পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

পড়শি যদি আমায় ছুঁতো যম যাতনা সকল যেত দূরে: লালন সাঁই

hhhhhhhhhhhhhh

নিউজক্লিকের দরজায় মিডনাইট নক কেন?

  • 10 October, 2023
  • 0 Comment(s)
  • 807 view(s)
  • লিখেছেন : মানস ঘোষ
নিউজ ক্লিক কিন্তু হঠাৎ গজিয়ে ওঠা নিউজ পোর্টাল নয়। এদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালে। নিউজ ক্লিক একটি স্বাধীন মিডিয়া হাউস যারা সমালোচনামূলক সাংবাদিকতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে বরাবর। যাদের অন্যতম বড় কৃতিত্ব হল, গোদি মিডিয়া যখন কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে নীরব, তারা তখন ঐ আন্দোলনের প্রায় প্রতিদিনের বিবরণী দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। এবার বোঝা যাচ্ছে অমিত শাহের দিল্লি পুলিশ, কেন ভোর না হতেই, পৌঁছে গিয়ে নিউজ ক্লিকের দরজায় কড়া নেড়েছিল?

গত ৩রা অক্টোবর এদেশের সংবাদমাধ্যমের ইতিহাসে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেল। নিউজ ক্লিক-এর অফিসে কাকভোরে হানা দিল দিল্লী পুলিশ। ইউএপিএ আইনের বলে গ্রেফতার করা হলো সংবাদসংস্থাটির প্রধান সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থ এবং সংস্থার মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান অমিত চক্রবর্তীকে।

শুধু এটুকুই নয় তারই সঙ্গে ছেচল্লিশ জন সাংবাদিকের বাড়িতে একই সঙ্গে ওই একই দিনে হানা দেওয়া হলো। তাদের ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন এবং অন্যান্য কাগজপত্র বাজেয়াপ্ত করা হলো। অভিযোগ, চীনের প্রচার মন্ত্রকের দেয় অর্থ ঘুর পথে আমেরিকান পুঁজিপতি নেভিল রয় সিংগমের মাধ্যমে নিউজ ক্লিক-এর তহবিলে এসে পৌঁছেছে। তারা নাকি চীনের হয়ে প্রচারমূলক খবর পরিবেশন করছে। নিউজ ক্লিক এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তাদের বক্তব্য খুব পরিষ্কার, পুলিশ দেখাক যে এরকম কোন খবর তারা পরিবেশন করেছে। খুঁজে পেতে এইরকম একটা পংতি নাকি পাওয়া গেছে যেখানে বলা হয়েছে, ‘চীনের ইতিহাস আজও শ্রমিক শ্রেণীর অনুপ্রেরণা’।

প্রসঙ্গত, নিউজ ক্লিক কিন্তু হঠাৎ গজিয়ে ওঠা নিউজ পোর্টাল নয়। এদের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালে। নিউজ ক্লিক একটি স্বাধীন মিডিয়া হাউস যারা সমালোচনামূলক সাংবাদিকতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে বরাবর। যাদের অন্যতম বড় কৃতিত্ব হল, গোদি মিডিয়া যখন কৃষক আন্দোলন সম্পর্কে নীরব, তারা তখন ঐ আন্দোলনের প্রায় প্রতিদিনের বিবরণী দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে। এছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বিশেষত দিল্লীতে যে নাগরিকতা সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছিল, তার খুঁটিনাটিও সংবাদমাধ্যমটি মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল নিয়মিত। বিগত কয়েক বছরে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে বিজেপি-শাসিত কেন্দ্র সরকারের সম্পর্কটা কী্রকম দাঁড়িয়েছে তা ঘটনা পরম্পরায় একটু চোখ বোলালে বোঝা যায়। উগ্র-দক্ষিণপন্থী সন্ত্রাসবাদের হাতে গৌরী লঙ্কেস বা এম এম কালবুর্গীর হত্যার কথাটা আরো একবার মনে করিয়ে দিতে চাই। তবে সাম্প্রতিক অতীতে কেবল ব্যক্তিসংবাদিককে আক্রমণেই শেষ তা থেমে থাকছে না, যেসব মিডিয়া হাউস গদি মিডিয়ার বাইরে অবস্থান করে স্বাধীনভাবে সংবাদ ও মতামত পরিবেশন করছে তাদের উপর আক্রমণ একটা দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে এদের কাছে।

