকে বিরুদ্ধ করেছে একথা বলে পার পাওয়া যাবে না। হিন্দু মুসলমান ভারতবর্ষের এই দুই প্রধান ভাগকে এক রাষ্ট্র সম্মিলনের মধ্যে বাঁধিবার জন্য যে ত্যাগ, যে সহিষ্ণুতা, যে সতর্কতা ও আত্মদমন আবশ্যক তা আমরা অবলম্বন করিনি। এভাবে নানা আশু ও সুদূর কারণে,অনেকদিনের পুঞ্জিত অপরাধে হিন্দু মুসলমানের মিলন সমস্যা কঠিন হয়েছে (হিন্দু মুসলমান)। দূরদ্রষ্টা কবির এই আবিষ্কার শুধু কয়েকটি শব্দ বা অক্ষরের সংযত প্রক্ষেপন নয়, বরং কবি আলো ফেলেছেন দুই সম্প্রদায়ের মিলনের সমস্যার অভিমুখে। যার থেকে আমরা বেরতে তো পারিই নি বরং সমস্যা আরও গভীর হয়েছে। মিলিত হতে গিয়েও হচ্ছে না বা এই হলো হলো, যা: আবার সুদূরে মিলিয়ে গেল সেই রামধনু আঁকা পাখা তার গভীরে নিহিত আছে আমাদেরই আন্তরিক হওয়া বা না হতে চাওয়ার কথা।অন্তরীন অভ্যস্ত মৌলবাদ শুধু মাত্র একটি সম্প্রদায়ের মধ্যেই বিদ্যমান আর অন্য সম্প্রদায়টি ধোয়া তুলসীপাতা তা দিয়ে যদি সরলীকরণের ব্যাসবাক্য নির্মাণ করা হয় তাহলে তা সোনার পাথরবাটি হতে বাধ্য। আজ যা হচ্ছে।
গত হপ্তাখানেকের বেশি সময় ধরে মুর্শিদাবাদের সামসেরগঞ্জের জাফরাবাদ, ধুলিয়ান বা সুতি সহ কোলকাতা লাগোয়া ভাঙড়ের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ওয়াকফ আইনের বিরোধিতায় যে আগুন জ্বলল এখনও যার রেশ চলছে তাতে যেমন ঘরবাড়ি পুড়েছে, উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ মরেছে, ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে মানুষ আশ্রয় নিয়েছে মালদহে। একটা বড়ে অংশ পরিযায়ী হয়ে লুকিয়ে ভিন রাজ্যে চলে যাচ্ছে, ভয় আতঙ্ক তাড়া করে ফিরছে। ছেলেমেয়েদের খাওয়া পরা লাটে উঠেছে, লেখাপড়ার সামগ্রী পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তাতে সম্প্রীতির যে উদার বাণী তা ধ্বজা হয়ে উড়ে গেছে! খাওয়া পরা,বাঁচা মরার ঊর্ধ্বে এক শ্রেণির মানুষের ক্ষমাহীন উস্কানি, প্রশাসনের দায়িত্বে থাকা এমএলএ,এমপি মন্ত্রী সান্ত্রী ও কিছু বিরোধী দলের লাগামহীন ‘ভার্বাল ডায়েরিয়া’ আরও বিপদে ফেলছে মানুষকে। ভিন রাজ্য থেকেও উড়ে আসছে কথাসরিৎ(!),“লাথো কে ভূত,বাতো সে কঁহা মাননেওয়ালা হ্যায় (যোগী আদিত্যনাথ)। যে কথা আগেই বলেছি মানুষের অসহায়তাকে পুঁজি করে রাজনীতির ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমেছে এরা। আমাদের রাজ্যেও এই পরিস্থিতিতে যা বহমান সত্য। আমাদের রাজ্যের প্রধান, যিনি সব বিষয়েই তাঁর একটি না একটি মন্তব্য আঁচলে গিঁট দেওয়া থাকে তাঁর নীরবতা কিংবা এই মুহূর্তের কিংকর্তব্য নিয়ে কোনো প্রাসঙ্গিক কথা আমাদের নজরে আসেনি। কী বলবেন তিনি, যখন ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় দেখি এক মাষ্টার মশায় যিনি তাঁর প্রিয় ছাত্র যাদের দিনের পর দিন পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি বসিয়ে নিত্যকার পাঠ দিয়েছেন তাঁরই ঘর পুড়িয়ে