পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

বাঘ ও বালিকা

  • 16 October, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1220 view(s)
  • লিখেছেন : শৈলেন সরকার
যেন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে সব কটা দেওয়াল। জানালার কাচ, সিঁড়ি। টিভির শাহরুক কিংবা কাজল পর্দা ছেড়ে ছিটকে বেরিয়ে যেন উড়তে শুরু করবে হাওয়ায়। যেন ভেঙে পড়বে যাবতীয় মেঝে, ছড়িয়ে পড়বে সিমেন্ট, বালি এমনকী অ্যাকোয়ারিয়ামের জলও। লাল নীল মাছগুলি ডানা মেলবে আকাশে। যেন ভেঙে টুকরো টুকরো হবে সেও।

চিলেকোঠার এই অন্ধকারে খুলে যাচ্ছে তার হাত, পা, বুক, পেট। আলগা হয়ে যাচ্ছে তার চোখ, নাক গলা। কাকলি চিৎকার করে ডাকতে চাইছিল কাউকে। বা নিজেকে জাহির করার জন্য নিজের উচ্চারণ করা কোনও ধ্বনি একবার অন্তত নিজের কানে শুনতে চাইছিল। পা দুটোকে টেনে বড় করতে চাইছিল। অন্তত একবারের জন্য হলেও মাটি ছুঁতে চাইছিল সে।

দেশ ছেড়ে যখন চলে আসছে কাকলি, পই পই করে বারণ করেছিল মা, বলে দিয়েছিল, দেশের কথা এই আবাদের কথা শহরে গল্প করিস না কিন্তু।

—কেন?

—বোকা ভাববে তোকে। ভাববে, জানিস না কিছু।

ভোরের ভুটভুটি ঘাটে লাগার আগে রেণুমাসি মাকে বোঝাচ্ছিল খুব। একবার গেলেই টের পাবে কাকলি। তখন নাকি শহর ছেড়ে আসতেই চাইবে না সে। টিভি দেখ, হাওয়া খাও ছাদে দাঁড়িয়ে আর এমন কিছু কাজও তো নয়— ঘর মোছা, বাসন ধোয়া আর স্কুল থেকে ছেলেটা ফিরলে দাদা-বৌদির ঘরে না ফেরা পর্যন্ত ওর একটু দেখাশোনা করা, ব্যস, এর পর তোমাকে আর কেউ বলতে আসছে না কিছু।

কাকলির ঠোঁট দুটো কেন কে জানে নড়ে উঠল হঠাৎ। যেন সে সত্যি ডেকে উঠল কাউকে, যেন বলে উঠল, মা— । আর কী অবাকের ভাবো, এই ডাক কেমন উড়তে শুরু করে হাওয়ায়। দোতলার ছাদ ছাড়িয়ে, ছাদের অন্ধকার ছাড়িয়ে, রাস্তা ছাড়িয়ে, মামনদের বাড়ি ছাড়িয়ে কেমন কুয়াশার মতো ছড়িয়ে দিতে থাকে নিজেকে। ইলেকট্রিকের তার রেললাইন, স্টেশনের পর স্টেশন। কাকলি নিজের উচ্চারণ করা শব্দটাকে স্পষ্ট চোখে দেখতে পাচ্ছে তখন। আকাশের মেঘ, চাঁদের হলুদ, দূরের একটা দুটো তারা। প্লাটফর্মে ট্রেনের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলি অবশ্য টের পাচ্ছে না কিছু, ওরা জানতেও পারছে না ছোট্ট একটা শব্দ কেমন হু হু করে গড়িয়ে যায় রেললাইন ধরে। এর পর শিয়ালদা স্টেশন, স্টেশনের ভিড়। আকাশ ঢাকা ছাদ, মাইকের কথা। প্লাটফর্মের টিভিতে শাহরুক। হাত দুটিকে শেষবারের মতো উপরে তোলার চেষ্টা করল কাকলি। অন্তত একবারের জন্য নিজের শরীরটাকে টান করার চেষ্টা করল সে। আর সেই ডাক, সেই এক অক্ষরের সেই শব্দ ‘মা’, কেমন টের পেল দেখ। শিয়ালদা স্টেশন থেকে নেমে আবাদ যাওয়ার বাস ধরার জায়গায় দাঁড়িয়ে সে কেমন থামে। পিছন ফিরে তাকায় একবার। যেন পিছন থেকে সত্যিই টেনে ধরবে কেউ তাকে। যেন এক্ষুনি কেউ বারণ করবে যেতে। যেন কাকলিই। যেন হঠাৎ করে তার মনে পড়ে গিয়ে থাকবে কোনও কথা। কাকলি ফের ছুঁতে চেষ্টা করল কিছু। তার গলা বুক— তার সারা শরীর দিয়ে কিছু বলতে চাইল সে, যেন ‘মা’ ডাকের সেই এক অক্ষরের শব্দকে সে থামতে বলবে। যেন সত্যিই আরও কিছু বলার আছে কাকলির। যেন শেষ মুহূর্তে হঠাৎ করে মনে পড়ল। এ বাড়িতে ঢুকে সে দিন রেণুমাসি বলে উঠেছিল, কই গো বৌদি দেখ নিয়ে এলাম কাকে?

