পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

স্কুল খোলা বিষয়ক দু একটি কথা যা আমি বলতে চাই

  • 09 October, 2021
  • 0 Comment(s)
  • 1453 view(s)
  • লিখেছেন : সুমন কল্যাণ মৌলিক
জুলাই(২০২১) এর শেষদিকে পৃথিবীর ১৭৫ টি দেশে স্কুল পুরোমাত্রায় খুলে গেছে। ফ্রান্স,পর্তুগাল, ডেনমার্ক, জাপান সহ পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে অতিমারীর সময় (২০২০) স্কুল বিশেষ করে প্রাথমিক স্কুল হয় পুরো খোলা থেকেছে অথবা সামান্য দিনের জন্য বন্ধ থেকেছে। পৃথিবীতে ভারতই একমাত্র দেশ যেখানে কোভিড অতিমারীর কারণে সবচেয়ে বেশি দিন স্কুল বন্ধ রয়েছে। ইউনেস্কোর খতিয়ান অনুসারে একমাস স্কুল বন্ধ থাকার অর্থ দু মাসের পড়াশোনা ক্ষতি।

সময়টা সম্ভবত ১৯৯৮। স্কুলের চাকরিতে ততদিনে মন বসিয়ে ফেলেছি। একদিন কমন রুমে বসে আছি, হন্তদন্ত হয়ে ক বাবুর প্রবেশ। আমাদের মত তরুণ শিক্ষকদের নিয়মিত নানা বিষয়ে জ্ঞান দেওয়াটা তিনি তাঁর দায়িত্ব বলেই মনে করেন। কমনরুমে ঢুকেই ইষৎ কাঁধ ঝাঁকিয়ে আমাদের বলে উঠলেন, যাও এইট বি তে, দ্যাখো কি কান্ড! আমাদের মধ্যে একজন চট করে ক্লাস থেকে ঘুরে এসে জানালো অঙ্ক ক্লাসে খ বাবু বোর্ডে বীজগণিতের একটা সমাধান করেছেন যেখানে উত্তরটা ভুল লেখা হয়েছে। সেটা তিনি সম্ভবত খেয়াল করেন নি, তাই বোর্ডে সেই ভুলটাই শোভা পাচ্ছে। ক বাবুর এই নাটুকেপনা দেখে রীতিমত বিরক্ত হয়ে বলে উঠলাম, ভুল তো মানুষ মাত্রেই হতে পারে। মুচকি হেসে ক বাবু বলে উঠলেন এটা ভুল নয়। খ বাবুর পক্ষে এটাই স্বাভাবিক কারণ তিনি ৭২ সালে পাশ করেছেন। সে বছর সবাই না কি গণ টোকাটুকি করে পাশ করেছিল, আদৌ কিছু জানে না। চমকে উঠেছিলাম। অথচ আমরা সবাই জানি খ বাবু ছাত্রদের খুব যত্ন করে অঙ্ক করান। আসলে এইভাবেই একটা নির্দিষ্ট ব্যাচ ( প্রজন্ম?) কোন কারণ ছাড়াই এই কালিমাটা বহন করে চলে।

