পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ওই মালতীলতা দোলে

  • 06 December, 2020
  • 0 Comment(s)
  • 2059 view(s)
  • লিখেছেন : শামিম আহমেদ
এই রকম ঝামেলা থেকে অট্টহাসতলা আর সোনারুন্দি থেকে বহু লোক এসে শিমুলিয়া গ্রামে আজাদ মির্জার বাড়ি আক্রমণ করে। তার গোয়ালের গরু নিয়ে পালায়। আজাদ মির্জা তালেবর লোক। সে পার্টি করে। তার হয়ে কথা বলবে, দরকারে লাঠি ধরবে, এমন লোকের সংখ্যাও কম নয়। যারা অট্টহাসতলা আর সোনারুন্দি থেকে এসেছে, তারা কেউ নারান পণ্ডিত বা সোমেন চক্রবর্তীর চেনা লোক নয়। গুলি বোমা পিস্তল এনে আজাদ মির্জার বাড়ি তছনছ করে পোস্টার লাগিয়ে গিয়েছে, গোমাতার কোনও অপমান তারা সহ্য করবে না! এই সময়ের একটি গল্প লিখলেন শামিম আহমেদ

পিয়ালতরুর কোলে

কারবালার ময়দানে বনবন করে লাঠি ঘোরাচ্ছিল নুর আলম কলবলি। গায়ে তার ফুলতোলা স্যান্ডো গেঞ্জি আর লাল রঙের হাফ প্যান্ট। গেঞ্জিতে সবুজ সুতো দিয়ে আঁকা পাঞ্জাতন। পাঞ্জাতনের প্রসঙ্গ এলেই দু চোখ জলে ভিজে যায় নুর আলম কলবলির। নবিজি, হজরত আলি, নবিকন্যা মা ফতিমা, আলি-ফতিমার দুই ছেলে—হাসান আর হোসেন হলেন পাঞ্জাতন। নবিজিকে গোস্তের মধ্যে বিষ মাখিয়ে খাইয়েছিল কোনও এক প্রৌঢ়া নারী, নমাজ পড়া অবস্থায় বিষ মাখানো তরবারি নিয়ে আলিকে হত্যা করে এক খারিজি, মা ফতিমাকে আঘাত করে মারা হয়, হাসানকে বিষ দেয় তাঁর বিবি, আর হোসেনের শির কেটে নেওয়া হয় কারবালার ময়দানে। সেই কারবালার ময়দানে বনবন করে লাঠি ঘোরায় নুর আলম কলবলি।

ক লব মানে হল হৃদয়। গলার ভিতরে সেই ক. উচ্চারণ করতে হয়, বড় কষ্ট তাতে। মৌলবি-মৌলানা ছাড়া সেই ক.লব কারোর আলজিহ্বা থেকে বেরোতে চায় না। আলজিহ্বার কথা বললেই নুর আলম কলবলির মনে পড়ে—আলজিহ্বাতে আলেক শহর, আল্লা বসে রয়েছে। সেই ক.লব নুর আলম কলবলির কলব নয়। কলবলি হল কলব-এ-আলি—আলির কুকুর। কুকুরের কথা বলা এখন বারণ। কারণ কারবালার ময়দানে লাঠি খেলা শেষ হলে পুকুরপাড়ে নুর আলম কলবলির আখড়ায় যেতে হবে। সেখানে গাওয়া হবে মহরমের সোজখানি আর মর্সিয়া। আখড়ার সামনে পিয়াল গাছ, তার ঠিক গোড়ায় মাটির বেদি, সেখানে বসে হবে মর্সিয়ার পাঠ আর আহাজারি। নুর আলমের পোষা কুকুর তখন চুপ করে শুয়ে থাকে। সে বরাবর মনিবের কাছে খাঁচার ভিতর অচিন পাখি শুনে এসেছে, কিন্তু দিন দশ ধরে সুরের বদল হওয়াতে সে প্রথম দিকে ভৌ ভৌ করে খানিক প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিল বটে, কাজ না হওয়ায় হাল ছেড়ে দিয়ে নীরবে অশ্রুপাত করে। সে কথা নুর আলম বিলক্ষণ জানে।

নুর আলমের সাধনসঙ্গিনী আসে চিনির শরবত নিয়ে। এক চুমুক মুখে দিয়ে সে বলে ওঠে, ঘরে কি কাগজি লেবু ছিল না? তানীবন বলে, না, তুমি গেল হাটে নিয়ে আসো নাই।

কাগজি লেবুর অভাবে নুর আলমের শরবত খাওয়া সামান্য বিঘ্নিত হয়। সে তাকিয়ে থাকে পিয়াল গাছের দিকে। ঘাড় ব্যথা করতে থাকে। চিনি-পানির তলানিটুকূ সে দূরে ফেলে দেয়। কুকুরটি একবার ছুটে যায় বটে, কিন্তু আবার ফিরে আসে তার পূর্বের জায়গায়।

নুর আলম বলে, আমার একতারা নিয়ে আয় বিবি!

