পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

“আমেরিকা স্বপ্নপুরী না হত্যাপুরী” - কেন সবার জানা উচিৎ?

  • 22 March, 2023
  • 1 Comment(s)
  • 1117 view(s)
  • লিখেছেন : আজমল হুসেন
যে কজন লেখকের কাছে পাঠক হিসেবে সমৃদ্ধির প্রত্যাশা রাখি, মার্কিন প্রবাসী মানবাধিকার কর্মী লেখক পার্থ বন্দোপাধ্যায় তাঁদের অন্যতম। কারণ তাঁর প্রতিটি লেখাই জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং জীবনবোধ থেকে নিঃসৃত, এবং একই সঙ্গে নির্ভরযোগ্য উৎস ও তথ্য সম্বলিত থাকে, যা সমাজের সমকালীন বিষয়গুলোকে নিয়ে পাঠককে নতুন করে ভাবায় । দেখা যাক লেখকের সদ্য প্রকাশিত “আমেরিকা স্বপ্নপুরী না হত্যাপুরী” বইটিতে এই প্রত্যাশা ঠিক কতটা পূরণ হয়।

কেন জানা উচিৎ আমেরিকার কথা?    

লেখকের জীবনের দুটি ভাগ দুটি দেশে কেটেছে। উত্তর কলকাতায় বেড়ে ওঠা, বছর কয়েক সুন্দরবনের একটি কলেজে অধ্যাপনা, তারপর উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকায় পাড়ি দেওয়া  এবং সেখানেই থেকে যাওয়া গত প্রায় চার দশক। এখন অবসরোত্তর জীবনে একজন সক্রিয় সমাজকর্মী হিসেবে আরও বেশি সময় এদেশে কাটাবার চেষ্টা করেন।  দুটি দেশেই মাটিতে পা রেখে চলা, এবং দুটি দেশেরই আর্থসামাজিক বিষয়গুলিকে গভীরভাবে অধ্যয়নের চেষ্টায় এবং সমাজ ও পরিবেশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে থাকতে গিয়ে লেখকের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তার নিরিখেই লেখা ওঁর প্রায় প্রতিটি বই।  

 

লেখক দু’দশকের কাছাকাছি সময় আমেরিকার শ্রমিক ইউনিয়নগুলোকে অত্যন্ত কাছে থেকে দেখার চেষ্টা করে গেছেন। এমনকি একটি শ্রমিক ইউনিয়নে দীর্ঘদিন শিক্ষকতাও করেছেন। লেখকের পর্যবেক্ষণে এসব অভিজ্ঞতার প্রতিফলন এবং বর্তমানে দুটি দেশের ক্ষেত্রে সেসব অভিজ্ঞতার প্রাসঙ্গিকতা বারবার পরিলক্ষিত হয়েছে ওঁর লেখায়।“আমেরিকা স্বপ্নপুরী না হত্যাপুরী” বইটিতেও তার অন্যথা হয়নি।                     

 

"দাদা, আমেরিকার কথা জেনে আমাদের কী হবে?" বইয়ের নাম দেখামাত্র এই প্রতিক্রিয়া হওয়াটা স্বাভাবিক, এমনকি যাঁদের সন্তানের মনে শয়নে-জাগরণে "অ্যামেরিকান ড্রিম" আর সন্তানের সেই স্বপ্নপূরণের জন্য পারলে নিজেদের জীবন বাজি রেখে দিতে পারেন, তাঁদের মনেও এই বই নিয়ে  একই প্রশ্ন আসতে পারে। এই সম্ভাবনা থেকেই লেখক যথাসাধ্য ঘাম ঝরিয়েছেন মোট চোদ্দটি পরিচ্ছেদে সাজানো এই বইটির একেবারে শুরুতেই, এবং এই উপমহাদেশে তথা বাঙালি সমাজে এর প্রাসঙ্গিকতা যথেষ্ট তথ্যসমৃদ্ধ করে উপস্থাপনা করার চেষ্টা করেছেন।            

 

যে তিনটি বানিজ্য আমেরিকার অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, সেগুলি নিয়ে সহজ অথচ গভীর আলোচনা রয়েছে বইটিতে। এসব বিষয় নিয়ে এরকম চর্চা  সচরাচর হয় না, যদিও এই সবকটা বিষয়ই আজকের দিনে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক আমাদের দেশে, আমাদের সমাজে।             

