তারা সোজা ভাবে বলেঃ “কান্না কইরছে”। তা খানিক আগের চিল্লানো কান্না করার মতো ঠেকে নি মকদুমের কানে। কেউ বুরবক হয়ে গাঁড় মারা খাইছে বলেই মনে হয়। এত রাতে এই চরে বুরবক হতে কোন মানুষটা আসবে? নিশ্চয় কোনো জ্বিন। জ্বিনরা এই চরে থাকে অনেক কাল। জ্বিনদের কারসাজিতেই কিনা জানা নেই, এখনও এই চরের সঙ্গে নদীর এই পারের যোগাযোগ বলতে নৌকা আর পা। নদীর ওই পারের সাথেও নৌকা আর পা দিয়েই যাওয়া আসা করা যেত। মাঝখান দিয়ে নদী নিজের মতো বয়ে চলে। বহুকাল আগে বখতিয়ারের একখান বড় প্রিয় ঘোড়া এখানে এসে মরে যায়। বখতিয়ার তখনো আরো উত্তরে গিয়ে আলি মেচকে নিয়ে আরো উত্তরে গিয়ে তিব্বতে হামলা করার কথা ভাবতেও পারে না। সেই ঘোড়ার কবরটাও এই মাজারের এক কোণে থেকে গেছে। একটা শিউলি ফুলের গাছ এখন তার উপর ভাদ্রের মাঝামাঝি থেকে ফুল ঝরাতে থাকে। এই মাজারে সবচেয়ে বেশি দিন শুয়ে আছে যেই জন সে নাকি হোসেন শাহের দরবারে চাঁদ আর সূর্যকে এক পাঁজিতে মেলাবার কাজের এক তালেবর ছিল । সেই সব মিলানোর পর তার নাকি মনে হয়েছিল চাঁদ, সূর্য, তারা, মাস , তারিখ সবই আসলে বালি। বালিকে বুঝতে চাইছিল সে। এই চরে এসে সেই থেকে তার বাস। ঘোড়ার কবরটার দিকে তাকায়ে নাকি কইত, “বখতিয়ারের ঘোড়া তো দূর! বখতিয়ার নিজে এখান থেকে দুই দিন হাঁটা পথে বালি হয়ে শুয়ে আছে। বালির দিকে ধীর ভাবে তাকাও। ওয়াক্ত আর ওয়াক্তের মানে বুঝতে পারবে”। যদিও সামনের লোকেরা কী বুঝত কে জানে! কিছুদিন পর সেই মুরুব্বি পীর হয়ে যায়। মকদুমের বড়দাদি মকদুমকে নাকি বলেছিল এই সব কথা। এই মাজার ঘিরেই লোকের বাস শুরু এখানে। জ্বিনদেরও সেই একই সময়ের কিসসা। নয়া কিছু এলেই এই চরের মানুষগুলান প্রাণপাত করতো যাতে সেই নয়া এখানে টিকতে না পারে। যদি সেই নয়া খুব টেঁটিয়াল হয় তাহলে সেই নয়াকে চরের মত করে নিতে হুদ্দোড় চলত। শেষ অবধি টিকে যাওয়া নয়ারা চর হয়ে সেই কোন আদ্দিকালের পুরানা হয়ে যায়। তখন ঠেকেই না যে সে আদতে চরুয়াই না। আর এইসব চলতে চলতেই এই বালিকে সময়রেখা মেনে নদীর দুইপার দুই দেশ হয়ে গেল। দুই পারকে দুই দেশ ভাবতে পারে নি এই চরের বালি, বাতাস, জল, পাখি, মানুষ কেউই। বি এস এফের লাঠির বাড়ি পিঠে খেতে খেতে, বুটের লাথ পেটে ও পাছায় নিতে নিতে, দু-চারটা গুলি কান ঘেষে বেরিয়ে যেতে যেতে এবং আরো উত্তর থেকে বয়ে আসা ফেলিনি খাতুনের ডেডবডির কাঁটাতারে ঝুলতে থাকার গল্প শুনতে শুনতে এই চর মেনে নিল তার দুই দিকে দুইটা আলাদা দেশ। তার আগে অবধি মেলা চিল্লামিল্লি করেছে এই চর।
