আমাদের দেশের মূলধারার সংবাদমাধ্যমের যা স্বভাব, যে কোন 'তথাকথিত মুখরোচক' বিষয় নিয়ে হইচই করে আলোড়ন তোলা, বিগত কয়েকদিন সেরকমটাই হচ্ছে, এবার খবরে মেঘালয়ে ঘটে যাওয়া এক নৃশংস হত্যাকাণ্ড৷ সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীর বিরুদ্ধে রীতিমতো পরিকল্পনা করে, ভাড়াটে খুনীদের দিয়ে স্বামীকে হত্যা করানোর অভিযোগ। প্রায় নজিরবিহীন অপরাধ চিরকালই জনতার আলোচনার ও আগ্রহের বস্তু । এবারেও ব্যতিক্রম হয়নি, সারা দেশ আতঙ্ক আর আগ্রহ নিয়ে বুঁদ হয়ে আছে ঐ খবরে। আর সংবাদমাধ্যম পুরো ঘটনাটিকে (তদন্ত এখনো পুরো মাত্রায় চালু) নাটকীয় ভাবে উপস্থাপন করে চলেছে। থেকে থেকে 'ব্রেকিং নিউজ' এর বন্যা বইয়ে দিচ্ছে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে খুনের ঘটনাটির চিত্রায়ণ পর্যন্ত করছে।
মেঘালয়ে ঘটে যাওয়া এই অপরাধের নৃশংসতা নিয়ে কোন দ্বিমত থাকতে পারে না, এই ট্র্যাজেডি দীর্ঘকাল মানুষের মনে থাকবে। কিন্তু আমি এই আলোচনার মধ্যেই আরও কিছু আলোচনার অভিমুখ উঠে আসতে দেখছি, সে নিয়ে চ্যানেলে চ্যানেলে স্টার এঙ্কর গলা ফাটাচ্ছেন আর বিশেষজ্ঞ প্যানেল পাবলিক সেন্টিমেন্ট মেপে বক্তব্য রাখছেন। সেই বিষয়গুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ, আর তা নিয়েই সামান্য দুটো কথা।
প্রথমত একদল সংবাদমাধ্যম তোড়জোড় করে আলোচনা করছে, এই হত্যার পিছনে গ্রহের প্রভাব বা প্রকোপ কতটা? এই চর্চায় বারবার উঠে আসছে নববিবাহিতা ও তার স্বামীর 'মাঙ্গলিক' হওয়ার বিষয়। এক জ্যোতিষী নাকি আবার দুজনের মাঙ্গলিকতার শ্রেণীবিন্যাস করেছেন, মেয়েটি উচ্চ ও প্রয়াত ছেলেটি নিম্ন মাঙ্গলিক। দেখলাম দুর্ধর্ষ আলোচনা - উচ্চ বনাম নিম্ন মাঙ্গলিক কোনটা বেশী খারাপ! আরেক সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে যে ধৃত মহিলা নিজের মাঙ্গলিক দোষ কাটানোর জন্যই অপর মাঙ্গলিক পাত্রকে বিয়ে করেছিল, যাতে সে নিজের প্রেমিককে মাঙ্গলিক দোষের প্রকোপ থেকে বাঁচাতে পারে ইত্যাদি। এই বিষয়টি মূলধারার মিডিয়াতে এতটা সময় ও নজর কেড়েছে, যে তার সামাজিক অভিঘাত ভাবলে, সেটা রীতিমতো চিন্তার বিষয়। দেশের উন্নতি শুধু জিডিপির নিরিখেই মাপা যায় না, মানবসম্পদের উন্নতি, শিক্ষা ও চেতনার উন্নতি আসল উন্নয়ন নিশ্চিত করে। অথচ উন্নয়নশীল ভারতে বিজ্ঞান চর্চা ও কুসংস্কার চর্চার সহাবস্থান ভীষণ স্বাভাবিক এক বিষয়। বিয়ের সময় পাত্র পাত্রীর জন্ম কুণ্ডলী মিলিয়ে দেখা এখনো পুরো মাত্রায় চালু আছে। এর ফলে নারী পুরুষ নির্বিশেষে বহু মানুষকে ভয়ানক মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় (মেয়েদের অনেক বেশী এই সমস্যায় পড়তে দেখেছি), অথচ এই কুপ্রথা যে শুধু টিকে আছে তা নয়, সেলিব্রিটিদের আর সংবাদমাধ্যমের দৌলতে সমাজে বিশাল গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে। হত্যার মতন অপরাধের আলোচনায় তাই আসছে মাঙ্গলিক প্রসঙ্গ। হয়তো হত্যাকারীর মানসিকতাতেও এই বিষয়টি কাজ করেছিল, সেও তো এই সমাজের একজন। কিন্তু আজ এক ঘৃণ্য অপরাধের নিন্দা করতে গিয়ে আমরা এই সব সামাজিক 'অপরাধের' বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছি না, বরং এইসব আলোচনাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নিচ্ছি। বিষয়টি আশঙ্কার!
