পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

কলকাতায় ট্রাম-সফরের বিদায় ঘণ্টি

  • 26 September, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 389 view(s)
  • লিখেছেন : দীপক সাহা
দ্রুত গতির জীবনে শ্লথ গতি, টুংটাং বেল, ঘটাং ঘটাং করতে করতে ধীরে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া এই বাহনটি অনেকের মতে, গতির যুগে বড্ড বেমানান। শহরের বুকে বিরাট বপু নিয়ে ধীরে সুস্থে এগিয়ে যাওয়া এই বাহনে চড়ে সময় নষ্ট করার সময় কই আজকের মানুষের হাতে। তাই বুঝি ফুরালো ট্রাম-সফর। নাম উঠলো তার ইতিহাসের পাতায়। নাম লেখালো সে অবসরের খাতায়। যদিও সরকার থেকে এখনও সেই দিনক্ষণ ঘোষণা করা হয়নি, তবুও বিদায় ঘণ্টা তো বেজেই গেছে।

কলকাতা শহর থেকে একের পর এক নস্টালজিয়া হারিয়ে গিয়েছে। হারিয়ে গিয়েছে হলুদ-কালো ট্যাক্সি, টানা রিকশা, দোতলা বাসের মতো কতকিছু। এবার সেই হারানো সুরের খাতায় নাম লেখালো এ শহরের ঐতিহ্যবাহী যান ট্রামও। শহরের মেজাজ পাল্টাচ্ছে। দ্রুত গতির জীবনে শ্লথ গতি, টুংটাং বেল, ঘটাং ঘটাং করতে করতে ধীরে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়া এই বাহনটি অনেকের মতে, গতির যুগে বড্ড বেমানান। শহরের বুকে বিরাট বপু নিয়ে ধীরে সুস্থে এগিয়ে যাওয়া এই বাহনে চড়ে সময় নষ্ট করার সময় কই আজকের মানুষের হাতে। তাই বুঝি ফুরালো ট্রাম-সফর। নাম উঠলো তার ইতিহাসের পাতায়। নাম লেখালো সে অবসরের খাতায়।

শেষমেশ বিদায় নিচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে শহরের রাস্তা থেকে। তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এখন সে শহরের বোঝা। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, যানটি আস্তে চলে। জনবহুল কলকাতায় এই যানটি যানজটের কারণ হয়ে উঠেছে। সড়কে ট্রামলাইন থাকায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে পড়েছে। দুর্ঘটনা ঘটছে। এই সব কারণে সরকার শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ট্রাম চলাচল বন্ধ করতে চলেছে। ‘কল্লোলিনী তিলোত্তমার’ ঐতিহ্যের একটু প্রমাণ রাখার জন্য ধর্মতলা থেকে ময়দান পর্যন্ত লুই লাইনে ট্রামের জয় রাইড চালাবে রাজ্য পরিবহন দপ্তর। থেমে যাবে কলকাতার পরিবহন ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায়। এক জনস্বার্থ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম নিয়ে কী সরকারের নীতি জানতে চেয়েছিল আদালত। এবার এই নিয়েই আপাতত নিয়মিতভাবে ট্রাম চালানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে চলেছে রাজ্য সরকার।

১৮৮৩ সালের দিকে ভারতের ১৫টি শহরে চলতো ট্রাম। শহরগুলো ক্রমে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আর ট্রামের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে আসে। যখন ট্রাম চলা শুরু হয় সেই সময়ে গরুর গাড়ি, টানা রিকশা দেখা যেত কলকাতার রাস্তায়। এখন অত্যাধুনিক ক্যাব মেট্রো চালু হয়ে গেছে। যানবাহনের সংখ্যা বাড়লেও রাস্তার সংখ্যা খুব একটা বাড়েনি। এই যখন অবস্থা তখন রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে ধীর গতির এই যানবাহন। কলকাতায় ১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রথমবার ঘোড়ায় টানা ট্রাম চালানো হয়। শিয়ালদহ থেকে আর্মেনিয়া ঘাট পর্যন্ত ওই ট্রাম চলে। ট্রামের ‘স্বর্ণযুগে’ কলকাতায় গমগম ২৭-২৮টি রুটে ট্রাম চলতো। ১৫ বছর আগেও ১২ রুটে সচল ছিল ট্রাম। শেষমেষ কলকাতায় টিকে ছিল। টিংটিং ঘণ্টা বাজিয়ে চলতো এই যান। কাঠের সিটে বসে গল্প জমাতো কলকাতাবাসী এবং শহরে বেড়াতে আসা পর্যটকরা। নতুন কেউ শহরে বেড়াতে এলে ট্রামে চড়ে দেখতেন তিলোত্তমার সৌন্দর্য। এখন সব অতীত।

এই মুহূর্তে মাত্র তিনটি রুটে যাত্রীরা ট্রাম পরিষেবা পান। টালিগঞ্জ-বালিগঞ্জ, গড়িয়াহাট-ধর্মতলা এবং ধর্মতলা-শ্যামবাজার। ১৫০ বছর ধরে কলকাতার অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে যাওয়া দূষণবিহীন এক শ্লথ গতির যান! লক্ষ লক্ষ যাত্রীর সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার নস্টালজিয়া সঙ্গী করে আর ক’দিনের মধ্যে চিরস্তব্ধ হয়ে যাবে সে! উল্লেখ্য, দেশে একমাত্র কলকাতাতেই চলত ট্রাম। তাও চিরতরে বন্ধ হচ্ছে। থেকে যাবে তিলোত্তমা নগরীর বুকে অজগর সাপের মতো যত রাস্তাঘাট। থাকবে না শুধু ট্রাম!