সবকিছুর বর্ডার হলেও জ্বিন আর ভূত বাতাসেরই মতো। তাই বর্ডার দিয়ে তাদের যাতায়াত আটকানো যায় নি। নয়া কোনো জ্বিন , কিংবা ভূত চরে বাসা খোঁজার ফিকিরে এলে আগে হুজুরের মাজারের উত্তর-পশ্চিম কোণে থাকা নিম গাছ থেকে একটা হাওয়া উঠতো। তারপর এই চৈত্র মাসেও শিউলির বাস ভেসে আসত মকদুমের নাকে। খানিক বাদ চর জুড়ে বালি উড়তো। জলে নুপুর পরে ঝমঝম করে কেউ হেঁটে যাচ্ছে মনে হতো। একটা পাতাও নড়ে নি। জল বুকের ভিতরের মত চুপ হয়ে আছে। বালি থম। তার মাঝে এই না-চরুয়া গলায় ভূতের লাথ খেয়েছে এমন চিল্লানো। মকদুম বিছানা ছেড়ে নেমে আসেন। পায়ে চটি গলিয়ে দ্রুত চিৎকারের উৎস খুঁজতে উৎসুক হয় মন। বলা যায় না কোনো বুরবক ভদ্রলোকের ভূত এই পছিয়া হাওয়ায় দিক বেভুল হয়ে এই চরে এসে পড়ে সেঁধিয়ে গেল কিনা কে জানে! মুসলমান ভদ্রলোক হলে তাও বাঁচোয়া। হিন্দু ভদ্রলোকের হলে তো সে বেচারা ভূতেরই মকদুমের সাহায্য লাগবে এই গো-খেকো স্থানের ভয় কাটাতে! চিৎকার আসছে হেকম্যানের ঘরের দিক থেকে। সকলে নিদে আছে মনে করে বড় আরাম করে একটি জোর আওয়াজে পাদ দেয় মকদুম। তার ছেমড়ি ডাক দেয়, “আব্বা, কোথা যাও?” । মকদুম খিঁচিয়ে ওঠে, “জাহান্নমে”।
হেকম্যান যোগালির পূর্বপুরুষদের কেউ একটা যোগালির কাজ করেছিল কোনোদিন! হেকম্যান ভেবে অবাক হয় যে তার আপন রক্তের কেউ রাজমিস্ত্রির সঙ্গে বসে সারাদিন মাপ নিচ্ছে, ইঁট গাঁথছে, সুরকি মাখছে! ঘামে ঘামে লটপট হয়ে একটা দালান গড়ছে ! দিন শেষে হা-ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাড়ি ফিরছে! এসব ভাবলেই হেকম্যানের শরীর দিয়ে ঘাম গড়াতে থাকে। ধরপড়ায় বুক। মনে হয় গলায় শ্বাস লাগি আসছে। তারপর শ্বাস নেয় সে। ভাবে। যে ব্যাটা হেকম্যানের বাড়িতে জন্মেও এমন খাটিয়া ছিল তাকে দিনে রাতে হাজার সালাম দেয় সে। তার চেয়েও একটা সালাম বেশি দেয় অন্য কারণে। নিজের বাড়ির আইটকুইড়্যা বদনাম ঘোচাতে সেই যোগালি নামের শেষে থাকা ‘মোমিন’ ফেলে দেয়। তারপর থেকে বংশ পরম্পরায় তারা ‘যোগালি’ হয়ে গেল। হেকম্যানের বাপ বড়দাদাদের কোনো খাটুনির কাম করতে