হত্যাকাণ্ডটিকে ঘিরে দ্বিতীয় আলোচনার অভিমুখটি আরো অদ্ভুত। এই আলোচনায় দেশের আইনকে বিচারের কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে। সব আইন নয়, মহিলাদের সুরক্ষার জন্য প্রণয়ন করা আইনগুলো। এক চ্যানেলের আলোচনায় শুনলাম দেশের সব আইন ঘোরতর পুরুষবিরোধী। পুরুষদের অধিকার রক্ষায় ব্রতী একটিভ্যিস্ট বলছেন এই সব আইনের জোরেই আজ মহিলারা অবাধে পুরুষদের উপর অত্যাচার করছে। এই অতি সরলীকরণের জোয়ারের মুখে, দুএকজন বক্তা নারীদের অধিকার সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কিছু বলতে গিয়ে রীতিমতো হেনস্থা হচ্ছেন। এই বিষয়টি ভাবার। এমনিতেই বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিসরে নারীবাদ নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা অনেক; রয়েছে অজ্ঞতাপ্রসূত বৈরীতা। নারীবাদীদের বিরোধিতার অস্ত্রে নতুন শান দেওয়ার জন্য, মেঘালয়ের এই হত্যাকাণ্ডকে যেন কেস স্টাডি করে ফেলা হচ্ছে। আর এই গুলিয়ে দেওয়া গোলমালে অনেকেই বলছেন, সত্যিই তো মেয়েদের পক্ষেই সব আইন। অথচ একটু তলিয়ে ভাবলে বোঝা কঠিন না যে খুনের মতো অপরাধের জন্য যে আইন, তাতে নারী - পুরুষ ভেদ নেই। আসল কথা আইন যা আছে তা অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করতে, পুরুষদের আলাদা করে বেছে বেছে শাস্তি দিতে নয়। গার্হস্থ হিংসা সংক্রান্ত সমস্যা আমাদের সমাজে এতটাই প্রকট ও অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীরাই যেহেতু তার শিকার, তাই এই সংক্রান্ত আইনে নারীদের অভিযোগকে প্রাথমিকভাবে গুরুত্ব বেশী দেওয়া হতো (যা এখন কিছুটা সংশোধিত)। একটা তথ্য দেওয়া যাক, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর ২০২২ এর পরিসংখ্যান বলছে মহিলাদের সাথে ঘটা অপরাধ বিগত দুই বছরের (২০২০-২১) তুলনায় বেড়েছে। ২০২২ এ রেকর্ড হওয়া এরকম অপরাধের সংখ্যা ৪,৪৫২৫৬, এর ৩১% হলো স্বামী বা স্বামীর পরিবারের সদস্যদের হাতে গার্হস্থ হিংসার ঘটনা। পাশাপাশি কিছু ছোট ছোট গবেষণা সামনে এসেছে, যা দেখাচ্ছে যে পুরুষদের নিগ্রহের ঘটনাও দেশে বাড়ছে। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আজও অসংখ্য মহিলা গার্হস্থ্য হিংসার শিকার, তাদের খুব সামান্য অংশই আইনের দ্বারস্থ হতে পারে। পুরুষতান্ত্রিকতা যেহেতু একটা মানসিকতার ও সামাজিক শাসন কাঠামোর অপর নাম, তাই এই পুরুষতান্ত্রিকতার শিকার মাঝে মাঝে কিছু পুরুষও হন আর তারাও অনেকেই আইনের দ্বারস্থ হন না। কিন্তু পুরুষদের সমস্যার উদাহরণ দিয়ে, যুগ যুগ ধরে চলে আসা নারীদের সমস্যাকে ছোট করে দেখানো একেবারে ভুল পদক্ষেপ। বরং দরকার পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে নারী-পুরুষের যৌথ লড়াই। নারীবাদ মানে পুরুষ বিদ্বেষ নয়, বরং সকলের সমানাধিকারের লড়াই, সমতার জন্য লড়াই। এই আঙ্গিকে কথা না বলে, যখনই গার্হস্থ হিংসা আইনের অপপ্রয়োগ দেখা যায় বা মেঘালয় হত্যাকাণ্ডের মতন ঘটনার কেন্দ্রে কোন নারী অপরাধীর (অভিযুক্ত) নাম উঠে আসে, তখন সামাজিক মাধ্যমে এক শ্রেণীর বিশেষজ্ঞরা তারস্বরে সেই সমস্ত আইনকে গালি দিতে শুরু করেন, যেগুলো আমাদের দেশে মহিলাদের সম্মান ও সুরক্ষা দিতে ও তাদের ক্ষমতায়নে কিছুটা হলেও ভালো অবদান রেখেছে। এই ভিত্তিহীন সমালোচনার চেনা প্যাটার্নটাই আবার এখন চ্যানেলে চ্যানেলে চর্চা হচ্ছে। এতে কোথাও সদর্থক কোন পরিবর্তন হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না। তার একটা বড় কারণ, এই সব সমালোচনা, রোগের চিকিৎসার কথা না বলে কিছু উপসর্গ নিয়েই হইচই করে আর নারী - পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে আমাদের যে বৃহত্তর সামাজিক দায়িত্ব আছে, সেই কথাটি সযত্নে এড়িয়ে যায়।
শেষে আরেকটা কথা, যেটা তেমন আলোচনায় আসছে না। আজকের আধুনিক যুগেও যে ছেলে বা মেয়েদের উপর বিয়ের সিদ্ধান্ত পরিবার থেকে চাপিয়ে দেয়, এটাও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের একটা জবরদস্তি। ঠিকুজি - কুষ্টি মেলানোর থেকে, বিয়ের ক্ষেত্রে দুটি প্রাপ্ত বয়স্ক / বয়স্কা মানুষের মনের মিল যে বেশী জরুরি এটা এখনো পরিবার, সমাজ মেনে নিতে চায় না। ভিন্ন ধর্ম বা জাতির ছেলে মেয়ে স্বাধীন ইচ্ছামত বিয়ে করলে তা এখন মিডিয়ার কাছে ও রাজনৈতিকভাবে 'লাভ জিহাদ'। তবে স্বধর্মে বা জাতিতেও স্বাধীন ইচ্ছামত বিয়ে করার স্বাধীনতা এখনো বহু মেয়েদের নেই, কিছু ছেলেদেরও নেই। এই চাপিয়ে দেওয়া বিয়ের পরিনাম কি মর্মান্তিক হতে পারে তার প্রমাণ অতীতেও পাওয়া গেছে আর এই হত্যাও সেটা আবার প্রমাণ করে (অভিযোগ প্রমাণিত হলে)।
কাজেই হত্যাকারী হিসেবে যদিও প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত মানুষরাই কাঠগড়ায় উঠবে কিন্তু পরোক্ষভাবে এই পরিস্থিতি সৃষ্টিতে যাদের অবদান বিশাল, তাদের কোন শাস্তিই হবে না। অতএব মতের বিরুদ্ধে বিয়ে, পরিবারের সম্মান রাখতে বিয়ে, সামাজিক চাপের সামনে নতি স্বীকার করে বিয়ে, এগুলো বন্ধ না হলে, নানা অপরাধ ঘটার জমি তৈরী হতেই থাকবে।
মেঘালয়ে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের জন্য যারা দায়ী, তাদের অপরাধকে কোনভাবে লঘু করে দেখানো আমার উদ্দেশ্য নয়। এই অপরাধীদের কঠিন শাস্তি দরকার। আর দরকার এক বৃহত্তর সামাজিক পরিনত মনস্কতা; যেখানে জাতপাত, কুষ্টি গণনার উপর ভিত্তি করে নয়, পারস্পরিক বোঝাপড়ার ও ভালোবাসার উপর ভিত্তি করে বিয়ে হবে, যেখানে পুরুষতান্ত্রিকতার জাঁতাকলে মেয়েরা পিষ্ট হবে না, ছেলেদেরও পিষ্ট করবে না। এর জন্য সামাজিক পরিসরে যে শিক্ষা ও আলোচনা দরকার, গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভর কাছে আজ আর তা আশা করা যায় না, অন্যান্য স্তম্ভের কাছে যায় কি? আর আমরাও কি নিজেদের চিন্তাভাবনা নিয়ে তলিয়ে ভাবতে প্রস্তুত যে এই নৃশংস ঘটনার সামাজিক দায়ভার কার?