তানীবন জানায়, মহরমের মাসে একতারা বাজানোর নিয়ম লয় গো নুর বাবা! খালি গলায় সোজ গাও দিকিনি!

নুর বলে, না, আমার একতারা লিয়ে আয়। পিয়াল গাছ গান শুনবে। একতারার আওয়াজ ছাড়া সে গান বোঝে না। তানীবনের সখী তালতীলমা একতারা এনে দিলে নুর গলা ছেড়ে গাইতে থাকে—

শুনতে পাই চার কারের আগে

সাঁই আশ্রয় করে ছিল রাগে

এ বেশে অটল রূপ ঢাকে

মানুষ রূপ লীলা জগতে দেখায়।

একে একে পিয়ালতরুর কোলে আসতে থাকে নুর আলমের পিরভাইয়েরা। মহরমের সোজখানি হয়ে ওঠে মরমিয়ার রহস্যোপাখ্যান।

কী সেই চার কার? –এই কথা জিজ্ঞাসা করে লয়াপি সেখ। তার দুই চোখ তালতীলমা বানুর দুই ভারি স্তনের প্রতি নিবদ্ধ। এত শীর্ণ দেহে এই বিপুল স্তনভার সে কীভাবে বহন করে, লয়াপি তাই ভাবতে থাকে।

তানীবন বলে, এই চার কারের কথা আমাকে শোনাও বাবা নুর আলম কলবলি!

নুর বলে, সে তো মাটি, পানি, আগুন আর বাতাস। বাকিটা বুঝতে গেলে অনেক সাধন পথ পেরিয়ে আসতে হয়রে বিবিজান!

ওদিকে লয়াপি আর তালতীলমা বিবি উঠে গিয়েছে সল্লার পুষ্করিণীর উত্তর দিকে যে ঘন জঙ্গল আছে তার অভ্যন্তরে। এই জঙ্গলে ঢুকতে সব লোকে ভয় পায়।

জঙ্গলে তখন মধুমাস। অনেক জঙলি ফুল ফুটে আছে। আমের মুকুলের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। মরুভূমির হাসান-হোসেনের ক্রন্দনধ্বনি এখানে এসে পৌঁছয় না। কয়েকটি ঘুঘু পক্ষী আর কিছু শালিখ ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে কীসব আগডুম বাগডুম বলে যাচ্ছে। বনের সকল গাছ যেন কামভারে অবনত। লয়াপি ও তালতীলমা সেই জঙ্গলের মধ্যে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াতে লাগল।

লয়াপি তালতীলমাকে জিজ্ঞাসা করে, কন্যা, কোথায় তোমার ঘর?

তালতীলমা উত্তর দেয়, নীল মেঘের মতো এই যে জঙ্গল, এটাই তো আমার বাড়ি!

“তুমি কি ফেরেশতা, না, জিন?”

“না গো, আমি ইনসান!”

“তবে আমার ডাকে সাড়া দিয়ে একা-একা এই জঙ্গলে চলে এলে কেন?”

“নফস আমাকে তোমার সঙ্গে ঠেলে দিল গো সেখের পো! সে বড় খতরনক চিজ, নফসের তীর-কামটার দেখেছো? পাঁচ খানা মুখ তার—একটো মারে ফজরে, আরেকটো দুফরে, বাকিগুলান বিকাল-সাঁঝ আর রাত্তিরবেলা!”

লয়াপি থমকে দাঁড়ায়। তালতীলমার বদনের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে।

মনে মনে নুর আলম বাবার সম্মতি নিয়ে তালতীলমা বিবি লয়াপিকে নিয়ে নীল মেঘের ভিতর ঢুকে পড়ে। তার অজনবি সুরতে লয়াপি তখন ফানা হয়ে গিয়েছে। তালতীলমা লয়াপিকে বলে, “এই বলো না গো, আমি জিনকন্যা না ফেরেশতা?”

