পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

এই সময়

  • 01 January, 1970
  • 0 Comment(s)
  • 202 view(s)
  • লিখেছেন : অমিতাভ সরকার
প্যাকিংবাক্সের কাঠ দিয়ে তৈরি ছোট একটা বাক্স গাড়ির টায়ার কাটা ফিতে কাঁধে ঝুলিয়ে আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে প্রায়ই হেঁকে যেতে দেখি লোকটাকে— জুতো সেলাই…পালিশ…। বেঁটেখাটো, রোদে পোড়া কালচে রোগাটে শরীর, মাথায় হালকা চুল মাঝবয়সী লোকটা। বর্ষা, শীত, এমন কী গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে রাস্তা যখন সুনসান, রোদ মাথায় নিয়ে হেঁকে যায় সে— জুতো সেলাই... পালিশ...৷

পরিবারের কারো চটি, জুতো একটুআধটু ছিঁড়ে গেলে এই ডাকের অপেক্ষায় থাকি। এলাকায় অনেকেই চেনেন তাঁকে। নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ছিঁড়ে যাওয়া বা আঠা খুলে যাওয়া চটি, জুতো সারাই কিম্বা পালিশ করার ভরসা এই মানুষটি। রাখাল দাস, জুতো সারাই করার ফাঁকে নাম জেনে নিয়েছিলাম তাঁর। মাঝেমধ্যে বাড়িতে আসাযাওয়ার কারণে আমাদের মধ্যে সখ্যতা গড়ে উঠতে খুব একটা দেরি হয়নি, ‘বাবু’ থেকে ‘বাবুদা’ হয়ে গেছি। আমাদের সামনের গ্রিলের বারান্দায় বসে সূচের আগায় সুতো জড়িয়ে জুতোয় ঢোকাতে ঢোকাতে কিম্বা চটিতে আঠা লাগাতে লাগাতে আড্ডা দিতাম তাঁর সঙ্গে।                                          

            সাতসকালে কাঁচালঙ্কা আর পেঁয়াজ দিয়ে পান্তা খেয়ে বেরিয়ে পড়ে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিকেল। সারাদিনে দুশো-আড়াইশো, খুব বেশি হলে তিনশো টাকা তার রোজগার। কোনোদিন খালি হাতেই ফিরতে হয় তাকে। এক-একদিন এক-একদিকে…। অবশ্য প্রতিদিন তা সম্ভব হয় না। দুটি সন্তান, ছেলে বড়ো, এইট আর মেয়ে ক্লাস  সিক্সে পড়ে। খুব ইচ্ছে দুই সন্তানকে যতদূর সম্ভব পড়াশোনা করানো। নিজে এলাকার প্রাইমারী পেরিয়েছে কোনোক্রমে। নিজের মনের কোণে ইচ্ছেটা ছেলেমেয়েদের মধ্যে পেতে চায় রাখাল। কিন্তু এই রোজগারে সংসারই চলে না, তার ওপর তাদের পড়াশোনা…। এখন তো প্রাইভেট টিউটর ছাড়া পড়াশোনাই হয় না। তাই বেশ কয়েক বছর হলো স্ত্রী মধ্যমগ্রামের এক প্রবীণ দম্পতির ফ্ল্যাটে রান্না করা, ঘরদোর পরিষ্কার, সেই সঙ্গে তাঁদের দেখাশোনার কাজ করেন। প্রয়োজনে রাতেও থেকে যেতে হয় প্রবীণ দম্পতির ফ্ল্যাটে। অবশ্য স্ত্রীর এই কাজ ছিল বলেই লকডাউনের সময় সামান্য কিছু হলেও তাদের আহার জুটেছে। লকডাউন সময়ে রাখালকে কপর্দকশূন্য অবস্থায় গৃহবন্দি থাকতে হয়েছে দিনের পর দিন। সেই সময় প্রবীণ দম্পতি না হলে কি যে হতো, সে কথা ভাবলেই এখনো শিউরে ওঠে রাখাল। প্রবীণ দম্পতির প্রতি তাঁদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।     

