ইতিহাসের এক বিরল মূহুর্তের ছবি দেখাচ্ছে এই মুহুর্তে লাদাখ। জম্মু কাশ্মীরকে পৃথক রাজ্য ও লাদাখকে ষষ্ঠ তপশিলে অন্তর্ভুক্তি এবং হিমালয়ের জীববৈচিত্র বাঁচানো ও জনজাতিদের স্বাভাবিক জীবন যাপনের অধিকার বজায় রাখতে দীর্ঘদিন ধরেই লড়াইয়ের পথে রয়েছেন লাদাখের মহিলা যুব ছাত্র সমাজ ও বৌদ্ধ ভিক্ষুকরা। এই লড়াইয়ের সামনের সারিতে রয়েছেন বিশিষ্ট পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানী সোনম ওয়াংচুক। সোনম ওয়াংচুক পরিবেশ আন্দোলনে শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত এক নাম। যে আন্দোলন তিনি গড়ে তুলেছেন লাদাখে, তা অন্য অঞ্চলের পরিবেশ আন্দোলনকেও শক্তিশালী করবে, হিমালয় ছাড়িয়ে সে বার্তা পৌঁচচ্ছে দেশে-দেশে। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অবদমিত গণতান্ত্রিক অধিকারকে মুক্ত করার দাবী তাঁরা তুলেছেন। কর্পোরেট স্বার্থে নয়, লাদাখের মানুষের স্বার্থে পরিবেশ উপযোগী উন্নয়নের অধিকার নিশ্চিত করার জন্যই তাঁরা গণতান্ত্রিক শাসনের অধিকার চাইছেন। অথচ পূর্ব-প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার সংবেদনহীন ও সম্পূর্ণ নীরব। এই আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে পরিবেশ-গণতন্ত্র-সংবিধানের আন্তর্সম্পর্ক উপস্থিত হচ্ছে দেশ জুড়ে। লাদাখে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন জারি আছে কার্গিল ডেমোক্র্যাটিক আল্যায়েন্স, লেহ এপেক্স বডি ও সোনমজীর নেতৃত্বে হাজার হাজার সাধারণ লাদাখবাসীকে সাথে নিয়ে। সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা লড়াইয়ের মাঠ ছাড়বেন না বলে ঘোষণা করেছেন। মনে রাখতে হবে, হিমালয় যুক্ত হয়ে আছে ভারতের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে এবং সমগ্র দেশের জলবায়ু ও ঋতুচ্ছন্দের উপর তার গভীর প্রভাব অবিংসবাদিত। তাই এই আন্দোলনের সমর্থনে দেশের নানা প্রান্তে পরিবেশ সংগঠন, সামাজিক আন্দোলনের সংগঠন সহ প্রচুর মানুষ জুড়ে যাচ্ছেন, পথে নামছেন। এই আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত হয়েছে 'ফ্রেন্ডস অফ হিমালয়া' যা হিমালয়ে অবস্থিত পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের পঞ্চাশটির বেশী সংগঠনের যৌথ মঞ্চ। হিমালয়কে রক্ষা করতে আজ সকলে মিলেই আওয়াজ তুলছেন।
শান্ত নিরীহ অতিথি পরায়ন লাদাখবাসী কেন আন্দোলনের পথে:
