পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

মণিপুরে এ-রক্তপাত বন্ধ হবে কবে

  • 04 July, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 982 view(s)
  • লিখেছেন : মিলন দত্ত
মেইতিরা মণিপুরের জনসংখ্যার প্রায় ৬৪ শতাংশ। বিধানসভায় ৬০ জন বিধায়কের মধ্যে তাদেরই ৪০টি, যদিও তাদের বসবাস রাজ্যের মাত্র দশ শতাংশ জমিতে। কুকি সমেত ৩৪ টি উপজাতি গোষ্ঠীর বসবাস রাজ্যের ৯০ শতাংশ পাহাড়ি অঞ্চলে। পাহাড়ের বাসিন্দা উপজাতিরা চাইলে ইমফল উপত্যকায় জমি কিনে বসবাস করতে পারে কিন্তু ইমফল উপত্যাকার মেইতিরা চাইলেই পাহাড়ে গিয়ে জমি কিনতে পারে না। পাহাড়ি উপজাতির মানুষের আশঙ্কা মেইতিরা উপজাতি হিসাবে স্বীকৃতি পেয়ে গেলে তাদের পায়ের নীচের মাটি আলগা হতে পারে। এটাই কি গণ্ডগোলের প্রধান কারণ?

মণিপুরের জাতিদাঙ্গা সাত সপ্তাহ পেরিয়েও থামেনি। বরং প্রতিদিনই বাড়িঘর পোড়ানো, লুটপাট, খুনোখুনি বেড়েই চলেছে। দেশের মহামান্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অনন্ত ক্ষমতার অধিকারী অমিত শাহ অনেক দেরি করে মণিপুরের গিয়ে রাজ্যের এমুড়ো ওমুড়ো ঘুরে এবং নানা রকমের বৈঠক করেও ফল হয়নি। আর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী মণিপুরের দিকে যাওয়ার চেষ্টাই করেননি। এমনকী সে রাজ্যের মর্মান্তিক জাতি দাঙ্গা নিয়ে গত দু মাসের মধ্যে একটি শব্দ উচ্চারণ করেননি। যেন মণিপুর ভারতের রাজ্য নয়, মায়ানমার বা অন্য কোনও দেশে তার অবস্থান। অবশ্য একটা কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, তাঁরা দাঙ্গা বাধাতে অধিক পটু, থামাতে জানেন না। গুজরাট এবং দিল্লির দাঙ্গা তার প্রজ্বলন্ত নজির। মণিপুরে প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কুশপুতুল পোড়ানো হচ্ছে মাঝেমধ্যেই— বিজেপি অফিসেও হামলা চালাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এই অবস্থায় মোদীজির মণিপুরে পা না দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।  

মণিপুরে এ পর্যন্ত ১৪০-এর বেশি মানুষ খুন হয়েছে। ৪০ হাজারের বেশি মানুষ হয়েছেন ঘরছাড়া। তাঁদের অনেককেই রাজ্যের বাইরে— অসম, মিজোরাম, ত্রিপুরা বা নাগাল্যান্ডে আশ্রয় নিতে হয়েছে। মোদী কথিত ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকার থাকা সত্ত্বেও সে রাজ্য আজ কোনও সরকারের অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না। এই জাতিদাঙ্গায় প্রায় ২৫০টা গির্জা আর ১৭টা মন্দির গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এবারের দাঙ্গা মূলত মেইতি আর কুকিদের মধ্যে। মেইতিরা মূলত হিন্দু— ইমফল উপত্যকায় বসবাস আর কুকিরা খ্রিস্টান— পাহাড়ের বাসিন্দা। দুই সম্প্রদায়কে আলোচনার টেবিলে বসানোর সব উদ্যোগই ব্যর্থ হয়েছে। মেইতি আর কুকিদের প্রাচীন বিরোধ আজ এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে যে, ইমফলে কুকিদের চিহ্নিত করে তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে খুন করা হচ্ছে। আবার কুকি অধ্যুষিত পাহাড়ি অঞ্চলে মেইতিদের একই দশা হচ্ছে। এমনকী পুলিশ বা সরকারি অফিসাররাও যে যার সুবিধা মতো বদলি নিয়ে নিচ্ছেন। কুকি সরকারি কর্মীরা ইমফল থেকে বদলি নিয়ে চলে যাচ্ছেন পাহাড়ি জেলাগুলোতে। আর মেইতি সরকারি কর্মী অফিসারেররা পাহাড় ছেড়ে চলে যাচ্ছেন ইমফলে। সরকার তাদের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। কুকি বিধায়কেরাও ছাড় পাচ্ছেন না। দু’পক্ষই যথেষ্ট অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তৈরি। তাঁরা সশ্স্ত্র হয়ে নিজ নিজ সম্প্রদায়ে গ্রাম পাহাড়া দিচ্ছেন আর মাঝে মাঝেই এক পক্ষ অন্যকে আক্রমণ করছে্ন। এই সব লেকেদের হাতে অস্ত্রের অভাব নেই। সরকারি অস্ত্রাগার থেকে তিন হাজারের বেশি অস্ত্রশস্ত্র লুট হয়েছে ইতিমধ্যেই।   