 

নিয়ন্ত্রণহীন পুঁজিবাদ কীভাবে আমেরিকাকে গ্রাস করেছে? কেন এই অভাবনীয় ধনী-গরিব বৈষম্য? কীভাবে এই বেলাগাম পুঁজিবাদকে একটা সফল মডেল বলে আমাদের দেশে এবং বাংলাদেশে চাপানো হচ্ছে? এই অন্ধ অনুকরণ কীভাবে আমাদের দেশ ও সমাজকে ধবংস করে দিচ্ছে, তা বুঝতেই আমেরিকার এসব কথা জানা আমাদের একান্ত প্রয়োজন।  

কী কী আছে বইটিতে?

 

আমাদের দেশের মতোই ধনী-গরিবের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ আমেরিকাতেও, যা আরও বেশি করে প্রকাশ পায় অতিমারীর সময়। অগণন মৃত্যুর অধিকাংশই সেই গরীব আমেরিকায়। কীভাবে দিনের পর দিন বাড়ছে এই ধনী-গরিব বৈষম্য তারই বিবরণ রয়েছে প্রথম পরিচ্ছেদে, এবং এটা আমাদের সমাজেও সমানভাবে প্রযোজ্য। তবে লেখক চূড়ান্ত জাজমেন্ট স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় পাঠকের উপরই ছেড়েছেন। "শিক্ষকের কথায় অন্ধভাবে বিশ্বাস না করে নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজে গবেষণা করে খুঁজে বার করা" - দীর্ঘ শিক্ষকজীবনে এটাই লেখকের দর্শন ছিল । এখানেও যথারীতি যথাসময়ে পাঠকের দিকে এই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন । তবে উত্তর যাচাই করার সুত্রগুলো ধরিয়ে দেওয়া আছে বইটিতে, একটু মনোযোগী হয়ে পড়লেই বোঝা যায়।                 

 

লক্ষ লক্ষ বাঙালি যে মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছিলেন, সেখানে আমেরিকা কীভাবে মদত যুগিয়েছিল পাকিস্তানকে? "একাত্তরের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়েই কিন্তু ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, চিলি এসব দেশে বিশাল বিশাল যুদ্ধ চলছিল, এবং প্রতিটি যুদ্ধের পিছনেই ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কম্প্লেক্সের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হাত," এভাবে লেখক পাঠকের চেতনার সদরে কড়া নাড়তে গিয়ে বিভিন্ন প্রসঙ্গ টেনেছেন।  "বস্তুতঃ, যুদ্ধ না লাগালে, এবং যুদ্ধ চালিয়ে না গেলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবেই ধ্বংস হয়ে যাবে।" এদেশে নয়তো ওদেশে এই যুদ্ধ যাতে সবসময় লেগেই থাকে তার জন্য ব্যবহৃত হয় মূলত বিভিন্ন দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ। কীভাবে আপনার-আমার সেন্টিমেন্টকে পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে এই যুদ্ধ ব্যবসা? কীভাবে আমেরিকা তার অর্থনীতির অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি ‘ওয়ার ইন্ডাস্ট্রি’ চালাবার জন্য যুদ্ধে লিপ্ত বিভিন্ন দেশের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহযোগিতা পেয়ে থাকে? দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে সবিস্তার আলোচনা রয়েছে এসব বিষয়ে, যার অধিকাংশই মিডিয়ায় আলোচনার উপযুক্ত পরিসর পায় না! ‘জার্নালিজম অফ এক্সক্লুশন’ শুধু সংবাদ মাধ্যম নয়, আমাদের মতো আপাত নির্ভেজাল পাঠক-দর্শক-শ্রোতাদেরকে সংবেদনহীনতার দক্ষ প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এই বিষয়টিও প্রসঙ্গত এসেছে যথাযথ রেফারেন্স ও উদাহরণসহ।                        

 

কীভাবে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করা হচ্ছে আমেরিকায়? তৃতীয় পরিচ্ছেদে এর বিবরণ দিতে গিয়ে লেখক প্রসঙ্গক্রমে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে আমাদের দেশেও গণতন্ত্র ধ্বংস হওয়ার দিকেই এগোচ্ছে। কেন এই আশঙ্কা? পড়ে দেখতে হবে, দেখে যাচাই করতে হবে।    

