পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

প্রতিবাদের কণ্ঠরুদ্ধ করাই লক্ষ্য

  • 22 July, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 961 view(s)
  • লিখেছেন : প্রশান্ত ভট্টাচার্য
'নিন্দারে করিব ধ্বংস কণ্ঠরুদ্ধ করি। নিস্তব্ধ করিয়া দিব মুখরা নগরী স্পর্ধিত রসনা তার দৃঢ়বলে চাপি মোর পাদপীঠতলে।... রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'গান্ধারীর আবেদন'এ এই দম্ভোক্তি করেছিল দুর্যোধন। শুনিয়েছিল পিতা ধৃতরাষ্ট্রকে। কিন্তু প্রজাদের কণ্ঠরুদ্ধ করেও শেষরক্ষা করতে পারেনি দুর্যোধন। এমনকী, মামা শকুনি, সখা কর্ণ ও ভাই দুঃশাসনকে নিয়েও পারেনি। মোদী কি পারবেন, সমস্ত শব্দকে স্তব্ধ করে দিয়ে প্রতিবাদ বন্ধ করতে?

'নিন্দারে করিব ধ্বংস কণ্ঠরুদ্ধ করি।
নিস্তব্ধ করিয়া দিব মুখরা নগরী
স্পর্ধিত রসনা তার দৃঢ়বলে চাপি
মোর পাদপীঠতলে।...
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'গান্ধারীর আবেদন'এ এই দম্ভোক্তি করেছিল দুর্যোধন। শুনিয়েছিল পিতা ধৃতরাষ্ট্রকে। কিন্তু প্রজাদের কণ্ঠরুদ্ধ করেও শেষরক্ষা করতে পারেনি দুর্যোধন। এমনকী, মামা শকুনি, সখা কর্ণ ও ভাই দুঃশাসনকে নিয়েও পারেনি। শকুনি বলতেই মনে পড়ে গেল ভারতের স্যসদে আর 'শকুনি' উচ্চারণ করা যাবে না। সাংসদদের মুখে লাগাম পরাতেই এই নকুন নির্দেশিকা জারি। কোপ পড়েছে আরও অনেক শব্দের ওপর। শব্দব্রহ্ম। এই বন্ধনে শব্দকে যে অর্থে ব্রহ্ম বলা হয়েছে, তা জানা বা না-জানা থাকলেও, শব্দকে কমবেশি ভয় পাই বা সমীহ করি আমরা সকলেই। কিন্তু বিপুল সংথ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েও মোদী সরকার দেখছি শব্দকে ভয় পাচ্ছে'। তাই নানা রকম নিষেধাজ্ঞা জারি করছে। সংসদের বাদল অধিবেশন শুরু হওয়ার আগে বুধবার প্রকাশিত হয়েছে ‘অসংসদীয় শব্দের’ একটি তালিকা। এই তালিকা প্রকাশ করে নিজেদের দীনতার-ই পরিচয় দিল মোদী সরকার। এমনটা দাঁড়াল, যে পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে কোনও কিছুকে ‘অসত্য’ বলা যাবে না, কাউকে ‘স্বৈরাচারী’, কাউকে 'দুর্নীতিগ্রস্ত’ বলা যাবে না বা ‘দালাল’ বলা বারণ। এমনকী, ‘দাঙ্গা’ শব্দটাও উচ্চারণ করা নিষেধ। এগুলো সব অসংসদীয়, বলেছে লোকসভা সচিবালয়। ফলে এমন শব্দ কেউ উচ্চারণ করলে স্পিকার এক্সপাঞ্চের নির্দেশ দেবেন। এটাই নয়া ফতোয়া। এখন কথা হল শব্দ হচ্ছে বহুমাত্রিক।