হয় নাই। জমিই ছিল না কোনোকালে যে আবাদ করতে হবে। লোকের জমিতে খাটুনির কামটা করতে যেত বাড়ির বিবিরা। যোগালিরা প্রথমে তামাকু, পরে বিড়ি ধরায়ে দিন শেষের অপেক্ষায় থাকে। হেকম্যানকে তার আইলসা বড়দাদার কাছ ছাড়া করতে হুইরুদ্দি বেওয়া ইস্কুলে পাঠায়। নৌকা করি গিয়ে, দু-তিন মাইল বালি ভেঙে তারপর কারো সাইকেলের পেছনে আরো তিন-চার মাইল যাওয়ার পর ছিল সেই স্কুল। কয়েকটা দিন যাওয়ার পর সকলের মাথায় আশমান ভাঙি পড়ল। হুইরুদ্দি নদীর ধার থেকে হেগে এসে দেখে ছাওয়াল তার ডান হাত বাঁকিয়ে “আল্লাহ! আল্লাহ!” বলে ছটপটায়! “ হ রে হেকম্যান কী হইল রে বা’জান মোর!”, হুইরুদ্দির বুকের গভীর থেকে উঠে আসা আর্তনাদ এই চরের প্রতিটি বালির কণার কাছে বাঁজখাই এক চিৎকার হয়েই জলে ভেসে যায়। সেই সকালটার কথা এই বিকালে বসি খুব মনে করতে পারে হেকম্যান। “আম্মা রে! মাস্টার ‘অ’ লিখায়েছে কাল পুরা ইস্কুল জুড়ে। আজও লিখাবে কয়েছে। হামার হাত বাঁকি যাইতেছে ” , হেকম্যান চিল্লাচ্ছে। হুইরুদ্দি হেকম্যানেরে বুকে জড়ায়ে নিয়ে মাজারের দিকে দৌড় লাগাইছিল। তিনদিন ঝাড়ফুঁকের পর হেকম্যান হাতে সাড় ফিরে পায়। মকদুমের বড়দাদার ঝাড়ফুঁকে কাম যে হত তা সকলে এই চরের স্বীকার করে। সাড় ফিরে পাওয়া হাতে হেকম্যান আর কোনোদিন সাদা খড়ি আর কালো স্লেট ছোঁয়ায় নাই। হুইরুদ্দি মাজার থেকে বেরিয়ে হেকম্যানকে বুকে জড়ায়ে ধরে বড় নরম ভাবে বলেছিল, “ বেটা’গে! ওই চোদনা ইস্কুলে তোরে যেতে লাগে না। হুইরুদ্দি নিজের বেটারে নুন-ভাত জুটায়ে দেবে”। সেই থেকে হেকম্যান খাওয়াদাওয়া, হাগা, ছোঁচা, ঘুম ছাড়া একটি কাজই করত সারাদিন ধরে। এই চর জুড়া ধূ ধূ বালির দিকে তাকায়ে জীবনকে বোঝার চেষ্টা। কখনো চোখ টানটান করি, কখনো ঢুলঢুল করি, কখনো আবার চোখ বুজি বালির উপর হাওয়ার শনশন শুইনে শুইনে। আর শেষ দুপুরে হাঁটা লাগাত আলিসগঞ্জের চায়ের দোকানে গুলতানি করতে। ফিরে আসার পর হুইরুদ্দির চুল বড় যত্ন করে তেল দিয়ে বেঁধে দিতো হেকম্যান। চিরুনি চালাতে চালাতে বলত, “আম্মা রে! তোর কত্ত ঘন চুল!”। এইসবও প্রায় পঁচিশ সন আগের কিসসা। এখন নিজের রান্না নিজেরেই করতে হয় হেকম্যানেরে। হুইরুদ্দি কিছু জমি করে হেকম্যানের ভাতের চিন্তা দূর করে দেয় এক যুগ আগে। তারপর হুইরুদ্দি বালি হয়ে হারিয়ে গেছে সেই কবে!