আবাদের গ্রামের সেই হাইস্কুলের মতো বাড়ি। রাস্তা ঘেঁষে দেওয়াল। জানালা, দরজা। বৌদি সে বার চোখ কুঁচকেছিল। বলে উঠেছিল, এত বড় মেয়ে?

—এত বড় কী গো? এই তো সবে চৌদ্দো গিয়ে পনেরো, গ্রামের মেয়ে তো— ।

— তুমি যে বললে দশ এগারো।

রেণুমাসি কেমন এড়াতে চাইল কথাটি। সঙ্গে সঙ্গে কেমন ধমকে উঠল কাকলিকে। বলে উঠল এই তোর বৌদি। যা, প্রণাম কর।

ঝড় হবে নাকি? কেমন হাওয়া আসছে না? দরজাটা কেমন দুম করে খুলে গেল হঠাৎ। এই এক্ষুনি ফের মাটি ছোঁয়ার ইচ্ছা জাগল মনে। ফের দুটো পা টান করে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করল সে। কেমন মেঝে, দরজা, সিঁড়ি যেন এবার ছাদ থেকে সিঁড়িতে পা দেবে কাকলি। এর পর দোতলায় নেমেই—  না, দাদাবাবুকে আর খুঁজবে না সে, বরং টিভির সামনেই বসবে। সিনেমাটা দেখে নেবে পুরোপুরি। কী হল এর পর শাহরুকের? ও কি পাবে কাজলকে? আর কাজল? দাদাবাবু বলছিল, কাজলের জায়গায় তুই হলে কী করতিস কাকলি ? শাহরুককে পছন্দ হয় তোর? ‘হাতটা সরাও, সরাও না দাদাবাবু, বৌদি দেখলে— ।’ ‘আহ্‌ কাকলি যদি শাহরুক হতাম আমি?’ ‘ওহ ছাড়ো না দাদাবাবু।’

থাক, বৌদি বাড়ি ফেরা পর্যন্ত সে বরং বাইরেই থাকবে। রন্টির মা হয়তো জিজ্ঞাসা করবে কিছু। হয়তো বলবে, কী পিয়ালীদি ফেরেনি এখনও? বা, তোর দাদাবাবু কী করছে? রেণুমাসি, একবার অন্তত এসে দাঁড়াও না। আমার ভয় করছে, বিশ্বাস কর। এত অন্ধকার এই ছাদ। আর কি হাওয়া ভাবো! রেণুমাসি, মা না আসা পর্যন্ত তুমি– । 

এক এক সময় সামনে পিছনে যে দিকেই তুমি তাকাও চোখে পড়বে না কিছু। অন্ধকার রাতে তখন বড় জোর আধ খাওয়া একটা চাঁদ তার হলুদ ছড়িয়ে দিয়েছে হাওয়ায়, বড়জোর দুপাশের গাছগুলিতে জ্বলতে নিভতে থাকা জোনাকি, সামনের বাঁক ছাড়িয়ে হয়তো দূর কোনও গৃহস্থ ঘরের কেরোসিন কুপি, বা দূরে জেগে উঠতে থাকা শ্যালোর শব্দ। কেমন ধক্‌ধক্‌। যেন পৃথিবীর ভিতরটা সত্যিই ফাঁকা করে দিচ্ছে কেউ। যেন যতই টানো তোমার দু-পা, কিছুতেই মাটি ছুঁতে পারবে না তুমি। . 

