পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

সারাদিনের ক্লান্তি আমার…

  • 27 October, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 621 view(s)
  • লিখেছেন : সাত্যকি মজুমদার
সারাদিন পশ্চিমের জানলার সামনে বসে আছি। নগর কোলাহল আমার পায়ের নিচে, শ্রাবণ শেষের মেঘ মাথার উপরে। এই মেঘ যখন আরও উন্মত্ত, আষাঢ়ের এমন এক দিনে মিলান কুন্দেরা চলে গেলেন। দীর্ঘ অসুস্থতা পেরিয়ে, তিনি যন্ত্রণামুক্ত হলেন। চেকোস্লোভাকিয়ার সবথেকে পরিচিত ঔপন্যাসিক হিসেবে তাঁর আন্তর্জাতিক খ্যাতি – কিন্তু তা বাদ দিয়ে, তিনি আমার খুব আপন জন। তাঁকে আমি মিলান বলে ডাকি, গোপনে। এমনটা কি করে হল? কবে হল?

ভোর হল। কলেজে ওঠার পর-পরই মিলানের লেখার সাথে আলাপ। বাংলায় অনুবাদ আমি পড়িনি। জানি হয়েছে। ইংরেজি অনুবাদ পড়েছি, দি আনবেয়ারেবল লাইটনেস অফ বিইং। প্রচ্ছদে একটি কুকুরের একরৈখিক আকার। এক অনিবার্য আকর্ষণে আমার সমস্ত মনোযোগ ধরে রেখেছে মিলান, একটি প্রশ্ন করে – প্রশ্নটি নিরন্তর প্রত্যাবর্তন নিয়ে – “বার বার আসি আমরা দুজন, বার বার ফিরে যাই…”। এবং এই বার বার ফিরে আসার প্রশ্ন যদি অনন্তকাল পুনরাবৃত্ত হতে থাকে, তা এক ভয়ানক ভারিক্কীর জন্ম দেয়। নিৎসে এই ধারনাকে এক অতলান্তিক ভার হিসেবে গণ্য করেছিলেন। এর তুলনায়, একটি এমন জীবন, যা এক বার মাত্র আসে, এবং এক বারেই মিলিয়ে যায়, যা ফিরে আসে না, এরম একটা জীবন, যা ছায়ার মতন, নির্ভার, আগে থেকেই নিশ্চিতভাবে মৃত। ভার আর নির্ভার, এই দুইয়ের মধ্যে আমরা কাকে নির্বাচন করবো – এই প্রশ্ন করেন খৃষ্টপূর্ব ষষ্ট শতাব্দীর এক দার্শনিক, পারমেনাইডিস। সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডকে  দ্বৈত রুপের আখ্যানে ভেঙে ফেলেন পারমেনাইডিস। আলো – অন্ধকার; ভারী – নির্ভার – এই দ্বৈতের মধ্যে এক দিক অস্তর্থক, অপরদিক নৈবার্থক। পারমেনাইডিস বলছেন নির্ভারতা অস্তর্থক। ভার নৈবার্থক। প্রশ্ন সেখানেই।

এই তো দেখছি সকাল হয়ে গেছে। কাজে যাওয়ার পালা। প্রেমের কথা বলেছেন মিলান বারংবার। বহু চরিত্রের মাধ্যমে তাদের সম্পর্কের জাল নির্মাণ করেছেন। প্রেম কি ধরনের অনুভুতি তৈরি করে মানুষের মনে? নিজের মনের কথা বলি – প্রেম যখন প্রথম আসে, তখন মনে হয়, বুকের মধ্যে, পাঁজরের ঠিক নিচে, কোন অদৃশ্য শক্তি হিলিয়াম বেলুন বসিয়ে রেখেছে। আনন্দে, উচ্ছ্বাসে নিস্বাস ফেটে বেরিয়ে আসতে চায়। তারপর প্রেমের যাত্রা শুরু হয় আমাদের। দেখা হওয়া, না হওয়া, কথা বলা, না বলা, একসাথে থাকা, ঝগড়া, ঝামেলা, আবার বোঝাপড়া – এর মধ্যে কবে যে ছিল নিছক প্রেম, সে বড় হয়ে উঠে ভয়ানক ভালবাসায় পরিবর্তিত হয় কে জানে। সেই মুহূর্ত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ছাত্র টমাসের ঘরে যেদিন প্রথম আসে টেরেসা, সেই হিলিয়ামের বেলুনের মতন হাল্কা প্রেমের জোয়ার কি আমাকেও স্পর্শ করে নি?