        এমন অবস্থা চিরকাল ছিল না তার। একটা সময় ছিল, স্বচ্ছতা না থাকলেও সংসার চালাতে বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি কোনোদিন। সেই সময়ে মা একটু সুখের মুখ দেখার জন্য একরকম জোর করেই বিয়ে দিয়েছিলেন রাখালকে। সারাটা জীবন অনেক কষ্ট করেছেন ভদ্রমহিলা। ছেলেকে বিয়ে দিয়ে একটু সুখের মুখ দেখতে চেয়েছিলেন। তাছাড়া আত্মীয় পরিজনহীন ছেলেকে বিয়ে দিলে আর একটি পরিবারে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। মনের কোণে এই ইচ্ছেটাও ছিল তাঁর।                  

        ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের সময় বিধবা ভদ্রমহিলা একমাত্র সন্তান রাখালকে কোলে নিয়ে পায়ে হেঁটে বনগাঁ বর্ডার পেরিয়ে চলে এসেছিলেন। দেশগ্রামের তাদের মতোই এক পরিচিত উদ্বাস্তু ব্যাক্তির সাহায্যে  মধ্যমগ্রাম স্টেশনের কাছে লাইনের ধারে বস্তিতে ঘরভাড়া নিয়েছিলেন। সেই ব্যাক্তির সাহায্যে প্রথম দিকে গৃহস্থের বাড়িতে বাসন মাজা, ঘর মোছা, পরবর্তীতে বস্তীর এক মহিলা তাঁর হাতে কাঁথায় নকশার কাজ দেখে মহাজনের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছিলেন। তারপর থেকে মহাজনের কাছ থেকে আনা ব্লাউজের হেম সেলাই, হুক লাগানো, বোতামের ঘর সেলাই, কখনো কখনো ব্লাউজের হাতায় নকশা তৈরি করে সামান্য জমিয়ে ফেলেছিলেন রাখালের মা। সেই জমানো পয়সা দিয়ে সস্তায় দেড়'কাঠা জমি কিনে ফেলেন মধ্যমগ্রাম থেকে বেশ খানিকটা দূরে 'খুলনা পল্লী'তে। যেখানে বাংলাদেশ থেকে আগত উদ্বাস্তুরা সকলে মিলে জলাজমির ওপর বাসা বেঁধে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। বেশ কয়েকমাস পর জমানো সামান্য টাকা আর মহাজনের কাছ থেকে ধার করে বাঁশের চাটাই আর মাটির টালি দিয়ে ঘর তৈরি করে রাখালকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন তিনি।               

            প্রাইমারি স্কুলের পড়া শেষ করতেই রাখালকে খুলনা পল্লীর এক জুতোর কারিগর, বিলাসের সঙ্গে কাজে লাগিয়ে দিয়েছিলেন রাখালের মা। হাতের কাজ জানলে কোনোদিন ভাতের অভাব হবে না, এই কথা ভেবে। মহাজনের কাছ থেকে আনা জুতো-চটির বিভিন্ন অংশ জুড়ে অর্ডার সরবরাহ করতে বিলাসের সঙ্গে রাখালও হাত লাগানো শুরু করে। রাখালের কাজে খুশি হয়ে মাঝেমধ্যে দু-পাঁচ টাকা হাতে গুঁজে দিতেন বিলাস। তাতে রাখালের উৎসাহ বেড়ে গিয়েছিল। জুতো-চটির অংশ জুড়ে পূর্ণ অবয়ব আনতে নেশা ধরে গেল রাখালের। সেই নেশায় সময়ের দিকে খেয়াল থাকত না তার। হ্যাজাকের আলোয় কাজ করতে করতে কখনো কখনো রাত এগারোটা, সাড়ে এগারোটা হয়ে যেত। রাখালের দেরি দেখে অন্ধকারে কুপি জ্বালিয়ে মা আসতেন খোঁজ নিতে। রাখালের কাজের আগ্রহ দেখে বিলাস বলত— ‘তোমার ছেলে একদিন ভালো কারিগর হবে গো দিদি…’।             