লয়াপি জবাব দেয়, “ইনসান তোমার তাখাল্লুস, আসলে তুমি পরি। তোমার ওই বক্ষদেশে আছে যে কলব তা আসলে মারফতি গানের গোলা।’’

“তবে একখান গান গাও, আমার সিনার গান, সিনা-পসন্দ!”

লয়াপি গান ধরে, ডুবে দেখ দেখি মন কীরূপ লীলাময়।

তালতীলমা তার বেহেশতীয় মায়ায় লয়াপিকে শাওয়াতুর করে তোলে। এই সেই শাওয়া, যাকে মারফতি সাধকরা কামনদী বলে থাকেন। নীল মেঘের মতো বনে একটি ক্ষুরধারা নদী এসে তাদের সামনে দাঁড়ায়। তালতীলমা তার উর্ধ্বদেশের বস্ত্র অনাবৃত করে গেয়ে ওঠে, তীরধারা বয় গো নদীর তীরধারা বয়। তার পর দুজন নেমে পড়ে সেই খরস্রোতা নদীতে। তালতীলমা তার দুই সুবিশাল তালফলবৎ স্তন দ্বারা লয়াপির বক্ষ মর্দন করতে করতে বলে, তুমি কি দানো না যক্ষ, না আলকুজাম, নাকি জিন গা? তুমি ইনসান, এই কথা জানলে তোমাকে আমের ননীর মতো চুষে চুষে খাইতাম!

লয়াপি বলে, তিল থেকে তাল হয় শুনেচি বাপু, কিন্তু তাল থেকে তিল হয় কী প্রকারে!

“এই দুনিয়া হল তাল, আর দুনিয়া ছেনে যা পাও তাই হল তিল—কলব। তোমাকে তালের আঁটির মতো চুষে খেয়ে ফেলতে বাসনা হয় গো সেখের পো!”

“কেন তালতীল মা আমার! এই নদীর স্রোতে আমাকে তো তুমি খাচ্ছোই। তবে আমিও ছাড়ার বান্দা নই। আঁটির ভেতরে থাকে যে শাঁস, যাকে ফকির বলে রুহ, আমি সেই থানে যেতে চাই।

লয়াপি তালতীলমার ওষ্ঠ পীড়ন করতে লাগল। লয়াপির নিষ্ঠুর আক্রমণে তালতীলমার স্তনবৃন্ত ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম হল। নদীর স্রোত এসে তাদের দুজনের সব বস্ত্র হরণ করে নিয়ে গেল। উর্ধ্বাঙ্গের পীড়নে নিম্নাঙ্গে জ্বলে উঠল শাওয়া। ঢেউ আসতে লাগল একের পর এক। শাওয়া-র আক্রমণে তরল এক বাড়বাগ্নি তালতীলমার জঠরে প্রবেশ করে। আপ্লুত হয়ে ওঠে সে।

তার পর দুজনেই দেখে সেই তীরধারা নদী আর নেই। দূরে বায়ু বইছে মৃদুমন্দ। বস্ত্র খুঁজে পরে নিয়ে তারা ফিরে এল নুর আলম কলবলির আস্তানায়। তখন সেখানে একতারা নিয়ে নুর বাবা গান গাইছে।

লামে আলেফ লুকায় যেমন

মানুষে সাঁই আছে তেমন

তা নইলে কী সব নুরিতন

আদম-তনে সেজদা জানায়।

কুকুরটি বসে আছে দূরে। তানীবন বিবি উনুনে খিঁচুড়ি চড়িয়েছে। দশ দিক ধোঁওয়ায় ঢেকে যাচ্ছে। একতারার সুরে আচ্ছন্ন নুর বাবার মুরিদরা পাশে বসে বসে ঢুলছে। কেবল দুজন গাঁজার কলকে নিয়ে একটু দূরে বসে রয়েছে। তাদের সফেদ ধোঁওয়াগুলো কুণ্ডলী পাকিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। লয়াপি ও তালতীলমা এসে পশ্চিম দিকে মুখ করে সেজদায় অবনত হয়। আশেপাশে কোথাও আসরের নমাজের আজান হয়। একতারা নামিয়ে রাখে নুর আলম কলবলি। কুকুরটিও গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। বড্ড খিদে। সকলে তানীবনের দিকে তাকায়। তালতীলমা বিবি কলাপাতা কাটতে যায়। লয়াপি আপন মনে আঁকিবুকি কাটতে থাকে মেঝেতে।

কলাপাতায় খিঁচুড়ি পরিবেশন করে তালতীলমা ও তানীবন বিবি। খেতে খেতে লয়াপি সেখ জিজ্ঞাসা করে বালক বাগদিকে, লামে আলেফ কথাটা যেন কী রকম?

