পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

বিজেপি'র হিন্দুরাষ্ট্রে দলিতদের স্থান নেই

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 201 view(s)
  • লিখেছেন : ত্রিয়াশা লাহিড়ী
ফ্যাসিস্ট বিজেপি-আরএসএস চায় ভারতবর্ষকে হিন্দুরাষ্ট্র বানাতে। সেই হিন্দুরাষ্ট্রের হিন্দু কোনও দলিত হিন্দু নয়। আরএসএস'এর মতে হিন্দুরাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা হবেন উচ্চবর্ণের হিন্দু। ব্রাহ্মণ। বিজেপি যতই বলুক দলিত-আদিবাসী সকলেই হিন্দু, ভারতীয় মুসলমানরাও হিন্দু– আসলে তাদের কাছে শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ পুরুষেরাই হিন্দু। তাই সারা দেশে দলিত হিন্দুরা স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরেও প্রতিদিন উচ্চবর্ণের কাছে নির্যাতনের শিকার হন।

গ্রেটার নয়ডার গৌতম বুদ্ধ নগরের আম্বেদকর মহল্লায় থাকত অনিকেত জাটভ। পেশায় গাড়িচালক। গাড়ি সারানোর কাজেও তাঁর ভালোই দক্ষতা ছিল। বাবার রোজগার না থাকায় পরিবারের সম্পূর্ণ ভার ছিল অনিকেতের কাঁধে। রামলীলার প্রস্তুতির মধ্যে একদিন ঠাকুর সম্প্রদায়ের কয়েকজন ছেলে অনিকেতের এক বন্ধুকে অকারণে মারধর করে। অনিকেত এই ঘটনার প্রতিবাদ করে এবং দলিত বন্ধুটির পাশে দাঁড়ায়। এরপর উচ্চবর্ণের ছেলেগুলো অনিকেতকে হুমকি দেয়, নিজের অওকাত মনে করিয়ে দেয়, জাত তুলে গালিগালাজ করে। ১৫ অক্টোবর ছিল অনিকেতের জন্মদিন। ওইদিন সে বাড়ির পাশে একটি মাঠে নিকট আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে কেক কাটছিল। এমন সময় হঠাৎই উঁচু জাতের কয়েকজন যুবক রড-হকি স্টিক নিয়ে অনিকেতের উপর চড়াও হয়। অনিকেতকে বাঁচাতে তার কাকা ছুটে যায়। তাকেও বেধড়ক মারধর করা হয়। অনিকেতকে মেরে রক্তাক্ত অবস্থায় ঝোপের মধ্যে ফেলে দিয়ে যায় দুষ্কৃতিরা। দিল্লির হাসপাতালে ভর্তি করা হলে কয়েকদিনের মধ্যেই অনিকেতের মৃত্যু হয়।

গত মাসে, উত্তরপ্রদেশের সালেমপুরে ভিভি গ্রামে চেয়ারে বসে রামলীলা দেখছিলেন রমেশ চাঁদ। একজন দলিত কিনা সকলের সঙ্গে, সমানে-সমানে, চেয়ারে বসবে? এই দৃশ্য মানতে পারেনি অনুষ্ঠানের আয়োজকরা। তারা পুলিশকে খবর দেয়। দু'জন কনস্টেবল এসে তাঁর গলার গামছা ধরে টান দেয়। রমেশ মাটিতে পড়ে যেতে তাঁকে লাথি-ঘুষি মারা হয়। জাত তুলে গালিগালাজ করা হয়। অপমানে, লজ্জায় সে বাড়িতে ফিরে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে।

কাকোরির একটি মন্দিরে যান ৬৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ রামপাল। রামপাল ছিলেন শ্বাসকষ্টের রুগী। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি মন্দিরে প্রস্রাব করে ফেলেন। এই অনাসৃষ্টি কান্ড দেখে বর্ণহিন্দুরা রেগে আগুন! চারিদিকে হায় হায় রব উঠে গেছে। মন্দির অপবিত্র হয়েছে। অগত্যা তারা মুহূর্তের মধ্যে মন্দিরকে পুনরায় পবিত্র করার উপায় বের করল। ঠিক হল, রামপালকে নিজের প্রস্রাব চেটে সাফ করতে হবে। তবেই মন্দির পবিত্র হবে। বৃদ্ধ তাদের কথামতো কাজ করল। তবুও ওইদিন রামপালকে মন্দির চত্বরে ফেলে মারা হয় এবং তাঁর জাত তুলে অশ্রাব্য ভাষায় খিস্তিখেউড় করা হয়। লক্ষ্ণৌতে, পরিচিত আত্মীয়ের বাইকে চেপে দিদির বাড়ি যাচ্ছিল ১৭ বছরের একটি মেয়ে। রাস্তায় বাইক থামিয়ে দলিত মেয়েটিকে পাঁচজন যুবক গণধর্ষণ করে। নির্যাতিতা যার বাইকে যাচ্ছিল, তাকে অমানবিক ভাবে মারধর করে। এখানেই শেষ না, কার্যসিদ্ধির পর পালিয়ে যাবার আগে, থানা-পুলিশ করার চেষ্টা করলে জানে মেরে দেওয়ার হুমকি দিয়ে যায়।