ফেব্রুয়ারি ২০২০, দিল্লি দাঙ্গা। সংখ্যালঘু মানুষের সঙ্গে টার্গেট করা হয়েছিল সাংবাদিকদেরও। অবশ্যই বলে দিতে হবে না যে সেই সব সাংবাদিক বা সংবাদমাধ্যম যারা গদি মিডিয়ার বাইরে আছেন। তৎকালীন এনডিটিভি দাঙ্গাকারীদের টার্গেট হয়েছিল। অক্টোবর ২০২০। কেরালার সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল হাথরাস গণধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা কাভার করতে যাবার সময়। বলা বাহুল্য তাঁর বিরুদ্ধে ইউএপিএ এবং রাষ্ট্রদ্রোহীতার মামলা করা হয়েছিল। দুবছর তাঁকে জেল খাটতে হল, যথারীতি চার্জশিট আজও পুলিশ দিতে পারেনি। ফেব্রুয়ারি ২০২১। ইডি থানা দিয়েছিল নিউজ ক্লিক-এর অফিসে। তার আগে দিল্লি পুলিশের আর্থিক অপরাধ শাখা নিউজ ক্লিককে জেরা করে। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আয়কর দপ্তর হানা দেয় বিবিসি’র মুম্বাই ও দিল্লি অফিসে, যদিও তারা কিছুই পায়নি। নিন্দুকেরা বলে, বিবিসি ‘ইন্ডিয়া দ্য মোদি কোয়েশ্চেন’ সম্প্রচার করেছিল ঘটনার কদিন আগেই। তাই তাদের উপর গিয়ে পড়ে রোষানল। এবছর ১৭ আগস্ট নিউজ ক্লিক এবং বেশ কিছু সিনিয়র জার্নালিস্টের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয় ও তাদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ মামলা দেওয়া হয়। আর ৩ আগস্ট কী ঘটলো সে কথা আমাদের অজানা নেই। প্রবীন সাংবাদিক পি সাইনাথ একে ম্যাকার্থি কৌশলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। যার মাধ্যমে একটা ভয় এবং হিস্টিরিয়ার বাতাবরণ তৈরি করে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীন স্বরকে স্তব্ধ করে দেওয়া যায়। তাঁর মতে সাধারণ নির্বাচন যত এগিয়ে আসবে এই অত্যাচার তত বাড়বে।

 আসলে ২০২০ সাল থেকেই নিউজ ক্লিককে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল। যদিও আজ পর্যন্ত কোন চার্জশিট বা দলিল দস্তাবেজ-সহ অভিযোগ আদালতে পেশ করা যায়নি। ফলে বারবার নিউজ ক্লিক-এর পক্ষে আদালত স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। সংঘাতটা চরমে ওঠে ২০২২ সালের এপ্রিল  নাগাদ। যে কেউ আন্দাজ করতে পারবেন সংঘাতটা কী, এককথায় আদানি বনাম নিউজ ক্লিক সংঘাত। নিউজ ক্লিক বারবার বলতে থাকে আদানি-মোদী সম্পর্কের কথা। আদানিরা মামলা করে। দিল্লী পুলিশ হানা দেয় অফিসে। তথাপি নিউজ ক্লিক নতি স্বীকার করেনি। তারা মোদি সরকার ও তার বন্ধুদের সম্পর্কে সমালোচনামূলক রিপোর্টিং চালিয়ে গেছে। তার মূল্য তাদের এই মুহূর্তে চোকাতে হচ্ছে। যাকে বলা হয় ‘পলিটিকাল ভেন্ডেটা’ বা ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসা’, তার শিকার নিউজ ক্লিক। আদানি-মোদি সম্পর্ক নিয়ে একাধিক রিপোর্ট, বিভিন্ন গণ-আন্দোলনের খবর প্রকাশ, কৃষক আন্দোলনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া – সংবাদমাধ্যমের এই ভূমিকা স্বাভাবিকভাবেই একটা ফ্যাসিবাদী মতাদর্শের কাছে অসহ্য বোধ হবে।