একটি শব্দের একটাই অর্থ নয়। বাক্যের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় বসে একই শব্দের ভিন্ন অর্থ প্রকাশ হতে পারে। দু’রকম করে বললে দুটো মানে বোঝানো যায়। আবার স্থান-কাল-পাত্র ভেদে শব্দের অর্থও বদলায়। কোন শব্দ ‘সংসদীয়’, কোনটা নয় তা ঠিক করার অধিকার কি রয়েছে কোনও সরকারের? ধরুন কালোবাজারি শব্দটা কি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ভারতীয় কোনও ভাষায় চালু ছিল কিম্বা সিন্ডিকেটবাজি শব্দটি কি অতি সাম্প্রতিক নয়! এছাড়াও, একুশের বিধানসভা নির্বাচনে বাংলায় সব চেয়ে উচ্চারিত ফ্রেজটি হচ্ছে, 'খেলা হবে', তা কি খেলা বলতে সেই বহু যুগের ওপার থেকে উচ্চারিত হয়ে আসা 'খেলা'র সঙ্গে কোনও সাযুজ্য তৈরি করে? সংঘজীবীরা (এই শব্দটি আমাদের এক সাংবাদিক বন্ধুর কয়েনেজ) কি জানেন, যে ‘রাম’ বললে ভগবানের নাম নেওয়া হয় তা দুবার উচ্চারিত হলে অর্থাৎ ‘রাম রাম’ হলে নিন্দাসূচক? এখানেই শব্দের মাহাত্ম্য। শব্দের মানে তারাই ঠিক করে, যে বলে আর যে শোনে। আর সে কারণেই মোদী সরকার এমন অনেক শব্দকে 'অসংসদীয়' বলে দেগে দিয়েছেন, যা এক্কেবারে নিরীহ। কিন্তু ওই যে বললাম, যে বলে আর যে শোনে, তারাই ঠিক করে শব্দের মানে। নইলে 'দাঙ্গা' শব্দটাও পার্লামেন্টে উচ্চারণ করা যাবে না! আসলে 'দাঙ্গা' শব্দটির সঙ্গে এমন এমন মানুষদের আত্মা জড়িয়ে আছে, যে শব্দটি কর্ণকুহর দিয়ে তাদের হৃদয়ে পশিলে মরমে মরে যায় তারা। কিম্বা উলটোটাও হয়ত হয়, যে তারা হিংস্র হয়ে ওঠে। আরও একটা শব্দ 'নাটক'। এই বিশেষ্য পদটি নন্দনতত্ত্বের অঙ্গ। মানুষের সৃষ্টিশীলতার একটি প্রকাশ। অথচ সরকারের ফতোয়া অনুযায়ী এই শব্দটি 'অসংসদীয়', কেন না, এটা যার উদ্দেশে বলা হচ্ছে, যেমন 'নাটক করছেন', তার স্বরূপটা নগ্ন হয়ে যাচ্ছে। অতএব নো নাটক! এভাবে কি ভাষাকে বেঁধে রাখা যায় মন্ত্রিমশাই!