নুর আলম কলবলি লয়াপির কথাটা লুফে নিয়ে বলে, মাছ যখন বঁড়শিতে লাগে, কেমন লাগে তোমার?

লয়াপি ভাবে, একটু আগে সে যে তালতীলমাকে নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে গিয়েছিল, সেই দিকেই বোধ হয় ইঙ্গিত করছে নুর আলম বাবা।

নুর আলম পুনরায় বলতে থাকে, বঁড়শি দেখসো তো? ব্যাঁকানো! ওই ব্যাঁকা ভাব না থাকলে যতই কেঁচো কিম্বা ময়দার টোপ দাও, মাছ ধরা দেবে না।

লয়াপির পুরুষাঙ্গ সামান্য বাঁকা। সে খিঁচুড়ি খাওয়া থামিয়ে নুর বাবাকে বলে, হুজুর! আর বলিয়েন না! আপনি অন্তর্যামী। সকলের সামনে আর আমাকে অপদস্ত করিয়েন না!

নুর বাবা বলেন, আলিফ হল একটা লাঠির মতো। সে হল গিয়ে হক আদায়ের ব্যাপার। আলিফের নীচে ওই ব্যাঁকানো ব্যাপার যদি থাকে তবে সে হয় লাম অক্ষর। লামের মধ্যে যেমন আলিফ লুকায়, তেমনি মানুষের ভিতর সাঁই আছেন, খোদাতালা আছেন। তা যদি না থাকতেন রে লয়াপি, তবে কি সব ফেরেশতা যাদের তন নুর দিয়ে বানানো, তারা কি আর আদমকে সেজদা করত!

লয়াপি হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।

খিচুড়ি খাওয়ার পর নুর বাবা শুরু করবেন সোজখানি। তারই তোড়জোড় চলছে। নুর আলম কলবলি খোদাতালা, নবিজি, ইমাম আলি ও হাসান-হোসেনকে স্মরণ করে বসল পিয়ালতরুর কোলে, হাতে তার একতারা। গান শুরুর আগে নুর বাবা বিসমিল্লাহখানির জন্য একটু সময় চেয়ে নিলেন। বিসমিল্লাহখানি হল গানের পূর্বে সামান্য কথন।

একবার খাঁড়েরা গ্রামের মাহাতারিমা ফাতেমা বিবি তাঁর একমাত্র পুত্র মৌলানা শাহ সুফি সৈয়দ মুস্তাফা আলিকে বললেন, বিরাট এক উরসের আয়োজন করো। সেই উরসকে কেন্দ্র করে সাত দিন ধরে চলল জলসা। সেই জলসায় হাজির হল মশহুর বাউল চন্দন ফকির। তার বয়স তখন এক শো বছর। জলসায় উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন জেলার বাউল-ফকির আর কলন্দর। তারা চন্দন ফকিরকে জিজ্ঞাসা করল, তুমি এতদিন কোথায় ছিলে?

চন্দন ফকির বলল, এখান থেকে বহুদূরে। যে পথ দিয়ে সেরেন দ্বীপ থেকে আদম বাবা হাঁটতে হাঁটতে জেড্ডায় গিয়েছিল, সেই পাক পথে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গিয়েছিলাম চিস্ত নামক এলাকায়। সেখানে গিয়ে শুনি নানা রকম গানের কত শত সমাহার!

উপস্থিত কলন্দররা বলল, তবে সেই গান হোক!

