পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

শিক্ষার গৈরিকীকরণ: একটি বিজেপি কর্ম-পরিকল্পনা

  • 01 August, 2022
  • 0 Comment(s)
  • 1168 view(s)
  • লিখেছেন : সৌভিক রায় স্বর্ণাভ চক্রবর্তী
আরএসএস-বিজেপি কর্তৃক গৈরিকীকরণের মাধ্যম হলো অপবিজ্ঞান ও কুসংস্কারের প্রচার। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো পড়ুয়াদের মধ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক ও যুক্তিভিত্তিক চিন্তাভাবনার সমূলে বিনাশ। সেই কারণেই হয়তো আইআইটি মান্ডির অধিকর্তা তাঁর ভূত ছাড়ানোর কথা সকলের সামনে দাবী করতে পারেন। সেই কারণেই হয়তো আইআইইএসটি শিবপুরে নোটিশ বেরোতে পারে মকর সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে সূর্য নমস্কারে অংশগ্রহণের কথা বলে।

দেশে ফ্যাসিবাদ যখন মাথা চাড়া দেয়, তখন তার প্রয়োজন হয় বিপুল ক্যাডারের এবং বিরোধী শুন্য একটা ব্যবস্থার। ফ্যাসিবাদের প্রচারের জন্য সে কয়েকটা পদ্ধতির অনুসরণ করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এবং পাঠ্যক্রমকে তার প্রচারের যন্ত্র বানিয়ে ফ্যাসিবাদ নবীন মস্তিষ্ককে তার রাজনৈতিক প্রচারের যন্ত্র বানায়। শিক্ষার্থীদের থেকে রাষ্ট্রের ভীতি চিরকালীন। শিক্ষার্থীরাই পারে রাষ্ট্রের সমস্ত মিথ্যে বুলির সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে ঠিক ঠিক প্রশ্নগুলো করতে। যদি সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্রীয় ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডার বানানোর যন্ত্র বানিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে এক ঢিলে দুই পাখি। ক্যাডারও হলো, আবার সঠিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোরও সম্মুখীন হতে হলো না। অতএব, বিজেপি শাসিত রাষ্ট্রে শিক্ষার গৈরিকীকরণ হবে এ আর এমন কি আশ্চর্যের কথা!

কিছু বছর আগেই হরিয়ানা সরকারের বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে ভাগবদ্গীতা অন্তর্ভুক্ত হয়। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ভগবদ্গীতাকে দেশের জাতীয় গ্রন্থ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়ে আসছে বেশ কিছু সময় ধরেই। কিন্তু এর পাশাপাশি যখন গোমাংস ভক্ষণে বা প্রকাশ্যে নামাজ পাঠে নিষেধাজ্ঞা জারি হয় বা কর্নাটকে হিজাব ব্যানের প্রস্তাব ওঠে, তখনই বুঝে নেওয়া সম্ভব হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য প্রচার ও মুসলিম বিদ্বেষ আসলে একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ।

রাষ্ট্রীয় ভাবে শিক্ষার গৈরিকীকরণের বিজেপির প্রধান অস্ত্রই হলো জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০। এতে ইউজিসির নতুন সিলেবাসে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণকে ইতিহাসের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াসে ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিব। এই নয়া পাঠ্যক্রম প্রাচীন ভারতের জাতিভেদ প্রথার প্রসারের কারণ হিসেবে মুসলিম শাসনকে চিহ্নিত করে, যা সম্পূর্ণরূপে অনৈতিহাসিক এবং মিথ্যে একটি তথ্য। আসলে এই জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ওসাম্প্রদায়িকীকরণ ব্যতীত কিছু নয়।

কিন্তু ভারতবর্ষের তথাকথিত অরাজনৈতিক কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো কি এই গৈরিকীকরণের বাইরে কোথাও অবস্থান করছে?

এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে গৈরিকীকরণের বিবিধ পদ্ধতি আমরা দেখতে পেয়েছি। এবিভিপির ফেসবুক লাইভে যখন আইআইটি খড়গপুরের অধিকর্তা ড. ভি কে তিওয়ারি উপস্থিত হন ও বক্তব্য রাখেন বা আইআইইএসটি শিবপুরের চিফ ওয়ার্ডেন ড. সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায় যখন ২০২১ সালে হওয়া নবাগত পড়ুয়াদের নিয়ে কর্মশালার প্রথম দিনে ওয়েবিনারে এবিভিপি দক্ষিণ বঙ্গের সভাপতি নামে উপস্থিত হন বা আইআইটি খড়গপুরের ফিজিক্সের প্রফেসর কমল লোচন পানিগ্রাহী যখন এবিভিপি দক্ষিণ বঙ্গের সহসভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন, তখনই আসল চিত্রটা পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। কিছুদিন আগেই আইআইএমসিতে ৬ জনকে সহযোগী অধ্যাপক এবং ২ জনকে সহকারী অধ্যাপক পদে নিযুক্ত করা হয়। আইআইএমসিতে সহযোগী অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হওয়ার জন্য অন্তত ৮ বছরের শিক্ষকতা অথবা গবেষণার অভিজ্ঞতা বাধ্যতমূলক। তবুও মাত্র ৫ বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে রাকেশ কুমার উপাধ্যায় সেই পদে নিযুক্ত হন। অবশ্য উপাধ্যায় মশাই বহু ঘটনায় বিজেপির পক্ষে অবস্থান নেওয়া এক ব্যাক্তি এবং খুব গুরুত্বপূর্ণভাবে আরএসএসের পত্রিকা ‘পাঞ্চজন্য ‘-এর সম্পাদকমন্ডলীর একজন। তাঁর জন্য নিয়মের এই হেরফেরটুকু হবে, সেটা বলাই বাহুল্য। আর এইখানে উল্লেখ করা জরুরি, শিবপুরের উক্ত কর্মশালার দ্বিতীয় দিনে ডি আর আগরওয়াল নামে এক ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ছবি দেখিয়ে আত্মনির্ভর ভারতের প্রচার করে যান। সেন্ট্রাল সিভিল সার্ভিসের বিধি অনুযায়ী প্রকাশ্যে কোনো দলের সমর্থন বা আনুগত্য প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু আইনবিরুদ্ধ কাজও তখন রাষ্ট্রের চোখ এড়িয়ে যায় কারণ এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মাথায় তাদের পোষা ক্যাডারদের বসিয়ে গৈরিকীকরণের প্রচেষ্টা, আসলে তাদেরই একটি কর্ম-পরিকল্পনা।

