পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা প্রসঙ্গে কমিউনিস্ট রাজনীতির ব্যর্থতা

  • 13 October, 2025
  • 0 Comment(s)
  • 354 view(s)
  • লিখেছেন : মিলি মুখার্জী
ইসরায়েলি শাসকদের দ্বারা ফিলিস্তিনে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে প্রতিবাদ বাড়ছে দেখা যাচ্ছিল। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ভাষণের সময় নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে কিছুটা দূরেই টাইমস স্কোয়ারে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী জড়ো হয়ে র‍্যালি করে। বিক্ষোভকারীরা নেতানিয়াহুর গ্রেপ্তারের দাবি জানাচ্ছিল। সেই কারণেই কি গাজায় আপাতত যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হলো?

সমগ্র ইউরোপ থেকে টিউনিশিয়া পর্যন্ত উত্তাল, উত্তাল বিশ্ব-বিবেক। গ্রেটা ও তার সাথীদের অপহরণের পর লাখ লাখ মানুষ প্রতিবাদ-বিক্ষোভে রাস্তায়। ইতালিতে রেল চলাচল বন্ধ। ইস্ট আফ্রিকা, কলম্বিয়া এবং মেক্সিকো শহর পর্যন্ত প্রতিবাদ প্রদর্শনের আগুন পৌঁছেছে। অন্যদিকে, ফ্যাসিস্ট দেশ ভারতবর্ষের সরকার উৎসব আর মদের দোকান খোলার অপেক্ষায়। ২০টি যুদ্ধজাহাজ থাকা সত্ত্বেও ইস্রায়েলের জায়োনিস্ট সেনারা সমুদ্রের মাঝখান থেকে গ্রেটা এবং তার সহযোগীদের অপহরণ করে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক জলসীমা থেকে ৪৪টি দেশের ৪৬২ জনকে অপহরণ করেছে।


গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা অবশেষে গাজায় পৌঁছায়। মিকেনো নামের এই জাহাজটি তার অবস্থান পরিবর্তন করে, ইজরায়েলি যুদ্ধজাহাজগুলোকে এড়িয়ে এসে পৌঁছায়। প্রথম  গাজায় ইসরায়েলি অবরোধ ভেঙ্গে পৌঁছানো জাহাজ হলো মিকিনো,  যার সমস্ত যাত্রীকে জায়োনিস্ট সেনারা আটক করে। ৪০ টি জাহাজে রাখা ক্ষুধার্ত শিশুদের জন্য দুধ, ডায়াপার, ওষুধ ও খাদ্য সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করে। তার মানে, ইসরায়েল ক্ষুধার্ত শিশুদের এক দানা খাবারও দিতে চায় না। প্রাচীনকাল থেকে মধ্যযুগীয় ইতিহাস পর্যন্ত হাজারো যুদ্ধ হয়েছে, বন্দি যাদেরকে ধরে রাখা হয়েছে তাদের খাবার এবং জল বন্ধ করা হয়নি, তাদেরকে সেই সমস্ত সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়েছে যা মানবিক মূল্যমানের প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় ছিল। ইতিহাসে এমন বেদনাদায়ক ও অমানবিক আচরণের কথা কখনও পড়িনি, গাজায় শিশুরা ক্ষুধায় মারা যাচ্ছে, ইজরায়েলি জনগণেরাই তাদের পক্ষে স্লোগান দিচ্ছে।


এদিকে ইসরায়েলি শাসকদের দ্বারা ফিলিস্তিনে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে প্রতিবাদ বাড়ছে দেখা যাচ্ছিল। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ভাষণের সময় নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তর থেকে কিছুটা দূরেই টাইমস স্কোয়ারে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী জড়ো হয়ে র‍্যালি করে। বিক্ষোভকারীরা নেতানিয়াহুর গ্রেপ্তারের দাবি জানাচ্ছিল। ২২ সেপ্টেম্বর ইতালির বিভিন্ন স্থানে প্রায় দশ লাখ মানুষ পালিস্তিন এবং সামুদ্রিক ত্রাণ জাহাজ ফ্লোটিলার সমর্থনে সাধারণ ধর্মঘট পালন করে। এ সময় শ্রমিক ও কর্মচারীরা বন্দর ও রেলওয়ে স্টেশন বন্ধ করে পুরো দেশকে অচল করে তোলে। রাজধানী রোমে ৩ লাখ প্রতিবাদকারী তাদের মিছিল শুরু করার আগে শহরের প্রধান রেলওয়ে স্টেশন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এর আগেও ডক শ্রমিকরা ফ্লোটিলায় ইসরায়েলি আক্রমণের ঘটনায় পুরো বন্দর বন্ধ করে দেয়। তবে, ইতালীয় সরকার ইসরায়েলি সরকারের সাথে সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে এবং অস্ত্র সরবরাহ করে চলেছে। এই পরিস্থিতিতে, শ্রমিকদের ক্রমবর্ধমান জিদ এবং সরকারের একগুঁয়েমি উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করছে। শ্রমিকরা ক্ষমতার কেন্দ্রে এখন প্রতীকী দখলের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, তবে ভবিষ্যতে তারা বাস্তবত দখলের দিকে অগ্রসর হতে পারেন।্জনগণের বিক্ষোভের সাপেক্ষে ফ্রান্স জাপান জার্মান ইত্যাদি বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকার প্যালেস্তিনীয় জনগণের জন্য একটি রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে মতদান করেন।  

