পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

সৌরভকে যেভাবে দেখেছি

  • 07 May, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1757 view(s)
  • লিখেছেন : সাদিক হোসেন
মফস্বলে যা হয় - কবিতা লিখছি, দু-লাইনও লিখতে পারিনি; অথচ 'লেখক-শিল্পি সংঘ'র মেম্বার হয়ে গেছি। সংঘ আবার কী, খায় - না, গায়ে মাখে? তারচেয়ে নিজেদের পত্রিকা করলে হয় না? পত্রিকার নাম কী হবে? চলুক আড্ডা। শুধু নামকরণ নিয়ে আমরা যে কত আড্ডা দিয়েছি ওদের শিবমন্দিরের চাতালে তার ইয়ত্তা নেই। আড্ডাই তো, আর কিছু নয়; তাহলে পত্রিকার নাম 'আরও কিছু' দিলে হয় না? কে যে প্রস্তাব করেছিল৷ এখন আর মনে নেই; সৌরভই হয়ত। হ্যাঁ, ধরে নেওয়া যাক - সে, সৌরভই ছিল। তাঁকে নিয়েই কিছু কথা থাকলো।
সৌরভ ছিল একজন ঢপবাজ ছেলে। কী নিয়ে যে ঢপ দেয়নি তা ভেবে পাওয়া মুশকিল।
থাকত পাশের পাড়ায়, তবে পড়ত অন্য স্কুলে, তাই মুখ চিনলেও ছোটোবেলায় যে ওর সঙ্গে খেলাধুলা করেছি - তেমন কিছু নয়। বরঞ্চ ঘনিষ্টতা হয়ে ছিল খানিক পর - আমি তখন সদ্য কলেজ; কবিতা লেখার সূত্রে। আজ থেকে প্রায় ২০ বছর আগে।
মফস্বলে যা হয় - কবিতা লিখছি, দু-লাইনও লিখতে পারিনি; অথচ 'লেখক-শিল্পি সংঘ'র মেম্বার হয়ে গেছি। সংঘ আবার কী, খায় - না, গায়ে মাখে? তারচেয়ে নিজেদের পত্রিকা করলে হয় না? পত্রিকার নাম কী হবে? চলুক আড্ডা। শুধু নামকরণ নিয়ে আমরা যে কত আড্ডা দিয়েছি ওদের শিবমন্দিরের চাতালে তার ইয়ত্তা নেই। আড্ডাই তো, আর কিছু নয়; তাহলে পত্রিকার নাম 'আরও কিছু' দিলে হয় না? কে যে প্রস্তাব করেছিল৷ এখন আর মনে নেই; সৌরভই হয়ত। হ্যাঁ, ধরে নেওয়া যাক - সে, সৌরভই ছিল।
পত্রিকা নিয়ে কম গল্প নাকি। সেখানে লিখতেন মুসা মোল্লা, আমরা মুসাদা নামে ডাকতাম, বয়স প্রায় ৭০র কাছাকাছি, কবিতায় তখনো নজরুলের নকল। অথচ তাঁর কবিতা রাখতেই হবে। না হলে তিনি রেগে যাবেন। শীতলচন্দ্র রায়, পেশায় ছিলেন ফেরিওয়ালা, তাঁকেই আমাদের পত্রিকার সম্পাদক করা হয়েছিল।
মুসাদার কবিতা নিয়ে আমরা কম হেসেছি নাকি! আর মাঝেমাঝেই হতো কবিতা পাঠের অনুষ্ঠান। সেইসব সন্ধ্যায় আমাদের আকড়ায় আসতেন পবিত্র মুখোপাধ্যায়, গৌরদা, দেবাশীষদা, গনেশদা, মিহিরদা…
একবার তো মনে আছে, সেকী প্রবল ঝড়জল, যে-স্কুলের হলঘরে অনুষ্ঠান হয়েছিল - তা লণ্ডভণ্ড; তবু মা কালির দিব্যি কবিতা পড়া আমরা থামাইনি। তখন কি এমন দিব্যি কেটে কথা বলতাম আমরা?
ভীষণ ঢপবাজ সৌরভ জয় গোস্বামীকে বলত জয়দা।
-জয় গোস্বামীর সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে?
মিটমিট করে হাসতো, কিছুতেই খোলসা করত না। আমরা ভেবে নিয়েছিলাম ঢপ। কেননা প্রবল বাহাদুরি দেখিয়ে জর্দা খাবার পর মন্দিরের চাতালে বসেছিল বেশ কিছুক্ষণ। দুনিয়া যে তার মাথার ভেতর ঘুরছে - তবু তা স্বীকার করেনি। আমরা ভুল ছিলাম না; বইমেলায় গিয়ে বুঝেছিলাম ও যাদের নামের পাশে 'দা' বসাত, তাদের ও মোটেই চিনতো না। কিন্তু বই বিক্রি করতে পারত। তখনো টেবিল পাইনি আমরা। ময়দানের বইমেলায় ঘুরেঘুরে পত্রিকা বিক্রি করতাম। সেখানেও ফাঁকি, সারা মেলা আমরা যখন ঘুরছি, ও ঝিলের পাশে বসে আছে খবর পেলাম।
রেললাইনের ওপারেই ডাক্তার বাবুর চেম্বার। সেইখানে কী যে ঝগড়া হতো। ঝগড়া করতে করতে ও নিজেই চা নিয়ে আসত। ডাক্তারবাবুর সঙ্গে ওর ঝগড়াগুলো ছিল ঐতিহাসিক। একবার আমরা টাটাদের পক্ষ নিয়ে ডাক্তারবাবুকে রাগাচ্ছি, ডাক্তারবাবু সত্যিই রেগে যাচ্ছেন, রাগতে রাগতে সত্যিই চেঁচিয়ে উঠেছেন - "আমি কমিউনিস্ট" এই বলে! আমার আর সৌরভের সেকী হাসি!
