পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

মণিপুর কী হতে চলেছে কফিনের শেষ পেরেক! একটি প্রশ্ন। উত্তর নিজের মত।

  • 22 July, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 1833 view(s)
  • লিখেছেন : সংবিদা লাহিড়ী
দুই নগ্ন মহিলাকে কিছু পুরুষ তাঁদের ভাষায় চিৎকার করতে করতে রাস্তা থেকে নামিয়ে মাঠের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। ভিডিওতে পুরুষের পৈশাচিক উল্লাস প্রকট। মহিলাদের চেহারা লজ্জা ও ভয়ে নুব্জ, এবং বারবার অত্যাচারীদের কাছ থেকে ক্ষমা পাওয়ার আর্তি। এই ঘটনা যদি একজন মানুষকে রাস্তায় না নামায়, প্রতিবাদে তাহলে আর তাঁকে কি মানুষ বলা যায়?

 

ইউপিএ দুইয়ের শেষের দিকে বড় বড় চুরি ধরা পড়ে সরকারের ভিত নড়বড়ে হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু ২০১৩ অর্থাৎ লোকসভা নির্বাচনের ঠিক একবছর আগে দিল্লি শহরে নির্ভয়া গণধর্ষণ কাণ্ড সরকার পতনের কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতেছিল। আশঙ্কা তৈরি হয়, মণিপুরের লাগাতর দাঙ্গা পরিস্থিতি এবং তার উপরে এহেন ভয়ানক নারী নির্যাতনের ঘটনা চলতি সরকারের পতনের কারণ না হয়ে দাঁড়ায়। 

কেন?  

এই সব প্রশ্ন তোলার আগে একটু স্মৃতি থেকে খুঁড়ে বের করে আনুন নির্ভয়া কাণ্ডের কথা। মনে আছে ২০১৩ সালে দিল্লির নির্জন বাসে এক তরুণীর দেহ নৃশংসভাবে ধর্ষণ করেছিল একদল পুরুষ। বছর ষোল’র এক কিশোরও ওই ঘটনায় অভিযুক্ত ছিল। ২০১৩ সালে নির্ভয়া কাণ্ডের পর সারা দেশ ইউপিএ-২ সরকারের কাছে নারী সুরক্ষা নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছে। তৎকালীন বিজেপির মহিলা নেত্রী, বর্তমান মহিলা ও শিশু সুরক্ষা মন্ত্রকের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি চুড়ি পাঠিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-কে। কংগ্রেসের মহিলা নেত্রী নেত্তা ডি-সুজা একটি প্রেস কনফারেন্সে গত ২০ জুলাই বলেছেন, স্মৃতি ইরানি তাঁর টুইটারে মণিপুরের ভাইরাল ভিডিওটি শেয়ার করেই কেন ক্ষান্ত হলেন। কেন পদক্ষেপ করতে পারলেন না মহিলা ও শিশু সুরক্ষা মন্ত্রী হিসেবে?

মোটের উপরে রাষ্ট্রীয় মদতে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার যে ছবিটি ধীরে ধীরে প্রকাশ পাচ্ছে, তাতে একটি ছবি পরিষ্কার হয়ে যায় যে ধর্ম ও সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে গত কয়েকমাস ধরে লাগাতর অশান্তি বহাল রয়েছে মণিপুরে কখনও শোনা যাচ্ছে পুলিশের থানা বা চৌকি লুঠ হওয়ার ঘটনা, কখনও শোনা যাচ্ছে দাঙ্গাকারীর হাতের অস্ত্র অত্যাধুনিক, যে পুলিশের কাছেও নেই এই সব খবরের কোনও সত্যিকারের ভিত্তি আছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায় তবে, মণিপুরের পুলিশ যে দাঙ্গাকারীদের নিরস্ত্র করতে অপারগ এবং তেমন কোনও বিশেষ পদক্ষেপ নেয়নি তা দ্য ওয়্যার-সহ একাধিক খবরের সাইটে প্রকাশিত হয়েছে

এদেশে এমনিতেই মহিলাদের বিরুদ্ধে যে কোনও রকম অত্যাচার বা হয়রানি হলে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তা একটি সাধারণ সত্য হয়ে দেখা দেয়। দেখা যায়, ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ যত সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হতে থাকে রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর নিষ্ক্রিয়তার প্রশ্নটি তত প্রকট হতে থাকে। সেটিকে ঢাকা-চাপা নানা উপায় বাতলানো হয়। কখনও ধর্মের বিচারে মুসলমান খুঁজে বের করে আনা হয়, অথবা সন্ত্রাসবাদের ছায়া দেখে সাধারণ মানুষকে নিরাপত্তা লঙ্ঘনের জুজু দেখানো হয়।

