পুলাপ্রে বালকৃষ্ণন এবং অমন রাজ, প্রথম জন অর্থনীতির অধ্যাপক ও দ্বিতীয় জন অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করছেন। ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে তাঁদের করা একটি সমীক্ষা প্রমাণ করে যে, অঘোষিত যুদ্ধ গরীবের বিরুদ্ধে জারি করেছে 'নতুন ভারত'। সেই সমীক্ষা 'বৃহত্তর অর্থনীতি'র প্রকৃত চরিত্র উত্থাপন করে দেখায়, গ্রামের ৪০ শতাংশ জনগণ দু’বেলা পেট ভরে খেতে পান না, ৯৫ শতাংশের রোজগারের নাগালের বাইরে দু'বেলা মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদি আমিষ জাতীয় খাবার। শহরের ১০ শতাংশ জনগণ দু'বেলা পেট ভরে খান না। ৫০ শতাংশ জনগণ আমিষ ও নিরামিষ খাবার দু'বেলা ভাগ করে খেতে পারেন না। প্রতিদিন ১৫৪ জনের বেশি কৃষক, ক্ষেতমজুর ও দিনমজুর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন, বছরে ১৩ হাজারের বেশি পড়ুয়া নিজেদের জীবন শেষ করে দেন। এর মধ্যে ১০,২৯৫ জন পড়ুয়ার বয়স ১৮ বছরের নিচে (ছাত্র ৪,৬১৬, ছাত্রী ৫,৫৮৮)। 'এনসিআরবি' রিপোর্ট (২০২২-২৩ সাল)-এ এমনি মর্মান্তিক চিত্র ধরা পড়ে। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ১৪,২৬৪ জন শ্রমিক মারা গেছেন(২০১৮-২০২২) কর্মক্ষেত্রে বেহাল পরিবেশ, সামাজিক সুরক্ষা, ন্যূনতম মজুরির থেকে বঞ্চিত হওয়ার ফলে।
এই মৃত্যু উপত্যকা, ভয়াবহ দারিদ্রতা সর্বস্ব 'নতুন ভারত'-এর কথা নিশ্চয়ই বিরোধী রাজনৈতিক দল, তথাকথিত শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক দল সিপিআইএমের নেতৃত্বেরও অজানা নয়। তার পরেও তাঁরা ভারত ও পাকিস্তানের শাসক শ্রেণির যুদ্ধের কাছে নিজেদের সমর্পণ করলেন, আরএসএসের মোদির বিজেপির অপারেশনে ব্রাহ্মণ্যবাদী 'সিঁদুর' মাখলেন। নির্ধারিত ধর্মঘটের পাঁচ দিন আগের (১৫ মে, ২০২৫) সন্ধ্যায় এক শ্রমিক অঞ্চলে ২০ মে সাধারণ ধর্মঘট নিয়ে জোর কদমে প্রচার চলছে। সেই সময় জানা গেল যে, ২০ মে সাধারণ ধর্মঘট বাতিলের কথা। বেশির ভাগ শ্রমিকেরা হতাশ, রেগে গেছেন। বিসিএমইউ (সিটু অনুমোদিত কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন)-এর এক নিম্নবর্ণ-শ্রমিক বললেন, 'আমাদের পলিটব্যুরো সদস্যেরা সব বিক্রি হয়ে গেছে'। আরেক ধাপ এগিয়ে এক মুসলমান-শ্রমিক বলেন, 'মোদির সুপরিকল্পিত যুদ্ধ বন্ধ করে রুটিরুজির দাবি তোলার রাস্তা ছিল এই সময়ের এই ধর্মঘট'। শ্রমিকের এমন বিদ্রোহী ভাবনাকে চাপা দিতে তাদের (বিসিএমইউ) এক নেতা(উচ্চবর্ণের পাতি বুর্জোয়া) বলেছিলেন, 'দেশের এই পরিস্থিতিতে ধর্মঘট করা যায় না, এতে আমাদের পক্ষে সাধারণ মানুষ আসবে না'। খেই হারিয়ে সেই নেতা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন, সরাসরি দক্ষিণপন্থার রাস্তা ধরেন। লেখককে প্রশ্ন করেন, 'ভারত রাষ্ট্র এখন পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদীদের দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত, এই দুঃসময় আপনি রাষ্ট্রের পক্ষে নন'? একতরফাভাবে ২০ মে সাধারণ ধর্মঘট বাতিলের সিদ্ধান্ত অধিকাংশ শ্রমিক সংগঠন ও তাদের কর্মীদের হতাশ করেছে, মনোবল অনেকটাই ভেঙে দিয়েছে। এ কী শ্রমিকের ঐক্যে, শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক লড়াইয়ে শাসক শ্রেণির এক প্রকারের অন্তর্ঘাত?