লা মানে গিরিপথ আর দাখ মানে দেশ, ঘন নীল আকাশের পটভূমিকায় ভেসে থাকা সাদা মেঘের সোনালি, হলুদ বাদামি রঙের পর্বতের সারির মাঝখান দিয়ে কাশ্মীর, হিমাচলপ্রদেশ, আর তিব্বতের দিক থেকে অসংখ্য গিরিপথ এসে পৌঁছেছে লাদাখের নানা নদী উপত্যকায়৷ গিরিপথের দেশ লাদাখ প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যে ভরপুর। অসংখ্য উচ্ছ্বল স্রোতধারা মিশে গড়ে ওঠা নদী, পর্বতের গায়ে ঝুলে থাকা গুম্ফা, নীল জলের সুবিশাল হ্রদের বিস্তার আর সহজ সরল মানুষদের অতিথিপরায়নতা লাদাখের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। পাকিস্তান ও চীনের সীমান্তবর্তী এলাকায় লাদাখ উপত্যকা ১৫০০০ ফুট উপরে অবস্থিত। এখানে বছরে ৩০০ দিনেই সূর্যালোকের কোন অভাব ঘটে না। কিন্তু এই উপত্যকার প্রায় ৯৭ শতাংশ অঞ্চল বৃষ্টিহীন অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। এখানে জলের উৎস একমাত্র গলিত হিমবাহের ধারা। অসমতল পাহাড়পৃষ্ঠে চাষবাসের যেটুকু জায়গা, তা প্রায়শই চাপা থাকে তুষারে, মাইনাস ৩৫°সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। এখানকার মোট জনগণের ৯০ শতাংশের বেশি আদিবাসীজন। তাঁদের জীবিকা মূলত পশুপালন, ভেড়ার লোম থেকে পাশমিনা চাদর তৈরি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নির্ভর করে কোনভাবে যাপনের ব্যবস্থাপনা।
তুষারশুভ্র পাহাড়, জঙ্গল, তৃণভূমি ও হিমবাহের দেশ লাদাখের বর্তমান প্রাকৃতিক অবস্থাটা :
প্রথমত: জনগণের প্রায় দ্বিগুণ পরিমাণ সামরিক সেনা এই উপত্যকাকে দীর্ঘদিন ধরে দখল করে রেখেছে জাতীয় সুরক্ষার নামে। স্বাভাবিকভাবেই সামরিক কার্যকলাপে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বহুগুণ বেড়ে গেছে। ফলে বায়ুদূষণ, স্থানীয় উষ্ণতা ও পরিবেশ পরিস্থিতির আকস্মিক বদল পশুপালকদের অত্যন্ত সমস্যায় ফেলেছে। দ্বিতীয়তঃ লাদাখের ‘ফে উপত্যকা’র ৫,০০০ মেগাওয়াট সৌর প্রকল্পের রূপায়ণে ৪০,০০০ একর তৃণভূমি কর্পোরেট বাহিনী দখল করে নিয়েছে। সেই বিদ্যুৎ পরিবহন ব্যবস্থাপনায় আহুতি দিতে হবে প্রায় ১৫৭ বর্গকিলোমিটার বনভূমিকে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আর একটি সমস্যা –মেষপালকরা আগে যতটা অঞ্চল পর্যন্ত যেতে পারতেন, বর্তমানে তার ১৫-২০ কিমি আগেই থমকে যেতে হচ্ছে চিনা বাহিনীর জবরদখলের কারণে। তৃতীয়ত: উষ্ণায়নের কারণে ধরিত্রীর গড় তাপমাত্রা অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বেড়ে যাওয়ার ফলে উত্তরাখন্ড, হিমাচলপ্রদেশ থেকে কাশ্মীর-লাদাখ পর্যন্ত বরফের চাদরের আস্তরণ দ্রুত গলে যাচ্ছে। বরফ আচ্ছাদিত অঞ্চলের পশ্চাদপসরণ ঘটছে অতি দ্রুত গতিতে। হিমবাহ গলে পিছিয়ে যাওয়ার ফলে নদী বিধৌত কাশ্মীর ও লাদাখ শুষ্ক মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। অন্যদিকে ভূউষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে হিমালয়ের বাস্তুতন্ত্রেও। হিমবাহ গলার পাশাপাশি বাড়ছে বৃষ্টিপাত, প্লাবন-ধস। আন্তর্জাতিক মৌসম সংস্থার গবেষণায় জানা যাচ্ছে –বিগত ১০ বছরে লাদাখে গড় বৃষ্টিপাত ৩০ মিলিমিটার থেকে বেড়ে ১৪০ মিলিমিটারে দাঁড়িয়েছে। এই বাড়তি বৃষ্টি ধারণ করার ক্ষমতা সংবেদনশীল পাহাড়ি মাটিতে নেই। চতুর্থত: কাশ্মীর ও লাদাখ অঞ্চলে সন্ধান মিলেছে লিথিয়াম সহ নানান রেয়ার আর্থ এলিমেন্টের। যার ওপর শ্যেনদৃষ্টি পড়েছে কর্পোরেট বাহিনীর। লিথিয়াম দিয়ে তৈরি হবে সৌরবিদ্যুতের ব্যাটারি। বিকল্প ও সবুজ শক্তির গালভরা প্রচারের ঢক্কা নিনাদে লুঠ হয়ে যায় হেক্টরের পর হেক্টর চারণভূমি। পঞ্চমত: ২০১৯ সালে ভারত সরকারের তরফে কাশ্মীরকে ভেঙ্গে একদিকে জম্বু কাশ্মীর, অন্যদিকে লাদাখ এই দুই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে জম্মু-কাশ্মীরে নির্বাচন প্রক্রিয়া সংঘটিত হলেও লাদাখ থেকে যায় কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবেই। দেশের সংসদে সেখান থেকে জনগণের কোন নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই। ভারত সরকার বারবার কথা দিলেও এবং ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি’র ম্যানিফেস্টোতে উচ্চকিত কণ্ঠে ঘোষিত হলেও লাদাখকে সংবিধানের ২৪৪(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ষষ্ঠ তফশিলের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। ফলত স্থানীয় অধিবাসীদের হাতে কোন প্রশাসনিক ক্ষমতা নেই। অঞ্চলের উন্নয়নের পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের স্বরূপ সম্পর্কে, সর্বোপরি হিমালয়ের জীববৈচিত্র রক্ষা করার প্রশ্নে তাঁদের মতামত দেওয়ার কোনরকম কোন সুযোগ নেই। উপরন্তু ৩৭০-এর রক্ষাকবচ তুলে দিয়ে লাদাখ ও কাশ্মীরের প্রাকৃতিক উত্তরাধিকারকে কর্পোরেটের মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত করা হল। ষষ্ঠত: ২০১৯ সালে বিজেপির নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে পরিবেশ হন্তারক বেশ কয়েকটি প্রকল্পের স্পষ্ট উল্লেখ ছিল। যেমন, গুগা উপত্যকায় জিওথার্মাল প্রকল্প, এনটিপিসি’র হাইড্রোজেন শক্তি প্রকল্প; সেয়ক, দূর্বুক, তেরিসা-থইস সহ সিন্ধু নদীর উপর সাতখানা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং উৎপন্ন বিদ্যুৎ হিমাচল প্রদেশ-পাঞ্জাব হয়ে হরিয়ানায় গ্রিডে পরিবহন করার পরিকল্পনা; স্বদেশ দর্শন-২ এর অধীনে লেহ-লাদাখ-কার্গিল এর নগরায়ন তথা পর্যটন প্রকল্প এবং সর্বোপরি বোরাক্স, গোল্ড, গ্রানাইট ও ক্যালসিয়াম কার্বনেট খনিজ উত্তোলন।
বর্তমান সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের সাথে এই প্রকল্পগুলি রূপায়িত হলে আদিবাসী মানুষজন নিজেদের জমিজমা, বাস্তুভিটে, সমাজ-সংস্কার, ভাষা, সংস্কৃতি : সবকিছুই বহিরাগত বণিক তথা দেশি-বিদেশি বহুজাতিক কর্পোরেটের লোভ, বাণিজ্য ও মুনাফার করাল গ্রাসের কাছে বন্ধক রাখতে বাধ্য হবেন। ভারত সরকারের তথাকথিত উন্নয়নী মডেলে স্থানীয় মানুষের মতামত, হিমালয় বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের ভবিষ্যদ্বাণী, কোন কিছুরই কোন মূল্য নেই। কতিপয় মানুষের কায়েমী