ইজরায়েলি ক্ষমতার প্রতি বিশ্বব্যাপী জনসাধারণের ক্রমবর্ধমান বিরোধিতাই ৫০টি দেশের কূটনীতিকদের নেতানিয়াহুর ভাষণ বয়কট করতে বাধ্য করে। এই বিপুল জনসাধারণের চাপের কারণেই জাতিসংঘের ১৫৭টি দেশ ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে। তবে, তাদের স্বীকৃতি কেবল একটি আনুষ্ঠানিকতা। পৃথিবীর প্রতিটি কোণে ইজরায়েলি-আমেরিকান শাসকদের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী জনগণের ক্রোধ বাড়ছে। বহু জায়গায় জনগণ তাদের শাসকদের ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি নিয়ে সড়কে নেমেছে। তবে এখনও বেশিরভাগ শাসক ইজরায়েলের আনুষ্ঠানিক বিরোধ ছাড়িয়ে যেতে প্রস্তুত নয়। আগামীর সময়ে বিশ্ব-জনগণের চাপ শাসকদের আনুষ্ঠানিক বিরোধ থেকে বাস্তব বিরোধে দাঁড়াতে বাধ্য করতে পারে, সেজন্যে বিশ্বব্যাপী খেটে-খাওয়া মানুষের একজোট হওয়া এই অবশ্যই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামী অংশের মানুষের প্রতিরোধ বলা যেতে পারে যা নির্দিষ্ট সাংগঠনিক কাঠামোর দ্বারা অর্গানাইজড নয় ।

ইসরায়েল সরকার-বিরোধী বিক্ষোভের এই ধারাবাহিকতায়, ইজরায়েলি অস্ত্র প্রস্তুতকারক কোম্পানি এলবিটকে দেশ থেকে বহিষ্কার করার জন্য রোমানিয়ায় একটি "এলবিট আউট" প্রচার শুরু করা হবে জানা গেছে। এলবিট সিস্টেমসের রোমানিয়ায় তিনটি কোম্পানি রয়েছে যেখানে অস্ত্রের যন্ত্রাংশ তৈরি করা হয়। গাজা গণহত্যায় এই অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। এই প্রচারে রোমানিয়া এবং ইসরায়েলের মধ্যে সামরিক আমদানি-রপ্তানি বন্ধেরও দাবি জানানো হবে। জনসাধারণের চাপ শাসকদের আনুষ্ঠানিক বিরোধিতা থেকে প্রকৃত বিরোধিতায় যেতে বাধ্য করতে পারে।

একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে এসে গেছে, দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে বিশ্বের নানা প্রান্তে গড়ে ওঠা কমিউনিস্ট পার্টিগুলো সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হতে পারছে না। তার পরিবর্তে এই বিক্ষোভগুলি সারা বিশ্বজুড়েই স্বতস্ফুর্ত ভাবে বিকাশলাভ করছে, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে যাচ্ছে। কমিউনিস্ট পার্টির কাঠামো কি একে ধারণ করতে পারছে না নাকি তত্বগত ভাবে কমিউনিস্ট পার্টিগুলো পুঁজিবাদী ব্যবস্থার পরিবর্তিত রূপের সাথে খাপ খাওয়াতে পারছে না ! প্রশ্ন উঠছে নানা রকম। আমরা দেখে নিই বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনীতি ব্যবস্থায় পুঁজির টিকে থাকার উপায়গুলি কী কী। একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে তথাকথিত “ইন্ডাস্ট্রিয়াল ক্যাপিটালিজম” বৃহৎ শিল্প-পুঁজি থেকে মুনাফার আশা কমে গেছে । কেননা নয়া নয়া পণ্য উৎপাদন এখন শ্রম-নির্ভর নয় , অনেকটাই প্রযুক্তি-নির্ভর। আমরা জানি শ্রম-নির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা ছাড়া উদ্বৃত্তমূল্য আহরণ করা সম্ভব হয় না অর্থনীতির নিয়মে। ফলে আজকের যুগে পুঁজি তিনটি উপায়ের মাধ্যমে মুনাফা আহরণ করে। আজকের যুগকে বলা হয় জ্ঞান-অর্থনীতির যুগ। কেউ কেউ এ যুগকে প্ল্যাটফর্ম ক্যাপিটালিজমের যুগ বলে চিহ্নিত করেছেন , অনেকটা মার্চেন্ট ক্যাপিটালিজমের ধরণ। এযুগে ডেটা, অ্যালগরিদম, ওয়েবসাইট, অ্যাপ নির্ভর প্রযুক্তি পরিকাঠামোর উপর নির্ভর করে জ্ঞান-অর্থনীতির বিকাশ ঘটেছে যার মাধ্যমে পুঁজির মুনাফা বৈশ্বিক নেট-ওয়ার্কের দ্বারা অর্জিত হচ্ছে। দ্বিতীয় উপায় হিসেবে দেখা যাচ্ছে পরিষেবা। নেট-প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে বিশ্বের সেরা সেরা পণ্য বাজারি-বিকিকিনির আওতায় নিয়ে আসছে আমাজন, ফ্লিপকার্ট, উবের, জোমাটো, এ আর বি এন বি ইত্যাদি ইত্যাদি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মার্কেট-ইকোনমির দানবেরা। SME SECTOR ( Small and Medium ) গুলোকে ব্যাঙ্ক এবং নন-ব্যাঙ্কিং ফিনান্স কোম্পানিগুলো ঋণ দিচ্ছে এবং এইসব আঞ্চলিক উৎপাদনকারী সংস্থাগুলি প্ল্যাটফর্ম-ইকোনমিক জায়ান্টগুলোকে সাপ্লাই দিচ্ছে। আর তৃতীয় উপায় হচ্ছে বিরল খনিজের লোভে, পর্যটনের লোভে আন্তর্জাতিক পুঁজি-হাঙরের দল রাষ্ট্র শাসকের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ দখল করতে মরীয়া হয়ে উঠেছে, চীন আমেরিকা ইজরায়েল জাপান এক নয়া সাম্রাজ্যবাদী কৌশলকে মদত দিচ্ছে। আজকের যুগে শ্রমিকের ভূমিকা নিয়েছে ফেসবুক ইনস্টাগ্রাম ইউটিউব ইউজাররা, বিনি পয়সার শ্রমিক হয়ে সোশ্যাল মিডিয়াকে যে আমরা বিকশিত করে চলেছি এটা ধারণা করার ক্ষমতা কমিউনিস্ট পার্টিগুলো হারিয়েছে। সংগঠিত ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার’ এর রমরমা আর নেই। বিশ্বের সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে শ্রমশক্তি শোষণ করে পুঁজিবাদীরা। ইন্ডাস্ট্রিয়াল লেবাররা যে আর বিপ্লবের অক্ষশক্তি নয় এটা বোঝার বা সমাজ অর্থনীতি বিশ্লেষণ করার চিন্তায় কমিউনিস্ট পার্টিগুলো নেই। মজে আছে পুরনো দিনের চিন্তাধারার  মধ্যে । আর তাই রাজনৈতিক দলগুলোকে ছুঁড়ে ফেলে বিশ্বের শ্রমজীবী জনগণ সাম্রাজ্যবাদী সংগ্রামে জোটবদ্ধ হচ্ছে। ইজরায়েল সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বিশ্ব-জনগণের জোট নানা প্রসঙ্গে রাস্তায় নেমে আসছে। ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলা আর কমিউনিস্ট পার্টি গঠন তার মধ্যে দিয়ে নির্দিষ্ট রাষ্ট্রে বিপ্লব ঘটানোর সময়কে যে দুশো বছর ছাড়িয়ে এসেছি এটা বুঝতে হবে আগে।

 

0 Comments

Post Comment