 

চতুর্থ পরিচ্ছেদের বিষয়বস্তু লেখকের নিজস্ব একটি তত্ব, যার নাম তিনি দিয়েছেন "দ্বিতীয় বৃত্ত"।  লেখক আশা প্রকাশ করছেন যে এই দ্বিতীয় বৃত্তই কিছু সম্ভাব্য বিপর্যয়ের মোকাবিলার পথ দর্শাতে পারে। সর্বত্রই প্রযোজ্য এই বিষয়টি কঠিন নয়, আর লেখক তা সহজতর করে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। আমারও বিশ্বাস, এই দ্বিতীয় বৃত্তই গতানুগতিক ঠিক-ভুল বাইনারি থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করতে পারে, বিভিন্ন দেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিকল্পের পথদ্রষ্টা হতে পারে।           

 

পঞ্চম পরিচ্ছেদের পুরোটাই ১১ই সেপ্টেম্বরের সন্ত্রাসী আক্রমণ ও তার আনুষঙ্গিক ঘটনাবলী নিয়ে। কিছুটা অভিজ্ঞ অভিমত আর বাকিটা ব্যক্তিগত স্মৃতি - একটা গভীরভাবে ভাবিয়ে তোলে আর অন্যটি পড়ে গায়ে কাঁটা দেয় - মর্মস্পর্শী কিছু অভিজ্ঞতার কথা এবং তার সুচিন্তিত আলোচনা রয়েছে এই পরিচ্ছেদে। ভারতীয় এবং বাঙালি সহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর উপর এসব নারকীয় ঘটনার প্রভাব কী? পড়ে দেখতে হবে, দেখে ভাবতে হবে।            

 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদে লেখকের অন্তর্দৃষ্টিমূলক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষণ রয়েছে। এগুলো কেবল বাঙালি বা ভারতীয় বলে নয়, সবারই জানা দরকার। ঠিক কীভাবে প্রাগৈতিহাসিক মুজাহিদীন গোষ্ঠীর পিছনে এসে দাঁড়িয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধব্যবসা, কর্পোরেট শক্তি এবং সিআইএ? কীভাবে অগণন মানুষের মৃত্যু হলো, আর কীভাবে নিউ ইয়র্ক টাইমস নাজিবুল্লার প্রকাশ্য ফাঁসির উল্লাস প্রকাশ করলো? আজকের এই মগজধোলাইয়ের যুগে মানুষকে সত্যি কথা বিশ্বাস করানো একটা দুষ্কর কাজ, যথারীতি   অজস্র ক্রস রেফারেন্স আছে, যেগুলো ঘেঁটে দেখলে চোখ খুলে যায়। এখানে লেখকের একটি কথা উল্লেখযোগ্য, "ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভুলিয়ে দিয়েও ইতিহাস ইতিহাসই থেকে যায়। সত্যকে কখনো মুছে ফেলা যায় না।"  কিন্তু সত্যকে পরখ করতে হলে ধৈর্য দরকার, বিশেষ করে যখন ‘জার্নালিজম অফ এক্সক্লুশন’ রমরমিয়ে চলছে বিশ্বব্যাপী।            

 

এক জায়গায় লেখক বলেছেন, "এটা সকলেই জানে (বা, বলা যায়, জানা উচিৎ) যে আফগানিস্তান বা ইরাকে ভয়ঙ্কর মার্কিনি বোমাবর্ষণ ও নির্বিচার হত্যা কেবলমাত্র মার্কিনি জনগণকে সন্তুষ্ট করার জন্যেই করা হয়েছিল।" বাস্তবে মার্কিনি জনগণ কতটা সন্তুষ্ট হয়েছিলেন সেটা আমার অজানা। তবে এদেশে এই আক্রমণ একটা রিপল্ এফেক্ট তৈরি করতে পেরেছিল, যার প্রতিফলন ছিল যত্রতত্র ধ্বংসসুখের উল্লাসে।  আরেক জায়গায় লেখক বলেছেন, "...যদিও বা ধরে নেওয়া যায় সন্ত্রাসী আক্রমণ সত্যিই হয়েছিল, তাহলেও যারা যুক্ত ছিল, সেই অপরাধীরা প্রায় সকলেই সৌদি আরবের হওয়া সত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন সৌদি আরবকে শাস্তি না দিয়ে ইরাক ও আফগানিস্তানকে নির্মম ভয়ঙ্কর আঘাতে গুড়িয়ে দিলো, তা আমরা সকলেই জানি।" কী কারণে এই ওয়েপন্স অফ মাস ডেস্ট্রাকশনের নামে মগজধোলাই, আর সেই অজুহাতে বাস্তবিক মাস ডেস্ট্রাকশন? ভেবে দেখার দরকার আছে বইকি ।      