ইতিহাসে এমন ঘটনার নজির কম নেই। বহু সময় শ্রমিক শ্রেণির বিদ্রোহী মনোভাব, বিদ্রোহী কর্মসূচিগুলি সাজঘরে ভেস্তে যাওয়ার ফলে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদী শক্তির হাত শক্ত হয়েছে, শ্রমিক শ্রেণির লড়াই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে এটি একটি দিক, আরেকটি দিকে শ্রমিক শ্রেণির পুনরায় গড়ে ওঠার ইতিহাসও রয়েছে। বর্তমানও তার বাইরে নয়। ওই দিনই (২০ মে, ২০২৫) পাঞ্জাবের সাঙ্গরুর জেলার ‘বীর এশওয়ান’ (বেচিরাগ বা আলোহীন) গ্রামে নিম্নবর্ণের ভূমিহীন কৃষকেরা ‘জমিন প্রাপ্তি সংঘর্ষ কমিটি’র নেতৃত্বে জিন্দ রাজপরিবারের ৯২৭ একর খাস জমি দখলের ডাক দেন। এর উপরে প্রবল আক্রমণ নামায় শাসক শ্রেণিগুলির নেতৃত্বকারী পাঞ্জাবের আপ সরকার। প্রায় ৮৫০ জনকে গ্রেফতার করা হয়, যাঁদের মধ্যে অর্ধেক জনই ছিলেন মেয়েরা। পাশাপাশি এই সময়তেই চলে পাঞ্জাব, হরিয়ানা প্রভৃতি রাজ্য জুড়ে কৃষকের ফসলের অধিকার, ফসলের ন্যায্য মূল্য, ঋণ মুকুবের মত গুরুত্বপূর্ণ দাবির লড়াই। সম্প্রতি জানা গেছে যে, এই বছরে প্রথম তিন মাসে (২০২৫, মার্চ পর্যন্ত) কেবলই মহারাষ্ট্রে ৭৬৭ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন(যা গত বছরে প্রথম ছয় মাসের নিরিখে কৃষকের আত্মহত্যার সংখ্যার থেকে অনেকখানি বেশি।)। জমি কেড়ে নেওয়া, ঋণের জালে জড়িয়ে পড়া, ফসলের দাম না পাওয়ার কারণে। একই সময় চলতে(গত বছরের শেষ থেকে) থাকে আদিবাসীদের জল-জঙ্গল-জমিন দখলের হিংসাত্মক অপচেষ্টা। শাসক শ্রেণিগুলি ছত্তিশগড়ে, মাওবাদী খতমের বিজ্ঞাপনে বেপরোয়াভাবে সন্ত্রাসীপন্থায়, 'অপারেশন কাগার' পরিচালান(এখনও করছেন) করেন। গত ২৬ ও ২৭ জুন ছত্তিশগড়ের পালমা সেক্টর ২ ব্লকে কেটে ফেলা হয় ৫ হাজার গাছ। 'নতুন ভারত'-এর লক্ষ্য এই অঞ্চলের ২১৫ হেক্টর জঙ্গল পুরোপুরি সাফ ও ১৪টি গ্রামের আদিবাসীকে উচ্ছেদ করার মধ্য দিয়ে ৬৫৫.১৫৩ মেট্রিক টন কয়লা বিদেশি লগ্নি পুঁজি নিয়ন্ত্রিত আদানি গোষ্ঠীর কুক্ষিগত করা (আরএসএসের মোদি'র বিজেপি সরকার ২০১৫ সালে এই অঞ্চলটিকে আদানি গোষ্ঠীর হাতে সঁপে দিয়েছে।)। এই দুঃশাসন, অসহ্যকর অত্যাচার, অনাচারের বিরুদ্ধে আদিবাসী সমাজ চুপ নেই, জঙ্গি আন্দোলনের পথ ধরেছেন। তাঁরা বলছেন, ‘একটা সময়ে এইসব অঞ্চলে মাওবাদীদের ব্যাপক দাপট ছিল। লাগাতার অভিযানের জেরে এখন মাওবাদীরা খানিকটা কমজোর হয়েছে। এরপরই আদানিদের হাতে আদিবাসীদের জঙ্গল ও জমি তুলে দিয়ে শুরু হয়েছে রাক্ষুসে উন্নয়ন।’ এমনিতেই 'নতুন ভারত'-এ অনুর্ধ্ব ৫ বছরের ৩৬ শতাংশ শিশু দীর্ঘস্থায়ীভাবে অপুষ্টিতে ভুগছেন। ৩২ শতাংশ শিশুর ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম। অর্ধেকের বেশি যুবতী ও মাঝবয়সী(১৫ থেকে ৪৯ বছর) মেয়েরা রক্তাল্পতার শিকার, তা ৪.