এবার নেহাৎ কৌতুহলের বশেই একটু দেখে নেওয়া যাক কোন সাংবাদিকদের ওপর সরকার খর্গ হস্ত। একজন হলেন ইতিহাসবিদ নাম তার সোহেল হাশমি। কে তিনি? তিনি বামপন্থী সংস্কৃতি কর্মী, চিন্তক ও নাট্যকার সাফদার হাশমির ভাই। ফলে ‘সন্দেহের তালিকায়’ পড়েন! আর একজন হলেন উর্মিলেশ। প্রবীণ হিন্দি সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিক। তিনি নিউজ ক্লিক-এর রিডারস এডিটর। হিন্দি সাংবাদিকতার জগতে অন্যতম সম্মানিত মানুষ এই উর্মিলেশ। কাশ্মীর বিষয়ে দুখানা বই লিখেছেন। লিখেছেন মার্ক্সবাদী পন্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নকে নিয়ে ‘রাহুল সাংকৃত্যায়নঃ সৃজন ও প্রতিরোধ’ নামে একখানা পুস্তক। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কাশ্মীর-প্রেমী ও মার্কসবাদী হিসেবে তিনি টার্গেট হবেন এ আর আশ্চর্য কী! পরের নাম ডি রঘুনন্দন। বিজ্ঞানী ও কলামনিস্ট। ফ্রন্টলাইন পত্রিকায় নিয়মিত তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। তিনি জেএনইউ’র মুক্তচিন্তার পরিবেশের সমর্থক, আর বিতর্কিত রাফাল ডিল বিষয়ে কয়েকটা ইঙ্গিতপূর্ণ লেখা লিখেছেন।

পুলিশের হেনস্থার তালিকায় অন্যতম প্রবীণ সাংবাদিক, লেখক ও তথ্যচিত্রকার পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা। দীর্ঘদিন ধরে জমি এবং প্রাকৃতিক সম্পদ যেভাবে কর্পোরেট সংস্থাগুলি লুট করছে তার বিরুদ্ধে লিখছেন, তথ্যচিত্র নির্মাণ করছেন। হিন্ডেনবার্গ ও আদানি বিষয়ে গত কয়েকমাস ধরেই রীতিমতো ভোকাল তিনি। অতএব তাঁকে থামাতে হবে। এরপর রয়েছেন ভাষা সিং যিনি ‘পিপলস আর্কাইভ অফ রুরাল ইন্ডিয়া’র প্রতিষ্ঠাতা। নবভারত টাইমসআউটলুক পত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং এবং ভারতবর্ষের দলিতদের অসহনীয় অবস্থা বিষয়ে পেঙ্গুইন থেকে তাঁর বই বেরিয়েছে। উত্তর ভারতে ঋণজালে জর্জরিত কৃষকের আত্মহত্যা বিষয়ে ক্ষুরধার সব লেখা লিখেছেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁকেও টার্গেট করা হয়েছে। আক্রমণের আর এক লক্ষ্যবস্তু গীতা হরিহরণ। তিনি লেখক ও সাংবাদিক, যাঁর শেষ উপন্যাস রোহিত ভেমুলা, কালবুর্গী এবং বারো শতকের ভক্তি আন্দোলন দ্বারা অনুপ্রাণিত। এঁদের তো ইউএপিএ দিতেই হবে। কারণ কোন অপরাধমূলক আইনে এইসব মানুষগুলোকে গ্রেপ্তার করা বা হেনস্থা করা সম্ভব নয়। এঁরা প্রত্যেকেই দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনে সৎ ও নির্ভীক কলমের জোরে এতটাই সুনাম অর্জন করেছেন যে সরকারের একমাত্র ভরসা ইউএপিএ। এই আইনে প্রায় বিনা বিচারে দিনের পর দিন আটক রাখা যায়। এক্ষেত্রে উদ্দেশ্যটা হল অন্তত দেশের পরবর্তি সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত এঁদের জেলবন্দি রাখা।

প্রেস ক্লাব অব ইন্ডিয়া, এডিটার্স গিল্ড অব ইন্ডিয়া, ডিজিপাব নিউজ ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন এই ঘটনায় সরকার ও পুলিশের ভূমিকার তীব্র নিন্দা করেছে। দিল্লি-সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ষোলোটি সাংবাদিকদের সংগঠন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে চিঠি লিখে এমতাবস্থায় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার আর্জি জানিয়েছে। মজার কথা হল, যে নিউইয়র্ক টাইমসের সংবাদকে কেন্দ্র করে ‘চৈনিক যোগ’ প্রমাণের চেষ্টা হচ্ছে সেই কাগজটি কিন্তু দিল্লিতে সংবাদমাধ্যমের ওপর পুলিশি জুলুমের খবর বড় করে প্রকাশ করেছে। শুধু তাই নয়, স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের ওপর মোদি-সরকারের উপর্যুপরি আক্রমণের কথা তারা সেখানে ফলাও করে ছেপেছে। তারা উল্লেখ করেছে, ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইন্ডেক্সে মোদি জামানায় ভারত ক্রমে পিছিয়ে পড়েছে।

আপাতত ১৮০টি দেশের মধ্যে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে এদেশের অবস্থান ১৬১ নম্বরে। স্বাধীন মত প্রকাশের আধিকারের চিত্রটা আজ কোথায় গিয়ে পৌছেছে তা বুঝতে কষ্ট হয়না!

0 Comments

Post Comment