পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

এই অবস্থা থেকে বেরনোর জন্য চাই ছোট ছোট ঘরোয়া আলোচনা

  • 27 May, 2019
  • 0 Comment(s)
  • 2247 view(s)
  • লিখেছেন : সুমন সেনগুপ্ত
শঙ্কিত সংখ্যালঘুর পাশে দাঁড়ানোর সময় এখন। দেশের এই ঘোর বিপদে আসুন তার পাশে থাকার চেষ্টা করি নিরন্তর। তার সঙ্গে মিলতে হবে সহজ করে। সেই পথেরই ইঙ্গিত দিয়েছেন সুমন সেনগুপ্ত।

ঘটনা ১:

আজকাল এক সমস্যা হয়েছে সুফি, আজান, কবীর, আরশিয়াদের। এদের কারো বয়স ৬, কারো ১৫ আবার কারো ৮। সমস্যাটা জটিল। সমস্যাটা মূলত স্কুলে। এদের বন্ধুরা মনে করে এরা পাকিস্তানি— আসলে মুসলমান। এদের নামটাই এই সমস্যার জন্য দায়ি। এদের মা-বাবারা যখন এই নামগুলো রেখেছিলেন তখনও ভারত নামের এই দেশটায় ঘৃণা বিদ্বেষ থাকলেও এই পরিমাণে তা প্রকাশ পেত না। ফলে সমস্যাটা এত জটিল ছিল না। কিন্তু ইদানীং সমস্যাটা গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্কুলে বন্ধুরা এদের সঙ্গে মিশতে চায় না, ভালভাবে কথা বলতে চায় না। সেই নিয়ে এই বাচ্চারা যথেষ্ট খারাপ আছে। কেউ কেউ তো তাঁদের মা-বাবার কাছে অভিযোগও করেছে। মা-বাবারা তাঁদের সাধ্যমতো স্কুলে কিংবা নিজেদের বাচ্চাদের সঙ্গে কথাও বলেছেন। আসলে রোগটা অনেক গভীরে।

ঘটনা ২:

কলকাতার সন্তোষপুরে বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্তের বাস। বেশ বড় জায়গা। সেখানে একটা অতিথিশালা বা গেস্ট হাউস তৈরি হয়েছে। মূলত মুসলমান কিছু মানুষজন মিলে জমি কিনে ৩ তলা বাড়ি বানিয়েছেন। সেখানে মাঝে মধ্যে এসে থাকেন যাঁরা, তাঁরা মূলত চিকিৎসা করানোর জন্য আসেন। কেউ বাংলাদেশী বা কেউ রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা মুসলমান নামুষ। থাকার জায়গা নিয়ে সমস্যা আগেও ছিল এখনও আছে। তাই এই অতিথিশালাতে সবসময়েই কেউ না কেউ থাকেন কিছুদিনের জন্য, আবার চলে যান। ইদানিং এই অতিথিশালা নিয়ে ছোটখাট সমস্যার কথা শোনা যাচ্ছে। পাড়ার অন্যান্যরা যারা আশেপাশে থাকেন তাঁরা অভিযোগ করছেন, কেন মুসলমানেরা এই অঞ্চলে থাকবে। ‘মুসলমান মানেই তো সন্ত্রাসবাদী, ওরা ক্রমশ সংখ্যায় বাড়বে’ আর হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে। ফলে বাঙালি মধ্যবিত্ত হিন্দু প্রতিবেশীরা সই সংগ্রহ করছেন যাতে কোনোভাবে এই অতিথিশালা বন্ধ করে দেওয়া যায়।

ঘটনা ৩:

দমদমের একটি আবাসন। মূলত উচ্চ মধ্যবিত্ত হিন্দু বাঙালি এবং অবাঙালিদের বাস। অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে আছেন। একসঙ্গে মিলে মিশে দুর্গাপুজো, কালীপুজো করেন। কিন্তু ইদানীং একটা ছন্দপতন ঘটেছে। কোনও একটি খালি ফ্ল্যাটে একটি মুসলমান পরিবার ভাড়া এসেছে। তাই নিয়ে শুরু হয়েছে গুঞ্জন। এই আবাসনে তো আগে কোনোদিন মুসলমান থাকত না তাহলে এখন কেন? যে বা যারা এই প্রশ্নগুলো করছেন তাঁদের মধ্যেও ওই একই ধারণা যে মুসলমান মানেই অন্যরকমের মানুষ, তাঁদের যেন রক্তের রঙটা আলাদা, সুতরাং তাঁরা কিছুতেই হিন্দুদের প্রতিবেশী হতে পারেন না। সুতরাং তাঁদেরকে উৎখাত করতে হবে।

ঘটনা ৪:

গুরগাওয়ে একটি মুসলমান ছেলেকে আক্রমণ করা হল ক্রিকেট খেলার অপরাধে। সেই ছেলেটির পরিবারের মানুষজনদেরও আঘাত করা হল। ভাঙচুর করা হল বাড়ি ঘর। বলা হল পাকিস্তান চলে যেতে। পরিবারটি পুলিশে অভিযোগ জানানোর পর উল্টে প্রশাসন থেকে বলা হল অভিযোগ তুলে নিলেই তাঁরা গুরগাওতে থাকতে পারবেন।

