পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

মুসলিম নারীদের ভোট কোনদিকে?

  • 08 March, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 558 view(s)
  • লিখেছেন : মৌমিতা আলম
সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষমতায়ন আর চাকরি - এই অধিকারের দাবি তোলার মতন স্বর তৈরি না করতে পারলে, মন্দের ভালো বা লেসার এভিল কে ভোট দেওয়া চলতেই থাকবে। উদার অর্থনীতির হাত ধরে আসা কনজিউমারিজম এখন প্রতিটি মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। আর দক্ষিণপন্থী দলগুলোর সাফল্য এখানেই।

ঘটনা - ১

ভোটত এইবার, কি হবে বুবু!

"কি আরো, মমতাক ভোট দিমো!" ঘর মুছতে মুছতে বললেন হাজরা বুবু।

কেনে খালি মমতাক ভোট দিবেন! লক্ষীর ভান্ডার দ্যাছে বলি?

হাজরা বুবু ঘর মোছা থামিয়ে বললেন, "লক্ষীর ভান্ডার দ্যাছে আর তাছাড়া মুসলমানের আর কায় আছে? তোমরা কি মুদিক ভোট দিবেন?"

হাজরা বুবুর এই দুটো প্রশ্নের উত্তর খুব গভীরভাবে না ভাবলেও উত্তর খুব স্পষ্ট একজন সংখ্যালঘু মানুষের কাছে। আমরা যারা ফেসবুকে একটু ডানা ঝাপটাই, এদিক ওদিকের খবর রাখি তাদের কাছে, মমতা - মোদি বাদ দিয়ে তৃতীয় কোনোকিছুর অবস্থান একটু স্পষ্ট হলেও, উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার পিছিয়ে থাকা এক মহিলার কাছে তৃতীয় কোনো শক্তির অবস্থান স্পষ্ট নয়। তাদের রোজকার জীবন ছুঁয়ে থাকে লক্ষীর ভান্ডার, বাচ্চার সাইকেল, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড, আধার কার্ডে নানা সমস্যা, এন আর সি নামক ভূত আর বিজেপির জুজু। আর এই সমস্যা গুলো বা সুবিধাগুলো পেতে যাদের দ্বারস্থ হতে হয় বা যাদের কাছে পায় তারা দুই "ম" শিবিরের লোক। খুব কষ্ট হলেও বলতে অসুবিধে নেই তৃতীয় শক্তির উপস্থিতি হাজরা বুবুর মতন লোকজনের কাছে অধরা।

ঘটনা - ২

রব্বানী (নাম পরিবর্তিত) বড় আব্বা আর বড় আম্মার মধ্যে ঝামেলা। বড় আম্মা ক্ষেপে আগুন। বড় আব্বা, বড় আম্মার লক্ষীর ভান্ডারের সব টাকা নিয়ে নিয়েছে। বড় আম্মা রেগে গিয়ে বলছে, "মোর টাকা তোমরা নিলেন ক্যানে!" বড় আব্বা ক্ষেপে গিয়ে তুমুল ঝগড়ার মাঝে বলে দিয়েছে… তালাক…তালাক…তালাক। তারপর সমাজিক বিচার ও শেষপর্যন্ত আলাদা থাকার বন্দোবস্ত।

 

জীবনের সায়াহ্নে পৌঁছে, এক মহিলা জোর গলায় বলছে, "মোর টাকা তোমরা নিলেন ক্যানে!" এই যে "মোর টাকা", এই দৃঢ়তা, এই ক্ষমতা দিয়েছে লক্ষীর ভান্ডার। যতই আমরা ডোল পলিটিক্সকে দোষ দিই না কেন, এই দৃঢ়তা, এই দৃপ্ততাকে অস্বীকার করলে আসলে অস্বীকার করা হবে বাস্তবকেই। কেন এই ডোল পলিটিক্স এত জনপ্রিয়তা লাভ করলো তা নিয়ে আলোচনা চলতেই পারে। কিন্তু এর প্রভাব পশ্চিমবঙ্গ তথা সমগ্র ভারতবর্ষে অস্বীকার করার উপায় নেই। এর প্রভাব এতটাই গভীর যে নরেন্দ্র মোদী একসময় এটাকে রেউরী (revdi) রাজনীতি হিসেবে ব্যঙ্গ করলেও তার দল বিজেপি এখন এই রাজনীতি নিয়েই কিছু রাজ্যে এগোতে চাইছে।