এই করোনা কালে যখন দীর্ঘ সময় স্কুল বন্ধ, ছেলে মেয়েরা বিনা পরীক্ষায় পরের ক্লাসে উত্তীর্ণ হতে বাধ্য হচ্ছে, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায় নানা ধরণের অবৈজ্ঞানিক ও অপরীক্ষিত মাপকাঠিতে এবং কিছুটা গোঁজামিল দিয়ে তাদের মূল্যায়ণ পত্র তৈরি হচ্ছে তখন ক বাবুর সেই ঘটনাটা আবার মনে পড়ে গেল। আজ এই ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রাম লাঞ্ছিত সময়ে যে কুৎসিত মিম ও মন্তব্য চারিদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে আমাদের কারণে একটা গোটা প্রজন্ম বিপন্ন হয়ে পড়ছে।মিমে দেখা যাচ্ছে একটা ব্রিজ ভেঙে পড়ে আছে,আর তার পাশে দাঁড়িয়ে একজন মন্তব্য করছেন ইঞ্জিনিয়ার নিশ্চিত ভাবে কোভিড ব্যাচ। এই রকম শত সহস্র মিম বাজারে ঘুরছে। ইতিমধ্যে বেসরকারি ব্যাঙ্ক এইচডিএফসির একটি আঞ্চলিক শাখার বিজ্ঞাপন নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে যাতে বলা হয়েছিল চাকরির ইন্টারভিউতে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে পাশ করা কোন স্নাতক অংশ নিতে পারবে না। বিজ্ঞাপনটি চারদিকে সমালোচনার কারণে প্রত্যাহৃত হলেও এটা নিশ্চিত ভাবে আগামী সংকটের সূচক। এই অসংবেদনশীল মিম বা চারিদিকে সব হাহুতাশ দেখলে কে বলবে বিগত একবছর ধরে এই তথাকথিত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটা বড়ো অংশ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্কুল বন্ধ রাখার পক্ষে সওয়াল করেছে,পরীক্ষা বন্ধ করার উদ্দেশ্য কয়েক লক্ষ মানুষের সই সংগ্রহ করে মাস পিটিশন করেছে, এমনকি দেশের সর্বোচ্চ আদালতে আর্জি পেশ করেছে যাতে পরীক্ষা বন্ধ করা যায়। আমি খুব সচেতন ভাবেই ‘মধ্যবিত্ত' শব্দটা ব্যবহার করেছি। কারণ একথা সবার জানা যে নব্বই এর দশকে আন্তর্জাতিক অর্থ লগ্নী সংস্থাগুলোর অভিভাবকত্বে ভারতে যে সংস্কার নীতি চালু হয় তাতে উচ্চ ক্রয় ক্ষমতা সম্পন্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম হয় যারা বর্তমানে যাবতীয় সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আখ্যানের জন্মদাতা ও নিয়ন্ত্রক। এরা ভেবেছিল রামা কৈবর্ত বা হাসেম শেখের ছেলে গোল্লায় যাক, টাকার জোরে তারা অনলাইন শিক্ষাকে গ্রহণ করতে পারবে। তবে যেভাবে তথাকথিত দামি স্কুলের শিক্ষার্থী ও সরকারি স্কুলের মিড ডে মিল খেয়ে বড়ো হয়ে ওঠা শিক্ষার্থীর পরীক্ষার ফলাফল এবার এক হয়ে গেছে তাতে পুরো বিষয়টা ঘেঁটে ঘ হয়ে গেছে।

আমরা যদি অতিমারী কালে প্রকাশিত বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির শিক্ষা বিষয়ক প্রতিবেদন গুলি লক্ষ্য করি তাহলে দেখব মোটের উপর ছবিটা একই রকম। জ্যঁ দ্রেজদের 'Locked Out' শীর্ষক প্রতিবেদন বা আজিম প্রেমজি ফাউন্ডেশনের 'Loss of learning during the Pandemic' বা প্রথম ফাউন্ডেশনের 'Annual status of Education Report-2020'-- শিক্ষার এক সার্বিক অধোগমনের ছবিকে তুলে ধরেছে।প্রতিবেদনগুলি ইতিমধ্যেই বহু আলোচিত তাই আলাদা করে উল্লেখ করছি না।সমস্ত প্রতিবেদনগুলির সারকথা হল -- প্রথমত ভারতের স্কুল শিক্ষায় অনলাইন ক্লাস সুপারফ্লপ। অ্যান্ড্রয়েড ফোন ও ডেটা কেনার অক্ষমতার কারণে সংখ্যাগরিষ্ট শিক্ষার্থী পড়াশোনার বাইরে থেকে গেছে। দ্বিতীয়ত ইউনিসেফের প্রতিবেদন (জুন-২০২০) অনুসারে স্কুল বন্ধের প্রভাব প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের ২৪ কোটি ৭০ লক্ষ শিক্ষার্থীদের মধ্যে অত্যন্ত নেতিবাচক। ইতিমধ্যে কোভিড অতিমারী জনিত শিক্ষা বিপর্যয়ের কারণে ৬০ লক্ষ শিক্ষার্থী শিক্ষার আঙিনার বাইরে চলে গেছে। তৃতীয়ত সমস্ত প্রতিবেদনে একথা পরিষ্কার বলা হয়েছে দীর্ঘ দিন স্কুল বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা আগে যা শিখেছিল তার বেশিটাই ভুলে গেছে। চতুর্থত কিছু রিপোর্টে মিড ডে মিলে রান্না খাবার না পেয়ে শিশুরা অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। এই ছবিটা অন্যরকম হওয়ার কথা ছিল না। টানা স্কুল বনধ রেখে এবং অনলাইন ক্লাস ও নাম কা ওয়াস্তে শিক্ষার্থীদের বাড়িতে অ্যাক্টিভিটি টাস্ক পাঠিয়ে সরকার যদি তার দায় সারে তবে শিক্ষার এই বিপর্যয় স্বাভাবিক ঘটনা।