স্বার্থে গড়ে ওঠা এই উন্নয়ন পরিকল্পনার কাঠগড়ায় হিমালয় ও হিমালয়জাত নদীর মৃত্যু সহ উপত্যকাবাবাসীর জীবনযাত্রা,জীবিকাজর্ন সমস্ত কিছুই বলিপ্রদত্ত হচ্ছে। ষষ্ঠ তফশিল বা সমতুল কোন রক্ষাকবচ না থাকলে লাদাখে কর্পোরেট মাফিয়াদের উন্নয়ন পরিকল্পনা শুধু বড় বড় হোটেল, রিসর্ট আর চার লেনের মহাসড়কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। অত্যন্ত সংবেদনশীল লাদাখে খনিজ পদার্থ উত্তোলন শুরু করলে ইতিমধ্যেই বিশ্ব উষ্ণায়ণের কুফলে আক্রান্ত পরিবেশ আরও ক্ষতিগ্রস্থ হবে। একের পিঠে আরেকটি বিপদ চক্রাকারে ঘুরেফিরে আসবে। বিপন্ন হবে তুষার চিতা, তিব্বতি এন্টেলোপ হরিণ, পাহাড়ি ছাগল, ভেড়া, চমরীগাই, পাহাড়ি মৌমাছি ও প্রজাপতির মতো অসংখ্য বিরল প্রজাতির প্রাণী ও জীববৈচিত্র। বিপন্ন হবে আমাদের ভবিষ্যতও৷
লাদাখ মূলত শীতল মরুভূমির ইকোসিস্টেম। যার ভূতাত্ত্বিক গঠন ও বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য দুই'ই দাঁড়িয়ে আছে কার্যত সুতোর উপর। সেদিকে খেয়াল না রেখে লাদাখকে দেশী-বিদেশী বৃহৎ পুঁজির মুক্তাঞ্চলে পরিণত করা হয়েছে। লেহ্কে স্মার্ট সিটির আদলে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা, মাত্রাতিরিক্ত পর্যটন শিল্পের বিকাশ, বিরাট মাপের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প কিংবা সুবিশাল সোলার পাওয়ার প্রোজেক্ট রূপায়ণ। অন্যদিকে লিথিয়ামের মতো নানান বিরল খনিজ পদার্থ উত্তোলনের জন্য খননকার্য : এসমস্তই লাদাখের মানুষ সহ সামগ্রিক প্রাণ ও প্রকৃতিকেই দাঁড় করিয়ে দিয়েছে ব্যাপক সঙ্কটের সামনে। বাধ্য হয়েই লাদাখের অধিকাংশ জনগণ লড়াইয়ের পথে।
আন্দোলন যে পথ ধরে :
সমস্যার সমাধানের দাবিতে একাধিকবার অনশন করেছেন সোনম ওয়াংচুক সহ লেহ লাদাখের অসংখ্য সাধারণ মানুষ। কেন্দ্রীয় সরকারের একগুচ্ছ প্রতিনিধির সাথে বারংবার ব্যর্থ আলোচনা, মিছিল সমাবেশ, প্রতিবাদ- প্রতিরোধ কোনকিছুতেই হয়নি সমাধান। বাড়তে থাকা বেকারত্ব, আঞ্চলিক সংস্কৃতির নিজস্বতা রক্ষা, জমির অধিকার রক্ষা, মুনাফার জন্য লাদাখের প্রকৃতি-পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে জমতে থাকা ক্ষোভ –সব মিলিয়ে লাদাখের জনগণ তীব্র রাগে জ্বলছিলেন। ধৈর্যের বাঁধ শেষ পর্যন্ত ভেঙে যায়। অক্টোবরের শুরুর দিকে হাজার হাজার লাদাখবাসী প্রতিবাদ প্রতিরোধে রাস্তার দখল নেন। কিছু ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটে। কিন্তু আলোচনায় বসে সদর্থক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে মানুষের ক্ষোভ বিক্ষোভ প্রশমিত করতে সরকারের কোন উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। গান্ধীবাদী সোনমজী বারবার করেই চাইছিলেন দুই পক্ষের সদর্থক আলোচনার মধ্য দিয়ে তাঁদের দাবিদাওয়া বাস্তবে রূপ পাক। কিন্তু সেই পথে না হেঁটে
