কোন পথে গ্রাম-রাজনীতি
এভাবে দেখলে, গ্রামবাংলার ইতিহাস হল যখনই নিম্নবর্গের উত্থান ঘটেছে, সে কংগ্রেস বা বাম যে দলের নেতৃত্বেই হোক না কেন, তাতে নিম্নবর্গের মানুষের অন্তর্লীন চেতনা, বিক্ষোভ ও প্রতিরোধ সকল সময়েই ‘সচেতন’ পার্টি-নেতৃত্বের ধ্যানধারণা ও নির্দেশনা ছাপিয়ে গেছে। নিম্নবর্গের এই উত্থানগুলোই রাজ্য-রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করেছে---কংগ্রেস জমানার অবসান ঘটিয়ে বাম জমানা নিয়ে আসার পেছনে যেমন কাজ করেছিল গ্রামীণ নিম্নবর্গের নিজস্ব চেতনা, আবার সেই একই চেতনা সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে কৃষক জাগরণ-পর্বে প্রবল প্রতাপশালী বাম দলগুলোকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিতে মুখ্য ভূমিকা নিল।
জমানা বদলের পর অর্থাৎ তৃণমূল রাজত্বকালে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতা কাঠামোয় খুব পরিবর্তন হল, এমনটা ভাবলে ভুল ভাবা হবে। বলা যায়, সিপিএম পার্টি-প্রশাসনিকতার যে সম্মিলন ঘটিয়ে দীর্ঘকাল এই রাজ্যে ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছিল, সেই একই পদ্ধতি তৃণমূল দলও অনুসরণ করে চলেছে, যেখানে গ্রামস্তরে পার্টি পঞ্চায়েত এবং ব্লক স্তরে প্রশাসন হাতে হাত মিলিয়ে গ্রামীণ মানুষের ওপর একইসাথে আধিপত্য ও সুযোগ-সুবিধা বিতরণের কর্মসূচি পালন করে চলে। এই আমলে একদিকে আরও অনেক জনবাদী প্রকল্প কার্যকর করে গ্রামীণ মানুষকে রাষ্ট্র-অভিমুখী করে তোলার প্রচেষ্টা নেওয়া হল। অন্যদিকে, নিম্নবর্গের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ উৎসারণ একপ্রকার নিষিদ্ধ করা হল। এর ফলে, গ্রামবাংলার গরিব মানুষ, মূলত মুসলিম ও তফশিলি জাতি উপজাতির মানুষজন, যাদের মধ্যে সাংগঠনিক জাল বিস্তার করে সিপিএম দীর্ঘ শাসন চালিয়েছে, তাদের সাথে তৃনমূল শাসকদের সম্পর্ক হল জটিল, একইসাথে সুযোগসুবিধা পাওয়ার জন্য নির্ভরতা, আবার উচ্চবর্গ-নির্ভর অপশাসনের বিরুদ্ধে চাপা ক্ষোভ ও অসন্তোষ।
সিপিএম যেহেতু গ্রামাঞ্চলে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য পুরোপুরি প্রশাসন-নির্ভর হয়ে পরেছিল, তাই ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার সাথে সাথে তাদের প্রবাদপ্রতিম গ্রামীণ সংগঠন রাতারাতি শূন্যে বিলীন হয়ে যায়, আর কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার সুবাদে সেই স্থান দখল নেয় বিজেপি। লালঝাণ্ডার পরিবর্তে বাংলার গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে তৃণমূলের ঘাসফুল আর বিজেপির পদ্ম-চিহ্নিত পতাকা। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতার রাজনীতিতে দীর্ঘদিন প্রান্তে পড়ে থাকা বিজেপি যে দ্রুতগতিতে নব্য শাসক দলের টেক্কা দিতে উঠে এল তার পেছনে যতটা না মোদী-ম্যাজিক কাজ করল, তার থেকে বেশি ছিল গ্রামস্তরে পূর্বতন বাম নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ভোলবদল। তৃণমূলকে মোকাবিলায় অক্ষম সিপিআই(এম) বিজেপিকে মাঠ ছেড়ে দিয়ে বাংলার রাজনীতিতে নিজেরা প্রান্তিক হতে হতে শূন্যে পৌঁছে গেল। আর এরই ফলে, একদা বাম দলগুলোর ঘাঁটি তফশিলি জাতি ও উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে হিন্দুত্ববাদী শক্তি দ্রুত প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হল।
এইভাবে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি আজ এক সন্ধিক্ষণে এসে পৌঁছেছে, নিম্নবর্গের মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভকে পুঁজি করে হিন্দুত্ববাদের উত্থান, এবং তার সুবাদে গরিব-মধ্যবিত্ত জনতার মধ্যে ক্রমব্যাপ্ত সাম্প্রদায়িক বিভাজন এই বঙ্গের সমাজ-রাজনীতিতে অশনিসংকেত হয়ে দেখা দিয়েছে। গ্রামসমাজে উচ্চবর্গ ও নিম্নবর্গের মধ্যে যে আড়াআড়ি বিভাজন একটা সময়ে বহু কৃষক আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল, আজকের সময়ে পার্টি-রাজনীতির প্রভাবে তা বদলে গেছে দল-ভিত্তিক খাড়াখাড়ি বিভাজনে, নিম্নবর্গের মানুষ ভাগ হয়ে গেছে বহু দল-উপদলে। এই বিভাজনের রাজনীতি সর্বনাশা, যা দরিদ্র শ্রমজীবী জনসম্প্রদায়গুলিকে ধর্ম-ভিত্তিতে ভাগ করে নিম্নবর্গের মধ্যে যেটুকু ঐক্য অবশিষ্ট ছিল, তাও নিশ্চিহ্ন করতে উদ্যত হয়েছে।
এই অবস্থায় পার্টি ও ধর্ম-ভিত্তিক বিভাজনের বেড়া ভেঙে গ্রামবাংলার নিম্নবর্গের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজটি কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়েছে, এবং সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়ার জন্য সংগঠিত রাজনীতির কোন অংশের কোনও ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। লক্ষনীয় হল, হিন্দুত্ববাদী শক্তির প্রবল উত্থান ও উস্কানি সত্ত্বেও গ্রামবাংলায় কিন্তু সাম্প্রদায়িক হানাহানি বা উত্তেজনা ছড়ানোর ঘটনা এখন অবধি খুবই নগণ্য, যা দেখিয়ে দেয় নিম্নবর্গের মানুষ নিজস্ব চেতনা ও শুভবুদ্ধির জোরেই এযাবত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রেখে চলেছেন। সন্দেহ নেই বিজেপি রাজ্যের ক্ষমতায় এলে এই অবস্থার বিপুল পরিবর্তন হবে, তখন রাষ্ট্রীয় প্রশাসন ও হিন্দুত্ববাদী দলবল সংখ্যালঘু মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিবর্তন করবে, শুধু তাই নয় সমাজের অন্য সকল অংশের মানুষের ওপরেও দমন-পীড়ন অন্যমাত্রা পাবে।