এই বিরোধ বহু পুরনো। মনিপুরের সংখ্যাগুরু মেইতি জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে তপশীলি উপজাতি বা এসটি তালিকাভুক্ত হওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিল। তাঁদের বসবাস মূলত ইমফল উপত্যকায়। পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করেন যে আদিবাসীরা, তাঁদের একটা বড় অংশ মূলত কুকি চিন জনগোষ্ঠীর মানুষ। সেখানে নাগা কুকিরাও যেমন থাকেন কিছু সংখ্যায়, তেমনই আরও অনেক গোষ্ঠী আছে। মণিপুরে মোট ৩৪টি জনগোষ্ঠীর মানুষের বাস। জনগোষ্ঠীর এহেন বৈচিত্র এদেশের আর কোনও রাজ্যে নেই। পাহাড়ি অঞ্চলের মানুষের আশঙ্কা মেইতিরা তপশীলী উপজাতির তকমা পেয়ে গেলে তাঁরা বঞ্চিত হবেন। কিন্তু গত ৩ মে মণিপুর হাইকোর্ট মেইতিদের তপশীলি উপজাতি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি সরকারকে বিবেচনা করতে বলে। তার বিরুদ্ধে পাহাড়ি উপজাতি জনগোষ্ঠী বিক্ষোভ মিছিল করে পরের দিনই। দাঙ্গার শুরু সেখান থেকেই— খুব দ্রুত পুরো রাজ্যেই ছড়িয়ে পড়ে। তপশীলি উপজাতি হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য হাইকোর্টের নির্দেশ আসার আগে থেকেই অবশ্য সরকারের এবং মেইতিদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দানা বাঁধছিল পাহাড়ি উপজাতিদের মধ্যে। ওইসব পাহাড়ি বনাঞ্চল থেকে সরকার ‘বেআইনি দখলদার’ সরাতে শুরু করেছিল সম্প্রতি। এগুলি সবই নাগা এবং কুকিদের বসবাসের এলাকা।

মেইতিরা মণিপুরের জনসংখ্যার প্রায় ৬৪ শতাংশ। বিধানসভায় ৬০ জন বিধায়কের মধ্যে তাদেরই ৪০টি, যদিও তাদের বসবাস রাজ্যের মাত্র দশ শতাংশ জমিতে। মেইতিরা মূলত হিন্দু এবং একটা বড় সংখ্যায় বৈষ্ণব। আবার তারা চিরাচরিত  প্রকৃতি পুজোও করে থাকে্ন। মেইতিদের মধ্যে কিছু মুসলমানও রয়েছেন। রাজ্যে মুসলমান আছে ৮.৬ শতাংশ। পাহাড়ি অঞ্চলে বাস করেন যেসব নাগা এবং কুকি উপজাতির মানুষ, তাদের বড় অংশ খ্রিস্টান। তাদের বসবাস রাজ্যের ৯০ শতাংশ পাহাড়ি অঞ্চলে। পাহাড়ের বাসিন্দা উপজাতিরা চাইলে ইমফল উপত্যকায় জমি কিনে বসবাস করতে পারে কিন্তু ইমফল উপত্যাকার মেইতিরা চাইলেই পাহাড়ে গিয়ে জমি কিনতে পারে না। অসমেও এই রকম একটা নিয়ম আইন আছে।

হাইকোটেই রায় নিয়ে তারা মণিপুরের নানা জায়গায় প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। ওই দিন ট্রাইবাল সলিডারিটি মার্চ বের করে। তাতে ৬০ হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করেন। চূড়াচাঁদপুরের তোরবাং এলাকায় মিছিল আক্রান্ত হয়। তারপরেই বড় আকারের হিংসা ছড়িয়ে পড়ে রাজ্যের নানা প্রান্তে। একটা পাল্টা যে মেইতিদের দিক থেকে আসতে পারে, সেটাও কুকিদের অজানা ছিল না। সংঘাত অনিবার্যই ছিল। তাহলে সরকার জেনেও ব্যবস্থা নিল না কেন? ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকারের এই ব্যর্থতাই আজ মণিপুরকে এমন আন্তহীন রক্তাক্ত হানাহানির জায়গায় ঠেলে দিয়েছে।