এই আন্দোলন রুখে দিতে কেন্দ্রীয় সরকার পুলিশ ও সামরিক বাহিনী লেলিয়ে দেয়। লাঠিচার্জ, গুলি, ধরপাকড় কোন কিছুই বাদ যায়নি। এই আক্রমণে সেনাবাহিনীর এক জোওয়ান সহ চারজন নিরীহ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। শেষ পর্যন্ত সোনম ওয়াংচুক সহ আরও কয়েকজন প্রতিবাদীকে গ্রেফতার করে জেলের কুঠুরিতে পুরে রাখা হয়েছে মাসাধিকাল।
পরিবেশ আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে হিমালয় কেটে ৫-৭ মাইলের পরিবর্তে আরও বেশী পাহাড় ফাটিয়ে, কেটে লণ্ডভণ্ড করে ১০-১১ মাইল চওড়া চারধাম যাওয়ার মাখন মসৃণ রাস্তা বানানো হয়ে যায় কোন্ জাদুমন্ত্রে, তা আমাদের মাথায় ঢোকে না। আমরা বুঝে উঠতে পারিনা, নদীর স্বাভাবিক গতিপথ আটকে বা পাল্টে দিয়ে যত্রতত্র জলবিদ্যুৎ প্রকল্প করে উৎপন্ন বিদ্যুৎ কোন্ মহিমায় বিক্রি হয়ে যায় নেপাল তিব্বত ভুটান বাংলাদেশে। প্রকৃতি ও জনজীবন ধ্বংসকারী এইসব অবৈজ্ঞানিক অযৌক্তিক প্রকল্পের কারিগররা হয়ে যায় দেশসেবক! আর সোনমজীর মতো যেসব পরিবেশ কর্মীরা হিমালয়, জঙ্গল, নদী, তথা প্রকৃতি পরিবেশ রক্ষা করার উদ্যোগে নিঃস্বার্থভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তাঁদেরকেই দাগিয়ে দেওয়া হয় দেশবিদ্রোহী হিসেবে। সত্যি সেলুকাস, এ বড়ই রঙ্গ।
লাদাখবাসীর মূল দাবিগুলো কী খুব অযৌক্তিক? কী চাইছেন তাঁরা?
▫️লাদাখকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া।
▫️সংবিধানের ষষ্ঠ তফশিল অনুযায়ী বিশেষ আইনগত সুরক্ষা প্রদান।
▫️স্থানীয়দের জন্য সরকারি চাকরিতে সুযোগ ও সংরক্ষণ।
▫️লাদাখের জনজাতিদের জীবন জীবিকা এবং বৈচিত্রময় ভাষা, সংস্কৃতি, পোশাক পরিচ্ছদ রক্ষা করা।
▫️লাদাখ সহ সমগ্র হিমালয়ের জীববৈচিত্র ও বস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য রক্ষা করা।
এই দাবিগুলো কার্যত পূরণ করা সম্ভব। তাহলে সমস্যাটা ঠিক কোথায়? দাবি মানতে হলে কেন্দ্রীয় সরকারকে আদানি আম্বানীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়। সমস্যাটা ঠিক এখানেই। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আজকের যুগের প্রযুক্তি ও বাজার নির্ভর অর্থ-পুঁজির মূল চালিকাশক্তি রেয়ার আর্থ মেটিরিয়াল বা বিরল খনিজ ভান্ডারের হাতছানি। লাদাখ এমন একটি ভৌগোলিক অঞ্চল, যেখানে সুউচ্চ পর্বতমালা এবং ভূমিরূপের অন্দরে রয়েছে বিপুল খনিজ সম্পদ। টেকটোনিক প্লেটের মিলনস্থলে অবস্থিত লাদাখের একটি অনন্য এবং বৈচিত্রময় ভূতাত্ত্বিক গঠন রয়েছে। ফলে এই অঞ্চলটি আজ ভূতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের জন্য একটি প্রধান স্থান হয়ে উঠেছে, বিভিন্ন পর্বত অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা খনিজ পদার্থের কারণেই। এটাই হয়তো লাদাখের জনজাতিদের চরম দুর্ভাগ্য!