চন্দন ফকির ধরলেন গান! সেই গানের কথা কোথাও লেখাজোখা নেই।

নুর আলম কলবলি বলল, তবে শোনো বাবা চন্দনের গান। তার গানের খুশবু ছড়িয়ে পড়ুক সারা গাঁয়ে।

ব্রহ্মা হইল মহম্মদ, বিষ্ণু হইল পয়গম্বর

আদম হইল শূলপাণি

গণেশ হইয়া গাজি, কার্তিক হইল কাজি

ফকির হইল যত মুনি।

ত্যাজিয়া আপন ভেক, নারদ হইল শেখ

জল হইল পাক পানি।

মাহাতারিমা ফাতেমা বিবি এবং তাঁর একমাত্র পুত্র মৌলানা শাহ সুফি সৈয়দ মুস্তাফা আলি চন্দন বাবাকে তিন দিন তিন রাত জলসায় গান গাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। সেই সব গানের মধ্যে ছিল অবাক আর বেবাক করা সব কিসসা। নিরাপদে তুমি যে ঘরের মধ্যে বাস করছ, তার ভিতর ছোট্ট গর্ত দিয়ে ঢুকে পড়ল কালসর্প। কাঁথা গায়ে দিয়ে তুমি শুয়ে আছো, এমন সময় সেই সর্প তোমার কাঁথার মধ্যে ঢুকে পড়ল। তার পর তোমাকে সেই সাপ যখন কামড়াতে যাচ্ছে...

নুর আলম বাবার গানের বিরতির ফাঁকে গল্পের এমন সময়ে দৌড়তে দৌড়তে হাজির হয় হারেস মিঞা।

“কী হল, হারেস মিঞা? হাঁপাও ক্যানে? বোসো বোসো। জিরান লাও। তার পর খুলে বলো, কী হল?” হারেস মিঞার উদ্দেশে নুর বাবা কথাগুলো বলে।

হারেস মিঞা না বসেই তড়বড় করে জানায়, পাশের গ্রাম শিমুলিয়ায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা লেগেছে। চার পাঁচ জন লোক খুন হয়েছে। আমাদের গাঁয়ের পূব দিক আর দক্ষিণ দিকে পুলিশ এসে ঘাপটি মেরে বসে রয়েছে। দেখলেই গুলি মারবে।

লয়াপি সেখ জিজ্ঞাসা করে, শিমুলিয়ায় কীভাবে দাঙ্গা লাগল?

হারেস মিঞা উত্তর দেয়, সোবহান মির্জার বড় ব্যাটা আজাদ মির্জা তাঁর দুই ভাইয়ের সঙ্গে মিলে বাপের কুলখানি দেবে বলে একখান গরু পাচুন্দির হাট থেকে কিনে ফিরছিল। সেই গরু যার কাছ থেকে কিনেছিল, সে হল গিয়ে আইজুনির নন্দ পণ্ডিতের ব্যাটা নারান পণ্ডিত। গরু বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর নারান জানতে পারে, তার ওই গরু আজাদ মির্জা বাপের কুলখানিতে জবাই করবে বলে কিনেছে। নারান পণ্ডিত এসে শিমুলিয়ার সোমেন চক্রবর্তীকে ধরে। সোমেন ঠাকুর আজাদ মির্জাকে ডেকে পাঠায়। আজাদ মিঞা এসে বলে, গরু এখন কার সোমেন ঠাকুর?

সোমেন চক্রবর্তী বলে, আগে ছিল নন্দর ব্যাটা নারানের, এখন তোর, আজাদের।

আজাদ মির্জা জানায়, তার গরু, সে কুলখানিতে জবাই করবে, না কশাইদের বিক্রি করবে, নাকি ঘরে তাক কেটে বাঁধিয়ে রাখবে, তা সে ঠিক করবে!

সোমেন ঠাকুর বলে, ঠিক কথা, কিন্তু আজাদ তুই বড্ড চ্যাটাং চ্যাটাং কথা কস। এই কথা কি ভাল করে কওয়া যায় না! তবে তোর নেয্য কথা, মানি। নারান তুমি বাড়ি যাও। নইলে টাকা দিয়ে গরু ফেরত নিয়ে যাও।

আজাদ মির্জা বলে, আমার গরু আমি বেচবো না!

ইতিমধ্যে অনেক লোক জড়ো হয় সেখানে। আজাদ মির্জা, নারান পণ্ডিত, সোমেন চক্রবর্তী বাড়ি চলে গেলেও লোকজনের মধ্যে তর্ক-বিতণ্ডা শুরু হয়, তার পর ঝামেলা। দু একজনের মধ্যে হাতাহাতিও হয়।

এই রকম ঝামেলা থেকে অট্টহাসতলা আর সোনারুন্দি থেকে বহু লোক এসে শিমুলিয়া গ্রামে আজাদ মির্জার বাড়ি আক্রমণ করে। তার গোয়ালের গরু নিয়ে পালায়। আজাদ মির্জা তালেবর লোক। সে পার্টি করে। তার হয়ে কথা বলবে, দরকারে লাঠি ধরবে, এমন লোকের সংখ্যাও কম নয়। যারা অট্টহাসতলা আর সোনারুন্দি থেকে এসেছে, তারা কেউ নারান পণ্ডিত বা সোমেন চক্রবর্তীর চেনা লোক নয়। গুলি বোমা পিস্তল এনে আজাদ মির্জার বাড়ি তছনছ করে পোস্টার লাগিয়ে গিয়েছে, গোমাতার কোনও অপমান তারা সহ্য করবে না!