মকদুমের বাড়ি থেকে হেকম্যানের বাড়ি না করেও জোর কদমে হাঁটলে তিন-চার মিনিটের পথ। মাজারটাকে ডানদিকে রেখে এগিয়ে যায় মকদুম। চাঁদের টুকরা উঠছে মাজারের আকাশ ঘেঁষে। চাঁদের দিকে তাকাতেই মনে হল একখান ছায়া মূর্তি জোর কদমে চলে গেল পাশ দিয়ে। মকদুমকে সালাম জানালো না। ডর লাগে। জ্বিনেরে ভয় পায় না সে। কিন্তু জ্বিনের চেয়েও বড় এই ডর তো আর মুসলমানি মন্ত্র শুনে ভাগবে না। এই চরে সপ্তাহে দুইদিন গরু কাটা হয়। কত বছর ধরে? হিসাব করতে গেলে চরের বয়সের হিসাব বাইর হয়ে পড়বে। তিন-চারশ বছর কেটে যাওয়ার পর মাসখানেক আগে এই খবর নাকি মাইকে ফুঁকে ফুঁকে বলা হয়েছে এই চর শেষে নদী পাড়ের ডাঙা আলিসগঞ্জের পাড়ায় পাড়ায়। মকদুমের ডর আসে। পিছনে তাকাবার সাহস নাই তার। ছায়ামূর্তিটা যদি অনেকগুলা ছায়া হয়ে যায়? যদি তার মুখ চেপে ধরে? যদি হাত আটকায় দেয়? তারপর যদি পা চেপে ধরে? যদি তারে জানে মেরে দেয়? এত যদির কথা ভেবে মকদুমের পেচ্ছাপ লাগে। ছায়ামূর্তি কোথাও নাই। অনেক দূরে বালির উপর চিকচিকাচ্ছে নদীর জল। মকদুম জানে এখনের মত মকদুম বেঁচে গেছে। সে আবার মকদুম মৌলভী হয়ে ওঠে। মাজারের নিমগাছটা এক চোখে তাকায়ে আছে তার দিকে। হেকম্যানের বাড়ির বেড়ার ধারে এসে দাঁড়ায় মকদুম। হুইরুদ্দি বেওয়া উঠানে গড়াগড়ি খাচ্ছে। জবাইয়ের সময়ের বাছুরের মত ছটপট করছে হুইরুদ্দি। কোথাও কেউ নাই আর।
“হেকম্যান, তোর দেশ কোথা?” ---- বড়দাদার বাপ হেকম্যান জিগায়।
“হুই বালিতে” ---- বড়দাদা হেকম্যান জানায়।
“হেকম্যান, তোর দেশ কোথা?” --- বড়দাদা হেকম্যান জিগায়।
“হুই বালিতে” --- বাপ হেকম্যান জানায়।
“ হেকম্যান, তোর দেশ কোথা?” --- বাপ হেকম্যান জিগায়।
“ হুই বালিতে” --- ব্যাটা হেকম্যান জানায়।
“হেকম্যান, তোর দেশ কোথা? “---- তেইশ বছর আগের আলিসগঞ্জের চায়ের দোকান জিগায়।
“হুই বালিতে”---- তেইশ বছর আগের হেকম্যান জানায়।
“ হেকম্যান, তোর আসল দেশ কোথা?” --- দু’মাস আগে আলিসগঞ্জের চায়ের দোকানে ফুঁইদার মণ্ডল জিগায়।
“ বরাবর ভারত। তোদের মত খ্যাদা খাওয়া বাঙাল নই হামরা” --- অহেকম্যানি গলায় হেকম্যান জানায়।
ফুঁইদার খ্যাঁকখ্যাঁক করে হেসেছিল খানিক। জিভে চা ঠেকাতে ঠেকাতে কয়েছিল, “ কাটাদের তো এত বোকাচোদা ঠেকে না। তোর শালা ঠিকঠাক কাটা হয়েছিল তো?”। আবার খ্যাঁকখ্যাঁক ।