গুঁড়িয়ে দিয়ে যায় সেই প্রিয় ছাত্রদের কেউ, এমনকি তাঁর নিজেরও চাকরির পরীক্ষায় বসার মূল্যবান নোটস পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে যায় তখন নজরুলের লিখে যাওয়া কথা,‘আমি শুধু হিন্দু মুসলমানকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে হ্যান্ডসেক করানোর চেষ্টা করেছিলাম মাত্র’যে কত ঠুনকো হয়ে যায় এবং এই অনভিপ্রেত ঘটনার পিছনে যে কোনো পরিকল্পিত রূপরেখা ছিল না তা কি হলফ করে বলতে পারবেন তিনি! যুক্তবঙ্গকে ভাঙা যেমন ইংরেজের একটি প্রকল্প বা ‘স্কিম’ ছিল এবং যা পরে দেশভাগের মধ্যে দিয়ে প্রমাণও হয়ে গেছে, ওয়াকফের বিরোধিতায় ঘর পোড়ানো, মৃত্যু, গ্রামকে গ্রাম শুনশান করে দেওয়ার পিছনে এ ধরণের যে কোনো ‘স্কিম’নেই তা কি হলফ করে কেউ বলবে। ঘটনা শুরু হওয়ার তিনদিন পর যখন প্রশাসন যায়, যখন আক্রান্ত মানুষ রাজ্যের পুলিশ প্রশাসনের ওপর ভরসা না রেখে বিএসএফ বা কেন্দ্রীয় বাহিনী দাবি করে তখন নিরাপত্তার ঊর্ধ্বে সরকারের প্রতি অনাস্থার কথাই আক্রান্ত মানুষ বলেন। কেন তিনদিন অপেক্ষা করা হল তার উত্তরে, নলের শরীরে শনি প্রবেশ করতে যতটুকু সময় লাগে সেটুকু দিতেই এই বিলম্ব। তাহলে কি সাম্প্রদায়িক শক্তি আগে থেকেই ওৎ পেতে ছিল! নইলে আগে আগে ঘটে যাওয়া ইদ বা রামনবমীতে যখন সম্প্রীতির ছবি দেখে আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি তখন অন্তরালে অশুভ শক্তিরা ঝুপ মেরে বসেছিল বা মানুষের ভিড়েই লুকিয়ে ছিল এবং তাদের প্রস্তুতি সারছিল এই অঘটন ঘটাবে বলে। সামশেরগঞ্জের ঘরছাড়াদের আশ্রয় দিয়েছিল মালদহের যে বৈষ্ণব নগরের গ্রাম, না, সেই নগর পোড়েনি কিন্তু পুড়েছে সামশেরগঞ্জ। আর যে নৌকোর মাঝিরা তাদের নৌকো করে আক্রান্তদের রাতের অন্ধকারে পৌঁছে দিল বৈষ্ণবনগরের পারলালপুরে তাদের কী বলব! দেবতা, পয়গম্বর নাকি মানুষরূপী ভগবান! সংখ্যাগুরু গরিবের গ্রাম। মাছ ধরে, ভুট্টার চাষ করে। সেই তারাই যখন চাঁদা তুলে এই অসহায় আক্রান্তদের দিন রাতের খাবার ব্যবস্থা করে তখন মনে হয় সুড়ঙ্গের শেষে একটু হলেও আলো দেখা যাচ্ছে। তারা বুঝেছে-‘ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার।’কিন্তু এই আঁধারের মধ্যে জেগে থেকে এত বড়ো হৃদয় তারা কোথায় পেল! যা মানুষের ভোটে তৈরি হওয়া একটি সরকার পারল না। তারা সাম্প্রদায়িকতা বোঝে না। দাঙ্গা কী বোঝে না। শুধু বুঝেছে, ‘মানুষ বড়ো কাঁদছে..’। শেষ করব শঙ্খ ঘোষের একটি কথা দিয়ে,“…প্রশ্নটা কেবল প্রীতির নয়, প্রশ্নটা অধিকারের দায়িত্বের সম্মানের আত্মপরিচয়ের। সেইখানেই হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িকতা। দাঙ্গা তার খুব ক্ষণসাময়িক একটা প্রকাশ মাত্র। প্রতিদিনই আমাদের সমাজে যে মানসিক দাঙ্গা ঘটে চলেছে, মানসিক বিচ্ছেদের যে বিস্তার ছড়ানো আছে আমাদের পরস্পরের অজানা-অচেনায় তার চেয়ে ভয়াবহ সাম্প্রদায়িকতা আর কিছু নেই।”