পুলিশ এসেছে অনেক দেরিতে। গ্রামের মাতব্বররা ঝামেলা থামাতে এসেছিলেন বটে, কিন্তু বোমা গুলির আওয়াজ শুনে সকলে নিরাপদে পালিয়েছেন। এখন পুলিশই একমাত্র ভরসা। শোনা যাচ্ছে, এই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়বে আশেপাশের অনেক তল্লাটে। কিছু দিন পর ভোট। প্রচুর বাইরের লোক এলাকায় এসে পড়েছে। তাদের মুখের জবান অপরিচিত।

নুর বাবা, কী হবে গো আমাদের?—হারেস মিঞা কেঁদে ফেলে।

নুর আলম কলবলি লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। একতারা নামিয়ে রাখে পাশে। তার পর জিজ্ঞাসা করে, কে এই দাঙ্গার হোতা? সে এক হপ্তাকালের মধ্যে বিষাক্ত কালসর্পের দংশনে ইন্তেকাল করবে!

তানীবন বিবি বলে, আপনি অকারণে আহাদিল দিচ্ছেন ফকির বাবা! দাঙ্গার হোতা এক জনা না, মেলা লোকে। সারা দেশ জুড়ে হচ্ছে। এক কালে দাঙ্গা হইত মানুষে-মানুষে ভুল বোঝাবুঝি থেকে। আজকাল সেই সব আর হয় না। জমি দখলের লড়াই চলছে গাঁ গেরাম আর শহরে। আপনি ওই লালনের গান দিয়া আর হাঙ্গামা থামাইতে পারবেন না।

নুর আলম কলবলি বলে, মানুষের উপর বিশ্বাস হারাইয়ো না বিবিজান! কয়েকটা লোক আমাদের মধ্যে হাঙ্গামা বাধিয়ে দিচ্ছে, আর আমরা হাঁ কইরা বইসা আছি। ভয়ে ঘরের দোর লাগাইছি। এই খানে আমাদের গুনাহ! ওরা আমাদের এমনিতেও খ্যাদাইতে আসবে, অমনিতেও খ্যাদাইবে। বীরের মতো দাঙ্গা আটকাইয়া শহিদ হইব, নইতো গাজি। চলো লয়াপি শেখ, বালক বাগদি! আমাদের ভাই বেরাদররা চলো গাঁয়ের পূব আর দক্ষিণে যাই!

বালক বলে, শুনলেন না, ওখানে পুলিশ আছে!

তাহলে আমাদের এখন কী করণীয়?—নুর আলম কলবলি জিজ্ঞাসা করে।

তানীবন বিবি ও তালতীলমা বলে, গান-বাজনা করেন। কী আর করবেন! কাল ভোরে উঠে গাঁয়ের হিন্দু মুসলমান মাথার মাথার লোকদের সঙ্গে কথা বলেন। কিছু লোক আছে, যারা ফ্যাসাদ চায়। তাদের সঙ্গে কথা বলিয়েন না।

“কারা তারা?” নুর আলম কলবলি জিজ্ঞাসা করে।

কেউ কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই ভারি বুটের আওয়াজ পাওয়া যায়। টর্চের জোরালো আলো এসে পড়ে নুর আলম কলবলির মুখে।

“কোন বেয়াদপ, মুখে আলা ফ্যালে!” নুর আলম কলবলি এই কথা বলা মাত্র দেখতে পায়, তার আখড়া ঘিরে ফেলেছে কিছু মানুষ। তাদের বেশভূষা পুলিশের মতো। কিন্তু নুর আলমকে তো এই তল্লাটের পুলিশরা চেনেজানে। তারা কেন হঠাৎ আখড়া ঘিরে ফেলল, এ কোন গভীর ষড়যন্ত্র! তবে কি এরা পুলিশ নয়?

0 Comments

Post Comment