          কয়েকবছর পর কারিগর বিলাসের বদান্যতায় রাখাল যুক্ত হলেন বারাসাতের একটি জুতো তৈরির দোকানে। যেখানে একটু স্বচ্ছল মানুষ পছন্দমতো জুতোর অর্ডার দিতে আসতেন। সেই সময়ে সেটাই চল ছিল। প্রথম প্রথম কারখানায়, পরে একটু বেশি রোজগারের আশায় কারখানা থেকে কয়েক জোড়া জুতো-চটির সোল, সুকতলা, আপার নিয়ে আসত রাখাল। অনেক রাত পর্যন্ত পেস্টিং, সেলাই করে সকালে ডিউটিতে যাওয়ার সময় সঙ্গে করে নিয়ে যেত। এই সময়েই রাখালের মা রাখালকে বিয়ে দিয়েছিলেন ।      

        বিয়ের পর প্রায় ছয়-সাত বছর বেশ চলছিল সংসার। ইতিমধ্যে দুই সন্তান হল, ছেলের ভরা সংসার দেখে চোখ বুজলেন রাখালের মা। তারপর থেকেই কেমন যেন পালটে যেতে লাগল রাখালের দুনিয়াটা। একে একে জুতোর কারখানা, দর্জির দোকানের ঝাঁপ বন্ধ হতে থাকল। ফলে কর্মহীন হয়ে পড়ল কারিগরেরা। রাখালের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। চারপাশে গড়ে উঠল আলো ঝলমলে বড় বড় জুতোর দোকান, শোরুম, মল। সেখানে শোকেসে শোভা পেতে থাকল পুরুষ ও মহিলাদের মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির আকর্ষনীয় রেডিমেট বস্ত্রসম্ভার ও হরেকরকম মনোহর জুতো। যাকে চলতি কথায় বলে ব্রান্ডেড। যেগুলি নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা এতকাল শুনেছে আর চোখে দেখেছে সিনেমায়, বিজ্ঞাপনে…। হঠাৎই সবকিছু মধ্যবিত্তের হাতের নাগালের মধ্যে চলে এলো।     

        অন্যদিকে কর্মহীন কারিগরদের শুরু হলো কাজ খোঁজার পালা। কেউ চলে গেলেন রাজমিস্ত্রির হেল্পারের কাজে…। কেউ কেউ চলে গেলেন ইঁটভাঁটায়…। কেউ পার্টির দাদাদের ধরে লোকাল ট্রেনে হকারি শুরু করলেন। আর রাখালের মতো কয়েকজন কাঠের বাক্সে যন্ত্রপাতি নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরতে লাগল— জুতো সেলাই…পালিশ…।   

        একদিন একটা বেশ দামি চামড়ার চপ্পলের সোল ফেটে যাওয়ায় রাখালকে ডেকে দেখালাম। রাখাল পরামর্শ দিল আপার পোরশন খুব ভালো আছে। শ’তিনেক টাকা খরচ করে সোল লাগালেই নতুনের মতো হয়ে যাবে। দীর্ঘদিন ব্যবহার না করার ফলে সোল শুকিয়ে ফেটে গেছে। আমি রাজী হওয়ায় সাইজ মতো সোল কেনার জন্য চপ্পলের একপাটি নিয়ে গেল।  

        দিন সাতেক পর সকালে কলিং বেল শুনে দরজা খুলেই দেখলাম রাখালের হাসিমুখ। বারান্দার গ্রিলের দরজা খুলে ফ্যানটা চালিয়ে বসলাম তার পাশে। রাখাল কাঠের বক্স থেকে কাগজ জড়ানো একপাটি চপ্পল বের করল। দেখলাম, প্রায় নতুনের মতো ঝকঝক করছে আমার চপ্পলের একপাটি। বারান্দায় কোণে রাখা আরেকপাটি  চপ্পল নিয়ে সোল লাগাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল রাখাল। কাজ করতে করতে বলল—    