ছোট সেই শব্দ, সেই ‘মা’-ডাক কেমন ভীতু দেখ, এই অন্ধকারে ফাঁকা রাস্তায় সে কেমন শিশু এখন। তার যেন কোনও হাত নেই, যেন পা নেই, যেন চোখও নেই। যেন বাতাস নয়, এক অন্ধকারই তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। সে কেমন বড় রাস্তা ধরে নীচে নামে। কেমন ঝোপঝাড়, বাবলার কাঁটা পড়ে থাকা জমি। সে পাক খায়। সে এমনকী পিছনেও তাকায় না আর। যেন কেউ ধমকাবে তাকে। যেন তাড়া দেবে খুব। যেন কেউ বলে উঠবে, কী হল?

হালকা এক আলো কেমন উড়ে এসে জুড়ে বসল দেখ। কেমন পায়ের পাতা, কেমন নখ। কেমন ফ্রক, ফ্রকের নকশা। সবুজ ফ্রক কেমন কালচে লাগে এখন। আর সেই ফুল? সেই গোলাপের মতো, হালকা গোলাপির সেই ছাপ। ফুলের সঙ্গে লতার মতো কালো সেই ঢেউ যেন ভেসে উঠবে কোথাও যেন ঢেউয়ের মাথায় জেগে থাকা পাঁপড়ি আর ফুলের ঘ্রাণও। তুমি টের পাচ্ছ? ফুলের এই ঘ্রাণ? মা—  ।

শিশুর মতো ঘুরে ফিরতে থাকা সেই ডাক, সেই বড় রাস্তা ছেড়ে ধু-ধু জমিতে নেমে যাওয়া শব্দ, উথাল পাতাল অন্ধকারে ডুবে গিয়েও ফের ভেসে উঠতে থাকা কোনও ঘ্রাণ যেন দাঁড়ায় কোথাও। ফড়িং-এর মতই। কোথাও নামতে পারবে না জেনে যে হঠাৎ থামে, ফিনফিনে ডানা বাতাস কাঁপায়, ঝিম মারে। ছোট এক অক্ষরের সেই ডাক, সেই শব্দ কী মনে করে পেছন ফিরে তাকায়। দূর আকাশে শহরের আলো। কেমন লালচে হলুদ এক আভা। অন্ধকার ফুঁড়ে কোথাও আলোর এক বিন্দু, একটা শব্দও। ক্রমে জেগে উঠতে থাকা এক ধ্বনি। সেই গোমতীর পাড়ে মাটির ঘরে ঘুমিয়ে থাকা এক মায়ের খুব চেনা এক ঘ্রাণ ফের শরীর তোলে। মোটরগাড়ির আলোতে সে কিছু সাহস পায় যেন। রাস্তা চোখে পড়ে তার। এই রাস্তা ধরেই সে একদিন পা দিয়েছিল তো শহরে। পাশে তখন রেণুমাসি বসে। রেণুমাসি জানতে চাইছিল, মন খারাপ করছে তোর? কষ্ট হচ্ছে মায়ের জন্য? এক অক্ষরের সেই ধ্বনি, সেই ‘মা’ ডাক খেত জমি ছাড়ে। ফের সেই ঝোপজঙ্গল, বাবলা কাঁটা। ফের বড় রাস্তা। দ্রুত চলে যেতে থাকা আলো। দু’পাশে মাছের ঘের, জলের চিকচিক, দূরে নেমে যেতে থাকা আকাশ। মাইকে শব্দ আসছে কোনও। কোনও গান। হো হো রব। কীর্তনের ধুয়ো তুলছে কেউ। একা না কি অনেকজন? সঙ্গে হারমোনিয়াম। ক্ল্যারিওনেট, বাঁশি। করতালধ্বনি। আকস্মিক ঝম্‌ঝম্‌ঝম্‌।