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছিল ৫৭.২ শতাংশে( ২০১৬-২০২০)। অথচ, বিগত এক দশকে একশো শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগ নিশ্চিতিকরণে সুফল হিসেবে লগ্নি পুঁজি নিয়ন্ত্রিত বৃহৎ পুঁজিপতির সংখ্যা দ্বিগুণ পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এঁদের বিপুল পরিমাণে কর ছাড় দেওয়া হয়েছে( আগের তুলনায় প্রায় ৯ শতাংশ হারে কর ছাড় দেওয়া পরিমাণ বেড়েছে), ব্যাংকগুলি ১৪.৫৬ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ মুকুব করেছে। উপরন্তু, শ্রমিকের মজুরির হার কমেছে ৪.১ শতাংশ( ২০১৬-২০২১), সিংহ ভাগ সংগঠিত ও অসংগঠিত জায়গাতেই শ্রমের সময় বেড়ে হয়েছে ১০-১৪ ঘণ্টা, শ্রমিকেরা সামাজিক সুরক্ষার সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। এমনকি, এদেশের মাটিতে 'সেজ' আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বিদেশি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের তথ্য প্রযুক্তি শিল্পগুলিতে মেয়ে কর্মী বা সাদা পোষাকের মেয়ে শ্রমিকেরা ন্যূনতম মজুরি পাওয়ার অধিকার, মাতৃত্বকালীন ছুটি, ক্রেশ ইত্যাদি নানা ধরনের ন্যূনতম অধিকারগুলি থেকে বঞ্চিতই রয়েছেন। তাঁদের কাজের সময় বাড়ছে, লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে, তা পূরণ না করতে পারলেই হাতে 'পিঙ্ক স্লিপ'(ছাঁটাই) ধরানোর প্রথা চালু আছে। এমনি অবস্থা গিগ শ্রমিকদেরও। সংগঠিত শিল্পক্ষেত্রে(যা ৫ শতাংশের থেকেও কম) ঠিকা শ্রমিকের হার ৩১ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে। রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠানগুলিতে মোট কর্মীর হার সারা বিশ্বে সর্বনিম্ন(৩.৮ শতাংশ), এমনি অভিযোগ, 'ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনে'-এর।
রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থা রেলের অবস্থা তথৈবচ। বিভিন্ন সময়ে রেলের দুর্ঘটনা, তা নিয়ে অনেক রিপোর্ট ভারতীয় রেলের পরিকাঠামো ও নিরাপত্তার উলংগ চেহারাকে সকলের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। এর পরিকাঠামোগত উন্নয়নের ঘাটতির পরিমাণ ১,০৩,৩৯৫ কোটি টাকা। একটি রিপোর্ট অনুযায়ী(২০২৩), রেলে ৩৭ শতাংশ দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। একটি আরটিআই অনুসারে, ৩.