‘জানেন বাবুদা, ছেলে অভি সামনের বছর স্কুল ফাইনাল দেবে। একটা কোচিং ক্লাসে ভর্তি করে দিয়েছি। সামনের বছরে মেয়েকেও দিতে হবে। একটু থেমে আনমনা হয়ে যেন নিজেকেই বলল— ‘খাটতে হবে, আরো খাটতে হবে আমাদের দু’জনকে…’।           

সোলের উপরে আপার পোরশনটা সেলাই করে যত্ন করে পালিশ করে দিল রাখাল। চপ্পল জোড়া আর একবার ব্রাস দিয়ে ঘসে এগিয়ে দিয়ে আমাকে পরে হাঁটতে বলল। বারান্দার এমাথা থেকে ওমাথা হাঁটলাম তার কথামত। ঘরের ভেতরে গিয়ে তিনশো টাকা নিয়ে এসে এগিয়ে দিলাম তার দিকে। রাখাল জানাল, বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে নিয়ে যাবে টাকাটা। হাতে ঝোলানো একটা বাজার করা থলিও রেখে গেল রাখাল।        

        সেদিন বিকেলে এলো না রাখাল। একদিন… দুদিন… দেখতে সপ্তাহ পার হয়ে গেল, রাখাল এলো না। ভাবলাম যা গরম, হয়তো অসুস্থ হয়ে পড়েছে, সুস্থ হলে চলে আসবে। কিন্তু দেখতে দেখতে এক মাস পেরিয়ে গেল, রাখালের দেখা মিলল না। মনের মধ্যে অশুভ চিন্তা আচ্ছন্ন করল। তাছাড়া তার প্রাপ্য টাকাটাও দেওয়া দরকার। রাখালের বাড়ি যাওয়ার মনস্থির করলাম। একদিন ভোরে উঠে একটা সাইকেল ভ্যান ভাড়া করে রওনা হলাম। ঠিকানা ছিল না, কারবালা পেরিয়ে ‘খুলনা পল্লী’ এইটুকুই শুনে ছিলাম রাখালের কাছে।          

        খুলনা পল্লীতে রাখালের বাসার সন্ধান পেতে খুব একটা অসুবিধা হলো না। লোকজনদের দেখিয়ে দেওয়া একটা টালির ছাদ দেওয়া বাঁশের চটার বেড়া দেওয়া বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। রাখাল… হাঁক পাড়তেই একজন বছর চল্লিশেক মহিলা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, সঙ্গে চোদ্দ-পনেরো বছরের কিশোরী। তাদের দেখেই বুঝলাম, রাখালের স্ত্রী ও মেয়ে। আমার পরিচয় দিতে সামান্য এগোতেই মহিলা কিশোরীকে বললেন—

“তোর বাবার বাবুদা-জেঠু, প্রণাম কর” । বলেই শশব্যস্ত হয়ে একটা প্লাস্টিকের চেয়ার ঘর থেকে বাইরে নিয়ে এসে বসতে বললেন। রাখালের কথা জিজ্ঞাসা করতেই ভদ্রমহিলা জানালেন— 

“সেদিন দুপুরে রাখাল হঠাৎ কাঁপিয়ে জ্বর আসায় একটা গাছের তলায় শুয়ে পড়ে। রাখালের কয়েকজন সহকর্মী তাকে ধরে বাসায় নিয়ে আসে। রাতে জ্বরের সঙ্গে শুরু হয় কাশি। কফের সঙ্গে সামান্য রক্তের আভাস দেখে পড়শির কয়েকজন মধ্যমগ্রাম হাসপাতালে নিয়ে যায়” ।

“এখন কোথায় আছে রাখাল?”  উৎকণ্ঠায় কথাটা শেষ করতে দিলাম না মহিলাকে। মহিলা জানালেন—

“রাখাল এখন কল্যাণী টিবি হাসপাতালে…” । 

কথা বলতে বলতে এক যুবক এসে সামনে দাঁড়াল। ঘামে ভিজে জবজবে জামা, আধময়লা সস্তার জিন্সের প্যান্ট, কাঁধে একটা বড় ঝোলা ব্যাগ। মহিলা আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন বাবার ‘বাবুদা’ বলে। ব্যাগটা রেখে আমাকে প্রণাম করে ছেলেটি দাওয়ায় বসে পড়ল।

“সামনের বছর তোমার স্কুলফাইনাল না?”  