খেয়াল রাখা দরকার, পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ মুসলিম, ২৩.৫ শতাংশ দলিত (নিম্নবর্ণ) এবং ৫.৮ শতাংশ আদিবাসী, সব মিলিয়ে প্রায় ৬০ শতাংশ অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ সামাজিকভাবে অবহেলিত এবং আর্থিকভাবে বঞ্চিত বর্গের মানুষ। আবার এই নিপীড়িত জনগোষ্ঠীগুলোর আবাস যেহেতু প্রধানত গ্রামবাংলায়, এরাই গ্রামীণ জনতার বিপুল অধিকাংশ, ব্রাহ্মন্যবাদী দর্শন অনুযায়ী যারা অন্ত্যজ (হীনজাত)---যেমন শূদ্রের জন্ম স্রষ্টার পা থেকে---তাই এদের পায়ের তলায় রাখাই হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ। এর সাথে ধরতে হবে নারী সম্পর্কে সংঘ পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি, নারীকে সর্বদা পুরুষের অধীন রাখাই যেখানে স্বাভাবিক বলে গণ্য। তাই বিজেপি এরাজ্যে ক্ষমতায় এলে তাদের আগ্রাসী বৈষম্যের শিকার হবেন নারীসহ এই সকল সম্প্রদায়ের মানুষ, ফলত তৈরি হবে নতুন করে নিম্নবর্গের প্রতিরোধের জমি, নিম্নবর্গের জাগরণের ভিত্তি। হয়তো সেই পরিস্থিতি আবারো এরাজ্যে নিম্নবর্গের ক্রমবিলীন চেতনা উন্মেষের পথ খুলে দেবে। মুসলিম, দলিত ও আদিবাসী জনতার ঐক্যের ওপরেই নির্ভর করছে নিম্নবর্গের রাজনীতির পুনরুত্থান।
এই আশা-নিরাশায় দোলায়মান গ্রাম-রাজনীতির ক্রম-বিবর্তন বুঝতে হলে কোন পূর্বানুমান ও পক্ষপাতদুষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী বিসর্জন দিয়ে বিভিন্ন পার্টি-রাজনীতিতে বিভাজিত মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠ সংযোগ স্থাপন করে প্রকৃত অবস্থার নিবিড় অনুসন্ধান করতে হবে। বাস্তব অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষণ থেকেই একমাত্র শুরু হতে পারে নতুন তত্ত্ব ও অনুশীলনের পথ খোঁজা।
আজকের বিশ্বজোড়া পুঁজির শৃঙ্খল ভেঙে কোনও খন্ড-ক্ষুদ্র জনসমষ্টি মুক্তির স্বপ্নটুকুও দেখতে পারে না। উন্নত সমাজদর্শনের অভাবেই বাংলার গ্রামসমাজ সংগঠিত রাজনীতির এক ঘরানা থেকে অন্য ঘরানায় আবর্তিত হয়ে চলেছে। বহু অশ্রু-ঘাম-রক্তের বিনিময়ে গ্রামের নিম্নবর্গের মানুষ দুনিয়াকে চিনছেন, জানছেন। সমাজকে ভাঙছেন, গড়ছেন। যেকোনও পালাবদলে, এমনকি দৈনন্দিন রাজনীতির ঘাত-প্রতিঘাতে তাদেরই রক্ত ঝরছে। তারাই সবচেয়ে বেশি মূল্য দিচ্ছেন। তাই তাদের বুঝতে-জানতে যেতে হবে তাদেরই কাছে। যেতে হবে শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতার মনোভাব নিয়ে, ছাত্রের মতো শেখার মনোভাব নিয়ে। তবেই বাংলার গ্রামসমাজের গর্ভে লুকিয়ে থাকা অসীম রত্নভাণ্ডারের সন্ধান পাওয়া যাবে, বোঝা যাবে গ্রামসমাজে পরিবর্তনের গতিপ্রকৃতি, যার মধ্যে মিললেও মিলতে পারে সমাজবদলের চাবিকাঠির হদিশ।
(২০০৫ সালে পশ্চিমবাংলার কিছু গ্রামের নিবিড় সমীক্ষার ভিত্তিতে রচিত ‘গ্রামবাংলার রাজনীতি’ শীর্ষক বই-এর মুখবন্ধ হিসাবে এই লেখাটি তৈরি করা হয়েছিল। সেই বই এখন নিঃশেষিত। তাই বর্তমান প্রেক্ষাপটে লেখাটির প্রাসঙ্গিকতা অনুধাবনে পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত করে প্রবন্ধটি পুনঃপ্রকাশ করা হল।)