১১ লক্ষ পোস্ট ফাঁকা রয়েছে। একই অবস্থা সড়কপথে যাতায়াতের। সরকারি বাসের দশা আগেই খারাপ হয়েছিল। এখন বেসরকারি বাসের ছাঁটাই পর্ব চলছে। একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, এই রাজ্যে গত ৭-৮ বছরে শহর থেকে শহরতলিতে প্রায় ১০০টির বেশি বাস রুট বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দৈনিক ২ হাজার ৫০০টি সরকারি বাসের সংখ্যাটা বর্তমানে কমে দাঁড়িয়েছে ৭০০-তে। বেসরকারি বাস মালিকদের রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকার যথাযথ সুযোগ, সুবিধা ও ভর্তুকি না দেওয়ায় তাঁরাও সরকারি বাসগুলিকে লিজে নিয়ে চালাতে পারছেন না। বরং, ব্যবসায় ঘাটতি বাড়ায়, বেসরকারি বাসগুলিকে আরও কমিয়ে দেওয়ার চিন্তা করছেন। রাজ্যের পরিবহণ দফতরের তথ্য অনুযায়ী, করোনার আগে কলকাতায় ৪ হাজার ৮৪০টি বেসরকারি বাস চলাচল করত। এখন শহরে চলছে মোট ৩ হাজার ৬১৫টি বাস। মিনিবাসের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৬৪টি। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৯৮-এ। অবশ্য এই তথ্য প্রকাশের পর আরও ৫৫০টি বাস বন্ধ করে দিয়েছেন বাস মালিকেরা, অতিরিক্ত পরিমাণে খরচ ও লাভের পরিমাণ কমে যাওয়ায় না কুলোতে পেরে। ২০২৫ শেষে আরও ১ হাজার ৫০০টি বেসরকারি বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। শূণ্যস্থান ফাঁকা থাকে না, এর বদলে জায়গা করে নিচ্ছে, বিদেশি লগ্নি পুঁজি নিয়ন্ত্রিত অ্যাপ ভিত্তিক বহুজাতিক সংস্থা ওলা, উবের ইত্যাদি। শাটেল বাস, চার চাকা প্রভৃতি। ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসাদার, ছোট পুঁজিপতিদের অবস্থাও আশঙ্কাজনক। তাঁরাও লগ্নি পুঁজি নিয়ন্ত্রিত দেশি-বিদেশি বৃহৎ পুঁজির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অভিযোগ, বৃহৎ পুঁজির একচেটিয়া রাজত্বে তাঁদের ব্যবসা দৈনন্দিনভাবে তলানিতে ঠেকছে। ২০২৩, খুচরো পাইকারি ব্যবসা ও ডিস্ট্রিবিউটর হাউজের মালিকদের সংগঠনগুলি অনলাইন ও জিও মার্ট, বিগ বাস্কেট, মোর ইত্যাদির মত লগ্নি পুঁজি নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে 'অসহযোগ আন্দোলনে'র ডাক দেন, এ নিয়ে আরএসএসের মোদি'র(প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কারণে) বিজেপি সরকারকে চিঠি দেন।
স্বভাবতই গরীব আরও গরীব হওয়ার জাঁতাকলে পিষে সমাজে স্কুল ছুট ও শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বাড়ছে। গোটা দেশে এক দশকে (২০১৪-২০২৪) সরকারি স্কুলের সংখ্যা ৮ শতাংশ কমেছে, বেসরকারি স্কুলের সংখ্যা ১৫ শতাংশ বেড়েছে। যেখানে জোর দেওয়া হয়েছে, প্রযুক্তিগত শিক্ষায় দক্ষ-শ্রমিক তৈরিতে ও ব্রাহ্মণ্যবাদী শিক্ষার উপরে, যা সম্পূর্ণভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব শক্তি আরএসএস ও লগ্নি পুঁজি নিয়ন্ত্রিত