নীচে দরজা খোলার শব্দ। বৌদি? না থাক। ডাকবে না কাকলি। বৌদি এসে থাকলে নিজেই খুঁজবে কাকলিকে। প্রথমে দাদাবাবুর ঘর। এর পর রান্নাঘর বারান্দা করে সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে কাকলির নাম ধরে নিজেই হয়তো ডাকবে চিৎকার করে। কাকলি অবশ্য সাড়া দেবেনা আজ। বৌদি হয়ে থাকলে সাড়া না পেলে রেগে উঠবে খুব। ফের ডাকবে। এর পর হয়তো রন্টির মাকেই জিজ্ঞেস করবে কিছু, জানতে চাইবে, কাকলিকে পাঠিয়েছ কোথাও? বউদি অবশ্য কাকলিকে রন্টিদের ঘরেই আশা করবে। ভাববে রন্টির দিদির পাশে বসে কিছু বাজে বকছে সে। বাজে বকা অর্থে, ছেলেদের নিয়ে মেয়েদের হাজারো কথাই। রন্টির দিদির প্রসঙ্গে বৌদির অবশ্য কুনালদার কথাই মনে আসবে। রন্টির দিদিকে কেন কুনালদার সঙ্গে হাজার জায়গায় দেখবে সবাই? রেল স্টেশন বা সিনেমা হল। কেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওরা দু’জনে এক ঘরে বসে গল্প করবে? মা, শুনতে পাচ্ছ? আমি। আমি কাকলি। সেই যে রেণুমাসি নিয়ে এল। তুমি রাজি হলে। বললে, দু’বেলা দুটো ভাত আর জামাকাপড় দিলেই— । রেণুমাসি পাঁচশো টাকা দেওয়ার কথা তোলায় তুমি অবাক হলে। আর? আর গলা নামিয়ে, ‘টাকার কথা ওর সামনে বলিস না রেণু’ বললে। মা, টাকা কিন্তু আমি চোখেই দেখিনি। দেখিনি মানে, আমার টাকা মাসে মাসে আমার পরিশ্রমের রোজগার পাঁচশোটা করে টাকা, ও টাকা তোমার কথা মতো রেণুমাসির কাছেই বাড়ছে। মাসের হিসাব আমার মনে নেই মা। কত হল কে জানে? তুমি একটা টেম্পো জাল ঠিকই কিনতে পারবে। টেম্পো জাল মানেই বাগদার মিন। ভাঁটার জলে নামা। আর বাঘের কথা কিন্তু তুমি মনে রেখো মা। সেই বাবাকে নিয়ে যে গল্পে ঝোপের আড়ালে অপেক্ষা করবে কেউ।

বউদি ডাকছে। একবার, দু’বার। দাদাবাবু গেল কোথায় তা হলে? সমীরদাদের বাড়ি? নাকি সিগেরেট ফুরিয়েছে? নাকি ক্লাব ঘরে? মাঝে মধ্যেই কেমন দমকা বাতাস বইছে দেখ। মাঝে মধ্যেই কেমন শব্দ তুলছে হঠাৎ। নারকেল পাতায় শো শোঁ। ইলেকট্রিকের তার। এ সময় একেক দিনে হালকা-পলকা বৃষ্টিও হয়। হঠাৎ করেই টুপটাপ। হঠাৎ করেই ছুটতে শুরু করবে কেউ, ছাদে শুকোতে দেওয়া চুড়িদার-শাড়ির কথা মনে পড়বে কারও।

আচ্ছা মা, সেই গল্পটা পুরোপুরি কী ছিল, সেই যে মীন ধরতে গেলে তোমরা মানে তুমি আর বাবা।

কাকলি অনেকবারই ভেবেছে জিজ্ঞাসা করবে মাকে, কী ছিল যেন গল্পটা? ঠিক করে বললে, গল্পটা কেউ তাকে কোনও দিন বলল কোথায়? স্রেফ এর ওর মুখের টুকরো কিছু কথাই। যেমন হয় কখনও। সেই ঝুলকালির মতোই। চাও বা না চাও গায়ে মাথায় লেগে থাকবে ঠিক। নীচে পায়ের শব্দ পাচ্ছে কাকলি। একেবারে দুম দুম করেই। দরজা খোলা, দরজা বন্ধ করা। জানালা। বৌদি তার মানে রেগে গেছে খুব। বৌদি হয়তো সন্দেহ করছে। ভাবছে, লোকটাই বা গেল কোথায়? আর কাকলি? সিঁড়ির দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দ হল না? খরখর-খরখর শব্দে কেমন ভয় পেল না সে? যেন বৌদিকে চোখে পড়বে এক্ষুনি। ছাদের ছোট্ট এক চিলেকোঠার দরজায় দাঁড়িয়ে যেন থমকে উঠবে। বলে উঠবে, হাওয়া খাওয়া হচ্ছে তোমার? বলে উঠবে, কার কথা ভাবছিলি শুনি? ও বৌদি, কেউ নয় গো, কে থাকবে আমার বলো। থাকার মধ্যে তোমরাই তো—  দু’বেলা ভাত, কাপড়-জামা। ভুল হয়ে গেছে গো, বিশ্বাস কর তোমাকে অপমান করতে চাইনি, তোমরা আমার ভাতকাপড়,  আমার, আমার সত্যিই কেউ নেই কোথাও, বিশ্বাস কর।