নব্বইয়ের দশকে মণিপুরে নাগা ও কুকি জনজাতির মধ্যে সংঘর্ষে কয়েক হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছিলেন। ১৯৯৩ সালে মেইতি জনজাতির দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ ঠেকাতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হয়েছিল পুলিশ। ১৯৯৭-‘৯৮ সালে কুকিদের সঙ্গে মেইতিদের সংঘর্ষ হয়। ২০০১ সালে এনএসসিএন (ইসাক-মুইভা) দাবি করে মণিপুরের একাংশ নিয়ে গ্রেটার নাগালিম তৈরি করতে হবে। তাতে অন্যান্য জনজাতি আপত্তি জানায়। কিন্তু এর পরে গত প্রায় ২০ বছর উত্তর-পূর্ব ভারতে বড় ধরনের জাতিদাঙ্গা হয়নি।

এই অবস্থায় কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রীকে পর্যন্ত সরানোর ঝুঁকি নিতে পারছে না। মুখ্যমন্ত্রী বিরেন সিং অবশ্য কয়েকদিন আগে পদত্যাগের একটা প্রায় বিশ্বাসযোগ্য নাটক করেছিলেন। তিনি পদত্যাগ করার জন্য রাজভবনের দিকে রওয়া হয়েছিলেন, কিন্তু মাঝপথে তাঁর সমর্থকেরা পথ আটকে তাঁর হাত থেকে পদত্যাগপত্র কেড়ে নিয়ে সেটা ছিঁড়ে ফেলে। আসলে মোদী সরাতে চাইছেন না মুখ্যমন্ত্রীকে— সেটা তাঁর ব্যক্তগত পরাজয় হিসেবে ধরে নিয়েছেন। তাতেও কোন সুবিধা হয়নি— মণিপুরে বিজেপির পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। মেইতিরা যে মোদী তথা দিল্লির ওপর থেকে আস্থা হারাচ্ছে সেটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। মোদীর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানের দিনে প্রতিকী প্রতিবাদ হিসেবে মেইতিরা ইমফল উপত্যাকায় রেডিও ভেঙেছে। তাঁদের বক্তব্য, ‘মন কি বাত’ নয় তাঁরা চান ‘মণিপুর কি বাত’। কিন্তু মণিপুর নিয়ে মোদীর ‘বাত’ বেরলো কই? ইতিমধ্যে রাহুল গান্ধি মণিপুরে পৌঁছে গিয়ে বিজেপিকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। ওই কংগ্রেস নেতা কেবল কুকি এবং মেইতিদের ত্রাণ শিবিরেই যেননি। রাহুলের মণিপুর সফর গোটা দেশে সংবাদমাধ্যম ব্যাপক প্রচারও করেছে।  

মণিপুরের এই সংকট কাটার নয়। ওই রাজ্যে এমন কোনও রাজনৈতিক নেতাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না যার সঙ্গে কোনও না কোনও জঙ্গী গোষ্ঠীর যোগ নেই। ২০০০ সালে পুলিশের দেওয়া হিসেব মতো মণিপুরে ১৫ হাজার মানুষ জঙ্গীদের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। এত দিনে সেই সংখ্যাটা কতটা বেড়ে থাকতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। মণিপুরে সবকটি জনজাতি গোষ্ঠীর নামে এক বা একাধিক সন্ত্রাসবাদী দল রয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জনজাতি গোষ্ঠীগুলোর পরিচিতি আদায়ের সংকট এবং রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ে তাদের স্বাধীন রাজ্য গড়ার দাবি— পরিস্থিতিকে এতটাই জটিল করেছে যে মণিপুর এই সংকট থেকে কোনও ভাবেই মুক্ত হতে পারছে না।

 আর একটি সমস্যা হল মণিপুরের ‘আর্থিক অবরোধ’। সে রাজ্যের আর্থ-সামাজিক ঘটনাবলিতে ‘আর্থিক অবরোধ’ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এবার যেমন মেইতিদের ভাতে মারার জন্য কুকিরা তিন সপ্তাহের ওপর ২ নম্বর জাতীয় সড়ক অবরোধ করে রয়েছে। এই রাস্তাই দেশের সঙ্গে মণিপুরের একমাত্র যোগাযোগ। এ পথ বন্ধ হলে মণিপুরের অর্থনীতি স্তব্ধ হয়ে যায়— মণিপুরের জীবন রেখা। পণ্যসামগ্রী, খাদ্য, ওষুধ-চিকিৎসা সরঞ্জামের যোগান বন্ধ হয়ে যায়। এই অবরোধ মানবাধিকার রীতিনীতির সম্পূর্ণ বিরোধী। এই দুভোর্গেও মণিপুরের মানুষ একটু মজার খোরাক পেয়েছেন অমিত শাহের কাছে থেকে। অমিত শাহ টুইট করে অবরোধ তোলার আবেদন করেন। কিন্তু যে এলাকায় যাঁদের উদ্দেশ্য করে তিনি আবেদন করেছিলেন সেখানে গত এক মাস যাবৎ ইন্টারনেট যোগাযোগ বন্ধ এবং নিষিদ্ধ।   

0 Comments

Post Comment