ফুঁইদার হেকম্যানের মনে কী জানি কী এক ঢুকিয়ে দিল! আলিসগঞ্জের চায়ের দোকানটারে তার অচেনা লাগে এখন। বালির দিকে তাকায়ে বুঝে নিতে চেষ্টা করে সব। কিছু ধরে পারে না। ঘরের দরজা জানালা লাগায়ে লুঙ্গি খুলে নিজের আগা কাটা বাঁড়ার দিকে তাকায়। চোখ কুচকায়ে। কীসব বোঝার চেষ্টা করে। তর্জনী আর বুড়া আঙুল দিয়ে কাটা চামড়াটা গুটিয়ে আনতে চায় বারবার। চামড়া গুটায়ে আসে। স্থির হয়ে থাকে খানিক। হেকম্যান ভাবে সে বেঁচে গেছে। আবার চামড়া সরে যায়। “বুরমারানি রে, মইরে গেলাম”, একখানা চাপা নিঃশ্বাস বের হয় হেকম্যানের কলিজা থেকে। “এত শক্ত দাড়ি কাটতে হামি কিন্তু পঞ্চাশ টাকা লিব, হেকম্যান চাচা”, ল্যাওড়া লাওয়্যাটার কথা শুনে হেকম্যানের মাথায় আগুন জ্বলে যায়। সে চুপচাপ থাকে। কোলের কাছে থাকা সাদা চাদরে জমা হতে থাকে হুই আদ্দিকালের হেকম্যানের দাড়ি। কাঁচির পর খুর চলে। গুমড়ায় হেকম্যান। সমস্ত কিছুর পর আয়নার দিকে তাকালে দেখতে পায় হুইরুদ্দি তার দিকে তাকায়ে আছে। দূরে বালির উপর সূর্য।
“ফুঁইদার, গরু না খেলে তো হামি ভারতেরই”, গলা নামায়ে জিগায়েছিল হেকম্যান। “গাল তো পুরা চৈতের চর কইরে ফেলেছো হে”, ফুঁইদার আমোদ নিয়ে বলে। “ফুঁইদার, গরু না খেলে তো হামি ভারতেরই”, আরো গলা নামায় সে। “দ্যাখ হেকম্যান, কাটা দাড়ি রাখলো না কাটলো, গরু খেল কি না খেলো, কাটার কি আর জোড়া লাগবে বল? কাটা তো কাটাই”, ফুঁইদার একটা কামালী বিড়ি ধরিয়ে বলে চলে। “ গরু খাওয়া ভালো না রে ফুঁইদার, পাইলস হয়”, হেকম্যান ফুঁইদারের কাছে এসে বসে। রোজ বিকালে ফুঁইদার কোথায় কোন মুসলমানকে পিটায়ে মারা হয়েছে জোরে জোরে তার খবর পড়ে। কখনো আবার হেকম্যানকে ডেকে মোবাইল ফোনে সেইসবের ভিডিও দেখায়। দু-মাস আগে ফতেমপুরায় পুড়ে যাওয়া তিরিশ ঘরের ভিডিও দেখাতে দেখাতে “ ইস রে”, বলতে বলতে চায়ে চুমুক দেয় ফুঁইদার।
রোজ রাতে এই চরের সবাই ঘুমিয়ে গেলে আর জ্বিনেরা জেগে উঠলে হেকম্যান মোম জ্বালিয়ে কাপড় খুলে ফেলে নিজের। নিজের বাঁড়ার কাটা চামড়ার দিকে তাকায়ে থাকে। সাদা দানাদার বৃত্তেরা রোজ জমা হয়। ন্যাকড়া দিয়ে মুছে ফেলে। চামড়া গুটায় আবার। না পেরে একদিন মোম দিয়ে পোড়াতে গিয়েছিল। গলা মোম ছলকেছিল কাটা চামড়া দিয়ে চামড়ার ভিতরে। “আগগে মা’গে”, চিল্লাতে গিয়ে দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরেছিল হাত। আয়নার সামনে এসে শব্দ ছাড়া আউ আউ করছিল। চাঁদের মত মরা আলো দিচ্ছিল মোমটা আয়নার ভিতর। হুইরুদ্দি তার দিকে তাকায়ে আছে। দৌড়ে বাইরে আসে। দূরে বালির উপর চাঁদ।