আর ছিল কারণে অকারণে মিটিং। তখন রামমন্দিরের শিলান্যাস নিয়ে কী একটা রায় বেরিয়েছিল। এলাকায় এসব নিয়ে কেউ চিন্তিতও নয়; অথচ সভা ডাকা হয়েছে আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে - তা নিয়ে। যাবার আগে সৌরভ বলল, আজকে গুলোবোই। সবাই যখন গুরুগম্ভীর জ্ঞান দিচ্ছে, আচমকা সৌরভ বলে উঠল, আমরা নিজেরা যে অসাম্প্রদায়িক তার প্রমাণ কী? বুড়োরা ক্ষেপে খ। কম বুড়োরা প্রমাণ করতে ব্যস্ত। সেদিন মিটিং থেকে ফেরার সময় আমাদের পেটে খিল লেগে গেছিল; এখনো দেখা পাচ্ছি সেইসব - সৌরভ ঢ্লা প্যান্ট পরেছিল, সবুজ-চেক টি-শার্ট। ও খানিক কাত মেরে সাইকেল চালাতো। হাঁটার নিজস্ব ছন্দ ছিল। ও গান গাইত - যত হামলা করো সব সামলে নেব...
লিটিল ম্যাগাজিন মেলায় প্রথমবার টেবিল পাবার কৃতিত্ব সৌরভের। পত্রিকা প্রকাশের সময় একাহাতে সব ঝুলিয়ে দিয়ে শেষপর্যন্ত উদ্ধার করার দায়িত্ব সৌরভের, শিয়ালদায় গিয়ে সস্তায় রাইস-উইথ-চিকেনগ্রেভি খাওয়ার প্লান সৌরভের।
কোন এক হেদুয়ার কোথায় একটা প্রেস ঠিক করেছিল সৌরভ। প্রেস মালিক কেন জানি না সৌরভের উপর ছিল হেভি খাপ্পা। কাজ শেষ হতে হতে অনেক রাত হয়ে গেছে, বাস থেকে নেমে দৌড়লে তবে শেষ ট্রেনটা পাওয়া যেতে পারে, সৌরভ বলল, শর্টকাট জানি। ওর কথা বিশ্বাস করা পাপ। আর আমরা বারবার ওকে বিশ্বাস করে ফেলতাম। কোনো এক গলির ভেতর কিছুদূর হাঁটবার পর বুঝলাম - আরে এটা তো হাড়কাটা গলি!
সৌরভ কম হারামি নাকি! তখন ঠিক করেছি, আর যাই হোক ইনফরমেসন টেকনলজি পড়ব না। আর তা নিয়ে বাড়িতে তুমুল অশান্তি। সৌরভ এসব জানতো। তাই কাটার উপর নুনের ছিটার মতো আমার বাবাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল - কাকু, সাদিকের লেখা পড়েন?
সৌরভ অতিমানব ছিল, অর্থনীতি নিয়ে পড়তে গিয়ে প্রথমবর্ষেই কার্ল মার্ক্সের ভুল ধরে ফেলেছিল। সে অবলীলায় সুনীল গাঙ্গুলির লেখা কপি করত। এমন সব কবিদের নাম বলত যাদের অস্তিত্ব বাস্তবে নেই। এক ছিপি মদ খেয়েই একবার আমার চোখের সামনেই প্লাটফর্মে দুলে উঠেছিল! সৌরভ সিগারেট খেত না। বিয়ে করেনি। এইতো বছর খানেক আগে দেখলাম সন্ধেবেলা একা লেকে ঢুকছে। জিজ্ঞেস করলে হেসে উঠল। তখন ওর কাঁধে স্কুলের ব্যাগ, ফুলস্লিভ শার্ট, তাও নীল রঙের...
সৌরভ তৃণমূলের কর্মী ছিল। আমরা ছিলাম বিপরীত। সৌরভ ছন্দ নিয়ে আলোচনা করত, আমরা বলতাম, তুমি তো ছন্দই জানো না। সৌরভ হেসে উঠত। ওকে নির্দ্বিধায় বলা যেত, যদি কোনোদিন শুনি তুমি বিজেপি হয়েছ, তোমাকে বাড়িতে এসে ক্যালাবো। ও শয়তানির হাসি হাসতো। কিছুদিন আগে, কৃষিআইন বিরোধী পথসভা করছি - ওকে খবর পাঠাইনি, তবু মইদুলদাকে নিয়ে জুটে গেল আমাদের সঙ্গে।
আসলে সৌরভ ছিল ভীষণ বোকা। আমরা যখন ঘরবন্দী, ও বোকাদের মতো কোরোনা রুগীদের নিয়ে হাসপাতালে চলেছে। ওর সাগরেদ মইদুলদা। মইদুলদাকে ভয় পান না; এমন বাঙালি কবি ইহলোকে জন্মায়নি। কতবার রাত ১০টার দিকে ঐ মানিকজোড়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে আকড়া প্লাটফর্মে। তারপর তিন চার কাপ চা উড়ে গেছে আম্ফানের মতো। সৌরভ সিগারেট খেত না।
সৌরভ ছিল ভীষণ ঢপবাজ। এইবার দেখা হলে জিজ্ঞেস করব, ডাক্তাররা যখন ভেন্টিলেশনের নল ঢোকাচ্ছিল, খুব লেগেছিল তোমার? শেষবার যখন দম ফেললে খুব কষ্ট হয়েছিল? মরে যাওয়ার সময় খুব ব্যথা লাগে?
জানি, সৌরভ হো-হো করে হেসে উঠবে!
0 Comments

Post Comment