সিঁড়ির দরজা তার মানে বন্ধই। দাদাবাবু তবে দরজা বন্ধ করেই বাইরে গেছে কোথাও। উফ্ কাকলি—  তুমি তবে একা, একা এই অন্ধকারে। এই সিঁড়ির ঘরে। খোলা ছাদের গায়ে নারকেলের ডালে কেমন শব্দ হচ্ছে দেখ। ভয় লাগছে তোমার? মামনির দিদির কথা ভেবে ভয় করছে। রেণুমাসি না বোঝাল তোমাকে? বলেনি, ভূত কোথায় শহরে? ভূত তো গ্রামে আবাদে, বলেনি? আর পাশের ফ্ল্যাটের মামনির দিদির বিষ খাওয়ার সময় তুমিই বা কোথায়? শুধু গল্প শুনে ভয় পেতে আছে? মামনির দিদি যদি অন্ধকার ব্যালকনিতে দাঁড়ায়ও সে কি তোমার জন্য? সে দাঁড়াবে, সে দাঁড়াবে, তুমি তো জানই দাঁড়াবে অভীকদাদার জন্য, চেন তুমি অভীকদাদাকে? আর যদি তাকায়ও এদিকে, এই অন্ধকার ছাদের দিকে, এই এলোমেলো হাওয়া আর নারকেল পাতার ঝিরঝির শব্দের মধ্যে, সে নির্ঘাৎ হেসে কুটিকুটি হবে, হয়তো বলে উঠবে, ওহ্‌ কাকলি, কী বোকা বোকাই না লাগছে তোকে। হয়তো বলবে, আমাকে দেখে এত অবাক হওয়ার কী আছে? জানতে চাইবে, কথা বন্ধ হয়ে গেছে কেন রে তোর, জিজ্ঞেস করবে, তোর চোখ কেন ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসছে রে কাকলি? মামন ভাববে যেন ওকে দেখে, ওর ভয়ে ভয়েই মাটির দিকে তাকিয়ে কাকলি বা কোনও সঙ্গী না পেয়ে এই অন্ধকারে একা একা যেন বোকার মতোই নিজের চারপাশে পাক খেয়ে পাক খেয়ে ‘আনি মানি জানি না’ খেলছে। | ফাঁকা মাঠ-জমির নিজস্ব শব্দ আছে কিন্তু। শহরে রেল রাস্তার মতোই। ট্রেন থাকুক আর না থাকুক, স্টেশনে দাঁড়িয়ে রেললাইন ধরে দূরে তাকালেই যেন ট্রেন চোখে পড়বে। দলা পাকানো কোনও আবছা অন্ধকার দেখে ভাববে, ট্রেন না? শব্দ হল না একটা হর্নের? আর তোমার কানও তখন ধাতব ঘর্ষণের শব্দ টের পাবে।  শহরের এক দোতলার ছাদ থেকে আবাদের দিকে ছুটে যেতে থাকা সেই ‘মা’-ডাক হঠাৎ থামে। গাছপালা ছুঁয়ে আকাশকে হঠাৎ বেঁকে যেতে দেখলে তুমি ভাববে নদী। জলের টানেই তবে আকাশের এই হঠাৎ নেমে যাওয়া। আর নদীর কথা মনে পড়া মাত্র ভট্‌ভট্‌ শব্দ শুনবে তুমি। সেই দাঁড়িয়ে থাকা নৌকা, ‘সর্দার পাড়া’’ বা ‘লজ-এর ঘাট’ বলে চিৎকার-করা সেই সব ডাক। বা এক্সপ্রেস-এক্সপ্রেস,  ন্যাজাট-ন্যাজাট— । এত রাতে নৌকা থাকে কখনও? আবাদের লোক হয়ে ভুটভুটির খবর রাখবেনা? বেলা পড়ে গেলে কে যাবে গ্রামে? ধামাখালি থেকে লজ-এর ঘাট? এখন তবে হাতে রইল চিক্‌-চিক্‌ ঢেউ। আর রইল অন্ধকার। এখন ভেসে পড়। শব্দ শোন গুব্‌গুব্‌- গুব্‌গুব্‌। গাদাবোটের। মাল আসছে ন্যাজাট থেকে। ন্যাজাট বা হিঙ্গলগঞ্জও হতে পারে। যাবে সেই দক্ষিণে। তোমার গোলাপের ঘাট, সর্দার পাড়া, লজ-এর ঘাট ছাড়িয়ে কাঁচাবাদা ছাড়িয়ে ডান দিকে বাঁ দিক করে কোথায় কে জানে? থাকবে বাগদার মিন, থাকবে বাঘ, কুমির, কামট। ভাল কথা, তখন সকাল কটা হবে গো মা? নাকি বিকেল? ছোটবেলাকার সেই দিনটির কথা কেমন ভুলে যাচ্ছি দেখ। মনে আছে তোমার ঠিকই। সেই যে হঠাৎ করে ইনসান চাচা খবর দিল, বাড়ির বাইরে থেকে নাম ধরে ডেকে উঠল আমার, বলে উঠল, ‘তোদের এ বার কী হবে রে কাকলি—? কী অদ্ভুত কথা ভাব মা? তোদের কী হবে? বাঘের কথা শুনে আমি তখন কী আর বুঝি? আমার তখন কত যেন? পাঁচ না ছয়? আমি তখন কিন্তু তোমার কথাই ভাবি। ভাবি, বাঘ তবে তোমাকেই— । রাত এখন কত মা? তুমি কি শুনতে পেলে? আমার ডাক পৌঁছেছে তোমার কানে? শুনতে পাচ্ছ? মা, তুমি কি ঘুমিয়ে পড়লে? ভাই? গোমতীতে এখন জোয়ার। পাড়ে লাগানো নৌকাগুলি জল পেয়ে এমন দুলছে। কাঁচাবাদা হয়ে, রায়মঙ্গল হয়ে কাঠের নৌকা এখন গোমতীতে ফিরছে মা। এইখান থেকে দেখ, সেই ভট্‌ভট্‌ শব্দ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। নৌকার টিমটিম আলো, পাশে অস্পষ্ট শরীর, শরীরের নড়াচড়া। মা