মকদুম ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। সে কী করবে? একবার তার মনে হল এইসব নিশ্চয় কোনো বদমাইশ জ্বিনের কারবার। তারে বিপদে ফেলতে সবকিছু করা হচ্ছে। চাঁদের আলোর আলো-ছায়া চোখে সয়ে গেলে সে দেখে হুইরুদ্দির পরণে সায়া নাই। রক্তে ভিজে আছে উঠানের মাটি। হুইরুদ্দির কি এখন নাপাক মাসিকের সময়? এতক্ষণে গায়ে কাঁটা দেয় তার। হুইরুদ্দি তো সেই কবে বালি হয়ে গেছে! আল্লাকে সজদা করতে থাকে মকদুম। চোখ বন্ধ করে ফেলে। নিশ্চয় চোখ খুললে সব ঠিক হয়ে যাবে আবার। চোখ খোলে। ঘষটাতে ঘষটাতে হুইরুদ্দি এগিয়ে আসছে তার দিকে।
আলিসগঞ্জ থেকে ভুটভুটি করে আধা ঘন্টা এলে বাস মিলে। সেই বাসে করে তিন ঘন্টা পর এই জায়গা। হিজড়াদের আস্তানা। এখানে আগেও দু-তিনবার এসেছে সে। নকল চুল নিতে বার কয়েক। আফিম, গাঁজা, ক্ষুর, মলম আগেও একবার নিয়েছে। তবে সেইবার সাহসে কুলায় নাই। এইবার যে সাহস আছে, তেমন কথা নয়। তবে এই ভয়ের চেয়েও বেশি ভয় আছে জীবনে। সে বড় জীবন ভালোবাসে। জীবন ভালোবাসে বলেই তার গাঁড়ে দম হয় নাই এই কাজটি আগে করার। একা পারবে না সে। একজনকে লাগবে। ১৮০০ টাকায় রফা হয়।
গরুর মাংস খাওয়ার ইচ্ছা হয় হেকম্যানের আজ। বিকালে গিয়ে কিনে আনে। সাত আলসার এক আলসা হেকম্যান শিলনোড়ায় মশলা বাটে। মাটির হাঁড়িতে মরিচ আর রসুন থেঁতলে দেয়। খানিক বাদে আদা। মাংসগুলোর দিকে মন দিয়ে তাকায় সে। প্রতিটা টুকরা জুড়ে লাল নদীর বওয়া এখনও ধুকপুক করছে। নলির হাড়গুলাতে চাঁদের হলুদ। সাদা চর্বি জুড়ে কী নরম পিছলে যাওয়া! জিভে জল আসছে তার। দূরে বিকালের বালি। এইসব ছাড়ি চলে যেতে হলে জীবনের কি কোনো মানে আছে? এটা মনে হতেই তার মনে হয় এইসব নিয়ে কোতল হয়ে গেলে কি জীবনের মানে থাকে? সাঁঝ লাগতে শুরু করেছে। হিজড়াটা এসে গেছে। হাঁড়িতে পেঁয়াজ দিয়ে কষিয়ে কষিয়ে পেকে উঠছে মাংস। ঘুমিয়ে গেছে এই চর। হুইরুদ্দির শাড়ি বের করে আনে গোলাপ আঁকা তোরঙ্গ থেকে হেকম্যান। আফিমের নেশায় পরচুলা পরতে বেগ পেতে হয় তাকে। ১৮০০ টাকা দিয়ে কাম’টা করতে নিয়ে আসা হিজড়াটা জল গরম করে ক্ষুর ফুটাচ্ছে। পাশে স্পিরিটের বোতল। আবার আফিম নেয় হেকম্যান। চাঁদের মৃদু আলোয় বালি চিকচিকায়। ক্ষুরও।
মকদুম বেজায় ভয় পাচ্ছে। হুইরুদ্দি বেওয়া হেকম্যানের গলায় কান্না করছে ক্যান! হুইরুদ্দির চোখের দিকে তাকায়ে কেমন বেকুব হয়ে আছে মকদুম। খানিক দূরে একলা হয়ে আকাশপানে সপ্তর্ষিমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে আছে খানিক তরল লেগে থাকা খোলা এক শিশি। আরো খানিকটা দূরে তরমুজের ক্ষেতে রক্ত মেখে শুয়ে আছে এক ক্ষুর। আরো খানিক দূরে কাঁটাতার। এইসবের চেয়ে অনেক দূরে নিজের বিল থেকে ইঁদুর ধরতে বার হয়েছে বিশাল এক গহুমা সাপ।