দেশি-বিদেশি বৃহৎ পুঁজিপতিদের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলির কাজে লাগবে। এই নিয়ে ছাত্র সমাজের মধ্যে কাজ করা অনেক সংগঠন, ছাত্র সংগঠনগুলি গভীর আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, প্রতিবাদে সরব হয়েছেন, আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এরা প্রত্যেকেই বিরোধিতা করছেন 'নয়া শিক্ষা নীতি'র, যা 'নতুন ভারত' গঠনে শ্রমকোডের সময়তেই পাশ করানো হয় সংসদ থেকে। শিক্ষা মন্ত্রকের 'স্কুল শিক্ষা ও স্বাক্ষরতা বিভাগ'-এর তথ্য অনুসারে সারা দেশে ১১.৭০ লক্ষের বেশি ছাত্রছাত্রী স্কুলের বাইরে ছিল, আর্থিক বছরে(২০২৪-২৫) প্রথম আট মাসে। স্কুল-বহির্ভূত শিশু বা ছাত্র-ছাত্রীদের সর্বাধিক সংখ্যা আরএসএসের যোগী আদিত্যনাথের বিজেপির উত্তরপ্রদেশে, ৭.৮৪ লক্ষ। কেবল মাত্র এই রাজ্যে ২৫,১২৬টি সরকারি স্কুল বন্ধ হয়েছে, ১৯,৩০৫টি বেসরকারি স্কুল গজিয়েছে। এক দশকে গোটা দেশ জুড়ে প্রায় ৯০ হাজারের উপরে সরকারি স্কুল বন্ধ করা হয়েছে।
এখন ডলারের তুলনায় ক্রমাগত ভারতীয় মুদ্রার দাম কমছে( বর্তমানে প্রায় ৮৬ টাকা) ফলে মূল্যবৃদ্ধি ঘটছে, প্রতিনিয়ত গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেল, দাম বাড়ছে, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম রোজগারের তুলনায় অনেকখানি বেড়ে গেছে। বেকারত্বের হার মাস প্রতি বেড়েছে(২০২৫, এপ্রিল মাসে ছিল ৫.১, তা মে মাসে দাঁড়িয়েছিল ৫.৬)। আসলে 'নতুন ভারত' দেশের জনগণের বিরুদ্ধেই অঘোষিত যুদ্ধ থেকে ঘোষিত যুদ্ধের পথে হাঁটা জারি রেখেছে। বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির বাজার দখলের সমঝোতায় ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধে 'সিজ ফায়ার' ঘোষণা করা হলেও দেশীয় পুঁজি ও শ্রমজীবী জনগণের বিরুদ্ধের যুদ্ধ ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে 'নতুন ভারত'-এ। প্রধানত, তিন ভাবে। এক, অর্থনৈতিক, দুই, সামরিক, তিন, রাজনৈতিক। বিদেশি লগ্নি পুঁজির হাতে দেশের বাজার, জল-জঙ্গল-জমি, শ্রমশক্তি, খনিজ সম্পদ - সর্বস্ব সঁপে দিতে মরিয়া হয়ে উঠেছে, 'নতুন ভারত'-এর নতুন শাসক শ্রেণিগুলি। যারা ব্রাহ্মণ্যবাদী মতাদর্শ ও রাষ্ট্রীয় সামরিক বাহিনীর দ্বারা সন্ত্রাসীপন্থায় লুঠ-পাট চালাচ্ছে, এর পাশাপাশি শ্রমিক শ্রেণির ঐক্যে, রাজনৈতিক লড়াইয়ে নানা ধরনের ছোট-মাঝারি অন্তর্ঘাতের দ্বারা ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করছে, লড়াকু জনগণের মনোবল ভেঙে দেওয়ার অঙ্ক সাজিয়ে। যার ফলে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদী রাজনীতির উত্তরণ ঘটছে - নারী, দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘুদের উপর হিংসাত্মক অত্যাচার বাড়ছে, ক্ষমতাধারী রাজনৈতিক দলগুলি জনসম্মুখে ধর্ষনের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার দুঃসাহস দেখাতে পারছে। সর্বোপরি মূল ধারার বা মূল স্রোতের রাজনীতির থেকে জনগণের মৌলিক অধিকারগুলিকে বাইরে দেওয়ার ও এই দেশের মাটিতে অন্যায়, অনাচার, দুঃশাসন যুক্ত ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদকে স্থায়িত্ব দেওয়ার নিকৃষ্টতম প্রচেষ্টা চলছে। এর বাইরে পশ্চিমবঙ্গ নয়। এই রাজ্যে সরাসরি শ্রমকোড না লাগু হলেও সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রগুলিতে শ্রমকোডের বিধিনিষেধ নানাভাবে লাগু রয়েছে। লগ্নি পুঁজির চাপে শ্রমিকের জীবনের দাম ঠিকাদারেরা প্রতি দিনের মজুরির 'রেটে' কেনা-বেচা করে।
তথাকথিত শ্রমিক শ্রেণির রাজনৈতিক দল সিপিআইএমের ২০ মে সাধারণ ধর্মঘট বাতিলের সিদ্ধান্তে অনেক লড়াকু ট্রেড ইউনিয়ন, বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি সমালোচনা করে বিবৃতি জারি করেছে। সেই সময়ে সাধারণ ধর্মঘট বাতিলের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না কি শ্রমিক শ্রেণির রাজনীতিতে অন্তর্ঘাত তা ইতিহাস ধরে বর্তমান দেখলে অনেকটাই অনুমেয়, বাকিটা ভবিষ্যতের গর্ভে। তবে এখন রাজনৈতিক দল সিপিআইএমও সাধারণ ধর্মঘটের প্রচারে জোর দিয়েছে(না দিলে তাদের আরও শক্তিক্ষয় হতে পারে।)। ৯ জুলাইয়ের সাধারণ ধর্মঘট আদতে একচেটিয়া লগ্নি পুঁজি নিয়ন্ত্রিত বৃহৎ পুঁজিপতি ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সকল অংশের জনগণের। এই সাধারণ ধর্মঘট নিজেকে বাঁচানোর, নিজের পরিবারকে বাঁচানোর, সন্তানদের স্থায়ী ভবিষ্যত সুনিশ্চিতিকরণের লক্ষ্যে। এটি এই মুহূর্তে ব্রাহ্মণ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী হিংস্রতার কবল থেকে দেশকে বাঁচানোর স্বার্থের প্রকৃত জাতীয়তাবাদী, দেশপ্রেমিক কর্মসূচির ডাক; শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্ত, ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসাদার, ছোট পুঁজিপতি ইত্যাদি ব্যাপক অংশের জনগণের। তাই এই সাধারণ ধর্মঘট প্রাথমিকভাবে চলমান প্রতিবাদ, আন্দোলনগুলিকে আরও শক্তিশালী করবার কাজে আসবে। দীর্ঘস্থায়ীভাবে তা আবার শাসক শ্রেণিগুলির চাপিয়ে দেওয়া সুপরিকল্পিত যুদ্ধ - এর বিরুদ্ধে জনগণের প্রয়োজন ভিত্তিক টেকসই উন্নয়নে 'নতুন গণতান্ত্রিক ভারত' গড়ে তোলার লক্ষ্যে অগ্রসরে সদর্থক ভূমিকা নিতে পারে। এখানেই সাধারণ ধর্মঘট সফল করার রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।