‘সর্দারপাড়া দিয়েও ঢুকতে পার তুমি, ও কথা ও আমার ডাক— !’

এক অক্ষরের সেই শব্দ ‘মা’ ডাক থমকায় যেন। সে তবে কোন পথে যাবে। সর্দারপাড়া দিয়েই সে কি নদী ছেড়ে দ্বীপে ঢুকবে? নাকি আর একটু গিয়ে। আর একটু গিয়ে বাঁ দিকে। যখন রায়মঙ্গলের একদিকে কঁচাবাদা আর একদিকে লজ-এর ঘাট। বনবিভাগের বাংলো। ঘাট কেমন বাঁধের মাথা ছুঁয়েছে দেখ। সেই ‘মা’-ডাক, সেই শব্দ এখন থতমত। একবার ‘থামি তা হলে’ ভেবে পরক্ষণেই গাদাবোটের সেই গুব্‌গুব্‌ ধ্বনির সঙ্গে, উত্তর থেকে দক্ষিণের সেই গতির সঙ্গে শামিল হয় সে। এর পর বাঁদিক। প্রথমে বনবিভাগের বাংলো। এর পর ঘাট। বাঘ এ সময় নদী পার হয় না মা? একেবারে কাঁচাবাদ থেকে গ্রামে। এসে লুকিয়ে থাকবে কোথাও। তাই না? হয়তো ধান খেত, হয়তো গোয়াল ঘর কোনও। কোথাও আচমকা চিৎকার তুলবে কেউ, কেউ হয়তো অবাকই হবে শুধুমাত্র। এর পর কাকলির মতোই পা দুটো টান করতে চাইবে। দু'হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরতে চাইবে কিছু। বা, হয়তো ফাটিয়েই দিতে চাইবে নিজেকে। ছিঁড়ে ফেলতে চাইবে নিজের দুটো হাত, পা। বমি করতে চাইবে নিজের রক্ত। কাকলির মতোই নিজেকে পাল্টাতে চাইবে।