এই ফতোয়া জারির পরেই বিরোধীরা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন। বিরোধীদের অভিযোগ, সাংসদদের মুখে ‘লাগাম পরাতে’ সক্রিয় হয়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। তাঁদের মতে, সেই শব্দগুলিকে ‘অসংসদীয়’ বলে দেগে দেওয়া হচ্ছে এবং সে কারণে তাদের ব্যবহার ‘নিষিদ্ধ’ করা হচ্ছে, সেগুলি মূলত মোদী সরকারের সমালোচনায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অর্থাৎ, মোদী সরকার তাদের নিন্দাসূচক কোনও শব্দ বিরোধীদের বলতে দিতে চায় না। তারা চায় বিরোধীদের ‘কণ্ঠরোধ’ করতে। এক্ষেত্রে বলা যায়, নিষিদ্ধ তালিকার অন্যতম শব্দ 'বিনাশপুরুষ', এই শব্দটি যে 'বিকাশপুরুষ'এর বিপ্রতীপ এটা সবাই বোঝে। বোঝে, অটলবিহারী বাজপেয়ীকে বিজেপি প্রথম 'বিকাশপুরুষ' বলে সম্বোধন করেছিল।
এখন কথা হচ্ছে, সরকার বা লোকসভার সচিবালয় যে যে শব্দের ওপর কাঁচি চালিয়েছে তা কি কোনওভাবেই উচ্চারণ করা যাবে না? আমরা যেমন ছোটবেলা থেকেই জানি, সংসদে বা বিধানসভায়, 'আপনি মিথ্যা বলছেন' বলা যাবে না, বলতে হবে, 'আপনি অসত্য বলছেন'। তেমনই আগামী সোমবার থেকে যে অধিবেশন বসছে, সেখানে 'বিশ্বাসঘাতক' বলা যাবে না, তবে কি এটা বলা যাবে, 'এটাকে বিশ্বাসঘাতকতা বলা যেতে পারে কিন্তু বলছি না’। নাকি সেটাও অসংসদীয় হবে? এই প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার একটি বহু চর্চিত ঘটনা উল্লেখ করছি।
একবার বিধানসভায় অধিবেশন চলাকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিরোধীদলের এক বিধায়ককে 'স্কাউনড্রেল' বলেন। অপোজিশন বেঞ্চ হই হই করে ওঠে। স্পিকার হাসিম আব্দুল হালিম মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলেন, 'আপনি এই শব্দ বলতে পারেন না।' তারপরই শব্দটি এক্সপাঞ্চের নির্দেশ দেন।
পরিষদীয় রাজনীতির চূড়ামণি জ্যোতি বসু তখন
স্পিকারের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'ঠিক আছে। কিন্তু স্কাউনড্রেলকে স্কাউনড্রেল বলা যাবে না তো কী বলা যাবে আপনি বলে দিন।' এই মহা উক্তিটি একইসঙ্গে 'সংসদীয়' আর 'অসংসদীয়' কোনটি নিয়ে একটি দার্শনিক প্যারাডক্স তুলে দিল। মোদী সরকার বা বিজেপির শব্দ নিয়ে এই কাণ্ডকারখানা দেখে জ্যোতি বসুর ওই ঘটনাটাই মনে পড়ছে। কেন না, কেউ যদি সংসদে নিজের বক্তব্য পরিষ্কার করে উপস্থাপন করতে 'নির্যাতন', 'লজ্জাজনক’, ‘‘বিশ্বাসঘাতকতা’, ‘নাটক’, ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’, ‘অযোগ্য’, ‘ভণ্ডামি’, 'দাঙ্গা'র মতো সব শব্দের অর্থ বোঝাতে চান, তবে তিনি কী করবেন? তা'হলে তো এর প্রতিশব্দের জোগানও দিতে হবে সরকার পক্ষকেই। তার বেলা! আমি মনে করি এটা শুধু ভারতেই হচ্ছে এমনটা নয়।
এটা নিরঙ্কুশ ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধবাদীদের ঠেকানোর একটি উপায়। এই প্রসঙ্গে গত বছর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। লেবার পার্টি সাংসদ ডন বাটলার (Dawn Butler ) তাঁর ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে হাউজে বারবার মিথ্যা বলার জন্য অভিযুক্ত করেন। ডেপুটি স্পিকার বাটলারকে lying শব্দটি নিয়ে আপত্তি করেন। এরপরেই বাটলারের উত্তর, 'It’s funny that we get in trouble in this place for calling out the lie, rather than the person lying'. যদিও এই মন্তব্যর জন্য ডেপুটি স্পিকার বাটলারকে হাউজ থেকে বের করে দিয়েছিলেন।