 

ঠিক কীভাবে বছরের পর বছর রমরমিয়ে চলছে আমেরিকার কারাগার অর্থনীতি? আমাদেরকেই বা তা জানতে হবে কেন? আমি মনে করি এটা জানা আমাদের একান্ত কর্তব্য, বিশেষ করে যখন ঠিক একইরকমের কারাগার অর্থনীতির পরীক্ষাগার এখন আমাদের দেশের একটি রাজ্য। আমাদের দেশের কথা জানা আমাদেরই কর্তব্য বইকি । আর ইতিমধ্যেই এই পরীক্ষাগারের গিনিপিগ হিসেবে রয়েছে মূলত লক্ষ লক্ষ গরিব অসহায় বাঙালি। বাঙালির আসন্ন সঙ্কটের বিষয়ে জানা এবং বোঝার দায় বাঙালিকেই তো নিতে হবে!   সপ্তম পরিচ্ছেদে বিষয়টি আলোচিত অনেকটা আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গদের অবস্থাকে কেন্দ্র করেই। কেমন আছেন আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গরা? লেখকের প্রাথমিক মন্তব্য, "উনিশশো চৌষট্টি সালে কাগজে কলমে ব্ল্যাক আমেরিকা সমানাধিকার পেয়েছে নিশ্চয়ই। কিন্তু ব্ল্যাকদের কী নিদারুণ অবস্থা! পুলিশি বর্বরতা, সামান্য কারণে বা বিনা কারণে কালো মানুষের গাড়ি থামিয়ে তাদের সার্চ করা, হেনস্থা করা, জেলে নিয়ে যাওয়া এসব তো চলছেই। দক্ষিণের রক্ষণশীল রাজ্যগুলোতে - টেক্সাস, জর্জিয়া, মিসিসিপি, অ্যালাবামা, কেনটাকি, টেনেসী, ওকলাহোমা - এসব জায়গার অবস্থা মারাত্মক।" আরেকটি জায়গায় লেখকের পর্যবেক্ষণ, "মাঝে মাঝেই এদেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে এরকম ঘটনার খবর পাওয়া যায়। কোনো কৃষ্ণাঙ্গ যুবক বা কিশোর পুলিশের গুলিতে বা অত্যাচারে মারা যায়, এবং সরকারি রিপোর্টে বলা হয়, ভয়ঙ্কর ধরণের অপরাধীর কাছ থেকে আত্মরক্ষার জন্যে পুলিশকে বাধ্য হয়ে গুলি চালাতে হয়েছে, আর নয়তো পুলিশ অফিসাররা ভেবেছিল মৃতের হাতে কোনো মারাত্মক অস্ত্র আছে, তাই তারা বাধ্য হয়ে গুলি চালিয়েছে। সমস্ত বিচারেই হত্যাকারী পুলিশ বা মিলিটারি অফিসারকে বেকসুর খালাস করে দেওয়া হয়।" আমেরিকার কারাগারগুলোতে বিশ্বের এক চতুর্থাংশ বন্দী রয়েছেন, তাঁদের মধ্যে লক্ষ লক্ষ কৃষ্ণাঙ্গ । কেন এত কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকার জেলে? লেখকের আংশিক ব্যাখ্যা,  "আমেরিকায় দশ লক্ষ কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ জেলে পচছে বছরের পর বছর। পুরুষ এবং নারী। বহু শিশুও আছে। যাদের বয়স হয়তো বারো কি চোদ্দ। তাদের মধ্যে এক বিরাট সংখ্যক কোনো গুরুতর কারণ ছাড়াই জেলে আছে। কারণ, তারা গরিব, এবং তাই ভালো আইনজীবির সাহায্য পায়নি।" প্রসঙ্গত, এই ভারতেই এশিয়ার বৃহত্তম ডিটেনশন ক্যাম্প (যার নতুন নাম ট্রানজিট ক্যাম্প ) তৈরি হচ্ছে ।  তাই কারাগার অর্থনীতির বিষয়টি নিয়ে আরও গভীরভাবে ভাবা দরকার, আর এই বিষয়গুলো নিয়ে সকলের অবগত থাকা উচিৎ।     