গত কয়েক বছরে মানুষের সার্বিক নিরাপত্তা ভারতে কমেছে বৈ বাড়েনি। তা অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, আইনি নিরাপত্তা বা সামাজিক নিরাপত্তা যাই হোক না কেন। সুরক্ষা ও নিরাপত্তা এই দুইটি শব্দ নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী গত কয়েক বছর ধরে যত জোরে চেঁচিয়েছেন, সুরক্ষা ও নিরাপত্তার বোধ মানুষের তত লঘু হয়েছে। সেই নিয়ে আমরা কেউ প্রশ্ন তুলিনি। আমরা জানি এই বিপুল ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রের কাছে আমরা নগণ্য কণামাত্র, সেখানে চেঁচানো চলে না। সয়ে যাওয়া ধর্ম, সইয়ে নেওয়ার উপায় বাতলানো কর্ম।

কিন্তু সমস্যা হয়ে যায়, যখন আমাদের বিবেকের অবদমন প্রায় অসাধ্য হয়ে যায়। এই যেমন মণিপুরে দুই নগ্ন মহিলার ভিডিওটি দেখে আমাদের মধ্যে চূড়ান্ত অস্থিরতা দেখা দেয় তখন। এর আগেও আমরা বুলডোজার চলতে দেখেছি। দরিদ্র মুসলমানের ঘর ভাঙতে দেখেছি, দিল্লির দাঙ্গা দেখেছি। তখনও আমাদের এতটা ব্যথা লাগেনি।

ঘটনার পুনরুল্লেখ

দুই নগ্ন মহিলাকে কিছু পুরুষ তাঁদের ভাষায় চিৎকার করতে করতে রাস্তা থেকে নামিয়ে মাঠের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ভিডিওতে পুরুষের পৈশাচিক উল্লাস প্রকট। মহিলাদের চেহারা লজ্জা ও ভয়ে নুব্জ, এবং বারবার অত্যাচারীদের কাছ থেকে ক্ষমা পাওয়ার আর্তি শোনা যাচ্ছে। 

এই ঘটনা সদ্য ঘটেনি। চলতি বছরের গত ৪ মে তারিখে কাংপকপিতে ঘটনাটি ঘটার পর অভিযোগ দায়ের হওয়ার পরেও কার্যত কোনও পদক্ষেপ করেনি মণিপুর রাজ্য সরকারের পুলিশ। ভিডিও ভাইরাল হতেই সারা দেশের সোশ্যাল মিডিয়া ও বিরোধীদের চাপে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয় মণিপুরের পুলিশ।

পুলিশ কী করেছিল?

দ্য ওয়্যার- একটি রিপোর্টে লেখা হচ্ছে যে, মে মাসের গোড়ায় কুকি ও মেইতেই সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতি বিদ্বেষজনিত দাঙ্গার কারণে যে অবস্থা চলছিল মণিপুরে, তা প্রায় বলার নয়। কুকিদের একাংশের অভিযোগ ছিল, মেইতেইদের সাহায্য করছে পুলিশ। এবং চারপাশে যেভাবে খুন-জখম-রাহাজানি বা কুকিদের গ্রাম দখলের ঘটনা ঘটছিল তার বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করেনি পুলিশ। উন্মত্ত মেইতেই সম্প্রদায়ের একাংশের মানুষ একের পর এক কুকি গ্রাম দখলের ঝোঁকে ছিল।

নির্যাতিতারা পুলিশকে জানিয়েছেন তাঁদের গ্রামেও খবর এসেছিল যে মেইতেইরা অচিরে ওই গ্রাম দখল করতে আসবে। এই শুনে গ্রামের সকলেই পালিয়ে যায়। কিন্তু তাঁরা গ্রাম ছেড়ে পালাতে সক্ষম হওয়ার আগেই মেইতেইরা এসে পড়ে। গ্রামে কাউকে না পেয়ে, শুধু এই দুই মহিলাকে পেয়ে সাম্প্রদায়িক শাস্তির বোঝা তাঁদের ঘাড়ে চাপানো হয়। অভিযোগ জামাকাপড় খুলে নেওয়া হয়। দুজনের মধ্যে একজনকে গণধর্ষণও করা হয় বলেও অভিযোগ দায়ের হয়েছে।  