“হ্যাঁ, পরীক্ষা তো দিতেই হবে। বাবা কোচিং-এ ভর্তি করে দিয়েছিল, ছেড়ে দিয়েছি। সংসার চালানোর জন্য কিছু তো করতে হবে। তাই এখন ট্রেনে হকারি করছি। যদিও মনে হচ্ছে হকারি আর থাকবে না বেশীদিন, নোটিস এসে গেছে। ইউনিয়নের সবাই খুব চিন্তায় আছে” ।     

রোদ তেতে উঠেছে, রওনা হওয়ার আগে পাঁচশো টাকার একটা নোট এগিয়ে দিয়ে বললাম—  

“রাখাল আমার কাছে রেখে গিয়েছিল…”। 

কিছু বলার আগে ভ্যানে চেপে বসলাম। ভ্যানের সামনে পা ঝুলিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ রাখালের ছেলের কথা ভেসে উঠল, ‘যদিও হকারি আর থাকবে না বেশীদিন, নোটিস এসে গেছে’। মনে পড়ে গেল কয়েকদিন আগে কাগজে পড়েছিলাম… শিরোনামে বড় বড় হরফে লেখা— 

‘হাওড়া-শিয়ালদহ ট্রেনে হকারি বন্ধে কেন্দ্রের ফরমান’। লোকাল ট্রেনে হকারি করে দিন গুজরান করেন হাজার হাজার মানুষ। এবার তাঁদের পেটে লাথি মারতে চলেছে রেল। হাওড়া-শিয়ালদহ লাইনের ট্রেনে হকারি বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে খবর। যার জেরে কর্মহীন হয়ে পড়তে পারেন এই লাইনে হকারি করা লক্ষাধিক মানুষ…’

বেশ মনে আছে, আর্টিকলের মাঝখানে বক্সে বড় বড় হরফে লেখা ছিল—  

‘…শোনা যাচ্ছে, নয়ডার কর্পোরেট সংস্থাকে ট্রেনে খাবার বিক্রির দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, যারা এবার ট্রেনে চা-ঝালমুড়ি বিক্রি করবে’।

#       

        একটা বিশেষ কাজে কলকাতায় যাওয়ার দরকার ছিল। সকালে স্নান খাওয়াদাওয়া সেরে স্টেশনে এলাম। ষ্টেশনের চারপাশটা দেখে মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে প্যাটফর্ম মাঝখানে সাজানো গোছানো চা-কফির কর্নার আর একটি জনপ্রিয় কোম্পানির কেক-পেস্ট্রির আউটলেট। অধিকাংশ যাত্রী কার্ড ঠেকিয়ে মেসিন থেকে টিকিট বের করে নিচ্ছে। আমি কাউন্টারে একশো টাকা এগিয়ে দিয়ে বললাম—'একটা শিয়ালদা রিটার্ন’। কাউন্টারে বসা ভদ্রমহিলা আমাকে কুড়িটাকা ফিরিয়ে দিলেন। টিকিটটা যাচাই করার জন্য চোখ বোলালাম। আসাযাওয়ার ভাড়া বাবদ আশি টাকার মধ্যে আছে… কনভেন্স ফি, ট্রাভেল ইনস্যুরেন্স আর কি কি আছে ঠিক বোঝা গেল না।  