 

কী ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সিআইএ-র ভূমিকা? যার  ফলস্বরূপ অগণন বাঙালি তরুণের মৃত্যু আর নারীদের সম্মানহানি। এরকম অজস্র হিংসা ও ভয়ের রাজনীতির  কথা সপ্রসঙ্গ সবিস্তার আলোচনা রয়েছে অষ্টম পরিচ্ছেদে। তাছাড়া আমাদের দেশের ইউএপিএর মতোই আমেরিকার প্যাট্রিয়ট আইনের হাতে কীভাবে গণতন্ত্র এবং নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার হত্যা হয় তার বিস্তারিত নিবন্ধীকরণ রয়েছে এই পরিচ্ছেদে।       

 

আমেরিকায় কেন এত ঘনঘন বন্দুকবাজির খবর পাওয়া যায়?  অন্যান্য কারণ ছাড়াও একটি মূল কারণ -  মার্কিন সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনীতে নাগরিকদের বন্দুক ব্যবহারের যথেচ্ছ অধিকার দেওয়া আছে, যথারীতি অহরহ  বন্দুকবাজি, যাতে কিনা বিপন্ন নিরীহ মানুষের জীবন।  "আমি শিকার করতে ভালোবাসি", এই অজুহাতেই একজন যতখুশি বন্দুক কিনে বাড়িতে রেখে দিতে পারে। গণহত্যা, বন্দুকবাজি এবং সিরিয়াল কিলিং নিয়ে বহু উদাহরণ এবং ক্রস রেফেরেন্সে সমৃদ্ধ আলোচনা রয়েছে নবম পরিচ্ছেদে।        

 

এক বিরাট সংখ্যক মার্কিন নাগরিক মিডিয়ার রচিত এক মায়াজালে আটকে থাকেন। তাঁরা আজীবন অর্থনৈতিক বঞ্চনা এবং তার ফলে অমানুষিক পরিশ্রম সত্বেও তাঁদের প্রতি সিস্টেমের অমানবিকতাও  নিষ্ঠুররতার কথা বুঝে উঠতে পারেন না। এই অমানবিকতার কিছু চিত্র তুলে ধরার এক পরিশ্রমী প্রয়াস দশম পরিচ্ছেদে।  ঠিক এই প্রক্রিয়াই এখন আমাদের দেশে চালু হচ্ছে, মিডিয়া যখন সারা দেশকে বলিউড, আইপিএল বা উগ্র দেশপ্রেমের নামে শাসকের প্রতি অন্ধ আনুগত্য তৈরিতে ব্যস্ত, ঠিক তখনই হয়তো জ্বালানি গ্যাস বা অন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দাম অনেকটা বেড়ে গেল, বা এমন কিছু ঘটনা ঘটল যার কোপ সরাসরি নিরীহ গরিব নাগরিকের উপরই গিয়ে পড়ে, কিন্তু মিডিয়ার রচিত কৃত্রিম চাঞ্চল্যে তখন তাঁদের প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার ইচ্ছে হারিয়ে গেছে।              

 

