পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় কি আমাদের সার্গিও মোরো ?

  • 05 March, 2024
  • 0 Comment(s)
  • 1272 view(s)
  • লিখেছেন : সুমন ভট্টাচার্য
আমরা যদি একবার হাইকোর্টের এজলাসে বসে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিভিন্ন মন্তব্য, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে রাহুল গান্ধীকে আক্রমণের বিষয়টিকে মাথায় রাখি, তাহলে একমাত্র ব্রাজিলের সার্গিও মোরোর বিচারব্যবস্থাকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির উদাহরণই মনে পড়বে। এবং তাঁকে নিয়ে কলকাতার তথাকথিত প্রথম শ্রেণির সংবাদমাধ্যম এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলির উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করার সময় খেয়াল ছিল না অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এই কথাগুলি আইনের এক্তিয়ার মেনে বলছেন না নিজেকে ‘মসিহা’ বলে তুলে ধরার চেষ্টায় ক্রিজের বাইরে গিয়ে খেলছেন।

সার্গিও মোরো আর অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের মধ্যে মিল কোথায়? ব্রাজিলের এই বিচারপতির মতোই অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ও তথাকথিতভাবে ‘দুর্নীতি’র বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। মোরোর নিশানায় ছিল ব্রাজিলের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট লুলা এবং তাঁর দল সেদেশের ‘ওয়ার্কার্স পার্টি’। ঠিক যেমন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের নিশানা পশ্চিমবঙ্গের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস এবং তার দুই শীর্ষ নেতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ব্রাজিলের দক্ষিণপন্থী মিডিয়া ২০১৬ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত লাগাতার প্রোপাগান্ডা চালিয়ে সার্গিও মোরোকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘আইকন’ হিসেবে তুলে ধরেছে। ঠিক যেমন আমরা অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে ‘বাজারি’ মিডিয়াকে, তাদের সংবাদপত্র, চ্যানেল, পোর্টাল দিয়ে করতে দেখেছি। এই বঙ্গের প্রোপাগান্ডা মেশিনে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় ফ্যাশন মডেলিংয়ের জন্য শ্যুট করলেও খবর হয়েছে, রায়দানের মধ্যে তিনি শুকনো মুড়ি খেলেন না চা-মুড়ি খেলেন তা নিয়েও প্রচারের ঢক্কানিনাদ চলেছে। ব্রাজিলে, লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় অর্থনীতিতে যেহেতু লুলা সমাজতান্ত্রিক এবং বামপন্থীদের নেতা বলেই পরিচিত, সেখানকার বামপন্থী এবং প্রগতিশীলরা বারবার সতর্ক করে দিয়েছিলেন যে সার্গিও মোরোর এই ‘দুর্নীতি দমন অভিযান’-এর পিছনে আসলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ’, ব্রাজিলের থেকে শিক্ষা নিয়ে বঙ্গজ কমিউনিস্টরা, বিশেষ করে ভট্টাচার্য-চট্টোপাধ্যায়-বন্দ্যোপাধ্যায়রা অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে ‘মসিহা’ বলে তুলে ধরার সময় খেয়াল রাখেননি আসলে তিনি ‘আইকন’ তৈরি হলে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সুবিধা হবে কি না! তৃণমূল যদি একেই ‘বাম-রাম’-এর জোট বা সেটিং বলে তাহলে দোষ দেওয়া যায় কি?