এই পরিস্থিতিতে এক ও একমাত্র উপায় হল অতি দ্রুত স্কুল খোলার ব্যবস্থা করা। স্কুল খোলার কথা উঠলেই যারা হৈ হৈ করে ওঠেন তাদের পরিষ্কার করে বলার দরকার সাধারণভাবে একজন শিশুর একজন প্রাপ্তবয়স্কের তুলনায় কোভিডে ১০০-৮০০০ গুণ কম সংক্রামিত হওয়ার সম্ভাবনা। ব্রিটেনের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সমীক্ষা অনুসারে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কয়েকলক্ষ শিশুর মধ্যে এই সমীক্ষা করা হয়েছে) যে সাধারণ ফ্লুতে শিশুর সংক্রমণের সম্ভাবণা যত, কোভিড সংক্রমণের সম্ভাবনা তার অর্ধেক। ইদানীং যারা কথায় কথায় ইউরোপ ও আমেরিকার উদাহরণ দেন তাদের উদ্দেশ্যে সবিনয়ে বলি খোদ ইউনিসেফের এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর হেনরিয়েট্টা ফোর ও ইউনেস্কোর ডাইরেক্টর জেনারেল অ্যান্ড্রে আজাউলে সম্প্রতি একটি বিবৃতি দিয়েছেন যার শিরোনাম ছিল -'Reopening schools can not wait'। অবিলম্বে স্কুল খোলার পক্ষে সওয়াল করতে গিয়ে এই বিবৃতিতে স্পষ্ট ভাষায় ( ১২ জুলাই ২০২১) - 'This should not go on, schools should be the last to close and the first to reopen'। এটা কোন নতুন ভাবনাও নয়। জুলাই(২০২১) এর শেষদিকে পৃথিবীর ১৭৫ টি দেশে স্কুল পুরোমাত্রায় খুলে গেছে। ফ্রান্স,পর্তুগাল, ডেনমার্ক, জাপান সহ পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশে অতিমারীর সময় (২০২০) স্কুল বিশেষ করে প্রাথমিক স্কুল হয় পুরো খোলা থেকেছে অথবা সামান্য দিনের জন্য বন্ধ থেকেছে। পৃথিবীতে ভারতই একমাত্র দেশ যেখানে কোভিড অতিমারীর কারণে সবচেয়ে বেশি দিন স্কুল বন্ধ রয়েছে। ইউনেস্কোর খতিয়ান অনুসারে একমাস স্কুল বন্ধ থাকার অর্থ দু মাসের পড়াশোনা ক্ষতি। তার মানে গত ১৭ মাস স্কুল বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের ৩৪ মাস পড়াশোনা নষ্ট হয়েছে।একথা মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে স্কুলগুলি বন্ধ করার সমর্থনে জনমত তৈরির পরিকল্পিত প্রয়াস রয়েছে। এর সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ হল তৃতীয় ঢেউ আসছে এবং তাতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হবে শিশুরা -- এই মর্মে একটি প্রচার যা তিনমাস আগে সব ধরণের মিডিয়াতে ব্যাপক ভাবে প্রচারিত হয়।কিন্তু কোন তথ্যের ভিত্তিতে এই ভবিষ্যৎ বাণী করা হল বা কোন্ এজেন্সি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন, তাদের নাম আজ পর্যন্ত জানা গেল না। কিন্তু অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্কুল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত মান্যতা পেল।

আশার কথা হল রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারগুলি চূড়ান্ত অপদার্থতা দেখালেও সময়ের দাবিকে উপলব্ধি করে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও অধিকার সংগঠন স্কুল খোলার দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন। কোভিড সুরক্ষা বিধি বজায় রেখে স্কুল খোলার হাজার উপায় আছে। শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের টীকাকরণ প্রায় সম্পূর্ণ। যথাযথ দূরত্ব বিধি, রোটেশনাল ক্লাস,স্যানিটেশনের ব্যবস্থা নিয়ে স্কুল খোলা সম্ভব। আসুন এই দাবিতে আমরা সোচ্চার হই।

0 Comments

Post Comment