সত্যজিৎ রায়ের 'মহানগর' থেকে সুজিত সরকারের 'পিকু'। মণি রত্নমের 'যুবা', সুজয় ঘোষের 'কাহানি'। তিগমাংশু ধুলিয়ার 'বুলেট রাজা', দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'ব্যোমকেশ বক্সি'— টলিউড-বলিউড থেকে শুরু করে দেশের ছায়াছবিতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ব্যবহার হয়েছে কলকাতার ট্রাম। মনে পড়ে, সেই পাঁচের দশকের শেষে একটি ট্রামগাড়ির শেষ আসনটিতে বসে পল্লী থেকে শহরে আসা যুবক অপু মাঝেমাঝেই একটি চিঠি পড়ছে। বুঝতে পারি যে ট্রাম কলকাতা শহরের ট্রেডমার্ক। এমনকি আরেক বিখ্যাত চলচ্চিত্রের শুরুতেই তো উমাপদর মুখে অশ্বচালিত ট্রামেরও বিবরণ পাওয়া যায়। চারুলতা (১৯৬৪)-র কথা বলছি। ট্রামের একটি স্থায়ী অভ্যুত্থান দেখা যায় মৃণাল সেনের ইন্টারভিউ (১৯৭১) ছবিতে। মৃণাল মনে করেছিলেন এই ধ্বংসোন্মুখ শহরে ঔপনিবেশিকতার যে অন্তিম স্মারকগুলি রয়ে গেছে, ট্রাম তার অন্যতম। এই ট্রামে চড়েই বিষ্ণু দে প্রতিদিন মৌলানা আজাদ কলেজে পড়াতে যেতেন, অমল রায়চৌধুরী যেতেন প্রেসিডেন্সিতে। আর সমর সেনের ট্রামযাত্রা তো জ্যোতি বসুকেও অবাক করেছিল। দুরন্ত ব্যস্ততার  মধ্যেও তিনি ট্রাম ছাড়া ফ্রন্টিয়ার অফিসে পৌঁছতে পারতেন না। বোস্টন শহরের ক্ষেত্রে টেনেসি উইলিয়ামসের হাতে বাসনার চিত্রকল্প হয়ে ওঠে ‘স্ট্রিটকার’। তেমনভাবেই জীবনানন্দ দাশের প্রতি অবিস্মরণীয় প্রণতিতে শক্তি চট্টোপাধ্যায় উপহার দিয়ে যান একটি অনশ্বর পংক্তি – ‘মৃত্যু, তুমি রাসবিহারী ট্রামলাইন।’

ট্রাম প্রেমীদের দাবি, শহরের যানজটের জন্য শুধুমাত্র ট্রাম দায়ী নয়। শহরের অন্যান্য যানবাহনের অব্যবস্থাপনাও যানজটের একটি প্রধান কারণ। কলকাতার মানুষ এবং ট্রাম প্রেমীদের মধ্যে এই সিদ্ধান্তের প্রভাব নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই মুহূর্তে শহরের একটি বড় অংশের মানুষের মন খারাপ। তারা শহরের ঐতিহ্যবাহী ট্রামকে বিদায় জানাতে মন থেকে প্রস্তুত নয়। এই পরিবেশবান্ধব যান ধীরে চলে কিন্তু কোনও দূষণ তৈরি করে না। ট্রাম দেশ বিদেশে কলকাতাকে দিয়েছে বিশেষ পরিচিতি। কলকাতার ইতিহাসে ট্রাম এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। প্রশংসাও কম পায়নি এই যান। তবুও বিদায় ঘণ্টা বেজে গিয়েছে।  শহরের রাস্তা তাকে ছেড়ে যেতে হবে। ঠাঁই নিতে হবে গল্পে, গানে, স্মৃতিতে! ‘চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন’ এ কেবল গানের আবেদন হিসেবে থেকে যাবার সময় এসে গেছে।

কলকাতা শহরটির বৈচিত্র্য ও ইতিহাসের প্রতীক হিসেবে ট্রামের গুরুত্ব অপরিসীম। ১৮৭৩ সালে শুরু হওয়া এই ট্রাম পরিষেবা একসময় শহরের পরিবহনের মূল মাধ্যম ছিল। ১৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ট্রাম কলকাতাবাসীদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছিল। কলকাতায় ট্রাফিকের গড় গতির চেয়ে তিন গুণ জোরে ছুটতে পারে ট্রাম! তবুও কিসের বাধা? আধুনিক শহরে দৃশ্যের যে কুচকাওয়াজ তাতে এখন ট্রামকে হয়ত অলস গতির বলে অবহেলা করা যায়। জোব চার্নকের এই শহরের ট্রামই হল কলকাতার অন্যতম মুখ। কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ট্রাম শুধুমাত্র একটি যানবাহন নয়। এটি শহরের সংস্কৃতির একটি অংশ। এটি কলকাতার মানুষের স্মৃতি এবং আবেগের সঙ্গে জড়িত। সরকারের এই সিদ্ধান্ত শহরের ঐতিহ্যকে ধ্বংস করবে।  ট্রামের টিংটিং ঘন্টি, কাঠের সিট, সিটে বসে বাদাম খেতে খেতে শহরের কত মানুষের কত স্মৃতি জড়িয়ে রয়েছে। ট্রাম বিদায় নিলে, ক্রমশ দুর্বোধ্য চিঠির মত দূরে সরে যাবে। কলকাতার হৃদয় বিদীর্ণ করে তার খোলস বদলে নিলে শহরটার আর কতটুকু পড়ে থাকে? যা পড়ে থাকবে তা মৃত রূপসীর হাসির মত। উন্নয়নের কঙ্কাল।

0 Comments

Post Comment