নীচে আর কোনও শব্দ নেই কোনও। কী অদ্ভুত চুপচাপ ভাবো। যেন খুব সতর্ক হয়ে অপেক্ষা করছে কেউ। যেন কাকলিকে না বুঝতে দিয়ে বাইরে থেকে লক্ষ করছে ওকে। শহরের মানুষ কী অদ্ভুত ভাবো মা, ওরা শুধু বাঘের গল্প শুনতে চাইবে। রায়মঙ্গলের কথা। দাদাবাবুকে আমি যত গ্রামের গল্প করি, দাদাবাবু তত বলবে, বাঘ কি সত্যিই আসে তোদের গ্রামে? ভাবো, আমি গোমতী নদীর কথা তুলি, রায়মঙ্গলের কথা, নদীর বাঁধ, জোয়ার, সেই কাঠের নৌকা, নৌকার আ্লো, শব্দ, সেই ভট্‌ভট্‌ ধ্বনি। আমি রাত্রির অন্ধকারের কথা তুলি। আমাদের ঘুম, আমাদের খিদে—  জানি তুমি রেগে যাবে। তুমি বারণ করেছিলে বারবার। তোমার কথা শুনলে আমার তো তোলাই উচিত ছিল না গ্রামের কথা, দ্বীপের কথা, আবাদের কথা। আসলে বাবার সেই গল্পের জন্যই। লোকটা জিজ্ঞেস করেছিল, মরল কীভাবে তোর বাবা? আচ্ছা, তুমি যে বলতে বাঘ একবার লক্ষ্য ঠিক করলে আর সরে না তার থেকে, তা কি ঠিক মা? ধর, ওপার থেকে এপারে যখন আসবে সে, তখন জোয়ার বা ভাটার টানে সরতেও তো পারে, আর সরেও নিশ্চয়ই, তবে? বাঘ কি বারবার ফিরে গিয়ে আবার শুরু করবে নতুন করে ? দাদাবাবু সেদিন কী বলেছিল বলো তো? বলছিল, তোকে ভালবাসি কাকলি। ও মা, অদ্ভুত এই কথা। গ্রামে থাকতে বিমলকাকুর ছেলে একদিন—  রাগ করবে না তো, মা শুনতে পাচ্ছ? আমার কথাগুলিকে আমি একেবারে যে পথে এসেছি সেই পথ দিয়েই বিশ্বাস করো, পুরো পথ মনে আছে আমার এখান থেকে স্টেশন, ওখান থেকে রেললাইন ধরে শিয়ালদা, এর পর বাসরাস্তা, ধামাখালি। এরপর নদী— সর্দারপাড়ার পথ আমি চিনি না মা, তাছাড়া এই অন্ধকার, এই হাওয়া, টিপটিপ বৃষ্টি—  আমি যাব লজের ঘাট ধরেই, লজ-এর ঘাটে নেমে আমি একবার ডান দিকে তাকাব ঠিক। চিক চিক করা জল ছাড়িয়ে ওপারে তখন অন্ধকার পুরো, অন্ধকারে ডুবে থাকা গাছপালা গরান, গেঁওয়া, বাইন। মাথার উপর আকাশ, আকাশের চাঁদ, ভারী মেঘের চলা, এদিক ওদিক গড়িয়ে পড়া হলুদ। মা আমি যেন সেই নৌকাটাকে দেখতে পাব ঠিক। তুমি আর বাবা। জঙ্গল ঘেঁষে দাঁড়ানো সেই নৌকা। তুমি বলতে, আমাকে কেন নিলে না ঠাকুর। তুমি বলতে, আমিই তো কাছাকাছি ছিলাম তোমার। বাবা নাকি তখন জলে, নৌকায় বসে তুমি তখন জাল পরিষ্কার করছ। হঠাৎ করেই। সবাই বলত তো তাই। বলত বাঘ যখন ঠিক করে কাউকে তখন শুধু তাকেই। বাঘ তবে অনেক আগেই বাবাকে ঠিক করে নিয়েছিল মা। এর পর যে যেখানে এমনকী তুমি নৌকা থেকে নেমে বাঘের গায়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালেও বাঘ নেবে বাবাকেই। একেবারে ডাঙা থেকেই ঝাপিয়ে পড়বে জলে।

দাদাবাবু বলেছিল ওদের বাড়িতে আসার সেই প্রথম দিন আমাকে দেখেই নাকি— | একা থাকা কী ভয়ের মা! কেমন পাল্টে যায় সব কিছু, তোমার হাত, পা। তোমার চোখ, ঠোঁট— হ্যাঁ মা পুরো শরীর। তোমার নদী, নদীবাঁধ, ঘরবাড়ি, হ্যাঁ মা, এমনকী স্বপ্নও পাল্টে যায় সব। বৌদি ঘরে ফিরলে কতবার ভাবতাম বলে দিই, বলি। রেণুমাসি কী বলল বলো তো? একদিন দেখা হতে বললাম ওকে। বললাম, আমাকে অন্য বাড়ি দেখে দাও মাসি। কারণ জানতে চাইলে বললাম সব কথা। একা ঘর। দাদাবাবুর ওই বাঘের গল্প শুনতে চাওয়া। মাসি কী বলল বলো তো? বলল, পুরুষ মানুষ ওরকম হয় একটু-আধটু। বলল, এই সব ধরতে নেই মেয়েদের।