ভুলিয়ে দেওয়া এবং সত্যকে সার্বিকভাবে  জানতে না দেওয়ার মিডিয়া কৌশল নিয়ে একাদশ পরিচ্ছেদ।  ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি এটা মানুষের মনের মধ্যে গেঁথে দিতে সক্ষম হয়েছে যে সিনেমায় হিংসা, খুন, রক্তপাত এসবকে সিরিয়াসলি নেওয়ার দরকার নেই - জাস্ট ফান! লেখকের অভিমত, ".. মনের ভেতরে হিংসা, ঘৃণা, রক্তপাত সম্পর্কে একটা সম্পুর্ণ সংবেদনহীনতা তৈরি করে দেওয়া গেছে। তাই, মৃত্যু, খুন বা গণহত্যার খবরেও মানুষের মনে আর কোনো আলোড়ন জাগে না। অন্যায়, অবিচার, চরম অ্যবনর্মাল বলে মনে হয় না কখনও। এখানেই এই মগজধোলাইয়ের বিজয়।“ আমাদের দেশে যেমন সম্প্রদায় বিশেষকে অপরাধী হিসেবে দেখানো হয়ে থাকে, আমেরিকান সিনেমায়ও চিরকালই কৃষ্ণাঙ্গদের দেখানো হয়েছে অপরাধী হিসেবে।   আরেকটি জায়গায় লেখকের পর্যবেক্ষণ, "বস্তুতঃ, দীর্ঘ কয়েক বছরের ইরাক ও আফগানিস্তান ধ্বংসের পরেও সার্ভে করে দেখা গেছে, বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ আমেরিকান ইরাক বা আফগানিস্তান কোথায়, তা জানে না। এই হলো মিডিয়া ও এন্টারটেনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রির এক্সক্লুশনের আসল চেহারা।"  

 

স্টক মার্কেটের মায়াজাল, কিছুটা পিছিয়ে এসে দেশের অর্থনীতিকে বিশ্লেষণের চেষ্টা আর আমেরিকার অর্থনীতিতে মাদকের ভুমিকা নিয়ে আলোচনা দ্বাদশ পরিচ্ছেদে। এক জায়গায় লেখকের আলোকপাত,  "র‍্যান্ড কর্পোরেশনের হিসেবে কেবলমাত্র দুহাজার আঠেরো সালেই এদেশে সাবস্টেন্স অ্যাবিউজ ও ভয়ঙ্কর মাদকসেবনের ফলে ৬৮০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।" কিন্তু কারা এই ড্রাগ ইন্ডাস্ট্রির চালিকাশক্তি? অনেক জটিল এই চক্র, আমি বললে কেন বিশ্বাস করবেন? পড়ে দেখে বুঝতে হবে।

 

কেমন করে আমেরিকায় পর্ণগ্রাফী একটি অত্যন্ত সফল ইন্ডাস্ট্রী হয়ে উঠেছে? হয়েছে তো হয়েছে, তা জেনে আমার কী? আমাদের কী? পড়ে দেখতে হবে, নিজের বিশ্লেষণ নিজেকেই করতে হবে। ইমিগ্রেশন, পর্ণ ইন্ডাস্ট্রি এবং সেক্স ট্রাফিকিং কীভাবে আমেরিকার জনজীবনকে প্রভাবিত করছে তাই দেখার চেষ্টা ত্রয়োদশ  পরিচ্ছেদে। ইমিগ্রেশন নিয়ে লেখকের আংশিক পর্যবেক্ষণ, "আমেরিকার সীমান্ত এলাকায় ইমিগ্রেণ্ট শ্রমিকরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢোকে। বর্ডার পেট্রোল যেমন সাব মেশিনগান নিয়ে পাহারা দিচ্ছে, তেমনই দিচ্ছে প্রাইভেট মিলিশিয়া, যাদের একটা জঙ্গী সংগঠনের নাম মিনিটম্যান। তারা সয়ংক্রিয় রাইফেল নিয়ে, আর দূরবীন নিয়ে বসে থাকে সীমানার কাছে বিভিন্ন জায়গায়। তারা ঘোষনা করছে, শ্বেতাঙ্গ খৃস্টান আমেরিকায় যদি অন্য কোনো দেশের, অন্য কোনো বর্ণের 'গডলেস' ইল্লিগাল ইমিগ্রেন্ট ঢোকে, তারা এক সেকেণ্ডও দ্বিধা করবেনা তাদের গুলি করতে।"  সেক্স ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে অন্য এক জায়গায় লেখকের বক্তব্য,  “সেক্স ইন্ডাস্ট্রিতে গোপনে যেমন দেহ ব্যবসা করে চলেছে অসংখ্য গরিব ছেলেমেয়ে, যাদের বয়স  চোদ্দ থেকে চল্লিশ হতে পারে, তাদের পিম্পরা আমাদের দেশের সেই আগেকার দিনের গণিকাপল্লীর মাসির মতোই আর তার ভাড়া করা গুণ্ডাদের মতোই তাদের শ্রম, কষ্ট ও বেদনার উপার্জিত ডলার কমিশন পাচ্ছে। এবং বহুক্ষেত্রে দেখা গেছে, যৌনকর্মী হয় কিছুই পাচ্ছে না, আর নয়তো কোনোরকমে বেঁচে থাকার মতো মজুরি পাচ্ছে। এই নিয়ম মেনে না চললে তাদের উপর নেমে আসবে নির্মম  অত্যাচার,…”। এই ঈশ্বরের নির্বাচিত দেশে আর কী কী আছে, আর তার অন্ধ অনুকরণে আমাদের সমাজ কীভাবে প্রভাবিত হচ্ছে সেটাও ভেবে দেখা উচিৎ, আর এই পরিচ্ছেদ পড়ার পর ঠিক সেই কথাটাই ভাবিয়ে তোলে।               