ব্রাজিলে, আমরা যে দেশটিকে ফুটবলের দেশ বলে চিনি, দক্ষিণ আমেরিকার সেই দেশে ২০১৮-র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঠিক আগে মোরো লুলা এবং তাঁর সহযোগীদের জেলে পাঠিয়ে দেন। সেদেশের জনপ্রিয় প্রেসিডেন্টের ওপরে এমনভাবে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় যাতে লুলা ২০১৮-র প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়তে না পারেন। সেই ফাঁকতালে বোলসেনেরো দক্ষিণপন্থীদের প্রতিনিধি হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতে যান। এবং অবশ্যই, অবশ্যই সার্গিও মোরো বোলসেনেরোর আইনমন্ত্রী হন। লাতিন আমেরিকার অতি দক্ষিণপন্থী এবং একনায়ক হওয়ার পথে এগিয়ে যাওয়া বোলসেনেরো এবং ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে গভীর সখ্যতা রয়েছে। করোনা অতিমারির সময় বোলসেনেরো এবং নরেন্দ্র মোদি একে অপরের প্রশংসা করেছেন। তাহলে বোলসেনেরো যেভাবে সার্গিও মোরোকে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন, ভারতবর্ষের দক্ষিণপন্থী নেতা নরেন্দ্র মোদি যদি সেই একই কৌশল অবলম্বন করে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো ‘পদত্যাগী’ বিচারপতিদের জিতিয়ে আনেন তাহলে আমরা কি ‘ফ্যাসিবাদ’-এর চেনা চেহারা বা বিচারব্যবস্থাকে ‘কিনে নেওয়া’র প্রবণতাকে চিহ্নিত করতে পারব?

সুপ্রিম কোর্টের বিখ্যাত আইনজীবী এবং বহু সামাজিক আন্দোলনের নেতা প্রশান্ত ভূষণ এর আগে সতর্ক করেছিলেন যে, কীভাবে আরএসএস এবং বিজেপি বিচারব্যবস্থাকে কবজা করতে চাইছে। আবার যদি লাতিন আমেরিকার ব্রাজিলে ফিরি তাহলে দেখব ২০২২-এর নির্বাচনের আগে সেদেশের সর্বোচ্চ আদালত পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয় যে, লুলার বিরুদ্ধে সার্গিও মোরোর সমস্ত রায়ই রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট ছিল। লুলা আবার নির্বাচনে লড়ার অধিকার ফিরে পান এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রত্যাশা মতোই বোলসেনেরোকে হারিয়ে দেন। বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি এবং কারচুপির অভিযোগ থেকে বাঁচতে প্রথমে আমেরিকায় পালিয়ে যান। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার তদন্তে দেখা গিয়েছে যে, ২০১৬ থেকে ২০১৮, অর্থাৎ ব্রাজিলের আগের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে পর্যন্ত দক্ষিণপন্থী নেতা বোলসেনেরো, বিচারপতি হিসেবে সার্গিও মোরো এবং তদন্তকারী সংস্থার অনেকেই আসলে এক বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অংশীদার ছিলেন। যেটা হওয়া উচিত না, বিচারপতি হিসেবে সার্গিও মোরো দিনের পর দিন সেটাই করে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ তদন্তকারী সংস্থাগুলির সঙ্গে গোপনে বৈঠক করে তিনি তাদের বলতেন কী ধরনের তথ্যপ্রমাণ তাঁর আদালতে দেখালেই তিনি কী ধরনের শাস্তির ঘোষণা করবেন। এর সঙ্গে জুড়েছিল ব্রাজিলের অতি দক্ষিণপন্থী মিডিয়াগুলির প্রোপাগান্ডা। ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্ট পরবর্তীকালে লুলা এবং তাঁর সহযোগীদের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা কারাবাসের রায় বাতিল করার সময় বলেছিলেন, সার্গিও মোরো এমন অনেক বিষয়ে রায় দিয়েছেন যা তাঁর এক্তিয়ারের মধ্যেই ছিল না।

আমরা যদি একবার হাইকোর্টের এজলাসে বসে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিভিন্ন মন্তব্য, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে রাহুল গান্ধীকে আক্রমণের বিষয়টিকে মাথায় রাখি, তাহলে একমাত্র ব্রাজিলের সার্গিও মোরোর বিচারব্যবস্থাকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির উদাহরণই মনে পড়বে। এবং তাঁকে নিয়ে কলকাতার তথাকথিত প্রথম শ্রেণির সংবাদমাধ্যম এবং টেলিভিশন চ্যানেলগুলির উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করার সময় খেয়াল ছিল না অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এই কথাগুলি আইনের এক্তিয়ার মেনে বলছেন না নিজেকে ‘মসিহা’ বলে তুলে ধরার চেষ্টায় ক্রিজের বাইরে গিয়ে খেলছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঠিকই ঝুলি থেকে বেড়াল বেরোল। অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টাকে সামনে এনে দিলেন।

0 Comments

Post Comment