পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

ত্রিস্তরীয় প্রহসন

  • 17 July, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 770 view(s)
  • লিখেছেন : দেবাশিস আইচ
কেন্দ্রীকরণের বিরুদ্ধে পালটা আন্দোলন চাই গ্রাম সংসদ/ গ্রাম সভা প্রতিষ্ঠার। গ্রামের মানুষই, গ্রাম উন্নয়নের পরিকল্পনা তৈরি করবে—এই স্লোগান তুলেই শুরু হোক এই দুঃশাসনীয় কেন্দ্রীকরণ আর হিংস্র দুর্নীতিরাজের বিকেন্দ্রীকরণের বিরুদ্ধে লড়াই। লিখলেন দেবাশিস আইচ।

 

কেমন হল পঞ্চায়েত ভোট? কে কোথায় বাড়িয়ে তুলতে পারল দলীয় শক্তি, দুর্বল হল কোথায়? এমন সব তুলনামূলক বিচারপর্ব যথারীতি শুরু হয়েছে। সেখান থেকে উচ্চারিত হচ্ছে নানান তথ্য এবং ভাবী নির্বাচনে বিভিন্ন দলের বিভিন্ন সম্ভাবনার কথা। আলোচনা করছেন যাঁরা, তাঁরা বিশেষজ্ঞ বলেই পরিচিত। কেউ দলীয় রাজনীতির, কেউ-বা ভোট রাজনীতির, কেউ পোঁড় খাওয়া রাজনৈতিক সংবাদদাতা তো কেউ দুঁদে আইনজীবী কিংবা প্রাক্তন পুলিশকর্তা।

সাধারণ ভাবে তাঁদের আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিবাদ যে অক্ষে ঘূর্ণায়মান—হিংসা, মৃত্যু, লুট, ছাপ্পা, পুলিশ, কেন্দ্রীয় বাহিনীর অনুপস্থিতির উল্লেখ সত্ত্বেও—তা হল ২০২৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন এবং তার ফলাফলকে বৈধতার স্বীকৃতি দান। অবৈধ যা ঘটেছে, তার বিরুদ্ধতার মধ্যেও লুকিয়ে থাকে সেই অবৈধতার স্বীকৃতি। যখন আলোচ্য হয়ে ওঠে লক্ষ্মীর ভান্ডার কীভাবে তৃণমূল কংগ্রেসের নিরঙ্কুশ জয়কে প্রভাবিত করেছে কিংবা ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে এই জয় মমতা বব্দ্যোপাধ্যায়কে এগিয়ে রাখবে। অতীত প্রসঙ্গের উত্থাপন করে, তারই আলোকে বর্তমান লুট, হিংসা, মৃত্যুকে দেখার অর্থ অতীতের তাবৎ অন্যায় কর্মকাণ্ডকেও একরকম বৈধতা দেওয়া। এতো শুধু ওই বিশেষজ্ঞ কিংবা রাজনীতিকদের তর্ক-বিবাদে ফুটে ওঠে তাতো নয়, সাধারণ ভাবে সাধারণ মানুষ মুখ খুললেও ঘুরে ফিরে নির্বাচনে হিংসা, ঘৃণা, লুটপাট যে রীতিসিদ্ধ তার পক্ষেই মতামত জোরালো হয়ে ওঠে।

আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ মনস্তাত্ত্বিক দিক হল গ্রামীণ সমাজ সম্পর্কে—যে সমাজের সিংহভাগ নিম্নবর্ণ, নিম্নবর্গ, দলিত, মুসলমান, আদিবাসী— ভদ্র, শিক্ষিত, বলিয়ে-কইয়ে শহুরে, আধা-শহুরে, গ্রামীণ উচ্চবর্গীয় সমাজের ঐতিহাসিক অসীম অজ্ঞতা ও অবজ্ঞা। সম্প্রতি এই নির্বাচন ও হানাহানি বিষয়ে এই লেখকের এক লেখায় জনৈক পাঠকের মন্তব্য এ বিষয়ে উল্লেখ করার মতোই। তিনি লিখছেন, "একটা উপলব্ধি আমার খুব বেশি করে আজকাল মনে হয় অশিক্ষিত মানুষের হাতে ক্ষমতা প্রদান খুব বেশি করে বিপর্যয় ডেকে আনে।" এমনটা মনে করার কোনও কারণ নেই যে, এটি কোনও এক ব্যক্তির একটি বিচ্ছিন্ন মন্তব্য। এ আসলে সেই মন ও মানসিক গঠন, যা প্রথমাবধি পঞ্চায়েতি-রাজ, নিচুতলার 'ছোটলোক'দের কখনও ক্ষমতাকে ভাল চোখে দেখেনি। এবং সর্বশক্তি দিয়েই তার বিরোধিতা করে এসেছে। আর ঐতিহাসিকতার অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়, দু'টির উল্লেখ করা যাক। 'মৈমনসিংহ-গীতিকা'র খোঁজ করতে গিয়ে স্বয়ং দীনেশচন্দ্র সিংহকে মৈমনসিংহের ইংরেজি শিক্ষিত মাতব্বরদের কাছে শুনতে হয়েছিল, "ছোটলোকেরা, বিশেষত: মুসলমানরা, ঐ সকল মাথামুণ্ডু গাহিয়া যায়, আর শত শত চাষা লাঙ্গলের উপর বাহুভর করিয়া দাঁড়াইয়া শোনে। ঐ গানগুলির মধ্যে এমন কি থাকিতে পারে যে শিক্ষিত সমাজের তৎপ্রতি আকৃষ্ট হইতে পারেন?" এ হল বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের কথা। দ্বিতীয়টিও সংস্কৃতি জগতেরই। ১৯৫৭ সালের খোদ কলকাতার কথা। বিনয় ঘোষের 'পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি' প্রকাশিত হয়েছে। 'গোলদীঘির বিদ্যাকেন্দ্রে' একটি বইয়ের দোকানে হঠাৎই তাঁর আলাপ হয় সংস্কৃত কলেজের এক পণ্ডিতমশায়ের। সেই পণ্ডিতমশায় পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি'র প্রশংসা করেই বলেছিলেন, "বলছি কি যে এত ভাল বইটাতে একটা ত্রুটি রয়ে গিয়েছে বলে আমার মনে হয়।...বড্ড বেশি 'ছোটলোকদের' কথা বলেছেন, মানে বাগদি বউরির হাড়ি ডোম সাঁওতাল, যেন সংস্কৃতিটা তাদের। আপনার বইটা পড়লে তাই মনে হয়।...আর একটা bias আপনার আছে। মুসলমান-প্রীতিটা আপনার অত্যধিক। সেটা কি ঠিক? মানে সংস্কৃতির দিক দিয়ে মুসলমানদের সম্বন্ধে অত কথা বলার দরকার কি?" বাম আমলের ভূমিসংস্কার, বর্গাদারদের মধ্যে জমি বণ্টন, ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এই 'ছোটলোক'দের ক্ষমতায়ন— গ্রামীণ ভূস্বামী থেকে শহুরে ধনী ও শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের  কাছ থেকে একই রকম নিন্দিত হয়েছিল। মণ্ডল কমিশন থেকে সাচার কমিটি'র রিপোর্টের বিরুদ্ধতার মধ্যেও সেই একই ট্র‍্যাডিশনের বহমানতাকেই লক্ষ্য করা যায়।

ভূমি সংস্কার ও ক্ষমতার 'বিকেন্দ্রীকরণ ছিল বামেদের দু'টি প্রধান স্লোগান। ১৯৮৫ সালে "গ্রামভিত্তিক জেলা উন্নয়নের পদ্ধতিগত রূপরেখা' প্রকাশ করেছিল বামফ্রন্ট। তার আগেই তৎকালীন মেদিনীপুর জেলা পরিষদ ও আইআইটি-র গ্রামোন্নয়ন কেন্দ্র বিকল্প উন্নয়নের দিশার মডেল নির্মাণ করে। নেতৃত্বে ছিলেন প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অজিত নারায়ণ বসু। ২০০২ সালের অক্টোবরে ওই মেদিনীপুর পরিকল্পনার ধাঁচে পঞ্চায়েত দপ্তর প্রকাশ করেছিল "সমন্বিত জন উদ্যোগে সহভাগী পরিকল্পনা বা গ্রামবাসীদের দ্বারা গ্রাম পরিকল্পনা"। এই নির্দেশনামায় গ্রাম সংসদকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। সবচেয়ে নিচের স্তরে—ওই 'বাগদি বাউরি হাড়ি ডোম সাঁওতাল'—সবথেকে বেশি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ও সিদ্ধান্ত চালু করার ক্ষমতা দেবার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বেশির ভাগ জেলাতেই রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে এই নির্দেশনামা গুরুত্ব পেল না। ক্রমে ক্রমে গ্রাম সংসদে যোগ দেওয়া, পরিকল্পনায় অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহ হারাল সাধারণ মানুষ। সিদ্ধান্ত নেওয়ার যতগুলি স্তর রয়েছে পঞ্চায়েত থেকে পার্লামেন্ট, তার মধ্যে প্রকৃত অর্থে সংখ্যা গরিষ্ঠ শ্রমজীবী মানুষের 'পার্লামেন্ট' ছিল গ্রাম সংসদ। এই সহভাগী মডেলের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ ছিল গ্রাম উন্নয়ন কমিটি। বিরোধীদেরও যেখানে স্থান ছিল বাঁধা। এই কমিটির জন্য প্রথম থেকেই অর্থ বরাদ্দ করা হত। যা তারা গ্রামের উন্নয়নের জন্য ইচ্ছেমতো খরচ করতে পারত। ২০০৫ সালে গ্রাম উন্নয়ন সমিতি তৈরি হয়।