 

ইমিগ্রেন্টদের নিয়ে সমস্যা আমাদের দেশেও আছে, আমেরিকায়ও আছে। ইমিগ্রেন্টদের অস্তিত্ব সঙ্কট বিশ্বব্যাপী । আমেরিকায় এই সঙ্কটের চেহারাটা কেমন? লেখক নিজে একজন ইমিগ্রেন্ট। নিজের অস্তিত্ব সন্ধানের কথা বলতে গিয়ে তাঁর বক্তব্য, "আমরা সারাজীবন আমেরিকায় থেকে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় যে কজন মার্কিনির সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পেরেছি, তারা ছাড়া বাকী আমেরিকায় আমরা সারা জীবন থেকেও সম্পূর্ণভাবেই অদৃশ্য ছায়ামানব। আমরা আছি, কিন্তু আমরা নেই।" এই অস্তিত্ব সঙ্কট নিয়ে পড়তে পড়তে অনেক কিছুই আমাদের দেশের বাঙালি সমাজের একাংশের কথা স্বাভাবিকভাবেই মনে পড়ে, ভাবিয়ে তোলে গভীরভাবে। আর অন্যসব ইমিগ্রেন্টদের অবস্থাই বা কেমন? লেখকের পর্যবেক্ষণ, "মেক্সিকো-অ্যারিজোনা সীমান্তের সুঁড়িপথ দিয়ে দেখে এসেছি সর্বহারা ইমিগ্রেণ্ট পরিবারের পালিয়ে আসার রাস্তা। দেখেছি টুসন শহরের ইমিগ্রেণ্টদের এই অপরাধের জন্যে বিচারের আদালত। দেখেছি হাতকড়া পরা পুরুষদের, নারীদের, যাদের একমাত্র অপরাধ দারিদ্র্যদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার ইচ্ছা। দেখেছি লাশকাটা ঘর, যেখানে মরুভূমিতে পড়ে থাকা দেহ তুলে এনে সনাক্তের আশায় রেখে দেওয়া হয়।" এরকম বহু অভিজ্ঞতা সহ ইমিগ্রেন্ট সমস্যা নিয়ে গভীর তথ্য-সমৃদ্ধ  বিশ্লেষণ চতুর্দশ ও শেষ পরিচ্ছেদে।    

 

উপসংহার 

 

লেখক কি শুধুই নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরতে চেয়েছেন? পাঠক হিসেবে আমার তা মনে হয়নি। আমেরিকার বিষয়ে এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, "এদেশে অনেক খারাপের মধ্যে একটা ভালো জিনিস হল, এখানে কোনও কাজকে কখনও ছোট করে দেখা হয় না, আমাদের দেশে যেমন, ঝাড়ুদার বা রেস্তোরাঁর ওয়েটার এসব কাজ যারা করেন, তাঁদের সম্মানের চোখে দেখা হয় না, এদেশে কিন্তু তা নয়।  এদেশে পরিশ্রমের মূল্য আছে, এখানে কাজের ভিত্তিতে মানুষকে কখনও ছোট করা হয় না এবং এখানে সবাই নিজের কাজ নিজে করে।"  আমেরিকার শিক্ষাব্যবস্থাও ভারতের তুলনায় অনেক আধুনিক। এই স্বীকারোক্তির পরেও লেখকের পর্যবেক্ষণ, "যদিও পৃথিবীর সব চাইতে উন্নত দেশগুলি যেমন জাপান, সুইডেন, নরওয়ে, আইসল্যান্ড, বেলজিয়াম, ডেনমার্কে, ফিনল্যান্ড, স্পেন এসব দেশের তুলনায় আমেরিকা সবদিক থেকে অনেক পিছিয়ে।"