আসলে মানুষের প্রেম-ঘৃণা-ক্রোধ-আসক্তি প্রকাশের আউটলেট হচ্ছে ভাষা, কথ্যভাষা। এটা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায়, যখন স্বাভাবিকতাকে রুদ্ধ করার চেষ্টা হয়, তখন তার সঙ্গে ক্ষমতার একটি সমানুপাতিক সম্পর্ক থাকে। ক্ষমতা যখনই কারে পড়ে, তখনই ভাষাকে শৃঙ্খল পরাতে চেষ্টা করে। আর এর উলটো দিকেও একটা বিকাশ ঘটে, যেমন এখনই ঘটছে। ইতিমধ্যে কৃষ্ণনগরের সাংসদ মহুয়া মৈত্র টুইট করে নিষিদ্ধ শব্দের বিকল্প শব্দ তুলে ধরেছেন। অসংসদীয় হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে যে শব্দগুলি, সেগুলির পরিবর্ত হিসাবে প্রতিশব্দের একটি তালিকা তৈরি করছেন এই তৃণমূল সাংসদ। আর সেই অন্য শব্দগুলি বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও তীব্র কটাক্ষ। মহুয়া জানান, এবার থেকে ‘যৌন হেনস্তা’র বদলে ব্যবহার করা হবে ‘মিস্টার গগৈ’ শব্দটি। তৃণমূল সাংসদের নিশানায় দেশের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। প্রধান বিচারপতি থাকার সময় গগৈয়ের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগ উঠেছিল। শুক্রবার মহুয়া টুইট করে বললেন, ‘আইওয়াশ’ অর্থাৎ ‘চোখে ধুলো দেওয়া’র পরিবর্তে তিনি এবার থেকে ব্যবহার করবেন ‘অমৃতকাল’ শব্দটি। এবারে মহুয়ার নিশানায় খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কেন না, স্বাধীনতার ৭৫ বছর থেকে ১০০ বছর পর্যন্ত এই ২৫ বছর সময়কে ‘অমৃতকাল’ হিসাবে উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। মহুয়া-ভাষ্যে এই ‘অমৃতকাল’ আসলে ভাঁওতাবাজি বা আইওয়াশ। এর পাশাপাশি কোন কোন শব্দ সংসদে এখনও ব্যবহার করা যাবে, তারও একটি তালিকা প্রকাশ করেছেন মহুয়া। সেই তালিকায় রয়েছে --
'বুলডোজার', 'থোক দো', 'গোলি মারো', 'ঘর মে ঘুস কে মারা', 'লাল আঁখ সে'র মতো শব্দবন্ধ। পাঠক খেয়াল করে দেখুন, এই শব্দবন্ধগুলি একাংশ বিজেপি নেতার প্রিয়। বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে ঘৃণাভাষণে, বিদ্বেষভাষণে এইগুলি ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। শিবসেনার সাংসদ প্রিয়ংকা চতুর্বেদী টুইট করেছেন, 'সেই পুরানো মিমটার কথা মনে পড়ে গেল। আপনি যদি করেন তবে কী করবেন, আপনি যদি বলেন কী বলবেন? শুধু বাহ মোদীজি বাহ! সেই জনপ্রিয় মিমটি এখন সত্য বলে মনে হচ্ছে।'
এগুলো তো ঢিলের পালটা পাটকেল কিম্বা প্রতিরাজনীতি। কিন্তু কথা হচ্ছে কোন শব্দ ‘অসংসদীয়’ এটা বিচার করবে কে? 'অসংসদীয়' শব্দের তালিকা তৈরির অধিকার কি আদৌ সরকারের আছে? বিশেষ করে মোদী সরকারের। যে সরকারের প্রধানমন্ত্রী পোশাক উল্লেখ করে বিভেদ তৈরিতে ইন্ধন দেন। সেই সরকারের কি এধরনের তালিকা তৈরি করার কোনও নৈতিক অধিকার আছে? আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার তো আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাংসদের রাজনৈতিক দল। সেই রাজনৈতিক দল কি এরকম একটি তালিকা তৈরি করতে পারে? কোন শব্দ সংসদীয় আর কোনটা নয়,
এটা নির্ধারণ করা উচিত আদালতের। সংবিধান এবং ভাষাবিদদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মতামতও নেওয়া উচিত। নইলে নৈরাজ্য বাড়বে বই কমবে না।

0 Comments

Post Comment