এই রকম অজস্র ঘটনা হয়তো একটু কান পাতলেই ইদানীং শোনা যাবে। যা হয়তো ৭-৮ বছর আগেও শোনা যেত না। শেষ ঘটনাটির দিকে নজর দিলে স্পষ্ট বোঝা যাবে কিভাবে প্রশাসনের মধ্যেও মুসলমান বিদ্বেষ বা বলা ভালো একটা বিশেষ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও বিদ্বেষ ধীরে ধীরে প্রবেশ করানো হয়েছে।

২০১৪ সালের নির্বাচনের পরবর্তীতে ভারতে একটা ধারণা সুচতুর ভাবে তৈরি করানো হয়েছে যে মুসলমানেরা আমাদের শত্রু। এটা করার জন্যেও একটা কৌশল নেওয়া হয়েছে, তাতে ঘটনাচক্রে বিরোধী দলগুলোও জেনে অথবা না জেনে সামিল হয়ে গেছে। ক্রমশ ভারতের নির্বাচনে মুসলমান প্রতিনিধিত্ব কমে এসেছে। যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী এবারের নির্বাচনে বিরোধী দলনেতার কেরালার ওয়েনার থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করাকে কটাক্ষ করে বলেন যে, ওই কেন্দ্রে যেহেতু সংখ্যালঘুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ তাই ওই কেন্দ্র বাছাই করা হয়েছে, তখন বেশীরভাগ নাগরিক চুপ থাকেন। কেউ প্রশ্ন করেন না উল্টে যে মুসলমানেরা কি সংবিধান অনুযায়ী ভারতীয় নন, নাকি তাঁরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক? তাহলে কি বেশীরভাগ ভারতের নাগরিকও এমনটাই মনে করেন? তারপরেও কি সংখ্যালঘু মানুষ ভালো আছে? এমন একটা রাতও কি তারা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে কাটিয়েছে? যারা পেহেলু খান, আখলাখদের হত্যা করে তাদেরই যদি জাতীয় নায়কের মর্যাদা দেওয়া হয় তখন কি ভারতের সংবিধান স্বীকৃত সহনাগরিকেরা ভাল থাকতে পারে? যখন গুজরাট দাঙ্গায় মূল অভিযুক্তদের নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হয়, যখন বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়া সত্ত্বেও স্বাধ্বী প্রজ্ঞার মতো ব্যক্তিকে সংসদে পাঠানোর জন্য ভুপাল থেকে টিকিট দেওয়া হয় তখন তা মুসলমানদের ভয় পাওয়ানো ছাড়া আর কি? এমন ভারতের স্বপ্ন কি আমরা দেখতে পারি না যেখানে প্রতিটি নাগরিকের ধর্মচর্চা করার এবং না করার অধিকার পাশাপাশি থাকবে?

শুধুমাত্র রাজনৈতিক মিটিং মিছিল করলেই কি এই সমস্যা মিটবে? নিশ্চয়ই না। প্রতিবেশী মুসলমান মানুষজন কি খাচ্ছেন, কি পড়ছেন, কি উৎসব পালন করছেন এটা জানাটা জরুরি নয় কি? অনেকে বলে থাকেন রাজনৈতিক দলেরা এগুলো করাচ্ছে, কিন্তু তা কি করে সম্ভব, যদি না মনের ভেতরে ঘৃণা বিদ্বেষ থাকে? ভিতরে আছে বলেই বাইরের শক্তি অনুঘটকের কাজ করতে পারছে। বাইরের শক্তি সাম্প্রদায়িকতার পালে হাওয়া লাগাতে পারছে। আমরা চিরকাল আমাদের স্বেচ্ছাবৃত্ত অজ্ঞতা দিয়ে অন্য ধর্মের মানুষদের দূরে সরিয়ে রেখেছি। সেখান থেকে তৈরি হয়েছে অবিশ্বাস আর তারপর বেড়েছে দূরত্ব। আর এই দূরত্বের ফোকর গলে ঢুকে পড়েছে ঘৃণা ও বিদ্বেষ।এই ঘৃণা ও বিদ্বেষ হয়তো অন্তর্নিহিত ছিল কিন্তু এই অপরিচয় আমাদের মধ্যেকার পাঁচিলটাকে আরও পাকাপোক্ত করেছে।

এই অবস্থা থেকে বের করার জন্যপ্রয়োজন ছোট ছোট ঘরোয়া আলোচনা, যার মধ্যে দিয়ে মানুষে মানুষে যোগ তৈরি করা যায়। তাহলেই হয়তো সত্যের ভোর আসবে একদিন, স্বপ্নের ভোর আসবে একদিন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, ‘ধর্মমত ও সমাজরীতির সম্বন্ধে শুধু প্রভেদ নয়, বিরুদ্ধতা আছে, এ কথা মানতেই হবে। অতএব আমাদের সাধনার বিষয় হচ্ছে, তৎসত্ত্বেও ভালো রকম করে মেলা চাই।’ এই ঘৃণা বিদ্বেষ ইন্ধনকারী সরকার চলে যাবে না থাকবে সেটা আগামী দিন বলবে। কিন্তু নিরলস প্রচারের কাজটা করেই যেতে হবে। যার থাকবে শুধু নতুন বন্ধু পাওয়ার আনন্দ, নতুন মানুষের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আকাঙ্খা। যে মানুষটির পাশাপাশি দীর্ঘদিন হাঁটছি কিন্তু কথা বলিনি কোনোদিন, মিশে দেখিনি সেই মানুষকে ছোঁয়ার আনন্দ। তাকে ছুঁতে হবে।

0 Comments

Post Comment