 

আমারিকান স্বপ্নটাও যেমন বাস্তব, আমেরিকার বাস্তবেও এমন কিছু উপাদান রয়েছে যা দুঃস্বপ্নের মতোই। ঠিক যেমন আমেরিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার এমন কিছু উপাদান রয়েছে যেগুলো মানুষকে আস্বস্ত করে, তেমনি কিছু নেতিবাচক উপাদান যেমন জাতি বিদ্বেষ, বর্ণবিদ্বেষ রয়েছে যেগুলো সেই স্বপ্নপুরীরই নির্মম বাস্তব। আমেরিকা নামক স্বপ্নপুরীতে যেমন রয়েছে হার্ভার্ড, প্রিন্সটন, বার্কলে, কলম্বিয়া, এম আই টির মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও অজস্র নোবেলজয়ী, আর অন্যদিকে আশি শতাংশ আমেরিকান অর্থাভাবে কলেজ যেতে  পারেন না।  আমেরিকায় নোম চোমস্কির মতো দার্শনিক ও রয়েছেন, আর তাঁরই আদর্শে প্রভাবিত তাঁর শিষ্যরাও রয়েছেন যেমন এই বইয়ের লেখক তথা মানবাধিকার কর্মী পার্থ বন্দোপাধ্যায়। রয়েছে কিছু মানবাধিকার সংগঠন যা এখনো আশা জাগায়, স্বপ্ন দেখায়, যা হয়তো টিপিক্যাল ‘অ্যামেরিকান ড্রিম’ নয় কিন্তু মৌলিক মানবাধারিকারের স্বপ্ন ।          

 

এবার দুটি কথা লেখক ও প্রকাশকের জন্যে। লেখকের সিরিয়াস অধ্যয়ন আর অদম্য পরিশ্রমের ফল এই বই। তবে টাইপিংয়ের কিছু ছোটখাটো ত্রুটি-বিচ্যুতি এড়ানো গেলে সমকালীন  ভারত এবং বাংলার প্রেক্ষিতে অত্যন্ত  প্রাসঙ্গিক এই বইটি আরও অনেক বেশি সুখপাঠ্য হতে পারত। আশা রাখছি পরবর্তী মুদ্রণে যথাযথ সংশোধন থাকবে।            

এখন পাঠকদের উদ্দেশ্য করে দুটি কথা বলে শেষ করা যাক। মূলস্রোতের মিডিয়া আমাদেরকে আমেরিকা নামক স্বপ্নপুরী দেখাতে সফল। কিন্তু মুদ্রার আরেক পিঠ যে রয়েছে! এই বইটিকে যদি সহায়ক মাধ্যম মনে করেই পড়েন, মুদ্রার অন্য পিঠ দেখে পাঠক সমৃদ্ধ হবেন । আমেরিকা নামক স্বপ্নপুরীটাকে বাস্তব বলে ধরে নিলেও এই হত্যাপুরীরটাও কিন্তু ততটাই বাস্তব। এই দুটো বাস্তবকে একইসঙ্গে দেখা উচিৎ। এমনকি যাঁরা আমেরিকা নামক স্বপ্নপুরীকে হাতের তালুর মতো চেনেন, তাঁদেরও চোখ খুলে দিতে পারে এই বই।               

 

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

“আমেরিকা  স্বপ্নপুরী না হত্যাপুরী” বইটির প্রকাশক : ভিরাসত আর্ট  পাবলিকেশন  ।

ISBN: 978-93-93063-16-8

মূল্য : ৩৫০ টাকা

 

নিম্নোক্ত লিংকে গিয়ে অনলাইনেও সংগ্রহ করা যায়:   

https://www.haritbooks.com/product/america-swapnapuri-na-hatyapuri-by-partha-bandhopadhyay/?fbclid=IwAR2pz3acWAZtD3oEW2emRBF2Lyzr71z8nYTUpo-qIqklqaG8GCCd42zRQOw

1 Comments

মূল বইটির বিষয়বস্তু এবং তার লেখনী, ঘটনাপ্রবাহের বুনোট যতোটা

22 March, 2023

It's a wonderful piece of creation. Thanks to Sohomon and kudos to the writer Dr. Partha Banerjee. A special mention for Azmal sir.

Post Comment