পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

যুদ্ধ কি কেবলই শান্তির শত্রু, নাকি পরিবেশেরও খুনি ?

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 201 view(s)
  • লিখেছেন : আশিস গুপ্ত
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত বিপর্যয় যখন মানব জাতির অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলছে, তখন ‘যুদ্ধ’ বিষয়টিকে শুধুই রাজনৈতিক বা মানবিক সংকট হিসেবে দেখা ভুল হবে। যুদ্ধ একদিকে যেমন অগণিত প্রাণহানির কারণ, তেমনি অপরদিকে পরিবেশের উপর এক নিঃশব্দ, স্থায়ী এবং গভীর ক্ষত তৈরি করে।
তেল দখলের লড়াই হোক কিংবা ভূখণ্ডগত আধিপত্য বিস্তারের যুদ্ধ—সকল রণাঙ্গনের ছায়াতলে গাছের মৃত্যু, মাটির দূষণ, বাতাসের বিষাক্ততা এবং প্রাকৃতিক সম্পদের ধ্বংস অনিবার্য। কানাডিয়ান পিস বিল্ডিং নেটওয়ার্ক এর মতে, "সামরিক ক্ষেত্র  বিশ্বের সবচেয়ে বড় একক দূষণকারীদের মধ্যে একটি। এটি জীবাশ্ম জ্বালানির প্রধান ব্যবহারকারী এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের অন্যতম উৎস।" যদিও সামরিক ক্ষেত্রের  সঠিক পরিবেশগত পদচিহ্ন প্রায়শই গোপন রাখা হয়, তবে এটি অনুমান করা হয় যে তারা বৈশ্বিক কার্বন নির্গমনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশীদার।
 
রাষ্ট্রসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি ইউএনইপি বহু বছর ধরে সংঘাতের পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে কাজ করছে। তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হলো, "গত ৬০ বছরে, সকল অভ্যন্তরীণ সশস্ত্র সংঘাতের মধ্যে অন্তত ৪০% প্রাকৃতিক সম্পদ সংক্রান্ত বিষয়গুলির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল।" (UNEP, 2011, Livelihood Security: Climate Change, Migration and Conflict in the Sahel). এটি ইঙ্গিত করে যে, প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব বা তাদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধ প্রায়শই যুদ্ধের কারণ হয়।বিশ্বজুড়ে সামরিক ক্ষেত্র একসাথে বছরে বিশ্বব্যাপী মোট গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমনের প্রায় ৫.৫% এর জন্য দায়ী। তুলনায়, বেসামরিক বিমান খাত দায়ী প্রায় ২% এবং সমুদ্র পরিবহন খাত প্রায় ৩% এর জন্য। অর্থাৎ সামরিক বাহিনী একা একাই এই দুটি বৃহৎ পরিবহন খাতের সম্মিলিত নির্গমনের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর গ্যাস নির্গত করছে। গ্লোবাল কার্বন প্রজেক্ট (Global Carbon Project)এর রিপোর্ট অনুযায়ী, সামরিক ক্রিয়াকলাপের ফলে বছরে প্রায় ২৫ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড (CO2) নির্গত হয়, যা অনেক ছোট দেশের মোট নির্গমনের চেয়েও বেশি। (এটি একটি অনুমান, কারণ সামরিক নির্গমনের তথ্য প্রায়শই প্রকাশ করা হয় না)।
 
২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধের প্রথম পাঁচ বছরে (২০০৩–২০০৮) শুধু মার্কিন সামরিক বাহিনীই প্রায় ১৪১ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড সমতুল্য (CO₂eq) গ্যাস নিঃসরণ করেছিল। এই পরিমাণ গ্যাস নির্গমন ২১টি ইউরোপীয় দেশের বার্ষিক নির্গমনের সমান। তেল কূপে বোমা বর্ষণ, জ্বালানির অসংযত ব্যবহার, বিশাল সামরিক যানবাহনের চলাচল এবং ধ্বংসযজ্ঞের পুনর্গঠন—সব মিলিয়ে এই নির্গমন হয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগ (DoD) একাই বছরে ৫৬ মিলিয়ন টন CO₂eq নির্গমন করে, যা পুরো পেরু রাষ্ট্রের সমপরিমাণ। গবেষকরা বলছেন, যদি মার্কিন সামরিক বাহিনীকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ধরা হয়, তাহলে এটি ৪৭তম সর্বোচ্চ নির্গমনকারী দেশ হতো।এছাড়া ২০২২ সালে শুরু হওয়া রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ, সামরিক সংঘাতের আরেকটি উদাহরণ, যা সরাসরি পরিবেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধের প্রথম দুই বছরে এই সংঘাতে প্রায় ১৭৫ মিলিয়ন টন CO₂eq নির্গত হয়েছে। এই পরিমাণ নির্গমন প্রতিদিন ৯০ লাখ গাড়ি চালানোর সমান। শুধু তেল ও জ্বালানি পরিবহনের জন্য ব্যবহার হওয়া সামরিক কনভয়গুলিই নয়, ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো পুনর্গঠন এবং আগুনে জ্বলে ওঠা গুদাম ও ভবনসমূহ এই নির্গমনের কারণ।
 
নেটো (NATO) জোট ২০২৩ সালে সামরিক খাতে ব্যয় করেছে প্রায় ১.৩৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার আনুমানিক পরিবেশগত ছাপ ২৩৩ মিলিয়ন টন CO₂eq। অর্থাৎ কেবলমাত্র সামরিক বাজেট বাড়ার ফলেও জলবায়ু পরিবর্তনের গতি বাড়ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, কোনও দেশের ১% সামরিক বাজেট বৃদ্ধির সাথে গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন ০.৯% থেকে ২% পর্যন্ত বাড়তে পারে। পরিবেশের উপর যুদ্ধের প্রভাব কেবল গ্যাস নির্গমনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ১৯৯১ সালের পারস্য উপসাগর যুদ্ধের সময় ইরাকে ৭৩৬টি তেল কূপে আগুন লাগানো হয়। প্রতিটি কূপ থেকে প্রতিদিন ৫০০০১ কোটিরও বেশি টন CO₂ নির্গত হয় এবং কয়েক মিলিয়ন গ্যালন অপরিশোধিত তেল আশেপাশের জলাশয়ে ছড়িয়ে পড়ে। এতে গঠিত হয় ২৫০ মিলিয়ন গ্যালনের ‘তেল হ্রদ’, যা কয়েক দশক পরও ভূগর্ভে জল দূষণ করছে। গাজা উপত্যকার সাম্প্রতিক সংঘাতেও ধ্বংসস্তূপ জমেছে ৩৭–৫০ মিলিয়ন টন, যা শুধু ভবন ধ্বংসের কারণে নয়—বিপুল জ্বালানি ব্যবহার, রাসায়নিক বিস্ফোরণ, জল পরিশোধন প্লান্ট ধ্বংস, এবং কৃষিজমিতে সামরিক প্রবেশের কারণে মাটির উর্বরতা হারিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের মতে, গাজা যুদ্ধজনিত এই পরিবেশগত বিপর্যয় একাধারে স্বাস্থ্য সংকট, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা এবং প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের পতনের দিকে ধাবিত করছে।
 
এই পরিসংখ্যানগুলো দেখায় যে যুদ্ধ একটি “দূরবর্তী” বিপর্যয় নয়, বরং তা আমাদের সকলের ভবিষ্যতের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। যুদ্ধ কেবলই তাৎক্ষণিক মানবিক বিপর্যয় নয়—এটি এক দীর্ঘমেয়াদি পরিবেশগত দুর্যোগের জন্ম দেয়, যা পরবর্তী প্রজন্মকেও বিপদের মুখে ফেলে।বিশ্বখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস্ রিসার্চ ইনস্টিটিউট (SIPRI) ২০২১ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে— "যুদ্ধ দ্বারা সৃষ্ট পরিবেশগত পরিণতিগুলো শান্তি স্থাপন প্রক্রিয়ায় পদ্ধতিগতভাবে উপেক্ষা করা হয়েছে, যা বিষাক্ত পরিবেশ, দূষিত জল ব্যবস্থা এবং বন উজাড়ের মতো ক্ষতিকর প্রভাব রেখে গেছে।" পরিবেশ ও সংঘাতের সম্পর্ক নিয়ে কাজ করা ব্রিটেনের সংস্থা কনফ্লিক্ট এন্ড এনভায়রনমেন্ট অবজারভেটরি (CEOBS) জানিয়েছে— "অনেক আধুনিক যুদ্ধেই, পরিবেশের ক্ষতি ইচ্ছাকৃত – এটি যুদ্ধেরই একটি কৌশল। ইরাকে তেলক্ষেত্রে আগুন লাগানো হোক, কলম্বিয়ায় বন উজাড় করা হোক বা ইউক্রেনে জল বিষাক্ত করা হোক, পরিবেশগত ক্ষতি এখন অস্ত্রে পরিণত হয়েছে।" এভাবে প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংসকে কৌশলগত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের চিত্র উঠে এসেছে। 
 
আমরা যখন জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণ করি, পরিবেশ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিই, তখন যুদ্ধ ও সামরিক প্রস্তুতির উপর প্রশ্ন তোলাটাও জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, একটি যুদ্ধের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে প্রকৃতিকে কখনও কখনও শতাব্দী পার করতে হয়। আর এই সময়টা, আমাদের হাতে আর নেই। পরিবেশ ও শান্তি গবেষকরা বারবার সাবধান করে দিয়েছেন— যুদ্ধ কেবল মানুষকে হত্যা করে না, তা প্রকৃতির প্রাণশক্তিও ধ্বংস করে। UNEP ও SIPRI-এর মতো সংস্থা জানাচ্ছে, পরিবেশ ধ্বংস শুধু যুদ্ধের উপসর্গ নয়, তা যুদ্ধ-পরবর্তী সমাজেও দীর্ঘমেয়াদে বিষক্রিয়ার মতো কাজ করে। পানি, মাটি, বনাঞ্চল—সবই পরিণত হয় যুদ্ধের নীরব শিকার। যেমন ICRC-এর ভাষায়, "যুদ্ধ মাত্র কয়েক মাসেই পরিবেশ রক্ষার বহু দশকের অগ্রগতি উল্টে দিতে পারে"। অর্থাৎ যুদ্ধের পরিণতি শুধু লাশে সীমাবদ্ধ থাকে না, তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শ্বাস-প্রশ্বাস, খাদ্য ও জলের ওপরও হানা দেয়।এই লেখায় উল্লিখিত তথ্যগুলো যুদ্ধের পরিবেশগত ধ্বংসলীলার মাত্রা বোঝাতে সাহায্য করে এবং কেন যুদ্ধ ও পরিবেশ একে অপরের শত্রু, তা স্পষ্ট করে তোলে। যুদ্ধ বন্ধ করা এবং শান্তি প্রতিষ্ঠাই পরিবেশ সংরক্ষণের অন্যতম প্রধান উপায়।
 
তথ্যসূত্র:
The Guardian, 2024–2025
Oil Change International, CEOBS Reports
UN Environment Reports, NATO 2023 Defense Spending
Reuters Environment, 2024 Gaza Conflict Assessments 
SIPRI Report, 2021
CEOBS, 2023  
 
 
 
 
 
0 Comments

Post Comment