কখন যে দুপুর হয়ে গেল, বুঝতেই পারলাম না। মিলানের কথা বিশ্বাস করেছি, সেভাবে ভালবেসেছি, সেই শব্দের ভিতে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, ভেঙেছে, টিকে গেছে বা যায়নি। প্রেমের মধ্যে যে ভালোবাসায় পৌঁছনর তাগিদ, সে যে দেখতে পায় না, কখন পাশ থেকে অন্য প্রেম, অপ্রেম, কুপ্রেম এসে জুড়ে বসে পড়ে, সে বুঝতে পারে না। অবোধের মতন দিনরাত আমার যুবনমদ-বিলসিত ভালোবাসা বসে থাকে – কবে আসবে সেই সুখের দিন, এই ভেবে সে নিজের মনে হলদে আলোর স্বপ্ন বুনতে থাকে। আর অ্যাটরোপিন নিদানে সেই স্বপ্নের বুনন অন্য দিকে ছাড়াতে থাকে, তাঁকে ছুঁয়ে থাকে অন্য জন, অন্য কোনও ভালো থাকার নীলচে স্বপ্নের আঙিনায়। বুকের মধ্যে হৃদয়ের ভার বেরে যায়। মিলান প্রশ্ন করেছেন, প্রতিটি যুগের প্রেমের কবিতায় কি নারী চান নি, পুরুষের ওজনের ভার উপলব্ধি করতে? আমি, আমার বন্ধু মিলান কে, আমার ঘরের সুরক্ষার মধ্যে বলতে চাই, না মিলান, চান নি। এই বলার জন্য কি আমাকে আলাদা ভাবে নারীমনের ভিতরে প্রবেশ করতে হবে? আমার নিজের মন কি যথেষ্ট নয়? মনেরও নারীপুরুষ? একাগ্রতারও নারীপুরুষ?

অস্ত গেলেন দিনমণি। ফিরে আসার প্রতিশ্রুতি আর ফিরে যাওয়ার আকাঙ্খা একে অপরের মুখোমুখি হয় যখন, তখন মনের মধ্যে এক অদ্ভুত যন্ত্রণা করে না কি? সেই যন্ত্রণা কি শুধু কষ্টই দিয়েছে আমায়, সুখ দেয় নি? কোনও এক রাতের অন্ধকারে, আমি যখন একা, মুখোশের আমি যখন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, সেই একাকীত্বে আমি কি সামান্য সুখ পাই নি, ফিরে যেতে না পারার যন্ত্রণার মধ্যে? আমার নস্ট্যালজিয়া হাতে হাত রেখে চলছে স্বগৌরবের সাথে, সর্বনাশের আশায়। কিন্তু সেজন দেখা দেয় না, দেখে যায়, আড়াল থেকে ভালোবেসে চায়। আমিও চাই গোপনে, লুকিয়ে ভালোবাসি, জানতে দিই না। ক্যালিপ্সো কি সত্যিই অডিসিউস কে সশরীরে ভালবেসেছিলেন? বাতাসের প্রতীক কি সূর্যাস্তের কিরণকে সশরীরে ভালবাসতে পারে? আমরা কি দেখতে পাই না, সেই উভয়ের বাড়ানো হাতের মাঝে অনন্ত শূন্যের ব্যবধান? সেই হাহাকার, সেই অশ্রুবারিধারা, হৃদয়বেদনা? ওজিজিয়ার দ্বীপে আজও কি সেই ঢেউয়ের উচ্ছ্বাস সেই অন্ধকার শূন্য গহ্বরের গায়ে আছড়ে পড়ে না? “ক্যালিপ্সো……, ক্যালিপ্সো……”

কদমগাছে পাখিদের কিচিরমিচির কমে এসেছে। বিকেল। একটি লাল রঙের বাড়ি। দেড়শ বছর পুরনো সেই বাড়ির পুব দিকের উপরের একটা ঘরে একটা ছেলে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। অনেক স্বপ্ন ছেলেটার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। স্বাভাবিক সাফল্যের পথে সে দেখেছে সন্দেহের বীজ। সে পথে হাঁটবে না বলে স্থির করেছে। সবাই তাকে পরামর্শ দিচ্ছে, এরম না করতে। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। নিজের ছাড়া অন্য কারুর কথা শুনবে না। ছেলেটা খালি যন্ত্রণা পায়। পৃথিবীর লক্ষ কোটি ভুল দেখা দেয় খালি। নিজের চোখ কে অভিশাপ দিয়ে ছেলেটা বারবার ভাবে, মৃত্যু কিরম হতে পারে, মুক্তির মতন? নির্যাতন তার বাহিরে দাগ কাটে না, অন্তরে দাগ কাটে। সে আবার ভাবে, কিছু কি বদলাবে তার চলে যাওয়ায়। বুঝতে পারে, বদলাবে না। শুধু কিছু মানুষ কষ্ট পাবে। যা তাদের প্রাপ্য নয়। সে কোনমতে মাথা তুলে, সম্মানের সাথে এগোতে থাকে, এক পা এক পা করে। ভারী শরীর আর তার চেয়েও ভারী হৃদয় কে সে অস্বীকার করে, মনের মধ্যে এক আকাশ ভর্তি তারার কথা ভেবে। নিজেকে নির্ভার রাখার চেষ্টা করে। পারে না, কিন্তু মাঝে মাঝে পারে, সেই পারাগুলো নিয়েই এক পা এক পা করে এগোয়। সবার মঙ্গল কামনা করে, গোপনে, মন্ত্রের মতন। মিলানের লেখায় এই ছেলেকে খুঁজে পাবে না। কিন্তু ছেলেটার মধ্যে মিলান রয়েছে, কোথাও।

মেঘ নেই, সন্ধ্যার কালো আকাশ পরিষ্কার। স্রেফ বেরঙ পটচিত্রে সাদাকালোর খেলায় মিলান ক্ষমতার চলন দেখিয়ে গেছেন ধারাবাহিক। একটি ছবি, তার মধ্যে একটিমাত্র বস্তু, যা থাকার কথা নয়। একটি টুপি। যিনি টুপি পড়িয়েছেন, তাঁকে রাষ্ট্রবিরোধী বলে উধাও করে ফেলা হয়েছে। কিন্তু তাঁর টুপিটি সবার নজর এড়িয়ে রয়ে গেছে। এ কথা কি আমার দেশের জন্য সত্য নয়? আমার জীবনের জন্য? বিদ্যালয়ের বন্ধুদের পুনর্মিলনের ছবি, শুধু কয়েকটা শূন্যস্থান, যা থাকার কথা ছিল না। কালরাষ্ট্রের দেশদ্রোহী, এ তিমির হতে নির্বাসিত। এন্নোরের একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র দেখতে পাচ্ছি দূরে, আসমানের নিভন্ত হুতাশন ঢেকেছে তুষারের মতন নেমে আসা ছাইয়ের আস্তরণে। ছয় শিশু খেলছে সেই ছাইয়ের স্তুপে। পরের ছবিগুলিতে পাঁচ, চার, তিন, দুই। সিনেমার রিলে হোঁচট খেয়ে সুদুর বোম্বের একটি বহুতলের কঙ্কাল দেখতে পাচ্ছি, একটি ছেলে, এই সে ছিল ছোট, সে এক ছাইয়ের স্তুপ থেকে মাথায় করে কিছুটা নিয়ে আরেক স্তুপে গিয়ে জমা করছে। ছাইয়ের খেলনাবাটি মিশে যাচ্ছে বরফের গুলাগের সাথে। সব সাদাকালো যেন মিশে যাচ্ছে সেই ছাইয়ের বৃষ্টিতে।

গভীর রাত। ঝিমিয়ে পড়া কলকাতায় এক বুদ হয়ে থাকা বহুতল। পাশে চৌকিদারের ঠেক, আবাসন। দীপাবলির দিন জ্বলন্ত বারুদের ডেলা অর্ধবৃত্ত সম্পূর্ণ করে এসে আবাসিকদের বিদ্ধ করছে। সাথে সবুজ শিশার খণ্ড। এই আলোকছটা দেখার আগেই এক নাবালক এলো শহরে। পিদিমের তলায় এইটুকু অন্ধকারে ঠাই পেয়েছে সে। অপলক তাকিয়ে রয়েছে আলোর দিকে। তাঁর অজান্তেই, তাঁর গলায় একটি একটি করে পাথর বেঁধে দিতে থাকলো কল্লোলিনী তিলোত্তমা। স্বপ্নের ঘোরে নিজেকে পাখি ভেবে উড়তে চেয়েছিল, চেষ্টা করছিল, পাথরগুলো টেনে তাঁকে আছড়ে ফেলল সেই লেলিহান শিখায়। ফাঁকি দিয়ে উড়ে গেল সে, অন্য কোথাও। দূরে, শাড়ির আঁচলে মোড়া ছবিগুলো থেকে এক এক করে মুছে গেল সেই পাখির স্বপ্নগুলো। কি নির্ভার, কি ভয়ানক নির্ভার না হতে পারলে এই অন্ধকারের ওজন অস্বীকার করা যায় !

কি ভারী এই অন্ধকার! ঘুমিয়ে পড়ি বরং। হয়তো স্বপ্নে এই ভার থেকে নিষ্কৃতি পাবো। পারমেনাইডিস কি তবে সত্য প্রমাণিত হলেন? নির্ভার হওয়াই শ্রেষ্ঠ, সকল প্রকারের ভার কদর্য? জানি না। মিলান উত্তর দেন না, সমাধান দেন না। সুন্দর ছবি আঁকেন, এটুকু।

0 Comments

Post Comment