পরিবেশ আইনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে লাদাখ, জম্মু কাশীর, তথা সমগ্র হিমালয় অঞ্চলে রত্নভাণ্ডার খননকার্য এগিয়ে নিয়ে গেলে, তা বন উজাড়, তৃণভূমি ধ্বংস, আবাসস্থলের ব্যাঘাত এবং প্রবল দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। বাড়বে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। বাস্তবে ঘটছেও তাই। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে লাদাখ, জম্মু কাশ্মীর, ধারালি সহ উত্তরাখন্ডের বিস্তৃর্ণ অঞ্চল থেকে হিমাচলপ্রদেশ হয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের এক বড় অংশ জুড়ে মেঘভাঙা বৃষ্টি, ভূমিধস, হড়পা বান, গ্লেসিয়ার লেক আউটবার্স্ট, মৃত্যুর মিছিল, অর্থনৈতিক ক্ষতি বেড়েই চলেছে। আর এক একটি দুর্যোগ ফের অন্য দুর্যোগের বাস্তবতা নতুন করে তৈরি করছে। হিমালয়ীয় অঞ্চলে এই ঘনঘটাগুলোই আজ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার-স্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনুষ্যসৃষ্ট এইসব দুর্যোগের সবচেয়ে বেশি করে খেসারত দিতে হচ্ছে ভূমিপুত্র জনজাতিদের। অর্থাৎ যে প্রাকৃতিক সম্বল হিমালয়বাসীর ভালোভাবে বেঁচে থাকার প্রধান রসদ হতে পারত, যে নৈসর্গিক প্রকৃতি তাঁদের জীবনযাপনের মান উন্নত করে অন্য ধারায় বইয়ে দিতে পারত, সেই সবের আর্থিকীকরণের ফলে এঁদের ভিটেমাটি হারিয়ে শিকড়চ্যুত হয়ে ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস হারিয়ে আশঙ্কা উদ্বেগের মধ্যে দিন গুজরান করতে হচ্ছে। দেশ জুড়ে বিভিন্ন প্রদেশের মানুষ বাধ্য হচ্ছেন বিক্ষোভ প্রতিবাদে সামনের সারিতে চলে আসতে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং জীববৈচিত্র বজায় রাখার জন্য লাদাখের ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণ অপরিহার্য।
লাদাখ সহ হিমালয়ের বুক চিরে পর্যটনশিল্প এখন কর্পোরেট বিনিয়োগের নতুন ঠিকানা। হোটেল, রিসর্ট, রিয়েল এস্টেট প্রকল্প স্থানীয় জনজীবনকে বাজারমুখী জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত করছে, যার নেতিবাচক ফল প্রকৃতিকে ঘনঘন অস্থির করে তুলছে। লাদাখের মতো ভঙ্গুর পর্বতভূমিতে বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা ঝুঁকি বাড়াচ্ছে প্রাণ-প্রকৃতির।
চীন, ভারত, নেপাল, ভুটান : সব দেশ হিমালয়ের সম্পদকে কৌশলগতভাবে কাজে লাগাতে সোল্লাসে কোমর বেঁধে নেমেছে। বিশ্বব্যাংক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক ও জাপানি বিনিয়োগে হিমালয় এখন “উন্নয়ন করিডর”। লাদাখও এই চক্রব্যূহে আবদ্ধ। উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া এই বিপর্যয়কারী উন্নয়ন চান না লাদাখের আপামর জনগণ। প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের আজ এই উন্নয়ন কাঠামোকে প্রশ্ন করা দরকার। দুঃখ থাকলেও লাদাখের জনগণ স্বস্তিতে থাকতে চান। আনন্দ দুঃখ খুশি সবটাই নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়ে তাঁরা 'আপন ভাগ্য' গড়ার অধিকার পেতে চাইছেন সরকারের কাছ থেকে। কর্পোরেট লুঠের নাগপাশ থেকে মুক্ত হতে চাইছেন লাদাখবাসী। কত, আর কত দিন ভূ-রাজনৈতিক অবহেলা সহ্য করে যেতে হবে তাঁদের? তাই ন্যায্য দাবীতে আন্দোলনরত লাদাখের জনজাতিদের ওপর কেন্দ্রীয় সরকারের হামলার তীব্র বিরোধিতা করার পাশাপাশি চলমান প্রকৃতি পরিবেশ অঞ্চা
আন্দোলনের সংঘটিতে আমাদের সকলের সামাজিক দায়। মনুষ্যত্বের দাবি। আজকের সময়ের অন্যতম প্রধান কাজ।