২০১৭ সালে থিঙ্ক ইন্ডিয়া নামক এবিভিপির অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছিল সমস্ত আইআইটিগুলোতে এবং আইআইইএসটি শিবপুরে। শিবপুরের সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সেই সময়ের অধিকর্তা ড. অজয় রায়। শিবপুরের মত একটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানে সেই হলো বিজেপির ধারাক্রমে প্রবেশের সূচনা। এরপরেও আমরা দেখেছি ২০১৯ সালে বিজেপির ন্যাশনাল ফ্রন্ট অফ ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়ন অনুমোদিত শিবপুর এমপ্লয়িজ ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশনের উদ্বোধনে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ আসেন শিবপুরের ক্যাম্পাসে। তাতে উপস্থিত ছিলেন চিফ ওয়ার্ডেন এবং ড. অভিজিৎ চক্রবর্তী সহ আরো অনেক বরিষ্ঠ শিক্ষক এবং ডিনেরা। ক্যাম্পাসে “বিজেপি জিন্দাবাদ”, “দীলিপ ঘোষ জিন্দাবাদ” প্রভূত স্লোগানিং প্রতিষ্ঠানের গৈরিকীকরণের দিকেই নির্দেশ করে।

আরএসএস-বিজেপি কর্তৃক গৈরিকীকরণের মাধ্যম হলো অপবিজ্ঞান ও কুসংস্কারের প্রচার। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো পড়ুয়াদের মধ্যে বিজ্ঞানভিত্তিক ও যুক্তিভিত্তিক চিন্তাভাবনার সমূলে বিনাশ। সেই কারণেই হয়তো আইআইটি মান্ডির অধিকর্তা তাঁর ভূত ছাড়ানোর কথা সকলের সামনে দাবী করতে পারেন। সেই কারণেই হয়তো আইআইইএসটি শিবপুরে নোটিশ বেরোতে পারে মকর সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে সূর্য নমস্কারে অংশগ্রহণের কথা বলে। নবাগত পড়ুয়াদের নিয়ে ২০২১ সালে হওয়া কর্মশালার চতুর্থ দিনে বক্তাদের তালিকায় না থাকা এক ব্যক্তিকে এনে ভাগবদ্গীতা ও হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য প্রচার করানো হয়। কিছুদিন আগেই কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বিজেপির সুভাষ সরকার শিবপুরের কনভোকেশনে এসে বলে গেছিলেন, আলোর বেগের আবিষ্কার নাকি প্রাচীন ভারতে হয়েছিল। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী বলতে পারেন গণেশ আসলে প্লাস্টিক সার্জারির ফসল, সে দেশে এমন অবৈজ্ঞানিক কথা আর নতুন কি! আইআইটি খড়গপুরের ২০২২ সালের বার্ষিক ক্যালেন্ডার তৈরিও আসলে গৈরিকীকরণেরই একটি ফসল। তাতে রয়েছে বৈদিক জ্ঞানের স্বীকৃতি, সিন্ধু সভ্যতার পুনর্মূল্যায়ন এবং আর্যদের ভারতবর্ষের ভূমিসন্তান প্রমাণের নাছোড়বান্দা প্রয়াসের মাধ্যমে জঘন্য ইতিহাস বিকৃতি।

যখনই এই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে বেড়িয়ে আসে বিরোধী সুর, সেই বিরোধী কন্ঠস্বর রোধ করতে বারবার হামলা করেছে এই ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলো। জেএনইউ-এ বা জেইউতে এবিভিপি কর্তৃক হামলার কথা বারবার খবরে এসেছে। কর্তৃত্বও এই বিরোধী কন্ঠস্বর দমিয়ে দিতে বিবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। টিআইএফআরের মত গবেষণা প্রতিষ্ঠানে তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় রাজনৈতিক কিছু পোস্ট করতে বারণ করে দেওয়া হয়, শিবপুরে মৃণাল সেনের ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল বন্ধ করে দেওয়া হয়, শিবপুরের মাইনিং ডিপার্টমেন্টের এক পিএইচডি স্কলারের ফেলোশিপ বন্ধ করে, তাঁকে বাধ্য করা হয় গবেষণা অসম্পূর্ণ রেখে পিএইচডি ছাড়তে।

তবুও এই সময় ভেঙে পড়ার নয়। কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর এই চরম দুর্দিনেও মনে রাখতে হবে এনআরসি-সিএএ-এর বিরুদ্ধে আইআইটি বোম্বেতে, আইআইইএসটি শিবপুরে ছাত্রদের দুর্দম মিছিলের কথা, মনে রাখতে হবে আইআইটি খড়গপুরের সাইন্স এডুকেশন গ্রুপের প্রতিবাদে গর্জে ওঠার কথা। যতই দেশের ‘পরে আঁধার রাত্রি নেমে আসুক, “আলো ক্রমে আসিতেছে"।

লেখক - ইন্ডিয়ান ইনস্টটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ারিং সাইন্স এন্ড টেকোলজি, শিবপুর

0 Comments

Post Comment