প্ল্যাটফর্মে একটা কোম্পানির বিজ্ঞাপনে মোড়া ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল, উঠে পড়লাম একটা কম্পার্টমেন্টে। আগের চেয়ে বেশ ঝকঝকে হয়েছে কম্পার্টমেন্ট, চতুর্দিকে করপোরেটের চমকপ্রদ সুন্দরী মেয়েদের ছবি ব্যবহার করা বিজ্ঞাপন। দেওয়ালের ওপরের দিকে প্রধানমন্ত্রীর শুভ্রশ্মশ্রু মুখের সহাস্য ছবি। নিচে লেখা— ‘দেশ এখন উন্নততর ভবিষ্যতের পথে’। ট্রেনের সাউণ্ডবক্সে মৃদুস্বরে যন্ত্রসঙ্গীত…। প্রতিটি ষ্টেশন আসার আগে সুমিষ্ট মহিলা কন্ঠে জানিয়ে দিচ্ছে ষ্টেশনের নাম।

        শিয়ালদহ ষ্টেশনে ট্রেন থেকে নামতেই চমক্ লাগল! এ কোথায় এলাম! চারপাশটা মলের মতো চেহারা নিয়েছে! ঝাঁ-চকচকে, আলোর রোশনাই, সবুজ গ্রেনাইডে পাথরের মেঝে, চোখের সামনে ‘অঞ্জলী’, সেনকো জুয়েলার্স, ব্রেণ্ডেড কোম্পানির রেডিমেট গার্মেন্টস, জুতোর শোরুম, আর একদিকে ফুডকোর্ট। সেখানে অনেকখানি জায়গা জুড়ে আছে হলদিরাম, কেএফসি, ডোমিনস্ ম্যাক-ডোনাল্ডস ইত্যাদি নানান ফাস্ট ফুডের কাউন্টার আর আইসক্রিম পার্লারে জমজমাট।  

        অফিস ছুটির পর ভীড়ের কথা ভেবে কাজ সেরে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই শিয়ালদহ স্টেশনে পৌঁছালাম। ষ্টেশনে এসে কফি কাউন্টারে এককাপ কফি চাইলাম। একটু বড় কাগজের কাপে মেসিন থেকে নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে দিলো কাউন্টারে ইউনিফর্ম পরা সপ্রতিভ যুবক। কফি খেয়ে পেছনের পকেট থেকে পার্টস হাতে নিয়ে কফির দাম জিজ্ঞাসা করতে যুবকটি নির্লিপ্ত ভাবে জবাব দিল—‘ওয়ান ফিফটি স্যার’। জবাব শুনে একটু অবাক হয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলাম। এবারে যুবকটি বাংলায় জানাল— ‘একশো পঞ্চাশ টাকা’। এককাপ কফির দাম একশো পঞ্চাশ! অনিচ্ছাসত্বে নিরুপায় হয়ে যুবকটিকে টাকা দিয়ে ট্রেন ধরার জন্য পা বাড়ালাম।    

        ট্রেনে খুব একটা ভিড় নেই, একদিকে ধার ঘেঁসে বসার জায়গা পেয়ে গেলাম। একে একে হকারেরা পেরিয়ে যাচ্ছে…। তাদের বাংলা, হিন্দির পরিমার্জিত কন্ঠস্বর শুনে তাকালাম! দেখলাম নির্দিষ্ট পোষাক পরা কয়েকজন যুবক নাইট্রোজেন গ্যাসভর্তি আকর্ষনীয় রঙিন প্যাকেটে বাদাম, ঝালমুড়ি, কেক, চকলেট, প্যাটিস ইত্যাদি ট্রেতে সাজিয়ে একে একে এসে চলে যাচ্ছে তারা! এরা কারা? এদের তো দেখিনি কোনোদিন! ভাবতে ভাবতে হঠাৎ কানে এলো একটা পরিচিত ডাক… জুতো সেলাই… চটি সেলাই…। ডাক শুনে চোখ মেলে দেখলাম, আমি বিছানায় শুয়ে, জানালার বাইরে ঝলমল করছে রোদ।         

নিজেকে একটু সামলে নিয়ে ‘রাখাল…’ বলে চিৎকার করে ছুটে গিয়ে দরজা খুললাম। দেখলাম গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রাখালের ছেলে অভির সমবয়সী এক যুবক। ‘আমাকে ডাকছেন বাবু…?’

 

            

            

0 Comments

Post Comment