আগস্ট মাসে, উত্তরপ্রদেশে বিজেপি কর্মী মুন্না বাহাদুর, বিদ্যুৎ দপ্তরের ইঞ্জিনিয়ার লাল সিং-কে জুতোপেটা করে। কারণ সে দলিত। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যেমনই হোক, বিজেপি নেতাকর্মীদের কাছে তাঁর একমাত্র পরিচয় সে দলিত৷ চলতি বছরের মে মাসে, উত্তরপ্রদেশের রাসরায় ম্যারেজ হল ভাড়া নেওয়ার কারণে দলিতদের উপর লোহার রড-লাঠি ইত্যাদি নিয়ে হামলা করে একদল উচ্চবর্ণের যুবক। দলিত হয়ে ম্যারেজ হল ভাড়া নিয়ে বিয়ে করা যে এত বড় অপরাধ, তা আপনারা কখনও ভেবে দেখেছেন?

গত ৩ জুন সরস্বতী মালিয়ান নামে এক যুবতীর আধ পোড়া দেহ উদ্ধার হয়। পরিবারের অমতে গিয়ে প্রেমিকের সাথে 'লিভ ইন' করছিল মালিয়ান। মেয়ের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে না পেরে বাবা এবং দাদা মেয়েটিকে খুন করে। ঝাঁসিতে রাখিবন্ধন উৎসবের দিন দলিত যুবকের সাথে প্রেম করার জন্য বোনকে খুন করে নিজের দাদা। ঠিক তার দু'দিন আগে দলিত যুবকটিকেও খুন করে বলে জানা গেছে।

এই ঘটনাগুলোর মধ্যে কি কোনও যোগসূত্র আছে? যোগীরাজ্যে দলিতদের জন্মদিন পালন করা, ম্যারেজ হল ভাড়া নেওয়া, মেয়েদের রাতে বাইকে চেপে রাস্তায় বেরোনো, ভিনজাতি সাথীকে ভালোবাসা, এমনকি উচ্চবর্ণের সাথে চেয়ারে বসে অনুষ্ঠান দেখা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শাস্তি মানে হেনস্থা-ধর্ষণ-খুন ইত্যাদি প্রভৃতি। এটাই ডবল ইঞ্জিন সরকারের আসলিয়াত।

২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে জাতি এবং ধর্মের নামে হানাহানি বৃদ্ধি পেয়েছে। উপরিউক্ত একটিও ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। ধারাবাহিকতা বজায় রেখে হিন্দুত্ববাদী শক্তি ক্ষমতায় থাকার সুবাদে দলিত, আদিবাসী, মুসলমান, প্রান্তিক যৌন-লিঙ্গের মানুষের নাগরিক অধিকার খর্ব করে চলেছে। হিন্দু ধর্মীয় স্থানগুলো এখন ক্রমে জাতিগত বৈষম্যকে প্রকট করার মঞ্চে পরিণত হয়েছে। ভারতে তথাকথিত 'উৎসবের মরসুমে' উচ্চবর্ণ হিন্দুরা যে শান্তি, ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির আদর্শকথা প্রচার করে, তার পেছনে এক অন্য বাস্তব লুকিয়ে আছে। গ্রামীণ স্তরের হিন্দু উৎসব ও পূজার সময় দলিতদের উপস্থিতি আজও তাদের কাছে কাম্য নয়। এই দেশের নাগরিক হিসেবে দলিতদের মৌলিক অধিকার আজও বারবার লঙ্ঘিত হচ্ছে। বহুবছর ধরে বহু মন্দিরে দলিতদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল, কিছু জায়গায় এখনও আছে।

দেশের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দলিত পড়ুয়াদের জন্য অসুরক্ষিত। আমরা জানি, রোহিত ভেমুলা, পায়েল তদভি, দর্শন শোলাঙ্কিদের কথা। ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়, আইআইটি, এনআইটি, আইআইএম এবং আইআইএসইআর- সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দলিত, বহুজন ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের ৯৮ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। 'তফসিলি জাতি ও তফসিলি উপজাতি (অত্যাচার প্রতিরোধ) আইন, ১৯৮৯' (PoA Act) অনুযায়ী নথিভুক্ত অপরাধের ক্ষেত্রে ২০২২ সালে ভারতীয় জনতা পার্টি শাসিত রাজ্যগুলিই শীর্ষস্থানে রয়েছে। উত্তরপ্রদেশে ২০২২ সালে সর্বাধিক ১২,২৮৭টি মামলা নথিভুক্ত হয়েছে, যা সমগ্র ভারতের ৫১,৬৫৬টি মামলার ২৩.৭৮ %। এই মামলাগুলির মধ্যে ৯৭.৭ % দলিতদের বিরুদ্ধে নিপীড়নের অভিযোগ। এর পরেই রয়েছে রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশ। দলিতদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের মামলার সংখ্যার দিক থেকে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে।