বামফ্রন্ট সরকারের শেষের দিকে প্রকাশিত সাচার কমিটির রিপোর্ট স্পষ্ট করে দেয়, পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের দুরবস্থার কথা। ২০০০ সালের কাছাকাছি সময় থেকে চালু হওয়া স্কুল সার্ভিস কমিশন ও পরবর্তী সময়ে মাদ্রাসা সার্ভিস কমিশনের সুবাদে কিছু চাকরি হতে শুরু করে এ রাজ্যে। আর সেই চাকরির সুবিধা পায় তুলনামূলকভাবে শিক্ষায় এগিয়ে থাকা মুসলিম পরিবারে ছেলে মেয়েরা। আজকে প্রতিটি শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে ২ - ৩ কিলোমিটার দূরে যে মুসলিম বসতিগুলো দেখা যায়, যেগুলোকে ঘেঁটো বললেও অত্যুক্তি করা হয় না, এই মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্ম বেশিরভাগ এই সার্ভিস কমিশনগুলোর হাত ধরেই। নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও নিয়মিত হলে হয়তো হাজরা বুবুর মতন পরিবারের মেয়েরাও সমাজের সবথেকে নীচুশ্রেণী থেকে মধ্যবিত্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখতো। কিন্তু ২০১১ সালের পর থেকেই নিয়োগ অনিয়মিত হয়ে পড়ে। যেটুকুও হয়েছে তাতেও হয়েছে পাহাড় সমান দুর্নীতি। আর তৃতীয় শক্তি, পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে নির্বাচনী রাজনীতিতে বিস্বাস করা বাম দলগুলির ক্ষয় মানুষের থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায়, দক্ষিণপন্থী দলগুলোর পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি মানুষকে মৌলিক অধিকার দাবির রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। স্কুলে শিক্ষক কেন নেই - এই প্রশ্নের থেকে, কন্যাশ্রীর টাকা বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। দুটোই যে হকের দাবি, সেটা কে বোঝাবে? সেটা বোঝাতে পারতো বা পারে বামপন্থী দলগুলো।

২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের পরপরই বামদলগুলোর ক্ষয়ের মধ্যে দিয়ে বিজেপির দাপাদাপি শুরু হয় পশ্চিমবঙ্গে। এতে সব থেকে বিপদে পড়ে বাংলার মুসলমান। একদিকে চরম দুর্নীতি আর অন্যদিকে মুসলিমবিরোধী এক দল। রাজনৈতিকভাবে মুসলিমদের কাছে আর কোনো চয়েস থাকেনা তৃতীয় শক্তির অনুপস্থিতিতে। সংখ্যালঘু ভোট বাই ডিফল্ট তৃণমূলের দিকে চলে যায়। আর যেহেতু তৃণমূল স্তরে পিছিয়ে পড়া মানুষজনের হকের রাজনীতি দাবি করার না আছে স্বর, না আছে রাজনৈতিক সচেতনতা, তাই এই ডোল পলিটিক্সটাই মন্দের ভালো হয়ে উঠেছে। যখন একটি সম্প্রদায়ের নিজস্ব রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি হবেনা, নারীর আরও পিছিয়ে যেতে বাধ্য। যাক কিছু তো পাচ্ছি! এই বোধের স্বীকার হয়ে ভোট দেবে, সেটাই স্বাভাবিক।

আর একমাস পরে যখন মুসলমান মহিলারা ভোট দিতে যাবেন তখন এটা নিশ্চিত যে লক্ষীর ভান্ডারের কথা মাথায় রেখেই ভোট দিবেন। সুমারি ভাবি বলে, "মমতা হারিলে লক্ষীর ভান্ডার বন্ধ হয়া যাবে!"

তাই এবারের ভোটেও মুসলিম মহিলাদের ভোট মমতার দিকেই। সেই ভোটে মমতা বাঁচবে কিনা জানা নেই তবে এটুকু অস্বীকার করে লাভ নেই যে, "হামার টাকা" বলার সাময়িক ক্ষমতায়ন কিন্তু লক্ষীর ভান্ডার করেছে মহিলাদের। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষমতায়ন আর চাকরি - এই অধিকারের দাবি তোলার মতন স্বর তৈরি না করতে পারলে, মন্দের ভালো বা লেসার এভিল কে ভোট দেওয়া চলতেই থাকবে। উদার অর্থনীতির হাত ধরে আসা কনজিউমারিজম এখন প্রতিটি মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। আর দক্ষিণপন্থী দলগুলোর সাফল্য এখানেই। গ্রামের এক সাধারণ ভোটার কে ন্যায় আদায়ের জন্য মিটিংয়ে আসতে বললে জিজ্ঞেস করে, "কয় টাকা দিবেন!" এর থেকে মুক্তি কোথায়! এইসময়ে ৫০০ থেকে ১০০০ হওয়া লক্ষীর ভান্ডার যদি ভোটবাক্সে ম্যাজিক দেখায়, পাঠক চমকে যাবেন না যেন!

হাজরা বুবুর - "লক্ষীর ভান্ডার দ্যাছে আর মোসলমানের কায় আছে!" - এই শব্দগুলোর প্রতিধ্বনি নীরব হলেও কিন্তু ব্যাপক।

 

 

 

0 Comments

Post Comment