নির্যাতিত মহিলাদ্বয়ের উভয়েই জানিয়েছেন ঘটনাস্থলে পুলিশ ছিল। চারজন পুলিশ একটি গাড়িতে বসেছিলেন। তাঁরা সবটা দেখেছেন, অথচ নির্যাতন আটকানোর চেষ্টা করেননি। শুধু তাই নয়, ৪ মে ঘটনাটি ঘটার কয়েকদিন পর, অর্থাৎ ১৮ মে এই যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে স্থানীয় পুলিশ থানায় অভিযোগ দায়ের করা হয় নির্যাতিতাদের তরফে। কিন্তু তারপর থেকে কোনও সক্রিয়তা দেখাতে পারেনি মণিপুর পুলিশ।

ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর মণিপুর পুলিশের তরফে দুটি ট্যুইট করা হয়। একটিতে জানানো হয়, কে এই ভিডিও ভাইরাল করেছে তাঁর খোঁজ চালানো হবে। দুই, জানানো হয় নংপক সেকমাই থানায় এই অভিযোগ গৃহীত হয়েছে এবং যৌন নির্যাতনের এই ঘটনায় অভিযুক্তদের অবিলম্বে গ্রেপ্তারির হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, ২০২০ সালে নংপক সেকমাই থানা দেশের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ থানার তকমা পেয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার তরফে।

২০১৩ এবং ২০২৩

নির্ভয়া কাণ্ডের পরও কিন্তু সরকার তরফে নির্যাতিতার পরিবারে চাকরি ও ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। ২০১৪ সালে লোকসভায় বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরেও একাধিকবার খবর হয়েছে নির্ভয়ার পরিবার কতটা নির্ভয়ে আছেন, তা নিয়ে। কিন্তু ওই অমানুষিক নির্যাতনের ঘটনার পরে সাধারণ উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মহিলা ভোটাররা কংগ্রেস থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। সুরক্ষা এবং ক্ষমতায়নের প্রশ্নটিকে সামনে রেখে উন্নয়নের দ্যোতক মোদীর সরকারকেই বেছে নিয়েছিলেন এ দেশের মহিলা ভোটারদের একটা বড় অংশ।

বছর তিনেক আগে প্যান্ডেমিক ও লকডাউনের ধাক্কা, সরকারের ব্যর্থতা এবং অমানবিক পদেক্ষেপ মহিলাদের কাজের পরিসর থেকে দূরে ঠেলেছে। কাজের সুযোগ কমেছে। কমেছে মজুরিও। সর্বশ্রেণীর মহিলারাই এই দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন।

মাত্র দুইমাস আগে মহিলা কুস্তিগীরদের যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে দিল্লিতে অবস্থান বিক্ষোভ করতে দেখা গিয়েছিল।পুলিশের খাতায় অভিযোগ জমা পড়েছিল যে যৌন হেনস্থাকারীর বিরুদ্ধে, তিনি ভারতের কুস্তি ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট এবং যিনি বিজেপির সাংসদ ব্রিজভূষণ সিং। তাতেও দিল্লি পুলিশের অস্বাভাবিক নিষ্ক্রিয়তা এবং আন্দোলনকারী মহিলা কুস্তিগীরদের ওপরে পুলিশি হামলা নিয়ে নিন্দার ঝড় উঠেছিল। সেই টালমাটাল দশা কাটাতে না কাটাতে ফের দাঙ্গা ও তার অনিবার্য ফল হিসেবে মণিপুরের এই নৃশংসতার ভিডিও ভাইরাল হল।

ভিডিও ভাইরাল হয়ে সাংঘাতিক প্যাঁচে পড়েছে দেশের কেন্দ্রীয় সরকার এবং মণিপুরের রাজ্য সরকার। দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে ওই দুই নির্যাতিতাকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। টাকার অংক ঘোষণা করা হচ্ছে। মণিপুরে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করার প্রস্তাব আনা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী অবশেষে মৌন দশা কাটিয়ে অভিযুক্তদের কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি দেওয়ার কথা বলছেন। কিন্তু এ সবই তো সেই ড্যামেজ কন্ট্রোল। কিন্তু তার পিছনে কতটা অপরাধীদের শাস্তি আর কতটা নিজের ভাবমূর্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। মনে প্রশ্ন জাগছে, তিনি বা তাঁর সরকার কি আদৌ আসল সমস্যার সমাধান করতে আগ্রহী, না হলে কেন তাঁর দল, মণিপুরের ঘটনার বিপরীতে বাংলা বা রাজস্থানের উদাহরণ এনে, মণিপুরের বিষয়টিকে লঘু করে দিতে চাইছেন? তাই আমাদের মনে আশঙ্কা জাগে।      

চিন্তা হয়, ঢাকের দায়ে মনসা না বিকিয়ে যাবে না তো!

 

 

 

 

 

0 Comments

Post Comment