বিকেন্দ্রিত প্রশাসনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল বামফ্রন্ট কিন্তু ক্ষমতার রাজনীতি, ভোটের রাজনীতি সেই আদর্শে ক্ষমতাসীন বামপন্থীদের থিতু হতে দিল না। গ্রামের সংসদ সিদ্ধান্ত নেবে, গ্রাম উন্নয়ন সমিতি (পড়ুন ছোটলোকরা) টাকা খরচ করবে—গ্রামীণ মাতব্বর থেকে বিধায়ক, সাংসদ, মন্ত্রীরা মেনে নিতে পারলেন না। না ক্ষমতাসীনেরা না বিরোধীরা। ২০০৮ সালে পঞ্চায়েত ভোটে ধাক্কা খেয়ে বিরোধীদের সঙ্গী করেই বিকেন্দ্রীভূত ব্যবস্থার শেষ ধাপ গ্রাম উন্নয়ন সমিতির বরাদ্দ বন্ধ করল বামফ্রন্ট। পঞ্চায়েত প্রধান, উপ প্রধান, উন্নয়ন সমিতি মানে গ্রামের মানুষই উন্নয়ন প্রকল্পে টাকা খরচ করছে—এমনটা আর সহ্য করল না ক্ষমতাসীন 'ভদ্রলোক'রা। আমলা কিংবা পঞ্চায়েত মন্ত্রী, শাসক দলের নেতা কিংবা বিরোধী একযোগে গলা টিপে মারল গ্রামের মানুষের ইচ্ছে-অনিচ্ছাকে।

তবুও যেটুকু বজায় ছিল, যেটুকু ক্ষমতায়ন হয়েছিল, আর্থিক, সামাজিক উন্নয়ন ঘটেছিল আম গ্রামীণ মানুষের তার ষোল আনার জায়গায় ১৮ আনা গঙ্গাপ্রাপ্তি ঘটে গিয়েছে। পরিণত হয়েছে ত্রিস্তরীয় প্রহসনে। ২০২৩ সালে নতুন কোনও কিছুই হয়নি, যা ২০১৮ সালে ঘটেনি। রাজ্য সরকার, রাজ্য নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে জেলা থেকে ব্লক প্রশাসন ও পুলিশ এবং সর্বশেষ ধাপে দলীয় গুন্ডাবাহিনী—এই ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েতি নির্বাচনী-রাজের মূল চালিকা শক্তি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর স্বৈরাচারী সরকার, আমলাকুল, পুলিশ ও বগটুই বাহিনী এ রাজ্যে ক্ষমতা চূড়ান্তভাবে কেন্দ্রীভূত করেছে। একমাত্র ৭২ সালের সঙ্গে যা তুলনীয়।

এর প্রতিস্পর্ধী রাজনীতি যদি কিছু থেকে থাকে তবে তা ওই গ্রাম সংসদ স্তর থেকেই তুলে আনতে হবে। সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবেন তাঁরাই—যেমন বনাধিকার এবং প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষার আন্দোলন, ১০০ দিনের খেতমজুরদের আন্দোলন, মিড-ডে মিল, আশা, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের আন্দোলনের কর্মীরা। এই আন্দোলনগুলিরও সমন্বিত রূপ চাই। কেন্দ্রীকরণের বিরুদ্ধে পালটা আন্দোলন চাই গ্রাম সংসদ/ গ্রাম সভা প্রতিষ্ঠার। গ্রামের মানুষই, গ্রাম উন্নয়নের পরিকল্পনা তৈরি করবে—এই স্লোগান তুলেই শুরু হোক এই দুঃশাসনীয় কেন্দ্রীকরণ আর হিংস্র দুর্নীতিরাজের বিকেন্দ্রীকরণের বিরুদ্ধে লড়াই। পঞ্চায়েতি-রাজকে তার প্রকৃত মহিমায় প্রতিষ্ঠা করতেই হবে।

 

0 Comments

Post Comment