ফ্যাসিস্ট বিজেপি-আরএসএস চায় ভারতবর্ষকে হিন্দুরাষ্ট্র বানাতে। সেই হিন্দুরাষ্ট্রের হিন্দু কোনও দলিত হিন্দু নয়। আরএসএস'এর মতে হিন্দুরাষ্ট্রের হর্তাকর্তারা হবেন উচ্চবর্ণের হিন্দু। ব্রাহ্মণ। বিজেপি যতই বলুক দলিত-আদিবাসী সকলেই হিন্দু, ভারতীয় মুসলমানরাও হিন্দু–  আসলে তাদের কাছে শুধুমাত্র ব্রাহ্মণ পুরুষেরাই হিন্দু। তাই সারা দেশে দলিত হিন্দুরা স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরেও প্রতিদিন উচ্চবর্ণের কাছে নির্যাতনের শিকার হন।

সম্প্রতি দেশ জুড়ে বিভিন্ন রাজ্যে বিশেষ নিবিড় সংশোধন বা SIR শুরু হয়েছে। এসআইআর'এর নির্দেশিকা অনুযায়ী দেশের সমস্ত সাধারণ জনগণকে কাগজপত্র দেখিয়ে প্রমাণ দিতে হবে যে সে এই দেশের নাগরিক। বলাবাহুল্য, এসআইআর হল ঘুরপথে এনআরসি। সর্বজনীন ভোটাধিকার এবং নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার নীল নকশা। বিহারে এসআইআর প্রক্রিয়া চলাকালীন ভারতের দলিত সংগঠনগুলির শীর্ষ সংস্থা 'ন্যাশনাল কনফেডারেশন অব দলিত অ্যান্ড আদিবাসী অর্গানাইজেশনস' (NACDAOR) একটি সমীক্ষা পরিচালনা করে। এই সমীক্ষায় রাজ্যজুড়ে তফসিলি জাতি (SC) সম্প্রদায়ের ৮,৫০০টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। ৫,৯৮৩ জন (৭১.৫৫%) উত্তরদাতা জানান, তাঁরা এই চলমান প্রক্রিয়ার ফলে ভোটাধিকার হারানোর আশঙ্কা অনুভব করছেন। ইতিমধ্যে বাংলায় এসআইআর শুরু হয়ে গেছে। এখানেও আমরা দেখতে পাচ্ছি, গরীবগুর্বো মানুষেরা কী প্রবল অসহায়তায় দিন পেরোচ্ছে! অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। প্রান্তিক অংশের মানুষেরা বিপর্যস্ত। দলিত, মতুয়া, নমঃশূদ্র, রাজবংশী, আদিবাসী, মুসলমান, মহিলাদের হয়রানি অন্তহীন। যাদের ভোট পেয়ে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছিল, সেই গণদেবতারই আজ নিজেকে এ'দেশের নাগরিক হিসেবে প্রমাণ করার দায়! সুতরাং, অঙ্ক মিলছে। সাধারণ মানুষের কাছে আজ বিজেপি-আরএসএস'এর চক্রান্ত জলের মতো স্বচ্ছ। অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করার নামে আরও একবার দেশের প্রান্তিক জনজাতি গোষ্ঠীর উপর সার্বিক হামলার নামই এসআইআর, এ'কথা ভুক্তভোগীদের বুঝতে বাকি নেই। এখন পক্ষ মাত্র দুটো। নয় আপনি হিন্দুরাষ্ট্রের, থুড়ি বিজেপি'র গোলামির পক্ষে, নতুবা প্রতিবাদী জনতার পক্ষে। সময় ফুরোচ্ছে। পক্ষ বেছে নিন।

অনেকেই হয়তো নিশ্চয়ই শাজিয়া ইকবাল পরিচালিত ছবি 'ধড়ক ২' দেখেছেন। 'ধড়ক ২'এর নীলেশ, শেখররা আসলে বাস্তবের রোহিত, অনিকেত আরও অনেকে। এই সিনেমায় যে কথাটা সোচ্চারে বলা হয়েছে, পরিশেষে সেটাই আরও একবার বলার– "ইউ ডু নট ফাইট ফ্যাসিজম বিকজ ইউ আর গোয়িং টু উইন, ইউ ফাইট বিকজ ইটস ফ্যাসিস্ট।"

0 Comments

Post Comment