জোয়ারের জল এখন বাঁধের মাথা ছোঁয়া একেবারে। বাঁধের গায়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাইনের গাছগুলির এখন একেবারে ডুবজল। কালো সরু সুতোর মতো লতানো ডালের গায়ে আটকে থাকা গোলাপি পাঁপড়ির কিছু ঘ্রাণ নিয়ে একটা শব্দ বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে কী যে করবে যেন ভেবে উঠতে পারে না। বাঁধ থেকে নেমে মউলে পাড়া, এর পর বিল। নদী গোমতী। দূর শহরের সেই দোতলার ছাদে অন্ধকার একটা ঘরে একটা মেয়ের পরনের ফ্রকটা নড়ছে। বাতাসের সঙ্গে ঢুকে পড়েছে দু’টো একটা জলকণা। কোত্থেকে সব ভারী ভারী মেঘের টুকরো দলা পাকাচ্ছে সেই ছাদের উপর গিয়ে। সেই ‘মা’ ডাক, সেই শব্দ, কী মনে করে হঠাৎ ঝাপিয়ে পড়ল বাঁধ থেকে। এর পর মউলে পাড়া, মউলে পাড়া ছাড়িয়ে বিল, বামুনপাড়া, নদী গোমতী।

গল্প যদি ভাল লাগে, তুমি কিন্তু গল্পের মধ্যেই ঢুকে যাবে মা। এই যেমন আমি। এই যেমন আমি টিভির সামনে কত বার কাজল হয়ে গেছি। কাজলকে তুমি চিনবে মা। শাহারুককে ভালবাসে মেয়েটি। আমিও কত বার টিভির সামনে বসে, শাহারুকের চোখ, নাক, ঠোট—  দাদাবাবু বলছিল, তুই কাজল হবি কাকলি? বলছিল, ধর আমি যদি— ।

দরজার বাইরে এসে কারা যেন দাঁড়াল মা। কে যেন উঁকি মারছে। কার যেন মুখ। ফিসফিস করে কথা বলছে কেউ। তুমি এখন ঘুমিয়ে আছ। আমার কথা কানে যাচ্ছে না তোমার। মা, দেখ এই আমি তোমার ঘরের পেছনে। এই আমি গোমতীর বাঁধ ছুঁয়ে দেখ, পাশে জোয়ারের জল কেমন শব্দ তুলছে। এই দেখ ভারী সেই মেঘ কেমন সরে গেল হঠাৎ, এর পর চাঁদ, জলের কি আহ্লাদ দেখ মা যেন পারলে নামিয়েই নেবে আমাকে। এই আমি নৌকা নিলাম মা। তুমি বলবে, আগে থেকেই কেউ লক্ষ করবে ঠিক। তুমি বলবে, আমার মতো করেই সে পাল্টাবে নিজেকে। এগোবে, পিছোবে, ঠোঁট চাটবে নিজের। আসলে গল্প ভাল লাগলে খুব ঢুকে পড়তে ইচ্ছা করে মা। মনে হবে আমিই, বরং স্টার্ট দেব নৌকায়, শব্দ জুড়ব ভট্‌ভট্‌, আমিই বন্ধ করব মোটর। কাঁচাবাদায় নৌকো লাগাব। আমিই জাল পরিষ্কার করব নৌকায়। বসে, বা আমি জলে নামাবো— । শহরের মানুষ বাঘের গল্পই ভালবাসে মা।

 

অনেকক্ষণ আগে একবার যেন ঠোট নড়ে উঠেছিল মেয়েটির। যেন কাউকে ডেকে উঠেছিল সে। যেন ডেকে উঠেছিল ‘মা’ বলে। এর পর আবাদ থেকে দূরে শহরের এক দোতলার ছাদে, অন্ধকারে মেয়েটি এখন একেবারে একা। একা একাই ভিজছে বৃষ্টিতে । ভিজেই যাচ্ছে।

 

 

 

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment