পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

একটি অপরাধের জবানবন্দী

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 209 view(s)
  • লিখেছেন : দেবাশিস মজুমদার
ইন্টারোগেশান রুমে পাশাপাশি হাতকড়া পরানো অবস্থায় বসানো রয়েছে রাজু আর পলাশকে। চারজন কনস্টেবল ঘরের চার কোণে পাহারায় রয়েছেন। অফিসার রাত্রি গাঙ্গুলী এসে তাদের উল্টোদিকের চেয়ারে বসে হাতের ফাইলটা সশব্দে টেবিলে রাখলেন। ঘরের চারিদিকে আলো নেই, ওই টেবিলের ওপর শুধু জোরালো এক আলো জ্বলছে আর রাত্রির ঠিক পেছনে আরেকটা স্ট্যান্ড লাইট।

আলোগুলো এমনভাবে দুইজন অভিযুক্তর মুখের ওপর পড়ছে যে তাদের চোখ বারেবারে কুঁচকে ফেলতে হচ্ছে। রাজুর চোখ কুঁচকালেও তার মুখ ইস্পাত কঠিন কিন্তু পলাশ মাঝে মাঝে শিউরে উঠছে। তার চোখেমুখেও আতঙ্কের ছাপ।

রাত্রি সোজাসুজি তাকালেন দুই অভিযুক্তের দিকে, তারপর সামনের ফাইলটা দেখিয়ে বললেন, ‘অনিমা দাসকে কিভাবে খুন করা হয়েছিল তা আমরা ভালোভাবেই জেনে গেছি। ফরেনসিক রিপোর্ট ত বটেই তার পাশাপাশি রাজু, তুমি নিজের স্ত্রী অনিমাকে খুন করতে অন্য যে দুইজনের সাহায্য নিয়েছিলে তোমার সেই দুই শাগরেদ মিন্টু আর কালুয়া, তারাও তাদের অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছে আর তারা যে একাজ তোমাদের কথাতেই করেছে সেটাও স্বীকার করে নিজেদের জবানবন্দী দিয়েছে, এবারে তোমাদের পালা, তোমাদের বাঁচার আর কোনও পথ নেই, সব প্রমাণ তোমাদের বিরুদ্ধে, এবারে ভালোয় ভালোয় সব স্বীকার করো, নইলে মুখ ত আমি খোলাবই তার সঙ্গে চার্জশিট এমনভাবে তৈরি হবে যাতে তোমাদের মৃত্যুদণ্ড অবশ্যম্ভাবী হয়’।

রাজু তবু কঠিন হয়ে উঠল, পলাশ শুধু অস্ফুটে নীচু স্বরে বলল, ‘আ-আমি কিছু করিনি, আমি খুন করিনি’, তার গলায় ভয়ের ভাব স্পষ্ট, কান্না ভেতর থেকে ঠেলে উঠে আসতে চাইছে।

‘আমি সত্যিটা জানতে চাই, তোমাদের মুখ থেকে’। কড়া গলায় বললেন অফিসার রাত্রি।

তার ঈশারায় পেছন থেকে কনস্টেবল বিকাশ এসে চুলের মুঠি ধরে টেনে পলাশকে মারতে উদ্যত হল, পলাশ এবারে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে কেঁদে উঠে বলল, ‘আ-আমি অ-অনিমাকে খুন করিনি, আ-আমি খুনী নই, বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, আমি খুন করিনি’। অঝোরে কেঁদে ফেলল পলাশ।

রাত্রি ইশারায় বিকাশকে থামতে বলে কড়া চোখে পলাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘সত্যিটা জানতে চাই আমি, একটাও বাজে কথা নয়, পুরো সত্যিটা, খুনের সময় স্পষ্টে তুমি ছিলে, ভিকটিমের দেহের সর্বত্র তোমার আঙুলের ছাপ রয়েছে, ভিকটিমে নৃশংসভাবে মারার ক্ষেত্রে তোমারও হাত রয়েছে, সত্যি কথা বলো’।

পলাশ মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে অঝোরে কেঁদে ফেলল। রাত্রির ইশারায় আরেকজন কনস্টেবল পলাশের জবানবন্দী রেকর্ড করার জন্য প্রস্তুত হল। কিছুটা অঝোরে কেঁদে নিয়ে কিছুটা সামলে উঠে পলাশ বলল, ‘আমি অনিমাকে খুন করিনি, আমি আ-আমি ত ওকে নিয়ে অন্যভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিলাম, ভালোবেসেছিলাম ওকে’।

রাত্রি বাঁকা হাসি হেসে বললেন, ‘অন্যের স্ত্রীকে ভালোবাসা, মানে পরকীয়া প্রেম, কি তাই ত?’

একটু ফুঁপিয়ে নিয়ে পলাশ আবার বলতে শুরু করল, ‘অনিমা রাজুর সাথে সুখী ছিল না, খুশী ছিল না, রাজু ওকে মারত, ওর গায়ে ছ্যাঁকা দিত, যখন তখন ওকে বাধ্য করত বিছানায় নিয়ে গিয়ে……এমনকি ওইসব সময়েও………’

রাজু পাশ থেকে একটা চাপা গর্জন করে হুঙ্কার দিতে চাইল, রাত্রি উঠে দাঁড়িয়ে তার গালে সপাটে একটা চড় মারলেন, তারপর হুঁশিয়ারি দিয়ে বললেন, ‘আমার সামনে কোনও হুমকি চলবে না, বিন্দু মাত্র চালাকি করলে আমি যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারি তার নমুনা একটা দেখালাম মাত্র’। রাজুর মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছে, সে আবার চুপ করে গুম হয়ে বসে রইল। পলাশ আবার একটু আমতা আমতা করে বলতে শুরু করল, ‘বাজারে রাজুর গ্যারাজের দুটো দোকান পরেই আমার ফুলের দোকান, রাজুর গ্যারাজে কয়েকবার অনিমা এসেছিল, তখনই ওকে দেখেছিলাম। দেখেই একটা ভালোলাগা তৈরি হয়েছিল। একদিন রাজু গ্যারাজে ছিল না, অনিমা আমার দোকানের সামনে এসে মাথা ঘুরে পড়ে যায়। আমি ওকে আমার দোকানে বসাই, রাজুর গ্যারেজ সেদিন বন্ধ ছিল, রাজু বাড়িতেও ছিল না, অনিমা ওকে খুঁজতে এসেই অসুস্থ হয়ে পড়ে, আমিই তখন বিক্সা ডেকে অনিমাকে বাড়ি পৌছে দিই, দিন তিনেক পরে একদিন ও পাড়ায় গিয়েছিলাম একটা কাজে, ওদের বাড়ির সামনে দিয়ে আসার সময় দেখি অনিমা বাড়ির সামনের বারান্দায় বসে কাঁদছে, আমি আর থাকতে না পেরে ভেতরে যাই, অনিমা নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করেও পারে না, কাঁদতে কাঁদতে আমার সামনেই ও অসুস্থ হয়ে পড়ে, অজ্ঞান হয়ে যায়, আমি আমার হাতে ওকে তুলে নিয়ে ঘরের ভেতর নিয়ে যাই, মাথায় জলটল দেওয়ার পরে ও কিছুটা সুস্থ বোধ করে আর আমার প্রশ্নের সামনে ভেঙে পড়ে আমাকে ওদের দাম্পত্য কলহের সবকথা বলে দেয়। রাজু একবার ওর পেটে আসা কন্যা ভ্রূণ পর্যন্ত হত্যা করেছে, মেয়েটার সারা দেহে আঘাতের চিহ্ন, পিঠে সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়ার চিহ্ন, রাজু মদ খেয়ে রাতে বাড়ি ফিরে ওর ওপর অত্যাচার করে, ও আমাকে সব বলে দেয়, আর আমিও কেমন যেন ওর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ি, ভালোবেসে ফেলি ওকে, ক্রমে রাজু না থাকলে আমি ও বাড়িতে যেতাম, গল্প করতাম, তারপর মোবাইলেও কথা শুরু হয়, আর আমাদের সম্পর্ক ভালোবাসার সম্পর্কে পরিণত হয়। অনিমা আমাকে বারবার বলত ওকে ওই নরক থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার জন্য, কিন্তু আমার সাধ্য সামান্য, বাড়িতে অসুস্থ মা রয়েছেন, আ-আমি কিভাবে, তাই অনিমার কাছে কিছু সময় চেয়েছিলাম, বলেছিলাম একটু আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হলেই ওকে আমি রাজুর কবল থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসব’। একটু থামল পলাশ।

রাত্রি তারদিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘কি সুন্দর ভালোবাসা, সেই মেয়েকেই নৃশংসভাবে খুন করলে শেষে তাও তার সেই অত্যাচারী স্বামীর সঙ্গে সাঁট করেই’। ব্যঙ্গাত্মকভাবে হাততালি দিয়ে উঠলেন রাত্রি।

আবারও কেঁদে ফেলল পলাশ, তারপর ফুঁপিয়ে বলে উঠল, ‘না, আমি আমি ওকে মারিনি। আসলে আমাদের যে একসাথে রাজুর গ্যারেজের পার্টনার মিন্টু দেখে ফেলেছে সেটা জানতে পারিনি। অনিমা বলেছিল রাজু বলে গেছে যে রাতে ও বাড়ি ফিরবে না, গ্যারাজের মাল আনতে সদরে যাবে, ফিরবে পরদিন দুপুরে, তাই ওই রাতে আমি গিয়েছিলাম অনিমার কাছে গোপনে, ভেবেছিলাম রাতটা ওর কাছে কাটিয়ে আসব। বুঝিনি ওটা রাজুর পাতা ফাঁদ। আমরা দুজনেই যখন অন্তরঙ্গ অবস্থায় ছিলাম তখনই রাজু তার শাগরেদদের নিয়ে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে পড়ে। মিন্টু আর কালুয়া আমার গলায় ছুরি ঠেকিয়ে আমাকে মেরেধরে আটকে রাখে আর রাজু, সে ক্ষ্যাপা হিংস্র পশুর মত ঝাঁপিয়ে পড়ে অনিমার ওপর………’

তখনই রাজু গর্জে উঠে বলে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি আমি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম ওই বেহায়া মেয়েছেলের ওপর। শরীরের কোন সুখটা দিইনি ওকে, কিসের কমতি ছিল আমার যে ওই মেয়েমানুষটা পরপুরুষকে আমার বিছানায় টেনে আনল, ওকে বোঝাতে চেয়েছিলাম আমার পৌরুষত্ব তাই সকলের সামনেই আগে ওকে বিছানায় ফেলে আমার পৌরুষত্বের প্রমাণ দিই, মিন্টু-কালুয়া আর এই নপুংসক পলাশের সামনে, তারপর ওর বেইমানির শাস্তি দিই, আমার নির্দেশেই মিন্টু আর কালুয়া অনিমার ওপর নিজেদের পৌরুষত্ব প্রয়োগ করে, তারপর আমি এই ভেজা বেড়াল পলাশকে দিয়েও একই কাজ করাই ওর সাথে, ওকে বোঝাতে চেয়েছিলাম আসল পুরুষ কে? আমি না অন্য কেউ, ওকে মারার আগে সেটা আমি প্রমাণ করে দিয়েছি’। রাজু কথা থামালো কিন্তু তার চোখ দিয়ে তখন আগুন ঝরছে।

রাত্রি একটা অদ্ভুত প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিয়ে তাকালো পলাশের দিকে। পলাশ কুঁকড়ে গিয়ে বলল, ‘আ-আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, ভয়, ভীষণ ভয়, প্রাণের ভয়, আমি মরে গেলে আমার অসুস্থ মায়ের কি হবে? ত-তাই রা-রাজু যা বলেছে আমি করেছি, রা-রাজু তারপর বিছানাতেই যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকা অনিমাকে গলা টিপে মারে, তারপর আমাকে বাধ্য করে ওদের তিনজনের সাথে অনিমার দেহটাকে টুকরো করে পলিথিনের প্যাকেটে ভরে ওদের বাড়ির পেছনের জঙ্গলে পুঁতে দিতে, যা করেছি প্রাণের ভয়ে রাজুর কথাতেই করেছি, আ-আমি অনিমাকে খুন করিনি, আ-আমাকে ক্ষমা করে দিন ম্যাডাম, আমার অসুস্থ বৃদ্ধা মা রয়েছেন, আমি ছাড়া তার আর কেউ নেই’।

এবারে হুঙ্কার দিয়ে উঠে রাত্রি বললেন, ‘রাজু একটা কথা ঠিকই বলেছে, পলাশ তুমি সত্যিকারের নপুংসক। নিজেকে বাঁচাতে এখনও নির্লজ্জভাবে একজন নারীর নাম নিচ্ছ, অথচ আরেকজন নারী, যে কি না তোমাকে বিশ্বাস করেছিল তার বিশ্বাসভঙ্গ করে তাকে ওই জঘন্য মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে তোমার এতটুকু বাঁধেনি। তুমি সত্যিকারের নরাধম। তোমার ক্ষমা হতে পারে না। আর রাজু তুমি হিংস্র নরপিশাচ, তোমার ভেতরে রয়েছে শুধুই ব্যর্থ পৌরুষের আত্মভরিতা। আমরা ভিকটিমের ছিন্ন ভিন্ন বডিতেও তোমার অত্যাচারের নিদর্শন পেয়েছি, একজন মেয়েকে নরকের দিকে ঠেলে দিয়েছ তুমি তোমার নৃশংস পৌরুষের দম্ভ দিয়ে, একজন মেয়ে তোমার কাছে শুধুই ভোগ্যপণ্য ছাড়া আর কিছু নয়, বে-আইনীভাবে তুমি একবার নিজের কন্যাভ্রূণও নষ্ট করেছ, তোমার অপরাধেই অনিমাও বিপথগামী হয়েছিল, তুমি ইচ্ছে করলে আইনী পথে তাকে ত্যাগ করতে পারতে কিন্তু তার গর্ভের সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ করে আর তাকে হত্যা করে তুমি আগেই নিজের খুনী স্বভাবের পরিচয় দিয়েছ, যাকে দিয়ে সেই পাপ কাজ করিয়েছিলে সেও এখন পুলিশের হেফাজতে, তোমরা সমাজের আসল কলঙ্ক, তোমরাই সমাজের আসল শত্রু। আমিও একজন নারী, কিন্তু আমার বাবা, দাদা আর আমার জীবনসঙ্গী তোমাদের মত নোংরা মানসিকতার মানুষ নয়। তাই আমিও সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচার উপযুক্ত হয়েছি। একজন মেয়ে হিসাবে তোমাদের মত ঘৃণ্য জীবদের যাতে চরম শাস্তি হয় আমি সেই চেষ্টাই করব’।

কথাগুলো বলে কনস্টেবলদের বাকি কাজের নির্দেশ দিয়ে রাত্রি ইন্টারোগেশন রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। রাজু একইভাবে শক্ত হয়ে বসে রইল, যদিও নিজের ভবিষ্যৎ শাস্তির কথা ভেবে গলায় বারংবার আকুতি আনতে আনতে কান্নায় ভেঙে পড়ল পলাশ।

0 Comments

Post Comment